জেনে শুনে মৃত্যুর ঝুঁকি নেন হৃদয় ও রাসেলের পরিবার

  • স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ফরিদপুর
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

এই ঝুঁকি নেওয়া আমাদের ঠিক হয়নি, জেনে শুনে একি ভুল করলাম বলে কাঁদছিলেন রাসেলের বাবা মজিবর হাওলাদার। ভাইয়ের ছবি হাতে নিয়ে নির্বাক হৃদয়ের বোন মুক্তা। মৃত্যুর ঝুঁকি আছে জেনেও রাসেল ও হৃদয়ের পরিবার অবৈধ পথে ভূমধ্য সাগর পাড়ি দিয়ে ছেলেদের ইতালি পাঠাতে রাজি হন। 

গ্রামের এমন কোনো বাড়ি নেই যেখানে অন্তত একজন পুরুষ প্রবাসী নন। এমনও বাড়ি আছে যেখানে সকল পুরুষই প্রবাস থাকেন। সেই গ্রামে বেড়ে ওঠা রাসেল ও হৃদয়ের। 

বিজ্ঞাপন

প্রতিবেশিদের মতো ভাগ্য বদলাতে ইউরোপে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে এই গ্রামের অধিকাংশ যুবক। সেই স্বপ্নে বিভোর ছিল ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার ঘারুয়া ইউনিয়নের কুমারখালী গ্রামের মিন্টু হাওলাদারের ছেলে হৃদয় হাওলাদার (২০) ও মজিবর হাওলাদারের ছেলে রাসেল হাওলাদার (২৪)। বিদেশ যাওয়ার স্বপ্নে লেখাপড়া না করে কর্মহীন ঘুরে বেড়াতেন তারা।

দালাল চক্রের কবলে পড়ে কম টাকায় কয়েকটি দেশে ট্রানজিট নিয়ে লিবিয়া হয়ে ইতালি যেতে রাজি হন। মৃত্যুর ঝুঁকি আছে জেনেও দালালদের সাথে টাকা পয়সা লেনদেন করে বিদেশ রওনা হন তারা।

বিজ্ঞাপন

তিন ভাই বোনের মধ্যে বড় ছিলেন হৃদয়। ভাইয়ের মৃত্যুর খবরে ছোট বোন মুক্তা কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, আর কারো ভাই যেন এভাবে হারিয়ে না যায়। সরকারের কাছে দাবি একটাই যতদ্রুত সম্ভব আমার ভাইয়ের লাশ দেশে আনার ব্যবস্থা করে দেন।

ইতালি নেওয়ার কথা বলে ওই দুই যুবককে লিবিয়ায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করছেন তাদের পরিবার। হৃদয়ের বাবা বলেন, দুই মাস আগে আমাদের গ্রামের তিনজন হৃদয়, রাসেল ও সোহেল প্রতিজন ১৬ লাখ টাকা করে দিয়ে ইটালি নেওয়ার কথা বলে দালাল চক্র। সেই কথায় রাজি হয়ে টাকা পরিশোধ করলে ২৩ নভেম্বর ২০২৪ বাংলাদেশ থেকে প্রথমে দুবাই, তারপর সৌদি আরব সেখান থেকে লিবিয়া নিয়ে আসা হয়। এত দিন ওদের যোগাযোগ ছিল। সপ্তাহখানেক হলো যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। তারপর থেকে টেনশন শুরু হয়। এরপর ছেলের খোঁজে দালালদের সাথে যোগাযোগ করি তারা বলে নৌকা করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। দুদিনপর আবার যোগাযোগ করলে তারা বলে নৌকা ফেটে গিয়ে ঝামেলা হয়েছে।

এরপর লিবিয়া গেম ঘর নামের একটি ফেসবুক পেইজ থেকে শুক্রবার আমার ছেলের লাশের ছবি পায়। স্থানীয় ভাবে আমরা যোগাযোগ করে জেনেছি তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ওই দেশের দূতাবাসের সাথেও যোগাযোগ করছি। তারা লাশ সনাক্তে সহযোগীতা করতে চেয়েছে। ওই দালাল চক্র লিবিয়ায় আরো অনেক লোককে হত্যা করেছে বলে জানতে পেরেছি। তবে সোহেল দালাল চক্রের আত্মীয় হওয়ায় তার কোনো ক্ষতি করা হয়নি বলে জানান মিন্টু।

হৃদয়ের মা বিলকিস বেগম বলেন, মৃত্যুর দুদিন আগেও আমার ছেলের সাথে কথা হয়। সে বলেছে মা আমি যদি বেঁচে থাকি তাহলেতো বেঁচে গেলাম। আর যদি আমার কিছু হয় তুমি ওদের ছেড়ো না। ওরা আমাকে অনেক কষ্ট দিচ্ছে। তারপর থেকে আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। দালালরা একবার বলে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে, একবার বলে হাসপাতালে আবার বলে নৌকা ফেটে গেছে। এমন করে দুদিন ঘুরিয়েছে। তারপর ওর লাশের ছবি পায়। ওই ছবি আমার ছেলের। ওর পিঠে গুলি করেছে বুক ফুটো হয়ে বের হয়ে গেছে। আমার ছেলেকে প্লান করে মেরে ফেলেছে দালালরা।

রাসেল এবং হৃদয়ের পিতাও প্রবাসী ছিলেন। বিদেশে যাওয়া আসা ও নদীপথে ঝুঁকি নিয়ে ইতালি যাওয়ার বিষয়ে তাদের ধারণা ছিল। আকাশ ওরফে রাসেল ছিল তিন ভাইয়ের মধ্যে মেঝো। দুবছর আগেও দুবাই গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে কাজ ঠিক মতো না পাওয়ায় দেশে চলে আসেন। এরপর ইতালি যেতে ওই গ্রামের আবু তারা মাতুব্বর তাদের আত্মীয় শহিদ ও আনোয়ারের মাধ্যমে জমি বিক্রি করে ১৬ লাখ টাকা দিয়ে ছেলেকে বিদেশ পাঠায়।

এই ঝুকির মধ্যে ছেলে পাঠানো ঠিক হয়নি। অনেক বড় ভুল হয়ে গেল। ছেলেকেও বুঝাতে পারলাম না। ওদের চক্রড়ে পড়ল। রাসেলের মা লিপিয়ারা বেগমের আত্ম চিৎকারে প্রতিবেশিরা বাড়িতে ভিড় করছে। কান্না করে তিনি বলছেন আমি টাকা দিয়ে কি করব। ওরা আমাদের টাকা দিতে চায়। আমি টাকা চাই না আমার ছেলেকে ফেরত চাই। বাবাকে কতবার নিষেধ করলাম শুনলো না।

দুই বাড়িতে ভীড় করা স্থানীয়রা জানান, আমাদের এলাকার অধিকাংশ ছেলেরা বিদেশে থাকে। দেশে যে কাজ করে দশ-বিশ হাজার টাকা আয় সেই কষ্ট বিদেশে করলে লাখ টাকাও আয় করা যায়। যে কারণে বেশির ভাগ ছেলেরাই বিদেশে যেতে চান। তবে অবৈধ পথে বিদেশ যেতে গিয়ে এভাবে মৃত্যু আর দালালের খপ্পরে না পড়ে বৈধ পথে বিদেশে যাওয়ার পরামর্শ সকলের। পাশাপাশি ওই এলাকায় দালাল সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি তাদের। যাতে হৃদয় রাসেলদের মতো কারো মৃত্যু না হয়।

এই বিষয়ে খোঁজ নিতে অভিযুক্ত আবু তারা মাতুব্বর ও আনোয়ারের বাড়িতে গেলে তাদের বাড়িতে পাওয়া যায়নি। এছাড়া তাদের ব্যবহৃত মোবাইল নাম্বারও বন্ধ পাওয়া গেছে।

ফরিদপুরের ভাঙ্গা থানার ওসি মো. মোকসেদুর রহমান বলেন, শুক্রবার থেকেই বিভিন্ন গণমাধ্যমে এবং স্থানীয়দের মাধ্যমে ভাঙ্গার দুটি ছেলেকে লিবিয়ায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছে বলে শুনেছি। সোহেল নামের আরো এক যুবক নিখোজ রয়েছে বলে তার পরিবার জানিয়েছে। তবে কারো পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় এখনো লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়নি। তাদের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে। লিখিত অভিযোগের পর তদন্ত করে দালালচক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।