ভরসা যখন ফিরোজার নাও

  • রফিকুল ইসলাম মন্টু, স্পেশালিস্ট রাইটার
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

খেয়া নৌকা চালক ফিরোজা বেগম/ ছবি: র. ই. মন্টু

খেয়া নৌকা চালক ফিরোজা বেগম/ ছবি: র. ই. মন্টু

পাখিদের কোলাহল, শিয়ালের ডাক, কখনো বা বাঘের গর্জন। এখানকার মানুষদের খুবই চেনা আওয়াজ। কখনো ভয়ংকর থাবা নিয়ে ছুটে আসে বাঘ।

অনেকবার আক্রমণের শিকার হয়েছেন মানুষজন। তাই প্রাণ বাঁচাতে বন লাগোয়া কিছু ঘর বানানো হয়েছে মাচা পেতে। ভয় আছে কুমিরেরও। তা সত্ত্বেও মাথা গোঁজার কোনো বিকল্প না পেয়ে মানুষগুলো এখানে আছেন।

বিজ্ঞাপন

সহায় সম্পদ হারানোর পর কেউ ছিলেন রাস্তার ধারে, কেউ অন্যের জমিতে। অবশেষে নিরূপায় হয়ে এখানে ঠাঁই। পাঁচ নদীর মোহনা থেকে খানিক দূরে সৃষ্টি হয়েছে এক দ্বীপ। নাম রেখেছে গোলাখালী। এখানে গোলচত্বরও নেই, গোলগাছেরও খুব একটা দেখা মিলল না; তবুও কী কারণে যে এ নাম; কারোরই জানা নেই। তবে তাদের জানা আছে এটুকুই- বিপন্নতার শেকলে বাঁধা পড়ে আছেন তারা। হাটবাজার, স্কুল, আয় রোজগারসহ নানান কাজে যখন নদীর ওপারে যেতে হয়; তখন ভরসা ফিরোজার নাও।

গোলাখালীর বিপন্ন বসতি/ ছবি: র. ই. মন্টু

গোলাখালী থেকে খানিক দূরে বয়ে চলা রায়মঙ্গল নদীটির নাম অনেকেরই জানা। প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপ্যাধায়ের ‘জলদস্যু’ উপন্যাসের পাঠকদের কাছে এ নদীর অবস্থান বোঝা খুবই সহজ। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে। উপন্যাসের সেই কাহিনীর মত অতটা ভয়ংকর চিত্র হয়তো এখন আর নেই। বন্যপ্রাণীর থাবা, জলদস্যুদের আক্রমণ আগের মতো নেই। তবে গোলাখালীর মানুষের জীবনে এখনও রয়ে গেছে দুঃখ-কষ্ট। এখানকার মানুষেরা প্রায় সবাই সুন্দরবনের রোজগারী। এক কথায় বনজীবী হিসেবে পরিচিত। কিন্তু বনের আয় রোজগার একেবারেই কমে গেছে। বছরে বেশ কয়েকবার বনে যেতে বারণ। চিংড়ির পোনা ধরা নিষিদ্ধ হয়েছে বহু বছর আগে। তবুও এ নিষিদ্ধ কাজটাই করতে হয় সময় সুযোগ পেলে। এ থেকে যা পাওয়া যায়; সেটাই জীবিকার অবলম্বন। পশ্চিম উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার রমজান নগর ইউনিয়নের নয় নম্বর ওয়ার্ডের আওতায় পড়েছে গোলাখালী। কালিঞ্চি আর গোলাখালী এলাকা নিয়ে ওয়ার্ডে লোকসংখ্যা চার হাজারের কিছু বেশি। এরই একটি অংশের বসবাস গোলাখালী দ্বীপে।

বিজ্ঞাপন

চিংড়ির ঘেরের আইল ধরে হাঁটছি। এক পাশে লোকালয়, আরেক পাশে সুন্দরবন। দু’পাশেই দু’টি নদী। প্রায় গোটা এলাকা জুড়েই চিংড়ির ঘের। বাড়িগুলো দু’পাড়ায় বিভক্ত; উত্তরপাড়া আর দক্ষিণপাড়া। অবস্থানগত কারণে পশ্চিমপাড়ার মানুষের ভোগান্তিটা একটু বেশিই মনে হলো। পাড়ার কাছাকাছি যেতেই উদোম শরীরে হন হন করে ছুটে এলেন চল্লিশোর্ধ্ব একজন। পরনে বেগুনি চেক লুঙ্গি। পোড়া শরীর। গলায় ঝোলানো তাবিজ। নাম মমিন আলী; বাবা সাজন আলী। দ্রুত ছুটে আসার কারণ বোঝা গেল কাছে আসার পর। বাইরে থেকে আসা লোক, অচেনা মুখ, তাই আসার কারণ জানতে এসেছেন। আগমনের উদ্দেশ্য জানাতেই মমিনের গলায় ঝড়তে থাকে একের পর এক অভিযোগ। কথা শুনতে শুনতেই পৌঁছে যাই গোলাপাড়া দক্ষিণপাড়া। গাদাগাদি করে আছে কয়েকটি ঝুপড়ি ঘর। মাটির দেয়াল। কয়েকটি ঘরের দেয়াল লাগোয়া নদীর ঢেউ। নদীতে সামান্য পানি বাড়লেই এদের বসবাস কঠিন হয়ে পড়ে। কতবার যে ঝড়ঝাপটায় ঘরের চালা উল্টে গেছে; দেয়াল ধ্বসে পড়েছে; তার হিসেব নেই।

বসতির সামনে ছমিরন নেছা/ ছবি: র. ই. মন্টু

বাইরের অচেনা মুখ দেখে পাড়ার মানুষেরা কিছুটা বিস্মিত। মমিন আলীর সঙ্গে আসতে দেখে তারই ঘরের সামনে জড়ো হলেন পাড়ার প্রায় সবাই। সবারই জানার আগ্রহ আসার হেতু কী? যে কথা একটু আগে মমিন আলীকে বলেছিলাম; সে কথাটাই আবার এদের সামনে বলতে হলো। প্রান্তিক জনপদের মানুষেরা শহুরে আলো বাতাস থেকে অনেক দূরে। এমনকি শহরের অনেক খবরও এদের কাছে পৌঁছায় না। সরকারের সুবিধা প্রদানের কথাগুলোও এদের কাছে অজানা। তাই অচেনা কাউকে দেখলেই এদের কাছে প্রথমেই মনে হয় কোনো সহায়তা এসেছে। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে এদের সেই ভুল ভাঙে। তবে সাংবাদিকের খাতায় নাম লেখাতে পারলেও যে কিছু একটা পাওয়া যেতে পারে; এ বিশ্বাস এরা এখনও লালন করেন। তাই নোটবুকে কারও নাম লেখার সময় অনেকেই ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে আসেন নাম লেখাতে। বছরের সারা মৌসুম সংকটে থাকা মানুষের এমন আচরণ খুবই স্বাভাবিক। মমিন আলীর ঘরের সামনে অপেক্ষমাণ নারী-পুরুষেরাও নাম লেখাতে চাইলেন- আমার নাম আয়শা বিবি, আমি সফুরা বেগম, আমি আয়নাল... ইত্যাদি।

পাড়ার একমাত্র শিক্ষিত অষ্টম শ্রেণী পাস মমিন আলী রেডক্রিসেন্টের কর্মী। মাঝে মাঝে শহরে যান। তার মাধ্যমে শহরের কিছু খবর আসে এখানে; কিন্তু মমিন আলীই বা কতটুকু জানেন! স্থানীয়দে কতটা জানাতে পারেন! এলাকার এমপিকে চেনেন? ভোট দিয়েছেন? প্রশ্ন করতেই ভিড়ের মধ্য থেকে একজন বলে উঠলেন, ভোটের সময় পোস্টারে এমপির ছবি দেখেছি। ভোট আইলে ভোট তো আমরা দেই। কষ্ট করে ওপারে যাই ভোট দিতে। যদি অবস্থার পরিবর্তন একটু হয়! কিন্তু ভোটের পরে আমাদের খোঁজ কেউ নেয় না। রাজনীতির খবরে এদের খুব একটা আগ্রহ নেই। কে এমপি, কে চেয়ারম্যান, সে খোঁজ রাখার প্রয়োজন মনে করেন না এরা। সুযোগ পেলে ভোট দেন; কেননা ভোট দিলে অবস্থার বদল হতে পারে; এ বিশ্বাস এখনও লালন করেন এখানকার কেউ কেউ।

গোলাখালীর প্রায় সবাই চিংড়ির পোনা ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন; কেউ কেউ নদীতে মাছ ধরেন; কেউ যান কাঁকড়া ধরতে। যখন যে কাজ পাওয়া যায়, তাতেই জীবিকা। দেশের পশ্চিম উপকূলীয় এলাকায় যখন কৃষি আবাদ ধ্বংস করে চিংড়ি চাষ শুরু হলো; তখন থেকেই এসব দরিদ্র মানুষদের চিংড়ির পোনা ধরার কাজে নামানো হয়। বেশ কয়েক বছর বেশ ভালোই চলছিল। বিপুল পরিমাণ পোনা পাওয়া যেত; দামও পাওয়া যেত ভালো। অনেকে পোনার ব্যবসায় বেশ অর্থকড়ি বানিয়েছেন। আর যারা নদী থেকে চিংড়ির পোনা ধরে আনতেন, তাদের বেজেছে বারোটা। কেননা, হ্যাচারিতে চিংড়ির পোনা উৎপাদন শুরুর পরে সরকার থেকেই পোনা ধরা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। যে মানুষগুলো কৃষি খামার থেকে বিতারিত হয়ে চিংড়ির পোনা ধরতে এসেছিলেন; তারা একূল-ওকূল দুই-ই হারান। গোলাখালীর মানুষেরা সেই দলের। তিনবেলা খেয়ে পড়ে টিকে থাকাই তাদের জন্য এখন কষ্টকর। যখন চিংড়ির পোনা পাওয়া যায় না; তখন পুরুষেরা ইটভাটায় কাজ করতে যান। বর্ষার ঠিক আগেই আবার ফিরে আসেন।

৩২ বছর ধরে গোলাখালীর এ মাটিতে আছেন ৭৩ বছর বয়সী সোবাহান আলী কারিগর। কষ্টের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, আয় রোজগার কিছুই নেই। বছরের বেশিরভাগ সময় ধারদেনা করে চলতে হয়। পশ্চিম ও পূর্ব দিক ক্রমাগত ভাঙছে। বড় তুফান এলে ঘরের মাটিও নিয়ে যায়।

চিংড়ির পোনা ধরছেন হালিমা বেগম/ ছবি: র. ই. মন্টু

না, শুধু বলে বোঝাতে চান না তিনি। হাত ধরে নিয়ে গেলেন ঘরের পেছনে; ভাঙন পাড়ে। যেখানে নদীর ঢেউ বইছে। ঢেউয়ের তালে দুলছে ঘাটে বাঁধা কয়েকটি ডিঙি নৌকো। পানির ভেতরেই কতগুলো কেওড়া গাছ দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশ মাটি সর্বস্ব। শেকড়ের মাটি সরে গেছে অনেক আগেই; দাঁড়িয়ে আছে মূলের জোরে। এ গাছগুলো পড়ে গেলে দক্ষিণ গোলাখালীর মানুষের টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়বে। ঝাপটা সরাসরি এসে লাগবে মাটির ঘরে।

বছরের সারা মৌসুম রোজগারে ভাটা থাকায় এ দ্বীপে দেনার বোঝা ঘরে ঘরে। কেউ মহাজনের কাছে, কেউ এনজিও থেকে আবার কেউ দোকান থেকে মালামাল বাকিতে এনে দেনার বোঝা বাড়িয়েছেন। সোবাহান আলী কারিগর ৪৫ হাজার টাকা দেনা আছেন মহাজনের কাছে। আবুল হোসেন মহাজনের কাছে দেনা পাঁচ হাজার টাকা। মমিন আলীর দেনা আছে এনজিওতে; ৪০ হাজার টাকা। ফিরোজ হোসেন সাত হাজার টাকা এনেছিলেন মহাজনের কাছ থেকে; আর শোধ করতে পারেননি। মনসুর আলীর গলায় ঝুলে আছে মহাজনের ১০ হাজার টাকার দেনার বোঝা। ছমিনর নেছার কাছে চালের দোকানে পাবে ১৬ হাজার টাকা। এভাবে প্রায় সকলেই কোনো না কোনোভাবে ঋণগ্রস্থ। এ দেনা হয়তো কোনোদিনই শোধ হয় না। কিছু শোধ হয়। আবার দেনার বোঝা নিয়েই শুরু হয় নতুন আরেকটি বছর।

ছমিরন বললেন, আমরা যে কীভাবে বেঁচে আছি; খোঁজ নেওয়ার কেউ নেই। প্রশ্ন জাগে, সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে এত প্রকল্প; এনজিও আছে, প্রায় প্রতিটি এলাকায়, তাহলে এ মানুষগুলোর এ অবস্থা কেন? নিচু মাটির ঘরগুলো খুবই নড়বড়ে। অতি পুরনো ছাউনি। মাটির দেয়ালে কবে প্রলেপ পড়েছে; কে জানে! এ পাড়ার সব শিশু স্কুলে যায় না। যারা যায়; তাদের সেই ফিরোজার নাওয়ে ওপারে যেতে হয়। শিশুদের কাছে স্কুলের নাম জিজ্ঞেস করলে ওরা বলছিল- গোলাখালী আকবর আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। নামটি শুনে মনে পড়ে ফিরোজা বেগমের নাওয়ে ওঠার আগে কালিঞ্চি গ্রামে একটি সাইনবোর্ডে স্কুলের নামটি লেখা দেখেছি। কিন্তু গোলাখালীর স্কুল কালিঞ্চি গ্রামে কেন? প্রশ্নের জবাবে মমিন আলী বললেন, এ দ্বীপের মাটি ভবন নির্মাণের উপযোগী নয়। সে কারণে স্কুলটি ওপারে করা হয়েছে। ছেলেমেয়েদের সেখানে আসা যাওয়ায় খুব কষ্ট হয়। একটি মাত্র খেয়া। বর্ষায় প্রবল জোয়ার এলে, ঝড়-তুফান এলে স্কুলে যাওয়া বন্ধ থাকে।

গোলাখালীর এক প্রান্ত ছেড়ে আরেক প্রান্তে। সুন্দরবনের গা ঘেঁসে বয়ে চলেছে নদী। এপারেই গোলাখালী। চিংড়ি ঘেরের আইল খুবই চিকন। হাঁটা খুবই কষ্টকর। বর্ষাকালে এ পথে হাঁটা আরও কষ্টকর। বলছিলেন আমার সহযাত্রী বনজীবী শহিদুল ইসলাম। সমস্যার কথা বলতে বলতে এগোচ্ছিলেন আমার সঙ্গে। পথে দেখা উত্তরপাড়ার রুবিনা বেগমের সঙ্গে। স্বামী হালিম শেখ। দু’জনেরই শারীরিক সমস্যা। রুবিনা শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, জোয়ারে ঘরবাড়ি ডুবে যায়। মাটির দেয়াল ভেঙে পড়ে। কখনো নৌকায় উঠে থাকি। কখনো ওপারে চলে যাই। হালিমা বেগম কেবলই চিংড়ির পোনা ধরে ফিরছিলেন। দেখা হতেই বললেন, কী করবো- এ না করলে পেট চলবে ক্যামনে?

ভাঙন তীরে বসে আছেন সোবাহান আলী কারিগর/ ছবি: র. ই. মন্টু

বেলা গড়ায়। দুপুরের খাবারের সময় পেরিয়ে যায়। কিন্তু বিরাম নেই ফিরোজা বেগমের। তার নাওখানা বন্ধ থাকলে যে এ দ্বীপের মানুষেরা ওপারে যেতে পারবেন না। স্বামী মতিয়ার গাজীর হার্টের সমস্যা বলে রোজগারের ভার নিতে হয়েছে ফিরোজা বেগমকে। ১৯৮৮ সালে এ এলাকার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রবল ঝড়ের মুখে পড়ার পর মতিয়ার অসুস্থ হন। আর ভালো হননি। কোনো কাজ করতে পারেন না। ছেলে ফারুক হোসেন বাইরে থাকেন; মেয়ে নূরনেছা বিবাহিত। স্বামী-সংসারের ভার ফিরোজার কাঁধে। সকাল-দুপুর-বিকেল নেই; লোকজন চলাচল অবধি তাকে বৈঠা হাতে নৌকায়ই থাকতে হয়। ভোর ছ’টায় কাজে বের হন। ঘরে ফিরতে সন্ধ্যা ছ’টা। সময় পেলে বিকেলের দিকে একবার খেয়ে আসেন। না হলে সেই সন্ধ্যায় খাওয়া। আর এ শ্রমে রোজগার দৈনিক ১০০-১৫০ টাকার বেশি নয়। হাস্যোজ্জ্বল ফিরোজা পান চিবোতে চিবোতে বললেন, ভালোই তো আছি। আল্লায় চালাইয়া নেয়।

দ্বীপের মানুষের জরুরি প্রয়োজন, ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাওয়া, অসুখ হলে ডাক্তারের কাছে যাওয়া, সব প্রয়োজনেই ডাক পড়ে ফিরোজা বেগমের। ফিরোজার নাওখানাই যেন ভরসা হয়ে আছে গোলাখালীর মানুষের।

রফিকুল ইসলাম মন্টু: উপকূল-অনুসন্ধানী সাংবাদিক