সাভারে ওসির চেষ্টায় অন্তিম ঠিকানা পেলেন নুরুন্নাহার
প্রাণঘাতী নোভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত না হলেও সাভারে দাফন করা যাচ্ছিল না সম্ভ্রান্ত পরিবারের গৃহবধূ নুরুন্নাহার বেগমকে (৬৫)।
চিকিৎসা শেষে পৌরসভার এক নম্বর ওয়ার্ডের জামসিং সোসাইটিতে বোনের বাড়িতে উঠেছিলেন তিনি। ছিলেন ক্যান্সারের রোগী। হঠাৎ করেই শ্বাসকষ্ট। মঙ্গলবার (৭ এপ্রিল) দিনগত রাত দেড়টার দিকে মারা যান তিনি।
তারপর শুরু হয় নানা নাটকীয়তা। নিঃসন্তান নূরুন্নাহারের স্বামী পেশায় চিকিৎসক। থাকেন বরিশালে। শ্বাসকষ্টে মারা যাওয়া নুরুন্নাহারকে কোভিড-১৯ রোগী বলে সন্দেহ করে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন গোটা এলাকার বাসিন্দারা। পরিবারটিকে এক রকম একঘরেই করে ফেলেন তারা।
এ পরিস্থিতিতে নুরুন্নাহারের মরদেহ বরিশালে বহন করে নিতে অস্বীকৃতি জানান অ্যাম্বুলেন্স চালকরাও। স্থানীয়ভাবে দাফনের চেষ্টা করা হলেও এগিয়ে আসা দূরের কথা, প্রতিরোধ গড়ে তোলেন প্রতিবেশীরা।
বোনের মৃত্যুতে এমন পরিস্থিতির মুখে দীর্ঘদিন এক সাথে চলা প্রতিবেশীদের ভিন্ন চেহারা দেখে বিমর্ষ হয়ে পড়েন সেতারা বেগম।
অঘোষিত লকডাউন। এমন পরিস্থিতিতে বরিশাল থেকে মোবাইল ফোনে স্ত্রীকে সাভারে দাফনের সম্মতি দেন স্বামী মফিজুল ইসলাম।
তবে ওই নারীকে দাফনের উদ্যোগ নিতে গেলেই শুরু হয় বিপত্তি। ফজর নামাজের পর থেকে জোহরের ওয়াক্ত পেরিয়ে গেলেও স্থানীয়দের সঙ্গে পরিবারটির চলতে থাকে টানাপোড়েন।
পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যকে হারিয়ে একদিকে শোকাতুর প্রিয় স্বজনরা। অন্যদিকে স্থানীয়দের বাধার মুখে দাফন করতে না পেরে ক্রমেই হতাশ হয়ে পড়েন পরিবারের সদস্যরা।
দীর্ঘ সময় এভাবে মরদেহটি পড়ে থাকায় শেষমেষ পরিবারটি শরণাপন্ন হয় সাভার মডেল থানায়।
সব শুনে মানবতার টানে এগিয়ে আসেন সাভার মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এএফএম সায়দ। নিরাপত্তার কারণে প্রথমে নিজেই যাচাই করে নেন, ওই নারীর মৃত্যুর কারণ।
ছুটে যান সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সায়েমুল হুদার কাছে।
রোগীর চিকিৎসা সংক্রান্ত সব কাগজ দেখে নিশ্চিত হন, করোনাভাইরাস নয়, প্রকৃতপক্ষে ওই নারীর মৃত্যু হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে ভোগা ক্যান্সারেই।
তাৎক্ষণিক তিনি পূর্ণাঙ্গ ইসলামিক মর্যাদায় ও যথাযথ সম্মানের সঙ্গে ওই নারীকে দাফনের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেন সাভার মডেল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) লোকমান হোসেনকে।
প্রয়োজনীয় ফোর্স নিয়ে এসআই লোকমান রওনা হন সাভারের জামসিং সোসাইটি এলাকায়।সেখানে সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করলেও এগিয়ে আসেননি স্থানীয়রা। কোনোক্রমেই স্থানীয় কবরস্থানে ওই নারীকে দাফন করা যাবে না বলে জানান তারা।
স্থানীয়দের বাধা উপেক্ষা করে শেষমেষ ওসির নির্দেশে এসআই লোকমান হোসেনের নেতৃত্বে চারজন পুলিশ সদস্য শুরু করেন জানাজার আনুষ্ঠানিকতা।
পরে তাদের সঙ্গে যোগ দেন স্থানীয় কাউন্সিলর মিনহাজ উদ্দিন মোল্লা। এভাবে দু- একজন লোক আর পরিবারের সদস্যরা যোগ দিলেও ওই মহল্লার অন্য কেউ সামিল হননি ওই জানাজায়। এরপর বিকেলে দাফন করা হয় ওই নারীকে।
নুরনাহারের ভাগ্নি জামাতা শফিকুল ইসলাম জানান, এমন পরিস্থিতিতে আমরা পড়বো তা কল্পনাও করিনি। ক্যান্সারে মারা গেলেও আমার খালা শাশুড়ি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন - এমন সন্দেহে আমাদের প্রতি বিরূপ আচরণ করা হয়। সাভার মডেল থানার ওসি সাহেব উদ্যোগ না নিলে হয়তো বা মরদেহতে পচন ধরত।
নিজ দায়িত্বের বাইরে এসে ওসি এএফএম সায়েদ যেভাবে আন্তরিকতা দিয়ে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, আমরা কোনো দিন তার এ ঋণ শোধ করতে পারব না- আবেগ জড়িত কণ্ঠে বলেছিলেন শফিক।
এসআই লোকমান হোসেন জানান, সম্পূর্ণ বিষয়টি ওসি সাহেব নিজে তদারকি করেছেন। হাজার অনুরোধ করেও দাফনের জন্য যখন আমরা কাউকে পেলাম না, তখন ওসি সাহেবের নির্দেশনায় উপস্থিত পুলিশ সদস্যরাই দাফনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করি। আমাদের দেখে দু-একজন পরে সাহস করে এগিয়ে আসেন।
পেশাগত কাজের বাইরে ও মানবিক বিভিন্ন কাজে সম্পৃক্ত থেকে এরই মধ্যে প্রশংসিত হয়েছেন সাভার মডেল থানার ওসি এএফএম সায়েদ। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে নিজেও নেমে পড়েছেন মাঠে। ঝুঁকি নিয়েই মানুষকে সতর্কতার পাশাপাশি সমানতালে অপরাধীদের গ্রেপ্তারের কাজটিও চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। নিজের পেশাগত কাজের দক্ষতায় সুনাম অর্জন করে হয়েছেন ঢাকা রেঞ্জের শ্রেষ্ঠ ওসি।
করোনাভাইরাস রোধে পুলিশের গাড়িতে করে জীবাণুনাশক ওষুধ ছিটানোর পাশাপাশি হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিতরণসহ তার নেওয়া নানা সতর্কতামূলক পদক্ষেপ স্থানীয়দের মাঝেও ব্যাপক প্রশংসিত।
ওসি এএফএম সায়েদ বলেন, আমি আমার দায়িত্বটুকু কেবল পালন করার চেষ্টা করেছি। সবাই যদি ভীতু হয়ে পিছটান দেন, তাহলে মানবতা রক্ষা করবে কে?