লকডাউনের বালাই নেই গ্রামে

‘ঘরে বউ-পোলাপানের ক্যাচরম্যাচর, তাই দোকানে আড্ডা’

  • জাহিদুর রহমান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

দোকানে চলছে আড্ডা, ছবি: বার্তা২৪.কম

দোকানে চলছে আড্ডা, ছবি: বার্তা২৪.কম

মহামারি নোভেল করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে প্রশাসনের নেয়া পদক্ষেপে কার্যত তেমন কোনো হেরফের হয়নি গ্রামীণ জীবনযাত্রায়।

পাড়া-মহল্লার চায়ের দোকানে সেই সাবেকি আড্ডা। ন্যূনতম সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা দূরের কথা, সব কিছুই যেন চলছে পুরনো ছকে। বুধবার (৮ এপ্রিল) এমন চিত্রই দেখা গেল রাজধানী লাগোয়া সাভারের টেউটি গ্রামে।

বিজ্ঞাপন

সকাল ১০টা। ভাটপাড়া পেরিয়ে টেউটি গ্রামে ঢুকতেই প্রথমে চোখে পড়ে একটি চায়ের দোকান। সেখানে বেশ কিছু মানুষের জটলা। চা বিক্রেতা এক নারী। তার সামনে কেউ সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে, কেউ বা চায়ের কাপে চুমুকে চুমুকে ডুবে আছেন গ্রাম্য আড্ডায়।

সাংবাদিক পরিচয় জানতে পেরে কিছুটা সংযত হলেন চা বিক্রেতা নারী। নিজের নাম প্রকাশে অনিচ্ছা জানিয়ে বললেন, ‘দোকান না খুললে খামু কি? কাস্টমাররা আহে (আসে) তাই দোকান খোলা রাখি। চা সিগারেট বিক্রি অইরা কোনোমতে পেটটা চলে।’

বিজ্ঞাপন
চলছে ক্রিকেট খেলা, ছবি: বার্তা২৪.কম

সেখানে কথা হয় মাহামুদুল্লাহ নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে। পেশায় রাজমিস্ত্রির যোগালি (সহকারী)। ‘শহরে তো সব কিছু বন্ধ। কাম কাইজ নাই। বাইত্তে কতক্ষণ থাকতে মন চায় কন? এই ধরেন দুপুর পর্যন্ত এইহানে সেইহানে ঘুরাঘুরি কইরা বাইত্তে যামু। খাইয়া একটু ঘুমামু। তারপর আবার বিকালে বাইরামু। এমন কইরাই আমাগো দিন চলতাছে,’ বলছিলেন মাহমুদুল্লাহ।

আব্দুল জব্বার নামে আরেকজন বললেন, ‘আমরা কর্মজীবী মানুষ। প্রতিদিনের অভ্যাস সকাল বেলা ঘর থেকে বাইরানো। শহরে তো কাম কাইজ নাই। তাই দোকানে বইসা গ্রামের মানুষের লগে আড্ডা দিতেছি।’

‘আরে কইলেই কী আর বাসায় থাকন যায়? বাসায় চাউল নাই, বাজার নাই। সকাল থন বউয়ের ক্যাচরম্যাচর (চেঁচামিচি), পোলাপানগো ক্যাওম্যাও (চিৎকার)। আর ভাল্লাগে না, তাই বাইরে আছি,’ রং মিস্ত্রি আবুল কালাম আজাদের এ কথায় কিছুটা হাস্যরসের তৈরি হয়। চায়ের দোকান থেকে কিছুটা নামার (নিচু জায়গা) পথ ধরতেই দেখা যায়, বেশ কিছু শিশু ব্যস্ত কেরাম খেলা নিয়ে। বিভিন্ন পরিবার থেকে আসা শিশুদের জটলায় দেখা যায়নি সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ন্যূনতম নজির। অবশ্য দেখার কথাও না।

সন্তানের খোঁজ নিতে এসেছিলেন গৃহবধূ সুফিয়া খাতুন। সন্তান অন্যদের সঙ্গে কেরাম খেলছে- দেখে আশ্বস্ত হয়ে ফিরে গেলেন তিনি। যাবার পথে বললেন, ‘পোলাপাইন গো কি আর ঘরে রাখন যায়! স্কুল নাই। পড়ালেহা নাই।’

দোকানে চলছে আড্ডা, ছবি: বার্তা২৪.কম

‘ভয় লাগে, কোন সময় কোন ডোবা কিংবা পুসকুনিতে যায়! বনে বাদারে কই না কই যায়! তার চেয়ে ভালো বাড়ির লগেই খেলতাছে,’ যোগ করেন তিনি।

শিশুদের ছাড়িয়ে কিছুটা এগুতেই দেখা যায়, এক বৃদ্ধ তার স্ত্রীকে নিয়ে ঘাস কাটছেন। গত ২৪ মার্চ থেকে আজ পর্যন্ত কারো কোনো সাহায্য সহযোগিতাই পাননি এই বৃদ্ধ। না পেরেছেন জনপ্রতিনিধিদের কাছে হাত পাততে। না পেরেছেন ত্রাণ প্রত্যাশী মানুষের সারিতে দাঁড়াতে। একমাত্র ছেলে থাকে প্রবাসে। অবরুদ্ধ থাকায় এ মাসে এখনো তিনি কোনো টাকা পাঠাতে পারেননি।

‘নিজেরা কেমতে চলি তার তো কেউ খোঁজ খবর নেয় না। ঘরতে বাইর না হইলে গরুর বাছুরের খাওন দিবো কেডা?’ প্রশ্ন শুকুর আলীর। তার সঙ্গে কথা বলে গ্রামের শেষ সীমানায় এসে দেখা যায় বেশ কিছু শিশু কিশোর মিলে ক্রিকেট খেলছে।

গ্রামের এই খণ্ড খণ্ড চিত্রই বলে দেয় প্রাণঘাতী মহামারি করোনাভাইরাস ঠেকাতে সরকারের অঘোষিত লকডাউন গ্রামীণ জীবনে খুব বেশি পরিবর্তন আনেনি।

নিশ্চিন্তে কেরাম খেলছে শিশু-কিশোরেরা, ছবি: বার্তা২৪.কম

তাদের ধারণা, এই মহামারি শহরের মানুষের ওপর দিয়েই যাবে। গ্রামে হয়তো আসবে না। এই বিশ্বাস থেকে এক রকম স্বাভাবিক আমেজ বিরাজ করছে গ্রামীণ পরিবেশে।

শহর থেকে অসংখ্য মানুষ গ্রামে ছুটে আসায় গ্রাম জুড়ে বিরাজ করছে উৎসবের আমেজ।

দূরদূরান্ত থেকে আসা মানুষগুলো দিনভর এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরছেন। দেখা করছেন আত্মীয়-স্বজনদের সাথে। আর বিকেল বেলা সবাই জড়ো হচ্ছেন বটগাছের নিচে কিংবা খাল বিলের পাড়ে।

ঘাস কাটছেন এক দম্পতি, ছবি: বার্তা২৪.কম

বাস্তবিক অর্থে শহর সাভারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কিছুটা কড়াকড়ি থাকলেও গ্রামীণ পরিবেশ একেবারেই ঢিলেঢালা।

বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের প্রেক্ষাপটে গত ২৬ মার্চ থেকে ছুটি ঘোষণা করে সরকার। কয়েক দফায় সেই ছুটি ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হলেও গ্রামীণ পরিবেশে এই নিয়ে দেখা যায়নি সাধারণ কোনো সচেতনতাবোধ।

চলছে ক্রিকেট খেলা, ছবি: বার্তা২৪.কম

সঙ্গরোধ থেকে শুরু করে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার আহ্বান এমনকি মানুষকে নিজ নিজ বাড়িতে থাকার আহ্বান জানালেও কার্যত তার কোনো প্রতিফলন ঘটেনি গ্রামীণ জীবনে।

অথচ শহর থেকে আসা মানুষগুলো এখন গ্রামে ছড়িয়ে গেছেন সবার মাঝে। গ্রামীণ জীবনেও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কোনো বকল্প নেই, সেটাও মানতে চাইছেন না বেশিরভাগ মানুষ। এ পরিস্থিতিতে করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে সরকারের নেয়া নানান পদক্ষেপ কতটা কার্যকর হয়, সেটা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে নানা মহলে।