বাল্যবিয়ে রোধে আনোয়ারের ‘লাল সাইকেল’ প্রচারণা
চোখের সামনে নিজের দুই ভাগ্নির বাল্যবিয়ে দেখেছেন। কিন্তু ঠেকাতে পারেননি। অতঃপর তাদের সইতে দেখেছেন অসহনীয় যন্ত্রণা। যা বিবেক তাড়িত করেছে বগুড়ার কাঠমিস্ত্রি আনোয়ার হোসেন তালুকদারকে (৫০)। বাল্যবিয়ের কারণে পারিবারিক ও সামাজিক অশান্তির বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে গত চার বছর ধরে ‘লাল সাইকেল’ নিয়ে দেশের পথে-প্রান্তরে ঘুরছেন তিনি।
রোববার (২৯ ডিসেম্বর) দুপুর দেড়টার দিকে রাজশাহী নগরীতে প্রচারণা করেন আনোয়ার। নগরীর আলুপট্টি মোড়, বোয়ালিয়া থানা মোড়, সাহেববাজার জিরো পয়েন্ট, নিউমার্কেট, রেলগেটসহ বিভিন্ন পয়েন্টে মানুষের মাঝে লিফলেট বিলি করে সচেতনতা সৃষ্টির কাজ করতে দেখা যায় তাকে। যা মানুষকে দারুণভাবে আকৃষ্টও করছে।
গায়ে আপাদমস্তক ‘বিপদজনক রঙ’ হিসেবে চিহ্নিত লাল পোশাক, এমনকি সাইকেলটিও লাল। সাইকেলের সামনে লাল-সবুজ পতাকা। পরিহিত পোশাকের পেছনের দিকে লেখা ‘হতে চাইনা বিয়ের পাত্রী, হতে চাই স্কুল ছাত্রী’, ‘থাকলে শিশু বিদ্যালয়ে, হবে না বিয়ে বাল্যকালে’, ‘থাকলে শিশু লেখাপড়ায়, ভালো হবে জীবন গড়ায়’ প্রভৃতি স্লোগান। এছাড়া বাল্যবিয়ে রোধে সরকারের কার্যক্রমে সহায়তা করারও অনুরোধ জানানো হচ্ছে তার প্রচারণায়।
জানতে চাইলে আনোয়ার হোসেন তালুকদার বলেন, ‘আমার বড় বোনের দুই মেয়ে ছিল। ওদেরকে আমি খুব আদর-স্নেহ করতাম। ওরা আমার কোলে-পিঠে চড়ে বড় হয়। তবে ওর বাবা একজনকে অষ্টম শ্রেণি আর আরেকজনকে দশম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বিয়ে দিয়ে দেয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাচ্চা দুটো মেয়ের কৃষক পরিবারে অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ায় সংসারের কাজ করতে হিমশিম খায়। বিয়ের এক বছরের মধ্যেই দুই বোন প্রায় একই সময়ে সন্তানের জন্ম দেয়। ওরা প্রায়ই অসুস্থ থাকত। অসুস্থ হলেই ওদের স্বামীরা মেয়ে দুটোকে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দিত। বাবাও গরিব ছিল। তাদেরকে ঠিকমতো চিকিৎসা করাতে পারত না।’
পরক্ষণে আবেগাপ্লুত হয়ে আনোয়ার বলেন, ‘মেয়ে দুটোর বাবা-মা নিজেদের ভিটেমাটি বিক্রি করে জামাইদের টাকা পয়সা দিত। যখন আর দিতে পারলো না, তখন তারা দুই মেয়েকে অল্প দিনের ব্যবধানে তালাক দিয়ে দেয়। চিন্তায় আমার বোনটা কিছুদিন পর রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। ওদের বাবাও মারা যায় আরও কিছু দিন পরে। আমি সাধ্যমতো ওদের সহযোগিতা করতাম। কিন্তু আমারও তো আয় কম।’
তিনি আরও বলেন, ‘পরে দুই মেয়ে তাদের সন্তানকে নিয়ে অসহনীয় কষ্টে জীবন যাপন করতে শুরু করে। একপর্যায়ে তারা এলাকা ছেড়ে ঢাকায় গার্মেন্টসে চাকরি নেয়। তাদের জীবনে এখনো অসহনীয় দুর্দশা। এগুলো দেখে আমার বিবেক বাধ সাধে। কাঠমিস্ত্রির কাজ করতাম, নিজের ছোটখাটো একটি ফার্নিচারের দোকানও ছিল। সেই দোকানটি ২০১৫ সালে বিক্রি করে ওই বছরের জানুয়ারি মাসে সাইকেল র্যালি বের করি। ৬৭ দিন সারাদেশে ঘুরে ৬৪ জেলায় প্রচারণা চালাই। ওই সময় চট্টগ্রামে গিয়ে আমি রিকশা চালিয়ে লিফলেট বানিয়েছি। প্রথম দফায় আমি জেলা শহরে প্রচারণা করেছি। তবে আমার মনে হলো- জেলা শহরের চেয়ে উপজেলায় বাল্যবিয়ে বেশি হচ্ছে, তাই উপজেলা পর্যায়ে এবার কাজ করছি।’
অভিযোগ করে আনোয়ার বলেন, ‘প্রথমদিকে কেউ সহযোগিতা করত না। এখন থাকার জায়গাটা সরকারিভাবে পাই। আজ (রোববার) এই যে- রাজশাহী ডিসি অফিসে স্যারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকেও দেখা পাইনি। এখন পাবনার ঈশ্বরদী যাচ্ছি। ওখানে রাত কাটিয়ে পরদিন আমি বাগেরহাটের উদ্দেশে রওনা হব। খুলনা অঞ্চলে শেষ করে বরিশালে যাব।’
তিনি বলেন, ‘আমি ইউনিসেফর সঙ্গে কাজ করেছি। সারা জাকের ম্যাডাম সে সময়ে আমার খোঁজ-খবর রাখতেন। প্রচার কাজের জন্য ৫০ হাজার টাকাও দিয়েছিলেন। পরে ওই প্রকল্প শেষে তিনিও খোঁজ রাখেননি। সামনাসামনি এখন সবাই প্রশংসা করে। কিন্তু কেউ সহযোগী হতে চায় না।’
নিজের পরিবারের বিষয়ে আনোয়ার বলেন, ‘আমার সন্তানরা সবাই নিজেরা আয়-রোজগার করে। নিজেরা স্বাবলম্বী। তাই আমি ওদের নিয়ে এখন আর চিন্তিত নই।’