উত্তর জনপদে ‘মঙ্গা’র আশংকা!
উত্তরের বিস্তীর্ণ জনপদে মঙ্গা একটি পরিচিত শব্দ, যা অতীতের বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু করোনার থাবায় আবার যেন ফিরে আসছে সেই ভয়াবহ পরিস্থিতি!
করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে সারা দেশ ও পৃথিবীর মতো রংপুর অঞ্চলেও চলছে লকডাউন আর সঙ্গরোধ। ফলে ঘরে থাকাতে বাধ্য নিম্নআয়ের খেটে খাওয়া মানুষের জীবন ও জীবিকায় নেমে এসেছে দুর্বিষহ চাপ। কামাই রোজগার কমে যাওয়ায় তাদের প্রাত্যহিক খাবারের সংস্থান করতে হিমসিম খেতে হচ্ছে।
চলমান করোনা পরিস্থিতিতে উৎপাদন হ্রাস পাওয়ায় ও মূল্যবৃদ্ধিতে খাদ্যের বাজার তেজি। ফলে সংকটে থাকা কর্মহীন মানুষগুলো চরম বিপাকে পড়েছে। অনেকে অর্ধাহারে-অনাহারে থেকে দিনাতিপাত করছে।
বেশী বিপাকে পড়েছে তিস্তাসহ বেশ কয়েকটি নদী বেষ্টিত চরাঞ্চলের লোকজন। এলাকায় প্যান্ট শার্ট পরা লোক দেখলে ত্রাণের আশায় ছুটে আসছেন তারা। ত্রাণের আশায় পাগলের মতো ঘুরছেন বিত্তহীন মানুষেরা। এ অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই মঙ্গার পদধ্বনির আশংকা করা হচ্ছে।
বছরের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর ও মার্চ থেকে এপ্রিল এই পাঁচ মাস কৃষিকাজ না থাকায় এ অঞ্চলের লোকজন বেকার হয়ে পড়তেন। মৌসুমি এই বেকারত্বের কারণেই দেখা দিত খাদ্যের অভাব। এটাই মঙ্গা নামে পরিচিত ছিল। ১০ বছর আগেও মঙ্গা শব্দটি এ অঞ্চলের মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল। তাদের মঙ্গার সঙ্গে যুদ্ধ করে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করতে হয়েছে।
তিস্তাসহ বেশ কয়েকটি নদীর ভাঙনে প্রতিবছরই এ অঞ্চলের মানুষ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এতে হাজার হাজার মানুষ সর্বস্বান্ত হয়। তা ছাড়া অসময়ে অতিবৃষ্টির ও উজানের ঢলের কারণে বন্যায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবার অনেক সময় খরায়ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। প্রতি বছর এ অঞ্চলে ইরি-বোরো চারা রোপণের পর কৃষি শ্রমিকদের হাতে কোন কাজ থাকে না। ফলে দিন মজুরসহ নিম্ন আয়ের মানুষেরা বেকার সময় পার করতেন।
এজন্য প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে কর্মহীন হয়ে পড়ায় তাদেরকে খাদ্য সংকটের ফলে সৃষ্ট মঙ্গার কবলে পড়তে হয়েছিল। কিন্তু সরকারের আন্তরিকতায় মঙ্গা শব্দটাই মুছে গিয়েছিল। উত্তরের জনপদে ফিরে এসেছিল আর্থিক স্থিতিশীলতা ও সুদিন। সেই সুসময় করোনার কারণে হুমকির সম্মুখীন।
মঙ্গা প্রসঙ্গে ২০১৫ সালে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) এক গবেষণায় জানা যায়, রংপুর অঞ্চলের পাঁচ জেলা রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা ও নীলফামারী মঙ্গা কবলিত। ২০০৮ সালে এসব জেলার মাত্র ২৩ শতাংশ পরিবার মঙ্গার সময় তিন বেলা খেতে পারত। সে সময় ৭৭ শতাংশ পরিবারের সদস্যরাই অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাতেন।
২০১৩ সালে এসে পরিস্থিতির উন্নতি হয়, ৭৪ শতাংশ পরিবারই তিন বেলা খেতে পারছে।
‘মঙ্গা নিরসনে সমন্বিত উদ্যোগ’-এর মাধ্যমে উত্তরাঞ্চলে মঙ্গা জয় করা সম্ভব হয়েছিল। সংক্ষেপে যাকে ‘সংযোগ’ নামে বেশি চেনে ওই অঞ্চলের মানুষ।
১০ বছর মেয়াদি এই কর্মসূচিতে সরকারি কোষাগার ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার মাধ্যমে এটা সম্ভব হয়েছিল। ১০ বছরে বেশীর ভাগ মানুষ দরিদ্র থেকে নিজেদের উত্তরণ করতে সক্ষম হয়েছিল।
এ ছাড়া ২০০৮ সালে এসব এলাকার একটি পরিবারের বার্ষিক গড় আয় ছিল ৩৫ হাজার ৪০০ টাকা। তবে ২০১৩ সালে সেটি ৪২ হাজার ৭০০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে ৭৮ হাজার ১০০ টাকায় দাঁড়ায়। অর্থাৎ আয় বেড়েছে ১২০ শতাংশ। একই সঙ্গে মঙ্গাপীড়িত জেলার পরিবারগুলোর জীবনমান, বিনিয়োগ ও সঞ্চয়ের পরিমাণও বেড়ে যায়।
গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব মাইক্রোফাইন্যান্সের (আইএনএম) একটি গবেষণায় এমনটাই উঠে আসে। সমাজ জীবনেও পরিলক্ষিত হয় উন্নয়নের প্রতিচ্ছবি। কৃষি ও দরিদ্রদের প্রণোদনা প্রদান ও যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হওয়ায় উত্তরাঞ্চলের মানুষেরা মঙ্গার অভিশাপ থেকে মুক্তি পায়। ঘুরে দাঁড়াতে থাকে এ অঞ্চলের হতদরিদ্র মানুষ।
কিন্তু বর্তমানে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে চলমান পরিস্থিতিতে ঘরবন্দী থাকা মানুষগুলো কর্মহীন দুর্বিষহ জীবন যাপন করতে শুরু করেছে। কর্মহীন হয়ে পড়ায় তাদেরকে আবারো মঙ্গার ভয়াবহ স্মৃতির কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। তখন প্রতিবছর এই সময়ে খেটে খাওয়া মানুষগুলো এলাকা ছেড়ে কাজের সন্ধানে বেড়িয়ে পড়েন দেশের নানা জায়গায়।
তারা কৃষির ওপর নির্ভরশীল না থেকে এ অঞ্চলের বাইরে গিয়ে পোশাকশিল্প, ইটের ভাটা, মানুষের বাসাবাড়ি, হোটেল-রেস্টুরেন্টে কাজ করতেন। অনেকে ঢাকাসহ বিভিন্ন বড় শহরে গিয়ে রিকশা ও ভ্যান চালাতেন। বিপুলসংখ্যক নারী দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত রয়েছেন শুধু অভাব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য।
সেখান থেকে যে আয় হত তা দিয়েই গ্রামে তাদের সংসার চলছে। করোনার কারণে সামাজিক দূরত্ব ও সঙ্গরোধের ফলে এইসব অভিবাসী-শ্রমিকের চলাচল ও আয় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। গত কয়েক বছরে যে মঙ্গা শব্দটাই তাদের মন থেকে মুছে গিয়েছিল, তাই আবার তাদেরকে শংকিত করছে। এ বছর মার্চ-এপ্রিল মাসে করোনা ভাইরাসের কারণে খেটে খাওয়া মানুষদের জীবনে ছন্দ পতন ঘটেছে। তারা প্রায় এক মাস থেকে ঘরে বসে বেকার জীবন পার করছেন। কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষেরা অর্ধাহারে-অনাহারে দিনাতিপাত করছেন। পরিবার পরিজন নিয়ে সামনে আর চলার সুয়োগ দেখছেন না তারা।
অনেকে করোনা পরিস্থিতি স্বল্প সময়ে শেষ হওয়ার আশায় ঋণ করে সংসার চালালেও পরিস্থিতি দীর্ঘ হওয়ায় চরম বিপাকে পড়েছে। এখন অনেকে চলমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় হতাশা ব্যক্ত করেছেন।
অন্য অঞ্চলের তুলনায় চরাঞ্চলের মানুষদের অবস্থা আরো কাহিল। কর্ম করে অর্থ উপার্জন ছাড়া তাদের কোন উপায় নেই। কর্মকেই তারা আর্শিবাদ মনে করেন।
এদিকে, চরাঞ্চলগুলোতে সরকারিভাবে তেমন ত্রাণ সামগ্রী ও অনুদান পৌঁছায় না। যে সব এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল সেসব এলাকায় সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ত্রাণ বিতরণ করলেও প্রত্যন্ত চরাঞ্চলের অনেক মানুষের ভাগ্যে তা জোটে না। ফলে তাদেরকে সরকারি সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হতে হয়। তাছাড়া কর্ম করে অর্থ উপার্জন না করলে শুধুমাত্র সরকারি ত্রাণ বা সহযোগিতা দিয়ে সংসার চালানো সম্ভব না।
একটি পরিবার চালাতে গেলে মোটামুটি যে অর্থের প্রয়োজন তা হাত পেতে পাওয়া যায় না। সবাই লালন করেন কাজ করে আত্মসম্মানের সঙ্গে জীবন ধারণ করার স্বপ্ন। কিন্তু করোনা যে স্বপ্ন ভেঙে দিচ্ছে। আশার স্থলে জাগাচ্ছে মঙ্গার আশংকা।