মৃত্যুর আগে হামলাকারীদের নাম বলে গেছেন নদী!
পাবনা: অর্ধমৃত অবস্থায় সাংবাদিক সুর্বণা নদী যখন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছিলেন তখন তার মা মর্জিনা বেগম, বড় বোন চম্পা খাতুন আর ৭ বছরের শিশু কন্যা জান্নাত তাকে নিয়ে ছুটছিল হাসপাতালের পথে। এ সময় পথিমধ্যেই কারা তাকে মেরেছে সে কথা স্পষ্টভাবেই স্বজনদের কাছে জানিয়ে গেছেন নদী।
পাবনার বিশিষ্ট শিল্পপতি, ইড্রাল ইউনানী ওষুধ কোম্পানি ও শিমলা হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিকের মালিক আবুল হোসেনের ছেলে নিহত নারী সাংবাদিক সুবর্ণা নদীর সাবেক স্বামী রাজিব হোসেন, রাজীবের সহকারী মিলনসহ বেশ কয়েকজন তার ওপর হামলা চালায়। এমন তথ্যই সাংবাদিকদের জানিয়েছেন নিহত নদীর মা মর্জিনা বেগম।
সুবর্ণা নদীর মা মর্জিনা বেগম আরও বলেন, ‘নদীর সাবেক স্বামী রাজিবসহ যারা নদীকে কুপিয়ে হত্যা করেছে তাদের অধিকাংশকেই নদী চিনতে পেরেছিল। যা আমাকে জানিয়ে গেছে। আমি নদীর মৃত্যুর পূর্বে ওই বয়ান পুলিশ এবং র্যাবকে জানিয়েছি।’ একই তথ্য জানায় নদীর একমাত্র শিশুকন্যা জান্নাতও।
পাবনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গৌতম কুমার বিশ্বাস জানান, পুলিশের তাৎক্ষণিক অনুসন্ধান এবং নিহত নদীর দেওয়া বয়ানসহ বেশ কিছু ক্লুর ওপর ভিত্তি করেই মর্জিনা বেগম বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। ওই মামলায় নারী সাংবাদিক নদীর সাবেক শ্বশুর বিশিষ্ট শিল্পপতি আবুল হোসেন, সাবেক স্বামী রাজিব হোসেনসহ তিনজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ৫ থেকে ৬ জনকে আসামি করা হয়েছে।
পাবনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ওবাইদুর রহমান জানান, মামলা দায়েরের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান আসামি নিহত নদীর সাবেক শ্বশুর আবুল হোসেনকে বুধবার দুপুর ২টায় তার নিজ প্রতিষ্ঠান শিমলা হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক টাওয়ার থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
নদীর বড় বোন চম্পা খাতুন বার্তা২৪.কমকে জানান, ২০১৫ সালে নদীর সঙ্গে শিল্পপতি আবুল হোসেনের ছেলে রাজীবের পরিচয় হয়। এরপর থেকে তাদের বাড়িতে রাজিবের যাতায়াত শুরু হয়। সম্পর্কটি গভীরে চলে যাওয়ায় ২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে নদী ও রাজিব গোপনে কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করে। তবে এই বিয়ে মেনে নেয়নি রাজিবের পরিবার। বছর খানেক আগে রাজিবের সঙ্গে চাপের মুখে বিবাহ বিচ্ছেদ হয় নদীর। এই বিয়ের আগে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছিলেন নদী। তখন ওই ঘরে জান্নাত নামে নদীর এক শিশু কন্যার জন্ম হয়। এরপর নদীর সঙ্গে প্রথম স্বামীর বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়।
পরিবারের লোকজন জানান, স্বামীর অধিকারের দাবিতে নদী শিল্পপতি আবুল হোসেনের বাড়ির সামনে গিয়ে অবস্থান নেন। কিন্তু আবুল হোসেন ও রাজিবের পেটুয়া বাহিনী নদীকে সেখান থেকে মারপিট করে সরিয়ে দেয়।
সূত্র জানায়, এরপর অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে পাবনা প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান নেন নদী। পর্যায়ক্রমে পাবনা ও ঢাকাতে একাধিক সাংবাদ সম্মেলন করেন নদী। নিজের নিরাপত্তা চেয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বিভিন্ন দপ্তরে ধরনা দিয়েও আশানুরূপ সহায়তা পাননি তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্বামীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় নানা কৌশল অবলম্বন করে যখন ব্যর্থ হন নদী, ঠিক তখনই আবুল হোসেন, রাজিব হোসেনসহ তিনজনের নামে যৌতুকের একটি মামলা দায়ের করেন পাবনার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে। গেল মঙ্গলবার এ মামলার সাক্ষ্য দেয়ার দিন ছিল। এতে সুবর্ণা তার পক্ষে আদালতে সাক্ষ্যও উপস্থাপন করেন।
পরিবারের লোকজনের দাবি, সাক্ষ্য আসামিদের বিপক্ষে যাওয়ার পর ক্ষিপ্ত হয়ে আদালত চত্বরেই নদীকে সাবেক স্বামী রাজিব ও তার সহযোগীরা অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ এবং হুমকি-ধামকি দেয়।
স্বজনদের অভিযোগ, ইতিপূর্বেও নদীকে বিভিন্ন ভাবে শহরে ভয়-ভীতি প্রদর্শন করা হয়। গত বছরের (২০১৭) জুনে তার গলায় চাকু চালানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় তারা। পরে নদী জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে পাবনা সংবাদপত্র পরিষদ মিলনায়তনে গত বছরের ২২ জুলাই সংবাদ সম্মেলন করেন। পরে ওই বছরেই ৩ অক্টোবর একই দাবিতে ঢাকার ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন মিলনায়তনে একটি সংবাদ সম্মেলন করেন তিনি।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, রাজিবের সঙ্গে বিয়ের সময়ে দেনমোহর ধার্য ছিল ৫ লাখ ১ টাকা। রাজিবের পরিবার এই বিয়ে মেনে না নেওয়ায় এবং জোরপূর্বক বিবাহ বিচ্ছেদ করার পর ঘটনাটি সুষ্ঠু সমাধানের লক্ষ্যে নদীর সঙ্গে সাবেক শ্বশুর ও স্বামী পক্ষের লোকজনের একাধিক বৈঠক হয়। কিন্তু বৈঠকে সুষ্ঠু সমাধান হয়নি।
বিশ্বস্ত সূত্র দাবি করছে, শিল্পপতি আবুল হোসেন এই ঘটনা সমাধানের জন্য দেনমোহরের পুরো টাকাসহ আর্থিক ভাবে সহায়তার চেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু স্বামীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় অনড় নদী ওই প্রলোভনে নিজেকে বিক্রি করে দেননি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিল্পপতি আবুল হোসেনের ছেলে রাজীব হোসেন ঢাকা থেকে ফার্মেসি বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করে বাবা আবুল হোসেনের শিমলা হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বসা শুরু করেন। ঢাকাতে অবস্থান কালে রাজীব নারী কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েন। পরে পাবনা আসার পর নদীর সঙ্গে বিয়ের আগে আরেকটি নারী কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটায়। বিষয়গুলো বাবা আবুল হোসেন সূক্ষ্মভাবে সমাধান করেন। নদীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের পর নতুন করে এক আত্মীয়কে বিয়ে করে সংসার করছিলেন।
রাজিবের বড় বোন শাপলা খাতুন বলেন, ‘নদীর একাধিক বিয়ে আর সন্তান থাকায় পরিবারের পক্ষ থেকে মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি। তাছাড়া অস্ত্র ঠেকিয়ে আমার ভাই রাজিবকে জোরপূর্বক বিয়ে দেয়া হয়। নদীর সঙ্গে আমাদের পারিবারিক বিষয় নিয়ে মামলা চলছিল এটা ঠিক। তবে আমরা যতটুকু জানি, নদীর একাধিক মানুষের সঙ্গে পেশাগত ও ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বও ছিল। তৃতীয় কোনো পক্ষ এই জঘন্য হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। আমাদের পরিবার এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়।’
প্রসঙ্গত, গত মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে নদী পাবনা শহর থেকে কাজ শেষে রাধানগর মহল্লায় আদর্শ গার্লস হাইস্কুল সংলগ্ন বাসার সামনে পৌঁছামাত্র ওঁৎ পেতে থাকা দুর্বৃত্তরা অতর্কিত তাকে এলোপাতাড়ি ভাবে কুপিয়ে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে পাবনা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক নদীকে মৃত ঘোষণা করেন।