লোকবল সঙ্কট, ব্রিটিশ আমলের রেললাইনে ঘটছে দুর্ঘটনা
যাত্রীসেবার উন্নয়নে বিভিন্ন রুটে একের পর এক নতুন ট্রেন চালু করছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। উন্নত প্রযুক্তির নতুন নতুন ট্রেন চালু হলেও বাড়েনি রেলওয়ের লোকবল। দক্ষ লোকবল সঙ্কটে ভুগছে প্রতিষ্ঠানটি। তাছাড়া ব্রিটিশ আমলে তৈরি রেললাইনের সংস্কার হয় না দীর্ঘদিন। এর ফলে ঘটছে দুর্ঘটনা, ব্যাহত হচ্ছে উন্নত যাত্রীসেবা।
রেল বিভাগও স্বীকার করেছে ব্রিটিশ আমলের রেললাইনে স্লিপারের কাঠ পঁচে যাওয়া, লাইনের পাথর সরে যাওয়ার কারণে দীর্ঘদিন থেকেই মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে রেলপথ। তাছাড়া মেয়াদ উত্তীর্ণ কোচ ও ইঞ্জিন তো আছেই।
রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে কম লোকবল নিয়েই চলছে রেল। আগামী বছরে রেলের উচ্চ পর্যায় থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের উল্লেখযোগ্য কিছু সংখ্যক দক্ষ কর্মচারী অবসরে যাবেন বলে শোনা যাচ্ছে। এমন অবস্থায় রেলের জনবল সঙ্কট আরো বাড়তে পারে।
এছাড়া রেলওয়ের ২ হাজার ৯৫৫ কিলোমিটার রেলপথের অধিকাংশই নির্মিত হয়েছে ব্রিটিশ আমলে। এর মধ্যে মানসম্মত রেলপথ মাত্র ৭৩৯ কিলোমিটার। রেলপথ নির্মিত হওয়ার পর খুব একটা মেরামত করা হয়নি এবং নতুন করে রেললাইন ট্রাক তৈরি হয়নি। বর্তমানে নতুন রেললাইন নির্মাণে যেসব প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে সেগুলো চলমান রয়েছে, কোনটি এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে রেললাইনসহ অবকাঠামো সেই অর্থে বাড়েনি।
রেল সূত্রে আরও জানা গেছে , বাংলাদেশ রেলওয়েতে বর্তমানে লোকবল আছে ২৫ হাজার ৭১৩ জন। তবে রেলের যাত্রীসেবা দিতে লোকবলের চাহিদা রয়েছে প্রায় ৪০ হাজার ২৭৫ জন। অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় বিপুলসংখ্যক লোকবল সঙ্কটে রয়েছে রেল বিভাগ। এমন অবস্থায় বর্তমানে ২৫ শতাংশ ট্রেনচালক ও গার্ড কাজ করছেন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে। ফলে এসব কর্মচারীরা কোন অপরাধ করলেও তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। তাই জনবল সঙ্কটের কারণে অবসরে যাওয়া চালক ও গার্ডের ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে রেলওয়েকে।
অন্যদিকে বন্ধ হয়ে যাওয়া পাঁচটি রেলস্টেশনকে পুনরায় চালু করা হয়েছে। তবে জনবল সঙ্কটে বন্ধ রয়েছে ১১২টি রেলস্টেশন। সারাদেশে মোট রেললাইনের দৈর্ঘ ২ হাজার ৯২৯ দশমিক ৫০ কিলোমিটার এবং সারাদেশে চলাচলকারী যাত্রীবাহী মোট ট্রেনের সংখ্যা ৩২০টি বলে জানা যায়।
রেল দুর্ঘটনার এক পরিসংখ্যান বলছে, গত তিন বছরে অন্তত ২০টি রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে ঢাকা-সিলেট রুটেই। এছাড়া প্রতিনিয়ত ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে দুর্ঘটনা ঘটছে। ব্রিটিশ আমলের রেললাইন সংস্কার না হওয়ার ফলে এসব দুর্ঘটনা ঘটছে।
দীর্ঘদিন রেলের সঙ্গে যুক্ত থাকা রেলের সাবেক মহাপরিচালক আবু তাহের সার্বিক বিষয় নিয়ে বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, ব্রিটিশ আমলে রেলের লোকবল ছিল প্রায় ৫৮ হাজার। কিন্তু বিভিন্ন সরকার বিভিন্ন সময়ে এসে নীতিগত কারণে রেলকে সংকুচিত করেছে। একসময় গোল্ডেন হ্যান্ডশেক দিয়ে ১৮ হাজার কর্মচারীকে রেল থেকে বিদায় দেওয়া হয়।
তিনি আরও বলেন, তবে আগের সমস্যা কিছুটা কাটিয়ে বর্তমান সরকার রেলকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। রেলের দক্ষ জনবল তৈরি করতে কমপক্ষে ৭ থেকে ৮ বছর সময় লাগে। সুতরাং এখন দক্ষ জনবলের দিকে নজর দিতে হবে কর্তৃপক্ষকে। পাশাপাশি পুরনো রেললাইনের সংস্কার অতীব জরুরি। তা না হলে বাড়বে রেল দুর্ঘটনা, ব্যাহত হবে নিরাপদ রেলসেবা।
রেলের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) মিয়া জাহান বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, 'রেলকে সুশৃংখলভাবে পরিচালনা করতে আমরা সার্বক্ষণিক কাজ করে যাচ্ছি। তবে দু-একটি ঘটনার জন্য পুরো রেল ব্যবস্থা কে দোষারোপ করা যাবেনা। রেলের কিছু নিয়ম কানুন আছে যেগুলো ফলো করলে দুর্ঘটনা ঘটবে না। নিয়ম না মানার ফলে দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনা প্রতিরোধে রেলের চিহ্নিত ঝুঁকিপূর্ণ লাইনগুলো সংস্কার করা হচ্ছে'।
এদিকে রেল সংশ্লিষ্টরা বলছেন, 'রেলের দুর্ঘটনা কমাতে হলে উন্নত প্রযুক্তির আধুনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি রেল লাইন গুলো সংস্কার করে। আধুনিক পদ্ধতির সিগনালিং ব্যবস্থা চালু করলে এবং প্রশিক্ষিত দক্ষ চালক নিয়োগ দিলে ট্রেন দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে আসবে।
সার্বিক বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে রেলপথ মন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, ১৯৮৫ সালে তৎকালীন সরকার রেলওয়েতে নিয়োগ বন্ধ করে দেন। ফলে নিয়োগ প্রক্রিয়া জটিল হয়ে পড়ে এবং বন্ধ হয়ে যায় রেলে নিয়োগ। লোকবল কম থাকার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই রেলের অবসরে যাওয়া দক্ষ কর্মকর্তাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে কাজ চালিয়ে নিচ্ছি আমার, যাতে করে রেলসেবা পেতে যাত্রীরা বাধাগ্রস্ত না হন। আমি এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে লোকবল নিয়োগের বিষয়টি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। নিয়োগ বিধির এই জটিলতা কাটানোর জন্যই আইন সংশোধন করে রেলের জন্য নতুন নিয়োগ বিধির কাজ চলছে। নতুন লোকবল আসলে যেসব সমস্যা রয়েছে সেগুলোর সমাধান হয়ে যাবে। একই সাথে পুরনো রেল লাইনগুলো সংস্কার করে আধুনিক করা হবে।
উল্লেখ্য, ১২ নভেম্বর রাত পৌনে ৩টা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার মন্দবাগ রেলস্টেশন এলাকায় ট্রেনের চালক সিগন্যাল অমান্য করে দুটি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় এতে প্রায় ১৬ জন নিহত হয় প্রায় ৭৪ জন আহত হয়েছেন।