‘খাওনের দায়িত্ব নিলে ঘরে থাকমু’
করোনা পরিস্থিতির কারণে সারাদেশে চলছে সাধারণ ছুটি। সেই সঙ্গে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় ঢাকা শহর প্রায় জনশূন্য। যন্ত্রের মতো কর্মচঞ্চল এই শহর স্থবির হয়ে পড়েছে এই কয়েকদিনে। সব ধরনের গণজমায়েত নিরুৎসাহিত করায় সব থেকে বিপাকে পড়েছেন দিন এনে দিন খাওয়া রিকশাচালকরা। করোনা আতঙ্ক পাশ কাটিয়ে জীবিকার তাগিদে ঘরের বাইরে বের হলেও খালি পকেটেই ফিরতে হচ্ছে অধিকাংশ রিকশা চালককেই।
সোমবার (৩০ মার্চ) সরেজমিনে ঢাকার ধানমন্ডি, মোহাম্মাদপুরসহ বেশ কিছু এলাকা ঘুরে রিকশা চালকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, কোন কোন দিন সারাদিন রিকশা চালিয়ে সন্ধ্যা বেলায় জমার টাকা দিয়ে খালি পকেটে বাড়ি ফিরার মতো ঘটনাও আছে।
ধানমন্ডি ১৫ নম্বর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় কথা হয় সালাম নামে এক রিকশাচালকের সাথে। করোনার ঝুঁকিতেও কেন রিকশা নিয়ে বাইরে এসেছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, খেয়ে যদি বাঁচি তাহলেই না করোনায় মরব। একদিন রিকশা নিয়া বাইর না হইলে আমাগো পেটে ভাত যাওনের ব্যবস্থা নাই। এই অবস্থায় সারা দিন ঘুইরাও কোন দিন জমার ৩০০ টাকাও উঠে না। আবার একদিন তো জমার টাকা দিয়া খালি পকেটে বাড়ি ফিরছি। রাস্তাঘাট ফাঁকা,লোকজন নাই বললেই চলে। সারাদিন সারা শহর ঘুরতেছি এই কয় দিন কিন্তু জমা বাদে সর্বোচ্চ দুইশ টাকা ঘরে নিতে পারছি। দুইশতে কি বাজার সদাই হয় ভাই! বাইর না হইলে তো খাওনের অভাবে মরমু।
খাবার ব্যবস্থা থাকলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঘরের বাইরে বের হত না এসব দিন এনে দিন খাওয়া মানুষেরা। এমনই মনে করেন মোহাম্মদপুর ও বসিলা এলাকার রিকশাচালাক হাসান। তিনি বলেন, আতঙ্ক নিয়াও চার দিন পর ঘরে থাইকা বাইর হইছি। আমার ঘরে চাল, ডাল তো দূরের কথা এক ফোটা পানিও নাই আইজ। অনেকেই গ্রামে চইলা গেছে কিন্তু আমরা আছি পরিবারের কথা চিন্তা কইরা। তারা যে গ্রামে কি খাইতাছে আর কি করতেছে সেইটা আমি জানি না। আমি তো আমার নিজের খাওনের জোগাড় করতে পারি না। আইজকা সকাল বেলা রিকশা নিয়া বাইর হইছি এখন বাজে বিকাল তিনটা। ভাড়া মারছি ১৭০ টাকা। জমার টাকা হইতে আরো ১৩০ টাকা বাকি। এখন পর্যন্ত কিছু খাই নাই।
নগর ঘুরে বেশ কিছু এলাকায় ব্যক্তি ও সংগঠনের উদ্যোগে একেবারেই ছিন্নমূল পর্যায়ের মানুষদের শুকনো খাবার ও চাল, ডাল বিতরণ করতে দেখা গেছে। প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই কম এসব উদ্যোগ ছিন্নমূলদের অধিকাংশের কাছেই পৌঁছাচ্ছে না।
নাম পরিচয় জানাতে অনিচ্ছুক মোহাম্মদপুর এলাকার এক নারী রিকশা চালক বলেন, আমাদের মতো মানুষদের হইছে বড় জ্বালা। আমরা হাত পাইতা কারো কাছে কিছু নিতেও পারি না আবার গতর ঘাটায়াও যখন কামাই করতে পারি না, তখন আমাগো মতো অসহায় আর কেউ থাকে না। একটু ক্ষোভের সুরেই বললেন, এখন পর্যন্ত দেখি নাই এই কয়েক দিনে কোন রিকশা ওয়ালাকে এক কেজি চাল কেউ দিছে। কাজে না বাইর হয়া কি না খায়া মরব মানুষ!
করোনায় স্থবির পুরো বিশ্ব যার প্রভাব পরেছে প্রত্যেকটি দেশ ও দেশের সব স্তরের মানুষের উপর। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জনগোষ্ঠীর অর্থনীতির সবচেয়ে তলানীতে থাকা এসব খেটে খাওয়া মানুষের জীবন ও জীবিকা দুর্বিষহ হয়ে উঠছে প্রতিদিন। দিনে দিনে দূর্বিষহর মাত্রা যেন জীবনের উপর দিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন ভুক্তভোগী এই মানুষগুলো।