‘ইউএস স্যাংশন না দিলে তাদের বিরুদ্ধে কিছু করার নিদর্শন দেখিনি’

  • আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

রাজনীতিবিদদের সঙ্গে আমলাতন্ত্রের আধিপত্যের যে দ্বন্ধ তা নিরসনে বৃহত্তর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রশ্নগুলো সমাধান জরুরি বলে মনে করেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী। এসব প্রশ্ন জিইয়ে রেখে আমলাতন্ত্র নিয়ন্ত্রণ বেশ কঠিন হবে বলেও মত তাঁর।

বাংলাদেশের সাবেক দুই শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক পদক্ষেপের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকেও অন্যতম কারণ মনে করেন এই তরুণ রাজনীতিক। তিনি বলেন, ‘ইউএস স্যাংশন না দিলে সরকার আভ্যন্তরীণভাবে তাদের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারতো বা করতো এমনটার কোন নিদর্শন আমরা দেখিনি।’

বিজ্ঞাপন

সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অবঃ) আজিজ আহমেদ ও সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তৎপরতা ও সম্পত্তি জব্দ করা নিয়ে বার্তা২৪.কম এর সঙ্গে কথা বলেছেন ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পরিকল্পনা সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম

বার্তা২৪.কম: সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদ ও সাবেক সেনা প্রধান আজিজ আহমেদকে নিয়ে চলমান বিতর্ককে রাজনীতিবিদ হিসাবে কিভাবে দেখছেন?

বিজ্ঞাপন

শামীম হায়দার পাটোয়ারী: কিছুটা বিতর্কিত নির্বাচন হওয়ার কারণে যারা দেশ চালাচ্ছেন, তারা অনেক ক্ষেত্রেই আমলাতন্ত্র-পুলিশতন্ত্রের কাছে কিছুটা সমঝোতার ভিত্তিতে দেশ চালাচ্ছেন। এই সমঝোতার একটি ভিত্তি হচ্ছে বিরোধী দলের আন্দোলনকে দমন করা, সরকারকে টিকিয়ে রাখা এবং এর বিনিময়ে হয়ত কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার অন্যায়ের ক্ষেত্রে এক ধরণের প্রশ্রয় পেয়ে থাকবেন। যে কারণে অনেকেই ভেবেছিল তারা আইনের উর্ধ্বে, দায়বদ্ধতার উর্ধ্বে; ভেবেছিল তাদের কোনই সম্পদ বাজেয়াপ্ত হবে না এবং একটা পর্যায়ে দুর্নীতি নীতিতে পরিণত হয়েছিল। কোন সিদ্ধান্ত না থাকার কারণে অনেকে বল্গাহীন ভাবে ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করেছেন। সেটা হ্রাস করার জন্য আজিজ-বেনজীরের বিরুদ্ধে এই পদক্ষেপের উদাহরণগুলো খারাপ না। কিন্তু সার্বিক দুর্নীতির চিত্র দেখলে আসলে... বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনায় এই সমস্যার সমাধান আদৌ সম্ভব নয়। প্রথমতঃ সৎ, নির্ভীক রাজনীতিবিদদের ক্ষমতায়িত করতে হবে। রাজনীতির অধীনে আমলাতন্ত্রকে আনতে হবে। কারণ রাজনীতিবিদরা জনগণের প্রতিনিধি। তাদের মাধ্যমেই জনস্বার্থ-সুশাসন সুরক্ষিত হবে-এটাই গ্রহণযোগ্য মানদণ্ড। তবে এখানে অবশ্যই একটি ডিভাইডিং লাইন করতে হবে। কোন জায়গাগুলোতে আমলাতন্ত্র এককভাবে কাজ করবেন, কোন জায়গায় রাজনীতিবিদরা এককভাবে কাজ করবেন এবং কোন জায়গায় যৌথভাবে কাজ করবেন-সেটা চিহ্নিত করতে হবে। এবং সংসদকে যদি প্রাণবন্ত করা যায়, সংসদে যদি প্রশ্নোত্তর, ৭১-বিধি, পয়েন্ট অব অর্ডার-সবকিছুর মাধ্যমে মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রীদের দায়বদ্ধ করা যায়-তখন যোগ্য মন্ত্রী তাঁর মন্ত্রণালয়কে দায়বদ্ধ করতে পারবেন ও সুশাসনও নিশ্চিত হবে। 

বার্তা২৪.কম: অনেক সংসদ সদস্যগণ সংসদে দেওয়া বক্তৃতাতেও আমলাতন্ত্র নিয়ে তাদের অসহায়ত্বের কথা বলেছেন। এই অচলায়তন থেকে বেরিয়ে আসাটা কতটা চ্যালেঞ্জিং বলে মনে করেন?

শামীম হায়দার পাটোয়ারী: আমি মনেকরি, আমলাতন্ত্রের মধ্যেও কিছু অসাধারণ দেশপ্রেমিক, সৎ ও যোগ্য-দক্ষ কর্মকর্তা আছেন; যাঁরা হয়ত সুযোগ পেলে সেই সততার ভিত্তিতেই আমলাতন্ত্রকে সাজাবেন, সৎভাবে কাজ করবেন। এখন দেশের বৃহত্তর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রশ্নগুলো যদি সমাধান হয়ে যায়-তখন আমলাতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করা; আমলাতন্ত্রের এই সমস্যা সমাধান করা কোন কঠিন কাজ হবে না। কিন্তু বৃহত্তর প্রশ্নগুলো জিইয়ে রেখে আমলাতন্ত্র নিয়ন্ত্রণ বেশ কঠিন হয়ে যাবে।

বার্তা২৪.কম: দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপকে অনেকে ‘আইওয়াশ’ হিসাবে বর্ণনা করছেন। আপনি কিভাবে দেখেন...

শামীম হায়দার পাটোয়ারী: ব্যাপরটা হচ্ছে-এই বিষয়গুলো নিয়ে মিডিয়া সরব ছিল সব সময়ই। দুইজনই খুব ক্ষমতাধর এবং দুটি মহান বাহিনীর প্রধান হিসাবে কাজ করেছেন। তাদের ব্যাপারে কথা বলতে গেলেও আমাদের খুব সাবধানে কথা বলতে হবে; যাতে বাহিনীগুলোর মর্যাদা যাবে কোনভাবেই হানি না হয়। এটি অস্বীকার করা যাবে না যে যুক্তরাষ্ট্র সম্পৃক্ত হয়ে স্যাংশন দেওয়ার কারণেই ব্যাপারটি একটি পর্যায়ে আসছে। ইউএস স্যাংশন না দিলে সরকার অভ্যন্তরীণভাবে তাদের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারতো বা করতো এমনটার কোন নিদর্শন আমরা দেখিনি। এখানে ঘোড়া গাড়ি চালাবে নাকি গাড়ি ঘোড়া চালাবে সেটাই বড় প্রশ্ন। ২০১৪ সালের পর দেখতে পাচ্ছি, গাড়ি ঘোড়াকে চালাচ্ছে। পলিটিক্যাল সরকারকে ব্যুরোক্রেসি চালাচ্ছে, অথচ হওয়ার কথা ছিল ব্যুরোক্রেসিকে সরকার চালাবে। আমরা শুনেছি, একসময় রাজনীতিবিদরা দুর্নীতি করতো, আমলাতন্ত্র বাধা দিত, সাইন করতো না। এটা নিয়ে টানাপোড়েন হতো। সৎ আমলাদের সঙ্গে এ নিয়ে প্রায়ই দ্বন্ধ লেগে যেত। এখন আমার কাছে মনে হচ্ছে কোন কোন জায়গায় আমলাতন্ত্র-রাজনীতিবিদ একসঙ্গে দুর্নীতি করছেন। কোন ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্র দুর্নীতি করলেও রাজনীতিবিদরা সেটা নিয়ে কথা বলার সাহস দেখাতে পারছে না। এটা তো অবশ্যই রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মূল ভিত্তিতে কুঠারাঘাত। যাঁরা ব্যুরোক্রেসির লোকজন তারা ট্রেইন্ট-প্রফেশনাল। আইনকানুন, নীতি-অডিট, ফাইন্যান্সিয়াল রুলস-এগুলো তারা খুব ভালো জানেন। রাজনীতিবিদরা ভুল করলেও তারা সতর্ক করবে। তারা কারেক্ট করবে, এটাই স্ট্রাকচারাললি হওয়ার কথা ছিল। এটা যখন উল্টো হয়ে যাচ্ছে, তখন ব্যাপারটির রক্ষাকবচ থাকছে না।

বার্তা২৪.কম: দায়িত্বরত অবস্থায় থেকে এত বিশাল বিত্ত-বৈভবের মালিক একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়ে যান, তখন দুদক এর মতো রাষ্ট্রের সংস্থাগুলোর ভূমিকাকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন...

শামীম হায়দার পাটোয়ারী: দুদকের ক্ষেত্রেও মনে হচ্ছে যে, দুদক অনেক সময় স্বপ্রণোদিত হয়ে পদক্ষেপ কম নিচ্ছে। রিপোর্ট ও স্যাংশন হওয়ার পর, প্রচুর ম্যাস আউট ক্রাই হওয়ার পর-তখন তারা কোন ক্ষেত্র স্টেপ নিচ্ছে। আর একটা বিষয় হচ্ছে যে, যদি কোন ব্যক্তি মনে করে যে, আমি সরকারের অত্যন্ত আস্থাভাজন, সরকার আমার ওপর নির্ভরশীল এবং এই সরকার সারা জীবন ক্ষমতায় থাকবে- তখন তাঁর মধ্যে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার আধিপত্য করার প্রবণতা সৃষ্টি হয়। আমলাতন্ত্র পরিবর্তন হতে পারে, সরকারি দল পরিবর্তন হতে পারে-এটা হচ্ছে মূল ভিত্তি -দায়বদ্ধতার। যারা সারাজীবন থেকে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি মনে করে তখনই আসলে দুর্নীতিটা বল্গাহীন হয়ে যায়।

বার্তা২৪.কম: এই বল্গাহীন দুর্নীতি যারা করছেন, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এক্ষেত্রে কি ভূমিকা রাখতে পারছে?

শামীম হায়দার পাটোয়ারী: দেখুন আমার সঙ্গে এই বিষয়টিতে অনেকেই একমত হবেন না হয়ত, কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, বিএনপি যদি ২০১৪ সালে ভোটে আসতো, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে ভোটে আসতো তাহলে সংসদে বিরোধী দলের একটা রিপ্রেজেন্টশন থাকতো। বিএনপির এমপিরা সংসদীয় কমিটিতে থাকতেন, টকশোতে যেতেন-কথা বলতেন। মন্ত্রীদের প্রশ্ন করতেন, এবং এর মাধ্যমে একটা দায়বদ্ধতা সৃষ্টি হতো। রাষ্ট্র পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ স্টেকহোল্ডার নাই, অনুপস্থিত; এজন্য বল্গাহীন এই দুর্নীতির সুযোগ পাচ্ছে। দায়বদ্ধতাহীন ও জবাবদিহিতাহীন একটা ব্যবস্থার মধ্যে দেশটা চলে গেছে। এজন্য সরকারি দল অবশ্যই দায়ী, তবে বার বার নির্বাচন বয়কট করে সরকারকে সেই সুযোগটাও করে দিচ্ছে বিরোধী দল বিএনপি। প্রতিদ্বন্ধিতা সৃষ্টি করা একটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব, আমি যদি মাঠ ছেড়ে চলে যাই, এবং একপক্ষ যদি এক তরফা গোল দিতে থাকে তাহলে এটা তো পলিটিক্যাল মডেল হতে পারে না।

বার্তা২৪.কম: এই অচলায়তন ভাঙতে আপনার দল কি ভূমিকা রাখছে? 

শামীম হায়দার পাটোয়ারী: জাতীয় পার্টি একটি নির্বাচনমূখী দল এবং সব সময় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেই পরিবর্তন করার চেষ্টা করেছে, একবার ছাড়া। জাতীয় পার্টি নির্বাচন করে সংসদে ধারণা অনুযায়ী অনেক আসন পেলে, আমরা দায়বদ্ধতার স্বাক্ষরটা আরও ভালো করে রাখতে পারতাম। কিন্তু গুটিকয়েক এমপি নির্বাচিত হওয়ার কারণে স্বাভাবিক ভাবেই জাতীয় পার্টি তার আশানুরূপ ভূমিকা সংসদে রাখতে পারছে না। সে কারণে আমরা কিছুটা সংকটে আছি। তবে আমার বিশ্বাস এই সংকট কেটে যাবে। জাতীয় পার্টি আবার ঘুরে দাঁড়াবে, আবার অনেকগুলো আসন পাবে এবং সংসদে-সংসদের বাইরে সর্বত্র জাতীয় পার্টি স্পষ্ট অবস্থান দেখাবে।