প্রশিক্ষণ শেষে চাকরি দিবে প্রশাসন
জেসিকা আক্তার (২৮)। তৃতীয় লিঙ্গের একজন মানুষ তিনি। রাজশাহী নগরীর কাজলা এলাকায় পদ্মা নদীর ধারে বেশ কয়েকজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সাথে দীর্ঘদিন ধরে থাকেন তিনি। পৈতৃক বাড়ি সিরাজগঞ্জে বলে জানিয়েছেন। বুঝে ওঠার পর থেকে রাজশাহীর একটি টিনশেডের বাড়িতে থাকছেন। ফলে বাবা-মায়ের কোনো স্মৃতি মনে নেই তার।
মূলত ঢাকা-রাজশাহী রুটে ট্রেনে যাত্রীদের থেকে দলবেঁধে টাকা তোলেন। তা দিয়ে একসঙ্গে দিনাতিপাত করেন তারা। প্রথম দিকে কয়েক বছর ট্রেনে যাত্রীদের থেকে জোর করে টাকা নিতে আনন্দ বোধ করলেও এখন আর এসব টানে না তাকে। তবুও রুটি-রুজির তাগিদে রোজ ট্রেনে চড়ে টাকায় আদায়ে যেতে হয় তাকে।
কিছুদিন আগে সমাজসেবা অধিদফতর থেকে ওই বাড়িতে থাকা ৯ জন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে প্রশিক্ষণ দেয়ার প্রস্তাব দেয়। জানানো হয়- দর্জির কাজ ও বিউটি পার্লার ও দর্জির কাজ শেখানো হবে তাদের। প্রশিক্ষণ শেষে চাকরির ব্যবস্থাও করা হবে। বিষয়টি শুনে চট করে রাজি হয়ে যান জেসিকা। অন্যরা এদিক-সেদিক ভেবে অবশেষে রাজি হন।
সোমবার (১৩ জানুয়ারি) থেকে শুরু হওয়া ৫০ দিনের জীবনমান উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কর্মশালায় অংশ নিয়েছেন জেসিকা ও তার সাথে থাকা ৯ জনই। তাদের সাথে রাজশাহী নগরী ও বিভিন্ন উপজেলা থেকে আরও ৪১ জন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ এ কর্মশালায় অংশ নিচ্ছেন।
রাজশাহী জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় সমাজসেবা অধিদফতর এ কর্মশালার আয়োজন করেছে। ৫০ দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ কর্মশালায় তাদেরকে বিউটিফিকেশন ও দর্জির কাজ শেখানো হবে। প্রশিক্ষণ শেষে তাদের ন্যূনতম পূঁজি এবং বিভিন্ন পার্লার ও দর্জির দোকানে চাকরি পাইয়ে দেবে প্রশাসন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের মধ্য থেকে আচরণ ও অধিক আগ্রহীদের সরকারি খাতেও চাকরি দেওয়া হবে।
রাজশাহী শিশু একাডেমি মিলনায়তনে আয়োজিত কর্মশালার উদ্বোধনী পর্বে প্রধান অতিথি ছিলেন জেলা প্রশাসক মো. হামিদুল হক। অন্যদের মধ্যে বক্তৃতা করেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইফতেখার আলম, সিটি মেয়রপত্নী ও রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি শাহীন আক্তার রেণী। সভাপতিত্ব করেন জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক হাসিনা মমতাজ।
কর্মশালায় এসে প্রথমে জেসিকা ইতস্তত বোধ করলেও ফিরে গেলেন চোখভরা স্বপ্ন ও হাসিখুশি মুখে। জেসিকা বলেন, 'আসলে আমরা যা করে দিনাতিপাত করি, তা আমাদেরও ভাল লাগে না। কারও কাছ থেকে জোর করে টাকা নেওয়া, সবজি নেয়া; এগুলো কার ভাল লাগে বলেন? তবুও পেটের তাগিদে করতাম। তবে ডিসি স্যারসহ অন্যরা যেভাবে আমাদের আশ্বস্ত করেছে, তাতে মনে হচ্ছে এবার ভাল জীবনে ফিরতে পারবো।'
তার সাথে থাকা নয়নতারা বলেন, 'আমাদেরকে তো মানুষ ভাল ভাবে দেখে না। বলে- আমরা খারাপ, আমাদের আচার-ব্যবহার খারাপ। কিন্তু আমাদের ভিতরে যে কী চলে, কত কষ্ট তা কেউ বুঝে না। এমন জীবন থেকে যদি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারি তাহলে আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া।'
দুর্গাপুর উপজেলা থেকে প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়া রোদেলা বলেন, 'আমারা বাপ-মা আছে। তারা আমাকে ঘরে রাখেনি। আমি ও আরও তিনজন গ্রামের বোর্ডঘরে থাকি। আমার পরিচয় দিতেও বাবা-মা, ভাই-বোনরা লজ্জাবোধ করে। ফলে আমিও তাদের পরিচয় দেই না। এলাকার মানুষ আমাদের দেখলে ভয়ে পালাই। এমন জীবন আর চাই না। কাজ করে খেতে চাই, ভাল জীবন কাটাতে চাই।'