এবার চামড়ার সরবরাহ কম সাভারের ট্যানারি পল্লীতে
ঈদুল আজহায় পশু কোরবানির মাধ্যমে মুসলমানরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করেন। আর এই ঈদেই দেশে সবচেয়ে বেশি পশুর চামড়া ক্রয়-বিক্রয় হয়। প্রতি ঈদুল আজহায় চামড়া ক্রয়-বিক্রয় জমজমাট হলেও গত বছরসহ চলমান প্রাকৃতিক দুর্যোগকালীন ঈদে ভাটা পড়েছে এই খাতে। ঈদুল আজহার দ্বিতীয় দিনেও সাভারের ট্যানারি শিল্প এলাকায় জমে ওঠেনি চামড়া কেনা-বেচা। সরবরাহ কমেছে প্রায় দ্বিগুণ।
সাভারের এই চামড়া শিল্প নগরী ২০০৩ সালের ১৬ আগস্ট অনুমোদন দেয় সরকার। পরে সাভারের বলিয়াপুর এলাকায় ২০০ একর জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠে দেশের বৃহৎ চামড়া শিল্প নগরী। ১৭ একর জায়গা জুড়ে শিল্পনগরের কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের (সিইটিপি) স্থাপনের কাজ শুরু হলেও এর কাজ এখনো চলমান রয়েছে। এই নগরীতে এখন পর্যন্ত ১৫৫টি ট্যানারি গড়ে উঠেছে। যারা প্রতি বছরেই দেশের সব ধরনের চামড়া ক্রয় করে প্রক্রিয়াজাত করেন।
রোববার (২ জুলাই) বিকেলে সাভারের ট্যানারি শিল্প নগরী ঘুরে দেখা যায়, নগরীর ১৫৫টি ট্যানারি কারখানার মধ্যে খোলা রয়েছে প্রায় ১৩৫টি ট্যানারি । যারা এখন পর্যন্ত গত বছরের তুলনায় প্রায় ২ গুণ কম চামড়া ক্রয় করেছেন। এতে করে কমেছে লবণ মাখানো শ্রমিকের সংখ্যাসহ মৌসুমি ব্যবসায়ীদের আনাগোনা। চলমান বন্যা ও করোনাভাইরাসের প্রভাবে মানুষ এবার অনেক কম পশু কোরবানি করায় চামড়ার সরবরাহ কমেছে লক্ষণীয়ভাবে।
প্রিন্স লেদার ইন্ডাস্ট্রিজ এর ম্যানেজার সানাউল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, গত ঈদের তুলনায় এবার চামড়ার সরবরাহ অনেক কমেছে। গত ঈদে আমরা গরুর চামড়া কিনেছিলাম সাড়ে ৩ হাজার আর ছাগলের চামড়া কিনেছিলাম ৬ হাজার। এবার শুধু ১ হাজার ১৬৮ পিস গরুর চামড়া ক্রয় করেছি। আর তেমন চামড়া আসার সম্ভাবনাও নাই। তবে এবার বেশি দামে চামড়া ক্রয় করা হয়েছে। প্রতিটি চামড়ার দাম সাইজ অনুযায়ী ৪৫০ টাকা থেকে ৬৫০ টাকায় ক্রয় করা হয়েছে। আর বিদেশি ক্রেতারা না আসায় চামড়া শিল্পের মালিকরা পড়েছেন টানাপোড়েনে। আগের চামড়া প্যাকেটজাত করেও বায়াররা নেয়নি। এছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ করোনায় লোকসানের মুখে পড়েছে কারখানা।
কালু লেদার ট্যানারির সুপারভাইজার আবু সায়েদ জানান, গত বছরে আমরা ২৫ হাজার চামড়ায় লবণ দিয়ে প্রক্রিয়া করেছি। এবার ৫ হাজার চামড়ায় লবণ দিয়ে প্রক্রিয়া করেছি। চামড়ার সরবরাহ আগের তুলনায় এবার খুবই কম। তবে সরকার নির্ধারিত মূল্যেই চামড়া সংগ্রহ করছেন বলে জানান তিনি।
কুমিল্লার একটি মাদরাসা থেকে চামড়া বিক্রি করতে এসেছেন কামরুল। তিনি বলেন, আমরা গতকাল রাত ১১টায় চামড়া বোঝাই ট্রাক নিয়ে এসেছি। চামড়া ক্রয়ে অনীহা ক্রেতাদের। পরে আজ (২ আগস্ট) সকাল ১১টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে প্রতিটি চামড়া সাইজ অনুযায়ী ৩৫০ টাকা থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি করেছি। চামড়ার আশানুরূপ দাম পেলাম না।
মৌসুমি ব্যবসায়ী রতনের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, চামড়ার দাম কমিয়ে নির্ধারণ করায় লোকসানের আশঙ্কায় কম চামড়া সংগ্রহ করেছি। প্রতিটি চামড়া ২০০ টাকা থেকে ৪০০ টাকায় কিনেছি। আর বিক্রি করেছি সর্বোচ্চ ৫৫০ টাকায়। তেমন লাভ করতে পারিনি। তবে লোকসানের হাত থেকে বেঁচে গেছি। এই শিল্পের সম্ভাবনা না বাড়লে আর চামড়া সংগ্রহ করবো না। শুধু পরিশ্রমই হয়, লাভের মুখ দেখা যাচ্ছে না দীর্ঘদিন।
এবার ঈদে ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা দিয়ে গরু কিনে কোরবানি দিয়েছেন লিটন। তিনি বলেন, চামড়া ক্রেতাই খুুঁজে পাওয়া যায়নি। পরে ব্যবসায়ীকে ডেকে নিয়ে মাত্র ১৫০ টাকায় চামড়া বিক্রি করেছি। চামড়ার দাম হঠাৎ করেই অনেক কমে গেছে। আসলে চামড়ার টাকা গরিব-দুঃখীদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়া হয়। গরিবের ভাগ্য খারাপ তাই তারা এবারও কম টাকা পেলো।
অন্যদিকে চামড়া কম পরিমাণে আসায় লবণ শ্রমিকরা পড়েছেন বিপাকে। শ্রমিক সর্দার জীবন বলেন, চামড়ার সরবরাহ অনুযায়ী শ্রমিকের পরিমাণ বেশি হওয়ায় শ্রমের মূল্যও কমে গেছে। আগে প্রতি চামড়ায় লবণ লাগাতেন ৬০ টাকায়, এবার তা নেমে এসেছে ২০ টাকায়। গত ঈদে ৩ হাজার চামড়ায় লবণ লাগিয়েছিলাম আর এবার মাত্র সাড়ে ৩০০। আমার আগে শ্রমিক ছিল ২২ জন বর্তমানে শ্রমিকের সংখ্যা ১০ জনে নেমে এসেছে। কাজ না থাকায় এই শিল্পের সাথে জড়িত শ্রমিকের অনেকেই পেশা ত্যাগ করেছেন।
এব্যাপারে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক মো. শাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, আমরা চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিলাম ১ কোটি। কিন্তু করোনাভাইরাস ও বন্যা পরিস্থিতির কারণে কম পশু কোরবানি হয়েছে। এ কারণেই এবার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না। ধারণা করা হচ্ছে, এবার ৭০ লাখের কম চামড়া ক্রয় করা সম্ভব হবে। এছাড়া ইটিপিই এর কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় বিদেশি ক্রেতারা আসছে না। চায়না, হংকংয়ে কম মূল্যে চামড়া রপ্তানি করা হচ্ছে। বিদেশি ক্রেতাদের কাছে বেশি মূল্যে চামড়া রপ্তানি করতে পারলেই চামড়ার বাজার আগের অবস্থায় ফিরে আসবে বলে আমি মনে করি।