অরক্ষিত ঐতিহাসিক ভুবনমোহন পার্কের শহীদ মিনার

  • হাসান আদিব, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, রাজশাহী
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ভুবনমোহন পার্ক শহীদ মিনার, ছবি: বার্তা২৪.কম

ভুবনমোহন পার্ক শহীদ মিনার, ছবি: বার্তা২৪.কম

ফুটপাত ব্যবসায়ীদের দখলে দু’পাশ। জুতা-স্যান্ডেল পায়ে দেদারসে শহীদ বেদিতে উঠছেন-নামছেন নানা বয়সী মানুষ। ফলকের আড়ালে দাঁড়িয়ে স্যুট-কোট পরিহিত মধ্যবয়সী ব্যক্তি টানছেন সিগারেট। কেউ-বা জুতা-স্যান্ডেল বিছিয়ে বসে পড়ছেন খবরের কাগজ। সিগারেটের আড্ডায় মেতে উঠেছে তরুণদের দু’টি গ্রুপও। শহীদ বেদি থেকে শুরু করে মিনার স্তম্ভ মঞ্চটিতে অপরিচ্ছন্ন অবস্থা বিরাজমান।

শনিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) দুপুর আড়াইটার দিকে রাজশাহীর ঐতিহাসিক ভুবনমোহন পার্কের শহীদ মিনারে গিয়ে এমন দৃশ্য দেখা যায়। ভাষার মাসেও ঐতিহাসিক শহীদ মিনারটির বেহাল দশা নিয়ে কাররও কোনো মাথাব্যথা নেই।

বিজ্ঞাপন

স্থানীয়রা জানান, সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে ভুবনমোহন পার্কটি মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়ে দখলমুক্ত করা হয়। তবে দু’দিন পরই আবার আগের রূপে ফেরে ফুটপাত ব্যবসায়ীরা। কোনো প্রহরী না থাকায় রাতে নিয়ম করে শহীদ মিনারে আড্ডা বসায় মাদকসেবীরা।

শহীদ মিনারের বেদিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছেন এক ব্যক্তি

জুতা পায়ে বেদিতে উঠে মোবাইলে কথা বলছিলেন সাব্বির রহমান নামে এক তরুণ। জুতা পায়ে ওঠা ঠিক কিনা প্রশ্নে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন তিনি। বলতে শুরু করেন, ‘এখানে বেদিতে তো কিছু লেখা নেই। সবাই উঠছে, তাই আমিও উঠলাম। শুধু আমাকে বলছেন কেন, সবাইকে গিয়ে গিয়ে বলেন দেখি কেমন পারেন!’

বিজ্ঞাপন

ফলকের আড়ালে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানা মধ্যবয়সী ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘পাশে একটি অফিসে চাকরি করি আমি। কাজ করতে করতে মাঝেমধ্যে সিগারেট টানতে বের হই। তো এখানে এসে সিগারেটটা টানা হয় আর কি!’

তবে কাজটি তিনি অজান্তে করে ফেলেছেন উল্লেখ করে বলেন, ‘বিষয়টি আসলে খেয়াল থাকে না। সবাই এখানে হইচই করে। পাশে চা-সিগারেটের দোকানও আছে। তবে আমি আগামীতে আর এমনটি করব না।’

কবি ও গবেষক ভাষাসৈনিক তসিকুল ইসলাম রাজা জানান, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামে রাজশাহীকেন্দ্রিক সকল প্রতিবাদ সভা-সমাবেশ গড়ে উঠেছিল ভুবনমোহন পার্ক ঘিরে। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উত্থাপিত পরিষদের ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে বাংলাকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি নাকচ হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় প্রথম প্রতিবাদ সংঘটিত হয় এখানেই। ওই বছরের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে হরতাল পালিত হয়। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানে মুখরিত হয় ভুবনমোহন পার্ক চত্বর। অতর্কিত হামলা চালায় পুলিশ ও মুসলিম লীগের কর্মীরা।

জুতা-স্যান্ডেল পায়ে শহীদ মিনারের পাশে সিগারেট টানছেন এক তরুণ

তার ভাষ্যমতে, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকায় ছাত্রজনতার মিছিলে গুলি ও হতাহতের ঘটনার খবর পৌঁছানোর পর ভুবনমোহন পার্ক থেকে রাজশাহীর ছাত্রজনতা বিক্ষোভ শুরু করে। এখানে বসে রাজশাহী কলেজে দেশের প্রথম শহীদ মিনার স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এই পার্কে জননেতা এম আতাউর রহমান শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাতে স্বাধীনতার চেতনায় প্রথম নাটক মঞ্চস্থও করা হয় এখানে।

রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘ভুবনমোহন পার্কের শহীদ মিনারে প্রয়োজন অনুযায়ী নিরাপত্তা প্রহরী আছে কিনা তা আমার জানা নেই। আমিও মাঝেমধ্যে গিয়ে খুবই বাজে অবস্থায় দেখেছি। মানুষের সচেতনতার পাশাপাশি সিটি করপোরেশনকে আরও উদ্যোগী হতে হবে। সেখানে ২৪ ঘণ্টায় নিরাপত্তা প্রহরী দিতে হবে এবং তারা যাতে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।’

রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল হক বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘পার্কটি জরাজীর্ণ অবস্থায় ছিল। কয়েক মাস আগেই পুরো পার্ক এবং শহীদ মিনার সংস্কার করা হয়। শুধু সিটি করপোরেশনের ওপর দায় চাপালে হবে না, নগরবাসীকেও সচেতন হতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘শহীদ মিনার আমাদের চেতনার নিশানা। সেখানে তরুণ-যুবক ও শিক্ষিত মানুষেরা জুতা-স্যান্ডেল পরে উঠছেন, বিড়ি-সিগারেট টানছেন। এটা পাহারা বসিয়ে বন্ধ করার চেয়ে সচেতনতা জরুরি। এক্ষেত্রে সবাইকে ভূমিকা পালনের আহ্বান জানাচ্ছি।’