রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন জাপার নেতাকর্মীরা
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে রাজনীতি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন বিদায়ী সংসদের বিরোধীদলের আসনে থাকা জাতীয় পার্টির নেতারা। অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকে ডাক না পাওয়ায় দলটির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকেই সন্দিহান হয়ে পড়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন ৫ আগস্ট সেনা প্রধানের বৈঠক ও রাষ্ট্রপতির বৈঠকে ডাক পাওয়ায় বেশ উৎফুল্ল ছিল জাতীয় পার্টি। এমনকি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে ভাঙচুর ও লুটপাটের পরও ছিল বেশ চাঙ্গা। শেখ হাসিনা সরকারের পতনেই দিনেই তাদের দুই প্রধান কার্যালয় আক্রান্ত হলেও তারা বিষয়টি চেপে গিয়েছিলেন।
সবই ঠিকঠাক চলছিল, নাম ঘোষণা হওয়ার পর অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অভিনন্দন ও জানান জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের। কিন্তু ১২ আগস্ট বিএনপি-জামাত এবং ছোট ছোট রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করলেও ডাক পাননি জাপা। জনশ্রুতি রয়েছে জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে অনেক দেনদরবারও করা হয় বৈঠকের জন্য। তবে শেষ পর্যন্ত প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে সাড়া পায়নি দলটি।
আর ওই ঘটনার পর থেকে নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা বাড়তে শুরু করেছে। অনেকেই জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎ অন্ধকার মনে করছেন। ইতোমধ্যে জাতীয় পার্টির তেজগাঁও থানা কার্যালয় দখল করার উদ্বেগ আরও বেড়েছে। দলটি ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে কখনও ইচ্ছায় কখনও চাপের মুখে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ মনে করেন, জাতীয় পার্টির কারণেই ২০১৪, ২০২৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন কিছুটা হলেও সুবিধা পেয়েছে আওয়ামী লীগ। আর ক্ষমতার ভাগ নিয়ে জাপা সাধারণ জনগণের কথা ভুলে গেছে। দলকে সংগঠিত ও জনপ্রিয় করার কোন প্রচেষ্টা দেখা যায়নি।
২০০৮ সাল থেকে নানাভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে থেকে নির্বাচন করে সংসদে থেকেছে জাতীয় পার্টি। কখনও সরকারের অংশীদার (২০০৮ ও ২০১৪) এমনকি ২০১৪ সালে একইসঙ্গে সরকার ও বিরোধীদলে থাকার বিরল নজীর গড়ে জাপা। তখন পার্টির মধ্যেই তুমুল সমালোচনার মধ্যেই পুরো ৫ বছর একইসঙ্গে সরকারের মন্ত্রিসভায় ও বিরোধীদলের আসনে ছিল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি। পার্টির প্রধান হুসেইন মুহুম্মদ এরশাদ ছিলেন মন্ত্রী মর্যাদায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। আর বিরোধীদলীয় নেতার আসনে ছিলেন সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ।
২০২৪ সালের নির্বাচনে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল নির্বাচন বয়কট করলেও জিএম কাদের এর নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশ নেন জাতীয় পার্টি। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ২৬টি আসন ছেড়ে দেওয়া হয়। তার মধ্যে থেকে মাত্র ১১ আসনে বিজয়ী হয় জাপার প্রার্থীরা। জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতার চেয়ারে বসেন জিএম কাদের।
যদিও জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে বরাবরেই বলা হয়েছে, তারা চাপের মুখে নির্বাচনে গেছে। কখনও কখনও হুমকির মুখে আওয়ামী লীগের সঙ্গে থেকেছেন বলে দাবি করা হয়। কিন্তু রাজনৈতিকদলগুলো থেকে সাধারণ মানুষ তাদের এই বক্তৃতা সেভাবে গ্রহণ করছে না। সরকারের লেজুড়বৃত্তির অভিযোগে অভিযুক্ত করে এসেছে। একদিকে সরকারের লেজুড়বৃত্তি অন্যদিকে দীর্ঘদিন ধরে মাঠে কর্মসূচি না থাকায় জাতীয় পার্টির মধ্যে উদ্বেগ বেড়েছে।
বিশেষ করে বিগত সময়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলের ভরাডুবি, নির্বাচনে দাঁড়ানোর মতো উপযুক্ত প্রার্থী না পাওয়ার অনেক নজীর রয়েছে। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মাত্র ৩ জন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন, আর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে শুধু রংপুরে লাঙ্গল জয়ী হয়। সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পার্টির জনপ্রিয়তা দেখাতে গিয়ে দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রির সংখ্যা বাড়িয়ে তুলে ধরে। সাংবাদিক সম্মেলনে বলা হয়েছিল, জাতীয় পার্টিকে নিয়ে আগ্রহ বেড়েছে যে কারণে ১৭৫২টি ফরম বিক্রি হয়েছে। ইলেকশন কমিশনে জাতীয় পার্টির দাখিলকরা আয়ের (২০২৩ সাল) হিসাবে ৩০০ এর নিচে দেখানো হয়েছে।
জাতীয় পার্টির উদ্বেগ উৎকণ্ঠা আর বাড়িয়ে দিয়েছে অন্তবর্তীকালীন ড. ইউনূস সরকার ও বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের ঘনিষ্ঠ ভিপি নূর। ভিপি নূর বলেছেন, জাতীয় পার্টির মতো একটি পরগাছা, পা চাটা দালালকে জায়গা দেওয়া হবে না। জাতীয় পার্টি বাংলাদেশের রাজনীতির ভাইরাস এই ভাইরাস কিভাবে বঙ্গভবনে আসে! এই জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। ভিপি নূরের ওই বক্তব্যের পর জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। ভিপি নূর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পা ছুঁয়ে সালাম করছে এমন ছবি ফেসবুকে শেয়ার করছেন নেতারা।
দলটির কয়েক বছর ধরেই মাঠে দৃশ্যমান কোন কর্মসূচি দেখা যায় নি। সাধারণ জনগণের ইস্যুতে সংসদে বক্তৃতা আর বিবৃতির সীমাবদ্ধ ছিল দলীয় কার্যক্রম। একদিকে এক তরফা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যাওয়ার রোষ, অন্যদিকে জনদুর্ভোগ নিয়ে তাদের নিরবতা দিনদিন সাধারণ জনগণ থেকে দূরে সরে দেয়।
পাশাপাশি নেতৃত্বের সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের হাতে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টি সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ভাঙনের রেকর্ড গড়েছে। জাতীয় পার্টি নামে ৬টি রাজনৈতিক দল মাঠে বিচরণ করছে। প্রত্যেক দফায় অনেক প্রভাবশালী নেতাদের হারিয়েছে দলটি। আবার অনেক সময় এরশাদের এক তরফা সিদ্ধান্তের কারণে অনেক নেতা নিষ্কিয় হয়ে পড়েছেন। সর্বশেষ এরশাদের সহধর্মীনী রওশনের নেতৃত্বে নতুন জাতীয় পার্টি গঠিত হয়েছে। সেখানে বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা হারিয়েছে দলটি। রাজধানীতে কোন কর্মসূচি পালন করতে হলে যারা বিপুল সংখ্যক লোকজন নিয়ে হাজির হতেন তারা এখন রওশনের গ্রুপে ভিড়েছেন।
জাতীয় পার্টিতে যে অস্থিরতা বিরাজ করছে তার কিছুটা আঁচ পাওয়া যায়, সাম্প্রতিক কর্মকান্ডে। পাইওনিয়ার রোডে অবস্থিত পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ৫ আগস্ট ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এখন পর্যন্ত সেই কার্যালয়টি মেরামত করা হয় নি। এমনকি ওই ঘটনার পর এখন পর্যন্ত পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের কিংবা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু সরেজমিন পরিদর্শন করেন নি। এতে নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা দেখা গেছে।
অন্তবর্তীকালীন সরকার বৈঠকে না ডাকলেও সমর্থন দিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে রেখেছে জাতীয় পার্টি। নির্বাচন প্রশ্নে অন্তবর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের সুরে সুর মেলাচ্ছেন। খানিকটা আগের মতোই বক্তৃতা বিবৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ তাদের কর্মকান্ড।