রাজধানীর ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজে এক কলেজ শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে হামলা-পাল্টা হামলা করেছে রাজধানীর তিন কলেজ। এর ফলে সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের অবকাঠামোগত ক্ষতির পাশাপাশি হারিয়ে গেছে হাজার হাজার শিক্ষার্থীদের সার্টিফিকেট-মার্কশীটসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র।
কলেজের শিক্ষার্থীদের পাল্টাপাল্টি হামলায় প্রায় ৪০ জনের মতো আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেলসহ রাজধানীর বিভিন্ন মেডিকেলে চিকিৎসা নিয়েছেন। এছাড়া ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের প্রায় ৬০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছেন অধ্যক্ষ ওবায়দুল্লাহ নয়ন।
জানা যায়, সহপাঠীর ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু হয়েছে এমন দাবিতে ন্যাশনাল মেডিকেলের সামনে আন্দোলন করার সময়ে কবি নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজের কিছু শিক্ষার্থী ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। এই হামলায় বেশ কয়েকজন আহতও হয়েছেন।
তবে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে সোহরাওয়ার্দী কলেজ প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় ২৪ নভেম্বর ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীসহ রাজধানীর আরও বেশ কয়েকটি কলেজের শিক্ষার্থীরা মিলে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ ও সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজে হামলা চালায়।
এই হামলার পর ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ জানান, শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে হামলায় ন্যাশনাল হাসপাতালের প্রসাশনিক কার্যালয়, বহিঃবিভাগ, জরুরি বিভাগ, জরুরি বিভাগ, ডেন্টাল বিভাগ, প্যাথলজি বিভাগে ভাঙচুর করা হাসপাতালের অভ্যন্তরে দেশে-বিদেশি শিক্ষার্থী, সাধারণ রোগী ও কর্মকর্তা কর্মচারীদের ওপর হামলা করা হয়। হাসপাতালের আর্থিক সেবায় নিয়োজিত পূবালী ব্যাংকের শাখাতেও ব্যপক ভাঙচুর করা হয়।
এছাড়া ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের প্রায় দশ কোটি টাকার ক্ষতি দাবি করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
ন্যাশনাল হাসপাতালের পরিচালক প্রফেসর ব্রি. জে. (অব.) ডা. ইফফাত আরা বলেন, একজন চিকিৎসকের কাছে তার রোগীর সেবা প্রার্থনার সমান। ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থী অভিজিতের ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। আমরা তার সেবায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। কিন্তু এত কিছুর পরও চিকিৎসকদের কপালে জুটেছে মিথ্যা অপবাদ। শিক্ষার্থী ও রোগীর আত্মীয়দের চাহিদা মত তদন্ত কমিটি গঠন করেও ছাত্র প্রতিনিধিদের অসযোগিতার কারণে তদন্ত করতে পারেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
অপরদিকে হামলার ফলে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজও। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির তিন তলা ভবনের প্রতিটি রুমে ভাঙচুর করা হয়েছে। নষ্ট করা হয়েছে কম্পিউটার, প্রিন্টারসহ সকল আসবাবপত্র। ক্যাম্পাসের আনাচে কানাচে পড়ে আছে প্রতিষ্ঠানটির হাজার হাজার শিক্ষার্থীদের গুরুত্বপূর্ণ সনদসহ নানা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র।
দ্বিতীয় তলায় কলেজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কক্ষ রেকর্ড রুমে গিয়ে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের সার্টিফিকেট, মার্কশীট ও রেজিস্ট্রেশনের হাজার হাজার কাগজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কর্মীরা নষ্ট হওয়া কাগজপত্রগুলো গোছানোর চেষ্টা করছেন।
রেকর্ড রুমে কাজ করা অফিস সহকারী মো. এমদাদ বলেন, হামলাকারীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিটা করেছে শিক্ষার্থীদের। তাদের জীবনের অর্জনের সার্টিফিকেট ও মার্কশীটগুলো নষ্ট করে দিয়েছে। আমি রাস্তা থেকেও অনেক মার্কশীট খুঁজে এনেছি। কলেজ প্রতিষ্ঠার পর থেকে সব কাগজ আমাদের রেকর্ড রুমে সংরক্ষরণ করা ছিলো। কিন্তু তারা সব শেষ করে দিয়েছে।
শিক্ষার্থীদের হামলায় পুরান ঢাকার এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষতির বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যক্ষ ড.কাকলি মুখোপাধ্যায় বলেন, ঘটনার দিন আমাদের ক্লাস বন্ধ ছিলো। আমাদের কলেজের শিক্ষার্থীরা ছিলো না। তবে আমাদের কলেজ পরীক্ষার কেন্দ্র হওয়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা চলছিলো। এই সময়ে হামলার ঘটনা ঘটে। হামলাকারীরা আমাদের শিক্ষক ও পরীক্ষার্থীদের মারধর করেছে। হামলার কারণে আমাদের অবকাঠামো ক্ষতির পাশাপাশি যে ক্ষতিটা হয়েছে তা হলো শিক্ষার্থীদের গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র নষ্ট হয়েছে। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবনের অর্জন সার্টিফিকে ও মার্কশীট নষ্ট হয়েছে। পাশাপাশি আমাদের কলেজের সম্পদের দলিলসহ বহু কাজগ তছনছ হয়ে গেছে। এগুলো সংগ্রহ করতে আমাদের অনেক পরিশ্রম ও হয়রান হতে হবে। আমার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ছিলাম। পরে আবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত হোলাম। আবার ঢাবিতে আসলাম। এই সকল নথি, শিক্ষার্থীদের কাগজ কি ভাবে পাবো বুঝতে পারছি না।
তবে রাস্তার পার্শ্ববর্তী এক ভবনের কিছু জানালার গ্লাস ভাঙ্গা ছাড়া তেমন ক্ষতি হয়নি আরেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কবি নজরুল সরকারি কলেজের। ভবনের ‘এ’ নম্বর ভবনের পেছনের দিকের কিছু গ্লাস ইট পাটকেলে ক্ষতি হয়। এই কলেজেও ঘটনার সময়ে শিক্ষার্থীরা ছিলো না। তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা চলায় কিছু শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন।
হামলায় ক্ষতি ও শিক্ষার্থীদের আহতের বিষয়ে জানতে কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যপক মোহাম্মদ হাবিবুর রহামনের সঙ্গে যোগযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে তিনি ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে কথা বলতে রাজি হন নি।
এদিকে, পুরান ঢাকার তিন প্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে সূত্রাপুর থানায় মামলা হয়েছে। মামলা ৮ হাজার শিক্ষার্থীকে আসামি করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির লালবাগ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) জসীম উদ্দীন বলেন, দুই কলেজ ও ন্যাশনাল হাসপাতালে হামলার ঘটনায় ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা করেছে। সে দিনের ঘটনায় কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত ও আমাদের একটি এপিসি ভাঙচুর করা হয়েছে। তবে এখনও পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার নেই।