নেত্রীর আন্তরিক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ছাত্রলীগ আদর্শিক অবস্থানে নেই
বাংলাদেশের সকল আন্দোলন সংগ্রামে ছাত্ররাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। এর মধ্যে ছাত্র সংগঠনগুলো বিশেষ করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের আন্দোলন সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস উল্লেখযোগ্য।
কিন্তু বর্তমান ছাত্রলীগ নিয়ে তখনকার ছাত্রলীগের অনেক নেতাই প্রশ্ন তুলেছেন। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও চাচ্ছেন ছাত্রলীগসহ অন্যান্য সহযোগী সংগঠন আদর্শের ভিত্তিতেই গড়ে উঠুক। ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিয়ে জানা-অজানা কথাগুলো বার্তা২৪.কম-কে তুলে ধরেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও সংসদ সদস্য র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী।
শনিবার (১১ জানুয়ারি) সংসদের এমপি হোস্টেলে নিজ অফিসে বার্তা২৪.কম-কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি রাজনৈতিক নানা চড়াই উৎরাই তুলে ধরেন।
বার্তা২৪.কম: আপনি তো ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ হয়েছে কখনো?
উবায়দুল মোকতাদির: আমার সঙ্গে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম দেখা হয় ১৯৬৯ সালে, তখন আমি ঢাকা কলেজে ভর্তি হই এবং ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। শহীদ শেখ কামাল আমাকে নিয়ে আওয়ামী লীগের পুরানা পল্টনের অফিসে যান এবং সেখানে বঙ্গবন্ধুর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। এই হলো বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার পরিচয়। তারপর একাধিকবার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে ৩২ নম্বরের বাড়িতে; কথা তেমন হয়নি, একবারই কথা হয়েছে। এরপর বেশ কয়েকটি উপলক্ষকে ঘিরে বঙ্গবন্ধুর কাছে যাওয়ার সুযোগ হয়।
ছাত্রলীগের ভেতরে যখন স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক ছাত্রলীগ গঠনের প্রস্তাব উঠল, যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন শহীদ স্বপন চৌধুরী, সেই প্রস্তাব নিয়ে ছাত্রলীগের ভেতরে বিতর্ক ছিল। অনেকেই সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ এই কথার সঙ্গে একমত পোষণ করেননি। আমি তখন ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সাধারণ সম্পাদক ছিলাম, নূর ই আলম সিদ্দিকী আমাদের প্রেসিডেন্ট, শাহজাহান সিরাজ সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা হয় এটা নিয়ে। মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধু একটা সিদ্ধান্ত দেন যে, রেজুলেশন পাস করে কোনো দেশ স্বাধীন হয় না। স্বাধীনতার কথা তো তোমাদের ভেতরে আছেই, তোমরা এখন নির্বাচন নিয়ে প্রস্তুত হও। তখন ১৯৭০ এর নির্বাচন সামনে ছিল। এই হলো রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনা।
বার্তা২৪.কম: বেরুবাড়ি হস্তান্তর নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আপনার একটা ঘটনার কথা শুনেছি, যদি বিস্তারিত বলেন।
উবায়দুল মোকতাদির: তখন বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সঙ্গে আমরা যারা ঘনিষ্ঠ ছিলাম, তাদের মাত্র কয়েকজনকে নিয়ে বেরুবাড়ি (ছিটমহল বিনিময়) হস্তান্তর বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলাম। আমরা তখন জিজ্ঞেস করলাম উনি (বঙ্গবন্ধু) অনেক কথা বললেন। ইসমত কাদির গামা ছিলেন, আমি ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর সেই সিদ্ধান্ত আজ ফলপ্রসূ হয়েছে। ছিটমহল বিনিময় এটা খুবই যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত এটা আজ প্রমাণিত। তখন নানান ভাবে বঙ্গবন্ধুকে ম্যালাইন করার চেষ্টা করা হয়েছে, আওয়ামী লীগকে ম্যালাইন করার চেষ্টা করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু বুঝিয়েছিলেন বেরুবাড়ি ভারতের কাছে চলে যাবে অনেক আগে থেকেই সিদ্ধান্ত, আমরা এর বিনিময়ে কী পাচ্ছি সেটা বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন। আমরা এর বিনিময়ে অনেক বেশি পাচ্ছি।
বার্তা২৪.কম: আপনি তো একজন মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের কোন স্মৃতি মনে পড়ে কি?
উবায়দুল মোকতাদির: আমি একজন সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের সময় মরে যাব কি বাঁচব, এটা চিন্তাই করি নাই আমরা। আমার এলাকা থেকে সহজেই আগরতলা যাওয়া যেত। মনি ভাই (শেখ ফজলুল হক মনি) আমাকে একটা দায়িত্ব দিয়েছিলেন। আগরতলা থেকে ধ্রুবি পর্যন্ত পায়ে হেটে গিয়েছিলাম পুরো রাস্তা। তখন আমার জীবনে ঝুঁকি ছিল। এরমধ্যে ময়মনসিংহ শহরে যখন উঠি তখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সরাসরি দেখা হয়ে যায়। সেখানে অত্যন্ত সর্তকতার সঙ্গে তাদের কাছ থেকে রেহাই পাই। আমার কাছে শুধু অস্থায়ী সরকারের পরিচয়পত্র ছিল। জীবনের ঝুঁকি নিতে একবারও ভাবিনি। আমার মাথায় ছিল দেশ মাতৃকার মুক্তি, বঙ্গবন্ধুর আহ্বান।
বার্তা২৪.কম: আপনি তো ছাত্রলীগ করেছেন? ছাত্রলীগ কি আপনাদের সময়ের সেই আদর্শিক জায়গাতে আছে?
উবায়দুল মোকতাদির: না বললেই না। আমাদের সময় একদিকে জাসদ বেরিয়ে গেছে অন্যদিকে শফিউল আলম প্রধান ভাঙ্গন ধরাচ্ছে, আমি তখন মনে করেছি এটা আমার দায়িত্ব, আমি থাকব। আমি বিদেশ যাওয়ার সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও আমি যাইনি। আমরা ক্ষমতাসীন দলের কোনো সুযোগ-সুবিধা নিইনি। ১৫ আগস্টের পর যখন প্রতিরোধ সংগ্রাম করতে যাই তখন কিন্তু যারা সুযোগ সুবিধা বেশি নিয়েছিল তারা সামনে এগোতে পারেনি। আমাদের কোনো সুযোগ সুবিধাও ছিল না, ভয়-ডরও ছিল না। আমাদের ছিল মুজিব আদর্শ। মুজিব আদর্শ স্মরণ করেই সেদিন নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করেছি। আমাদের বিষয়টা ছিল পুরোপুরি আদর্শভিত্তিক। ১/১১ পর ছাত্রলীগের ভূমিকা দেখেন, অনেক পার্থক্য। এমনকি এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময়ও ছাত্রলীগের যে ভূমিকা ছিল, আমলাদের তার চেয়ে বেশি ছিল।
বার্তা২৪.কম: আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তো সবসময় চাচ্ছেন ছাত্রলীগসহ অন্যান্য সহযোগী সংগঠন আদর্শভিত্তিক গড়ে উঠুক। সেই পথে কি হাঁটছে সংগঠনগুলো?
উবায়দুল মোকতাদির: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চাচ্ছেন, আমি জানি না, কেন পারছেন না। নেত্রীর আন্তরিক ইচ্ছা সত্ত্বেও হচ্ছে না। আমার তো মনে হয় কোথায় যেন ত্রুটি আছে।
আমি বড় কোনো পদে নেই, তারপরেও এলাকার মানুষ যারা আমাকে ভোট দেন, আমি যে মানুষের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছি তাদের জন্য উন্নত সমৃদ্ধ ব্রাহ্মণবাড়িয়া গড়তে চাই। আমার কাজ করার অনুপ্রেরণা দেশপ্রেম আর মুজিব আদর্শ। আমি এলাকার মানুষের ভালমন্দের সঙ্গে মিশে গেছি। কোনো কিছুর বিনিময়ে কাজ করি না।
আমি যখন প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব ছিলাম তখন আমাকে বলেছিলেন তুমি যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জন্য কাজ কর কিসের জন্য? আমি উত্তর দেওয়ার আগেই বলেছিলেন, ‘কাজ করবা আল্লাহর ওয়াস্তে। বিনিময়ে কিছুই চাইবা না।’ নেত্রীর সেই কথা এখনো আমার পাথেয় হয়ে আছে।
বার্তা২৪.কম: আপনি তো আগেই দুইবার অন্যান্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি ছিলেন। এবার বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি। বিগত সময়ে এই মন্ত্রণালয় লোকসানের বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছিল, এই মন্ত্রণালয়কে এগিয়ে নিতে আপনার পরামর্শগুলো কি কি?
উবায়দুল মোকতাদির: দেখুন এই মন্ত্রণালয় এখন সরাসরি প্রধানমন্ত্রী হস্তক্ষেপ থাকে। যে কারণে আমরা অনেকটাই বের হয়ে আসার চেষ্টা করছি। কমিটির সভাপতি বা আমাদের সদস্যদের ভূমিকা আলাপ আলোচনা করা, পরামর্শ দেওয়া। তবে আমি মনে করি এই মন্ত্রণালয়ে মাত্রার দিক থেকে দুর্নীতি অনেক কম। আমি সভাপতি হওয়ার পর পর্যটন খাতকে দাঁড় করাতে মন্ত্রণালয়কে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছি। কাজ হচ্ছে আশা করি এক বছরের মধ্যে অনেক পরিবর্তন আসবে।
বার্তা২৪.কম: বাংলাদেশের ট্যুরিস্ট স্পটগুলো পর্যটন বান্ধব করার বিশেষ কোন পরিকল্পনা কি আছে?
উবায়দুল মোকতাদির: হ্যাঁ, তা তো অবশ্যই। আপনারা জানেন কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর করার পরিকল্পনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমরা বলেছি এবং চেষ্টা করছি ননমুসলিম পর্যটকদের জন্য স্পেসিফিক জোন করে দেওয়ার। সেক্ষেত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি কেউ এগিয়ে আসলে তাদেরও সুযোগ দেওয়া হবে। বিশেষ করে সিলেট, কক্সবাজার, সুন্দরবন ও তিন পার্বত্য জেলাগুলোতে নন-মুসলিম পর্যটকদের জন্য পৃথক জোন করা হবে। ওখানে তাদের জন্য সব ধরনের সুযোগ সুবিধা রাখা হবে।
বার্তা২৪.কম: আপনার বিরুদ্ধে অতীতে কিছু অভিযোগ আসছে সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে, যদি বিষয়টা পরিষ্কার করেন।
উবায়দুল মোকতাদির: আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা, আমার ভেতর দেশপ্রেমটাই মুখ্য, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই মুখ্য। আমি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করি। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলাদেশ আমার ক্ষুদ্র অবস্থান থেকে লড়াই করে যাচ্ছি, লড়াই করে যাব। এই জন্যই কিছু মহল আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায়। আমি আমার অবস্থানে অনড়।
বার্তা২৪.কম: সময় দেওয়ার আপনাকে ধন্যবাদ
উবায়দুল মোকতাদির: বার্তা২৪.কম-কেও ধন্যবাদ।