পদ্মার পাড়ে চাক চাক বেগুন ও ইলিশে ভুঁড়িভোজ
মাওয়া টু জাজিরা প্রান্তে খরস্রোতা পদ্মা নদীতে একের পর এক পিলারের ওপর বসানো হচ্ছে স্প্যান! এখন অর্ধেকের বেশি দৃশ্যমান বাংলাদেশের গর্ব, চ্যালেঞ্জ, বহুকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের সেতু! বেশ কিছুদিন ধরে পদ্মা সেতু নিয়ে এক সহকর্মীর সরজমিন রিপোর্ট দেখে ইচ্ছা প্রকাশ করতেই রাজি হলেন শ্রদ্ধেয় এডিটর ইন চিফ!
ঠিক হলো- ৬ জনের টিম, যাব পদ্মা সেতু নিয়ে রিপোর্ট করতে। একদিনের প্ল্যান; এডিটর ইন চিফ হাতে টাকা ধরিয়ে দিলেন দুপুরের খাবারের জন্য। অফিস টু বাসা—এমন নিরামিষ দিনে এ যেন আমিষের স্বাদ! এরপর রাতেই কলিগের সঙ্গে ঠিক করলাম—কাজ সেরে মাওয়া যাব, ইলিশ খাব।
ইদানীং যদিও ঢাকা শহরের জ্যাম ঠেলে কোথাও যেতে তেমন ভালো লাগে না। তবে শীতকালটা আসলে মনটা কেমন জানি ভবঘুরে হয়ে ওঠে! তার ওপর ছুটির দিন শুক্রবার; গুলিস্তান ফুলবাড়িয়া স্টেশন থেকে গ্রেট বিক্রমপুর নামের বাসে দেড় ঘণ্টায় মাওয়া গোল চত্বর। ভাড়া জনপ্রতি ৭০ টাকা।
নেমেই পদ্মা সেতুর এক নম্বর পিলারের কাছে অফিসের কাজ সেরে, অটোতে করে মাওয়া ঘাট। এরপর স্পিড বোটে করে খুব কাছ থেকে স্বপ্নে সেতুর স্পর্শ! আধা ঘণ্টার স্পিড বোট ভ্রমণ শেষে তখন মধ্য দুপুর! সকালের নাস্তা তেমন না হওয়ায় সবার পেটে তখন ইঁদুর দৌড়!
মাওয়া ঘাটে আসা যাত্রীদের কেন্দ্র করে ঘাট টার্মিনালে ফলের দোকান থেকে শুরু করে খাবার দোকান সবকিছু রয়েছে। বিক্রেতা হাঁকডাকে বিকিকিনিও জমজমাট। আপাতত সব কাজ ফেলে কেজি খানেক ওজনের দুইটা ইলিশ অর্ডার দিয়ে একটি হোটেলে বসলাম।
গরম ভাত, ইলিশ মাছ ভাজা আর চাক চাক করে কাটা বেগুন ভাজা। আস্ত ইলিশ ছাড়াও এখানকার হোটেলে পিস হিসেবেও ইলিশ পছন্দ করা যাবে ইচ্ছেমতো। উপরে টিনের চালা আর নিচে রঙিন ত্রিপলের বেড়া দিয়ে ঘেরা হোটেলটা একেবারে পদ্মার তীরে। তার একটু দূরেই— খরস্রোতা পদ্মা! প্রমত্তা এই পদ্মার বুকে রাতভর ঘুরে ইলিশ নিয়ে আসেন জেলেরা। তাদের ইতিহাস, গল্প হয়তো বাংলা সাহিত্য নিয়ে ঘাটাঘাটি যারা করেন তাদের কিছুটা জানা।
জানুয়ারি মাস, সকালে শীতের প্রকোপ থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শীত উধাও। এই সময়টা প্রমত্তা পদ্মার রূপ থাকে স্থির শান্ত। বিভিন্ন স্থানে জেগে ওঠে চর। তার মধ্যে নাম না জানা কয়েকটি অনিন্দ্য সুন্দর অতিথি পাখির বিচরণ।
এরই মধ্যে খাবার চলে আসে। গরম ভাতের সঙ্গে ইলিশ ভাজা খেতে বসে চোখ যায় পদ্মায়। দূর থেকে দেখা যায়— মাঝ পদ্মায় দুলতে থাকা নৌকা, দ্রুত গতি এগিয়ে চলা স্পিডবোট, ট্রলার আর লঞ্চ। মাঝ নদী থেকে ভেসে আসা এসব জলযান দেখে মন কেমন উদাস হয়! এই উদাসিনতা যে কেবল আমার তা নয়, টের পেলাম পাশে থাকা সহকর্মীদের মধ্যেও। কারো কারো মাঝে জীবন্ত হয়ে ওঠে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কপিলা আর কারো মাঝে কুবের!
এদিকে বড় কড়াইয়ে তেলে ছ্যাড় ছ্যাড় শব্দে ভাজা হচ্ছে ইলিশ, পাশে রাখা চাক চাক বেগুন ভাজা। যার ঘ্রাণে হোটেলে আসা ভোজনরসিকরা কুপোকাত! কেউ কেউ দরদাম করতে করতেই ঢেঁকুর তুলছেন! কেউ আবার অর্ডার দিয়ে টেবিলে বসে জিভের জল সামালাচ্ছেন।
তবে আমার চোখ তখন ইলিশ ভাজা, ইলিশের লেজের ভর্তা, তেল চুপপচুপে বেগুন ভাজা, শুকনো মরিচভর্তি প্লেটের দিকে। সব উদাসিনতা রেখে গোগ্রাসে গেলা শুরু, নিমেষে প্লেট উধাও। পাশে বসা সহকর্মীদের মুখেও তৃপ্তির ঢেঁকুর।
খেয়ে তৃপ্তি পেলেও, দরদাম করতে না জানলে ঠকে আসাটা অবধারিত। আরেকটা বিষয়, ইলিশ চিনতে না জানলে রুপালি, চান্দা ইলিশ পদ্মার ইলিশ বলে চালিয়ে দেবেন বিক্রেতা। তবে আমাদের মতো কম অভিজ্ঞ হলে তাই খেয়েই পদ্মার ইলিশ খেলাম বলে পরম তৃপ্তি নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে।
মুন্সিগঞ্জ জেলার মেদিনীমণ্ডল ইউনিয়নে মাওয়া ঘাট। পুরো এলাকাটাই মূলত পদ্মাবিধৌত, অধিকাংশ মানুষের জীবন-জীবিকাও পদ্মাকে ঘিরে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সময়টুকু কেমন জানি ঘোরের মধ্যে কেটে যায়। পদ্মা, তার উপর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা দেশের অহংকার-পদ্মা বহুমুখী সেতু কেমন জানি মায়ার বন্ধনে আবিষ্ট করে। ক্ষণিকের এ মায়া ত্যাগ করে আবার আসিব ফিরে মহামায়া পদ্মার তীরে— মনকে এই প্রবোদ দিয়ে আমাদের ঘরে ফেরা।