২০২৫ সালের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতৈক্য বাড়ছে। বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর সঙ্গে এবার এই প্রশ্নে সায় দিল জামায়াতে ইসলামীও।
রবিবার প্রথম আলো ও মানবজমিন এর রাজনৈতিক সাময়িকী ‘জনতার চোখ’-এ প্রকাশিত পৃথক প্রতিবেদন ও সাক্ষাৎকারে এসব বিষয়গুলো উঠে এসেছে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে নির্বাচনের সময় নিয়ে একটা ধারণা দিলেও তাতে সন্তুষ্ট হয়নি দলগুলো। কারণ, নির্বাচন কবে হতে পারে, তা নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে কোনো আলোচনা করেনি সরকার। বিএনপি এবং অন্যান্য দল বলছে, নির্বাচন নিয়ে স্পষ্ট বক্তব্য না দেওয়ায় সরকারের সঙ্গে তাদের দূরত্বও তৈরি হচ্ছে।
সক্রিয় দলগুলোর বড় অভিযোগ হচ্ছে, তাদের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের নিয়মিত, আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক কোনো যোগাযোগ নেই। যখন কোনো প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে, তখন প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোকে ডেকেছেন। এ পর্যন্ত তিন দফায় রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে সরকারের।
দ্য ডিপ্লোম্যাট-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে (জনতার চোখ-এ প্রকাশিত) বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘বর্তমানে দেশে যেসব চ্যালেঞ্জ এবং বিতর্ক আছে তার অনেকটারই সমাধান হয়ে যাবে নির্বাচনে। তা না হওয়া পর্যন্ত যুক্তিতর্ক ও বিতর্ক অব্যাহত থাকবে।’
নির্বাচনের গুরুত্ব তুলে ধরে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘একজন উদার গণতন্ত্রপন্থি হিসেবে আমি বিশ্বাস করি অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি, যেখানে অংশগ্রহণের জন্য সব দলের সুযোগ থাকবে- কোনো রাজনীতিকে বাদ দিয়ে নয়। রাজনৈতিক দলের প্রতি জনগণের পছন্দ বাছাই হতে হয় নির্বাচনের মাধ্যমে। এজন্যই আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচন দেয়ার জন্য জোর অনুরোধ করি।’
তিনি বলেন, ‘‘যদিও অভিযোগ আছে যে, ‘বিএনপি সংস্কারের বিরোধী’ অথবা ‘দুর্নীতিতে যুক্ত বিএনপি’ তবু আমরা দুই বছর আগে সংস্কার শুরু করেছি। সামনে তা অব্যাহত থাকবে। গণতন্ত্রে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী জাতীয়তাবাদী দল আমরা। এটা তাদের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করে, যারা পরাধীনতা পছন্দ করে। আমরা এমন একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ চাই যেখানে গণতান্ত্রিকভাবে সব সমস্যার সমাধান চর্চা করা হবে। আমরা যে নীতিটি নিশ্চিত করতে চাই তা হলো- আপনার মতের সঙ্গে আমি একমত না-ও হতে পারি। কিন্তু আপনার স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকারকে সুরক্ষিত রাখবো।’’
অন্তর্বর্তী সরকারের বয়স চার মাস পার হওয়ার পর ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে নির্বাচনের সময় নিয়ে একটা ধারণা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেছেন, ২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা যায়। এরপর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, ‘আশা করতে পারেন যে নির্বাচন হচ্ছে ২০২৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে।’
তবে বিএনপি নেতৃত্ব মনে করে, নির্বাচনের জন্য লম্বা সময়ের প্রয়োজন নেই। তারা দ্রুত নির্বাচন চাইছে। এদিকে জামায়াতে ইসলামী সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় সময় দেওয়ার কথা বললেও এখন ২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচন দাবি করছে। দেরিতে হলেও সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে নির্বাচনের কথা বলায় এটিকে রাজনৈতিক দলগুলো ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে বক্তব্য স্পষ্ট নয় এবং সময় নিয়ে একটা ধারণা দেওয়ার ব্যাপারেও দলগুলোর সঙ্গে কোনো আলোচনা করা হয়নি বলে অভিযোগ করেছে তারা। এখন দলগুলো তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে রোডম্যাপ তৈরির দাবি করছে।
বিএনপি নেতৃত্ব মনে করে, নির্বাচনের জন্য লম্বা সময়ের প্রয়োজন নেই। তারা দ্রুত নির্বাচন চাইছে। এদিকে জামায়াতে ইসলামী সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় সময় দেওয়ার কথা বললেও এখন ২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচন দাবি করছে। দেরিতে হলেও সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে নির্বাচনের কথা বলায় এটিকে রাজনৈতিক দলগুলো ইতিবাচক হিসেবে দেখছে।
বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, নতুন দল গঠনের পেছনে সরকারের একাংশ আছে কি না এবং তাদের জায়গা করে দিতে নির্বাচন প্রলম্বিত করার চেষ্টা হতে পারে কি না—রাজনীতিতে এ আলোচনা আছে। আর এসব কারণে সরকারের প্রতি আস্থা কমে যাচ্ছে। ফলে দলগুলোর চিন্তা বোঝার জন্য তাদের সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ বাড়ানো প্রয়োজন।
স্বৈরাচারী শাসনের পতনের পর অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতারা নতুন দল গঠন করছেন। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় কোনো দল গঠন করা হচ্ছে কি না, এ প্রশ্নও তুলেছে বিএনপিসহ বিভিন্ন দল। বিএনপির দ্রুত নির্বাচনের দাবি নিয়েও কোনো কোনো রাজনৈতিক দল ও সরকার–সমর্থক কোনো কোনো মহল থেকে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। বিএনপি নেতারা বক্তব্যে এর ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্প্রতি দলের এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, রাজনৈতিক দল হিসেবে তাঁরা বারবার নির্বাচনের কথা বলবেন, নির্বাচন চাইবেন। এটাই স্বাভাবিক।
তবে দ্রুত নির্বাচন চাওয়ার ক্ষেত্রে বিএনপির ভেতরে নানা আলোচনা রয়েছে। দলটির একাধিক সূত্র জানিয়েছে, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করাসহ অর্থনীতিতে গতি আনা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ও প্রশাসনে স্থিতিশীলতা আনতে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যর্থ হয়েছে। সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না। আর এতে মানুষের মধ্যে সরকার সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে। দ্রুত নির্বাচনের দাবির পেছনে এ পরিস্থিতিকেও অন্যতম কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে। নির্বাচন যত দেরি হবে, সংকট ততই বাড়বে বলে মনে করেন বিএনপি নেতৃত্ব।
নানা ষড়যন্ত্র হতে পারে, এটিও বিবেচনায় রাখছে বিএনপি। দলটির নেতারা মনে করেন, ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শীর্ষ নেতৃত্বসহ ওই সরকারের মন্ত্রীদের বেশির ভাগই বিদেশে পালিয়েছেন। কিন্তু দেশের ভেতরেও তাঁদের অনেক কর্মী–সমর্থক রয়েছেন। তাঁদের দিক থেকে নানা সংকট তৈরির চেষ্টা থাকতে পারে। এই বাস্তবতাও আমলে নিচ্ছে বিএনপি।
স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনের ছাত্র নেতৃত্বের কয়েকজন সরকারে রয়েছেন। তাঁদের পক্ষ থেকে নতুন দল গঠনের কথা বলা হচ্ছে। এর পেছনে রাষ্ট্র ও সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা আছে কি না, সেই সন্দেহ তৈরি হয়েছে বিএনপিতে। দলটির নেতারা বক্তব্যেও তা বলছেন।
দলটি বলছে, সরকার ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। সব কমিশনের সব প্রস্তাব বাস্তবায়ন এক–দুই বছরে সম্ভব নয়। বিএনপির একজন জ্যেষ্ঠ নেতা বলেছেন, নির্বাচনব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, জনপ্রশাসন ও বিচার বিভাগ—শুধু এই চারটি ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার চায় বিএনপি। এর বাইরে অন্যান্য সব সংস্কার প্রস্তাব নির্বাচিত সরকার এসে বাস্তবায়ন করবে।
বিএনপি মনে করে, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে নির্বাচনের জন্য চার–পাঁচ মাস সময় প্রয়োজন। ফলে নির্বাচনের জন্য ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চায় না দলটি। ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হলে তাতে আপত্তি থাকবে না বিএনপির।
এদিকে, সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে সময় দেওয়ার পক্ষে জোরাল অবস্থান জানালেও জামায়াতে ইসলামী এখন ২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলছে। দলটি আগে সার্বিকভাবে সংস্কার শেষ করে নির্বাচনের কথা বলেছিল। সেই অবস্থানে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার গতকাল বলেন, সব সংস্কার এখন সম্ভব নয়। সে জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে নির্বাচন চান তাঁরা।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের গতকাল কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে একটি যুব সম্মেলনে বলেছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০২৫ সালের মধ্যেই হতে হবে। এই সময়ের মধ্যে সব সংস্কার শেষ করতে হবে।