সুফি মিজান এমনই!
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৪৯ বছর হলো। ১৯৭৬ সাল থেকে একুশে পদক চালু করা হয়। এ পর্যন্ত ৫০১ জন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সরকার প্রধান বিশেষ এ রাষ্ট্রীয় পদক তুলে দেন।
উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, প্রত্যেকটি একুশে পদক ১৮ ক্যারটের ৩৫ গ্রাম ওজনের সোনার তৈরি। সার্টিফিকেটের সঙ্গে থাকে নগদ দুই লাখ টাকার চেকও।
সঙ্গীত, নৃত্য, অভিনয়, চারুকলা, মরণোত্তর, গবেষণা, অর্থনীতি, সমাজসেবা, চিকিৎসা, ভাষা ও সাহিত্যের জন্য এসব পুরস্কার মনোনীত করা হয় বিভিন্ন ধাপে। যাঁর জন্য একুশের পদকের প্রস্তাব করা হবে তাঁর বিষয়ে ৩৫০ শব্দের একটি যৌক্তিক ব্যাখ্যা তুলে ধরেন প্রস্তাবক। তারপর জেলা প্রশাসন, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন স্তরের ব্যাপক খোঁজখবর যাচাই-বাছাই শেষে চূড়ান্ত মনোনয়ন দেয়া হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে এ পর্যন্ত মাত্র দুইজন শিল্প উদ্যোক্তাকে একুশে পদক দেয়া হয়। প্রথম ব্যবসায়ী শিল্প উদ্যোক্তা হিসেবে মরণোত্তর পুরস্কার পেয়েছিলেন দেশের অন্যতম শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্কয়ার গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা স্যামসন এইচ চৌধুরী। ২০২০ সালে দ্বিতীয় পুরস্কারটি পেলেন জীবদ্দশায় দেশের আরেক সফল শিল্পপ্রতিষ্ঠান পিএইচপি ফ্যামিলির চেয়ারম্যান সুফি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। পিএইচপির বাংলা অর্থ হল, ‘সুখ শান্তি ও সমৃদ্ধির ছায়া।’
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে সুফি মিজানুর রহমান ব্যবসা শুরু করেন ব্যাংক কর্মকর্তার সামান্য চাকরি ছেড়ে। এ পাঁচ দশকেই তিনি গড়েছেন ৩৩টি প্রতিষ্ঠান। যাতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে প্রায় ১০ হাজার কর্মজীবী। তাঁর গড়া প্রতিষ্ঠানগুলো বছরে লেনদেন করে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। সরকারকে ভ্যাট, শুল্ক ও আয়কর বাবদ প্রতিবছর পরিশোধ করে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা।
সুফি মিজানের জন্ম নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জে। কিন্তু তিনি স্থায়ী নিবাস গড়েছেন বন্দরনগরী চট্টগ্রামের নাসিরাবাদে। তাঁর অধিকাংশ শিল্পপ্রতিষ্ঠানও চট্টগ্রামে। বয়স ৭৬ বছর। উচ্চতা ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি। সাদা-শুভ্র শ্রুশ্মু। পরনে থাকে সূতির সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি-টুপি। খুব সাধারণ বেশভূষা। রোজা রাখেন বছরের প্রায় অধিকাংশ দিন। করলা ভাজি, ডিম ভাজি, ডাল, কৈ মাছ, ইলিশ মাছ তাঁর প্রিয় খাবার। সদা হাস্যোজ্জ্বল বিনয়ী। পরিচিত কেউ বলতে পারবেন না যে, সুফি মিজানের আগে কখনো তাকে সালাম দিতে পেরেছেন।
সহধর্মিনী তাহমিনা রহমান ছায়ার মতোই আছেন সুফি মিজানের সাথে। বিভিন্ন বক্তব্যে তাহমিনাকে ‘মহিয়সী নারী’ বলে তুলে ধরেন তিনি। সাত ছেলে, এক মেয়ে। ছেলেদের ৪ জন অস্ট্রেলিয়া এবং বাকি ৩ জন আমেরিকা থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তাদের মধ্যে কেউই বিদেশে স্থায়ী নিবাস গড়েননি। দেশে এসে বাবার গড়া প্রতিষ্ঠানগুলোর হাল ধরেছেন। ছেলেরাও নতুন নতুন শিল্প গড়ছেন। সুফি মিজান এখনো নিয়মিত প্রতিদিন অফিস করেন। অফিসে ঢুকেই প্রতি ছেলের রুমেই গিয়ে খোঁজখবর নেন, তিনি ছেলেদের ‘আব্বু’ বলেই সম্বোধন করেন সবসময়। বাসায় ফিরে ছেলের বউদের খোঁজখবর যেমনি রাখেন, তেমনি নাতি-নাতনিদের সাথে সময় কাটান। কখনো কখনো স্কুলপড়–য়া নাতি-নাতনিদের শিক্ষকও বনে যান তিনি।
এ বছর মোট ২০ জন্য ব্যক্তি ও দুটি প্রতিষ্ঠানকে একজন একুশে পদক তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্যে ৫ জন মরণোত্তর একুশে পদক পেলেন।
সুফি মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে এতো কথা তুলে ধরার একটি কারণ নিশ্চয় আছে। সেটি হলো- ৭৬ বছর বয়সেই একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে বাংলাদশের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পুরস্কার নিতে পেরে তিনি নিজেকে খুবই ধন্য মানছেন। পুরস্কার সুফি মিজানের মতো আরও অনেকেই পেয়েছেন। কিন্তু সফল ব্যবসায়ী হিসেবে জীবদ্দশায় পুরস্কার পাওয়ার ঘটনাটি তাঁর মনোজগতে এক অন্যরকম আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। রাষ্ট্রীয় সম্মান পাওয়ায় জীবনে আরো অনেকদিন বেঁচে থাকার স্পৃহা নতুন শিল্পগড়ার প্রেরণা পাচ্ছেন বলে জানান তিনি। তাঁর পুরস্কার গ্রহণের সময় সঙ্গে ছিলেন সাত ছেলে, একমাত্র মেয়ে এবং তাঁর সহধর্মিনী। ব্যবসায় সাফল্য পাওয়ার সাথে পারিবারিক ঐক্য ও বন্ধন অটুট রাখার এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত সুফি মিজান। তিনি সবসময় আমাদের জন্য অনুকরণীয়-অনুসরণীয়। অতি সাধারণ জীবনযাপন করেও আকাশছোঁয়ার মতো সফলতা অর্জন করেছেন কঠোর পরিমশ্রম, সততা, মেধা ও আন্তরিকতার মাধ্যমে। তাঁর ছেলেরা সবাই একবাক্যে বলেন, ‘আব্বুর মতো পরিশ্রমী কাউকে আমরা দেখিনি জীবনে। এ বয়সেও তাঁর পরিশ্রমের কাছে আমরা সবাই হার মানি।’
সবশেষে আমার ছোট্ট একটি অভিজ্ঞতা দিয়ে শেষ করতে চাই। ধান চাষ করেছেন গ্রামের বাড়ি রূপগঞ্জে। ফলন ভালো হয়েছে। সেটি দেখার জন্য আমাকে সঙ্গে নিয়েই চট্টগ্রাম থেকে রওনা হন ফজরের নামাজ পড়ে। রূপগঞ্জে গিয়েই সোনালী ধানের ফলন দেখে আমি মুগ্ধ। তিনি বলেন, ‘শিল্পপতিরা যদি চাষবাদে এগিয়ে আসেন তাহলে বাংলাদেশের খাদ্য ও পুষ্টি সংকটসহ অনেক কিছুরই সমাধান হয়ে যাবে।’ ১৩ বছর আগের ঘটনা এটি। বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ।
সুফি মিজানের যে অফুরন্ত দম তিনি যে অসম্ভব পরিশ্রমী সেটি বুঝতে পেরেছি সেদিন। ধান ক্ষেত দেখে আমি ফিরি চট্টগ্রামে। তিনি চলে যান ঢাকায়। আমি ফিরে ক্লান্তশ্রান্ত হয়ে রাতে আর প্রতিবেদন তৈরি করতে পারিনি, করেছি পরেরদিন। আসার আগে আমাকে মায়া করে নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছেন। তাকে খেতে বললে তিনি বলেন ‘আমি রোজা রেখেছি’। পরে জানতে পারলাম তিনি ঢাকায় গিয়ে অফিস করেছেন। বিদেশ থেকে আসা অতিথিদের সঙ্গে মাহফিল করেছেন। ১৩ বছর আগে তখন সুফি মিজানের বয়স ছিল ৬৩ বছর। আর তখন আমার বয়স ছিল ৩৮ বছর। সুফি মিজান এমনই, একজন যুবকও যার সঙ্গে দৌড়ে পেরে উঠেন না !
রফিকুল বাহার, আবাসিক সম্পাদক, চট্টগ্রাম, একুশে টেলিভিশন লিমিটেড।
আরও পড়ুন: পিএইচপি পরিবারে কিছুক্ষণ
সুফি মিজানের কণ্ঠে মাইজভান্ডরী গান: ‘মন অহংকারে দিন…..’
একশো টাকা থেকে বিলিয়নিয়ার, রহস্য কী? (১ম পর্ব)