ভেঙে পড়ছে জাতীয় পার্টির চেইন অব কমান্ড
ভেঙে পড়ছে জাতীয় পার্টির চেইন অব কমান্ড, মধ্যম সারি থেকে সিনিয়র নেতাদের প্রকাশ্য চিটার-বাটপার-তেলবাজ বলে ফেসবুক ফাটানো হচ্ছে। যারা এসব রটাচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় দিনদিন বেপরোয়া হয়ে উঠছেন এই শ্রেণির নেতা-কর্মীরা।
জাতীয় পার্টির একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, পার্টির নেতাকর্মীদের ফেসবুকে ঢুকলেই চোখ আটকে যায়। কি হচ্ছে এসব, কারো মুখেই লাগাম নেই। জুনিয়র সিনিয়রের মধ্যে যেখানে হৃদ্যতা সম্পর্ক থাকার কথা, সেখানে কেউ কাউকে ছাড় দিচ্ছে না। একজন সেরতো আরেকজন সোয়াসের। গালমন্দে আটকে থাকছেন না, গড়াচ্ছে হুমকি ধামকি পর্যন্ত। কেউ কেউ আবার অন্যকে শায়েস্তা করার জন্য বরাদ্দ রেখেছেন সেটিও প্রকাশ করছে ফেসবুকের স্ট্যাটাসে এসে। কেউ কেউ পার্টির চেয়ারম্যান ও মহাসচিবকেও একহাত নিচ্ছেন কমেন্ট করতে এসে।
পার্টির মধ্যে শিষ্টাচারেও বেশ ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। অনেক অনুষ্ঠানেই মঞ্চে বসা নিয়ে গোলমাল দৃশ্যমান। সিনিয়র নেতারা বসার চেয়ার পাচ্ছে না। প্রত্যেক নামের সঙ্গে একেকটি বিশেষণ জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। কাউকে আরেকজনের নাম জিজ্ঞেস করলেন, তিনি হয়তো এমন উত্তর দিচ্ছেন ওহ ইয়াবা…..। পার্টিটাকে শেষ করে দিচ্ছে। চেয়ারম্যানকে ফুসলিয়ে যাতা করে ফেলছে। আরেকজন হয়তো বলছেন, ….দালাল।
এই বিতর্কে সামিল হচ্ছেন তৃণমূল থেকে চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা পর্যন্ত। পার্টির চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা পরিষদের দু’জন সদস্য ইদানিং এসব কর্মকাণ্ডে বেশ সরব। জিএম কাদের দায়িত্ব পাওয়ার পর কয়েক দফায় প্রমোশন পেয়ে উপদেষ্টা পরিষদে ঠাঁই পাওয়া এই দু’নেতা ফেসবুকিংয়ে শীর্ষে রয়েছেন। একজনতো প্রকাশ্য আরেকজনকে সাইজ করার জন্য বরাদ্দ রাখার ঘোষণা দিচ্ছেন।
পার্টির চেয়ারম্যানের আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত উপদেষ্টা মনিরুল ইসলাম মিলন। ১৭ মে স্ট্যাটাসে লিখেছেন “……ইসলাম ধর্মে শীর্ষ শয়তানের নাম দেওয়া হয়েছে-ইবলিশ। আর ইবলিশ এর বাংলাদেশি ভার্সন হচ্ছে রেজাউল।”
৬ মে এক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, এক কলা বিক্রেতার রেজাউল টাইপের ধুরন্ধর দুইটা পুত্র ছিল……। এই স্ট্যাটাসে স্বেচ্ছাসেবক পার্টি জৈন্তাপুর উপজেলা শাখার আহ্বায়ক আকবর এইচপি আইডি থেকে কমেন্টে লিখেছে, গল্প পড়ে আমি মনে করছি পাশের গ্রামের রেজাউলের কথা, পরে ভাবছি প্রতিবেশী বিভাগের (চট্রগ্রাম বিভাগের) রেজাউল হবে, চিন্তায় আছি রেজাউল নিয়ে! আরেকজনের কমেন্টের রিপ্লাই অপশনে মনিরুল ইসলাম মিলন লিখেছেন, “ভালো বলেছো। আর ঐটা মেইড ইন ব্রাহ্মণবাড়িয়া।” আরেক আইডি থেকে লেখা হয়েছে, এটাকি ভুঁইয়া পরিবারের? সেই কমেন্টে লাইক দিয়ে বিষয়টি আরও পরিষ্কার করেছেন উপদেষ্টা মনিরুল ইসলাম মিলন। এই স্ট্যাটাসে ১৮২টি কমেন্ট পড়েছে। যার বেশিরভাগই জাতীয় পার্টির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মী ও সাবেক নেতা।
রেজাউলের পরিচয় পুরোপুরি না লিখলেও পরের কমেন্ট এবং লাইকে প্রেসিডিয়াম সদস্য ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় অতিরিক্ত মহাসচিব রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়ার সঙ্গে মিল পাওয়া যায়। এসব স্ট্যাটাসে যে সব কমেন্ট পড়েছে তার কিছু কিছু সভ্য সমাজে মুখে আনা কঠিন।
মনিরুল ইসলাম মিলন বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, আমি গল্পে রূপক অর্থে রেজাউল নামটি ব্যবহার করেছি। নির্দিষ্ট কাউকে বুঝাতে চাইনি। নির্দিষ্ট করে বুঝাতে চাইলে তাহলে তার নাম পদবি দিয়েই লিখতাম। আমাদের দলেতো আরও অনেক রেজাউল রয়েছে। ভূঁইয়া বংশের কিনা এমন কমেন্টেতো আপনি লাইক দিয়েছেন, তার অর্থ কি দাঁড়ায়। জবাবে বলেন, আমি লাইক দিয়েছি মানে দেখেছি। তার মানে এই নয় যে আমি এটাকে সঠিক বলেছি।
পার্টির অন্যান্য নেতা-কর্মীদের ফেসবুকে নানা রকম আপত্তিকর লেখালেখি পার্টির জন্য ক্ষতিকর হচ্ছে কি না। জবাবে বলেন, আমি মনে করি দলীয়ভাবে এ বিষয়ে কিছু একটা করা উচিত। এতে দলের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় অতিরিক্ত মহাসচিব অ্যাড. রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, আমি ঈদ উপলক্ষে গ্রামে অবস্থান করছি। এ বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, মনিরুল ইসলাম মিলনের বিষয়টি স্টপ করা হয়েছে। স্পষ্ট কেউ বাড়াবাড়ি করলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আইসিটি বিষয়ে ভালো আইন করেছেন যদিও আমরা এটার সমালোচনা করেছি।
জাতীয় স্বেচ্ছাসেবক পার্টির দফতর সম্পাদক মাহবুবার রহমান কামাল, আজমল হোসেন জিতু নামের একজনের স্ট্যাটাসে এসে লিখেছেন আগে সুনীল শুভকে বিদায় করতে হবে। প্রেসিডিয়াম সদস্য ও পার্টির চেয়ারম্যানের প্রেস ও পলিটিক্যাল সেক্রেটারির বিরুদ্ধে এভাবে প্রকাশ্য কেউ লিখতে পারে এটা অন্যদলের ক্ষেত্রে অভাবনীয়। কিন্তু এই স্ট্যাটাসের বিষয়ে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে এমন কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
মিজানুর রহমান নামে এক সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা স্ট্যাটাসে লিখেছেন পার্টির ফান্ডের হিসেবে চাই। তিনি পার্টির কাউন্সিল, বন্যা এবং বিভিন্ন সময়ে তোলা ফান্ডের খরচ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সেখানেও হামলে পড়ছে পার্টির কর্মী সমর্থকরা। একজনতো এসে চেয়ারম্যানের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলতে ছাড় দেননি।
আরেকজন উপদেষ্টা রয়েছেন তিনি এক কাঠি বেশি সরস। যাকে তাকে হুমকি-ধামকি দিতে সিদ্ধহস্ত। আজমল হোসেন জিতুর স্ট্যাটাসে কমেন্ট করতে এসে লিখেছেন। এবার…দেখে নেবো। সাইজ করার জন্য বরাদ্দ রেখেছি…ইত্যাদি ইত্যাদি। এমন কমেন্টের পর সেখানেও আবার নানা রকম আলোচনা। এক শ্রেণির নেতাকর্মী রয়েছেন এসব আলোচনা উস্কে দিয়ে মজা নিচ্ছেন।
নিজের সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য প্রশ্নে জিএম কাদের বলেন, আমি পাবলিক ফিগার আমাকে সবাই পছন্দ করবে এমনটা আশা করা কঠিন। কেউ গালাগাল করবে এটাই স্বাভাবিক। দলীয় কর্মীরাই অনেকে আপত্তিকর মন্তব্য করছে এমন প্রশ্নে বলেন, আপনি যাদের কর্মী বলছেন তারা হয়তো কেউই দলের রেজিস্টার্ড কর্মী নয়, রেজিস্টার্ড কর্মী হতে হলে দলীয় চাঁদা দিতে হয়, দলের কোনো ফোরামে নাম থাকতে হয়। তারা কেউই জীবনে চাঁদা দেয়নি, নামও দেখাতে পারবে না। হয়তো ২০ বছর আগে কোনো একবার চাঁদা দিয়ে থাকতে পারে। তারা আসলে বেকার কাজ নেই, পার্টি অফিসে আসা যাওয়া করে, বিভিন্ন প্রোগ্রামে হাজির হয়, আমরাও এন্টারটেইন করি। তারা আসলে অফিসিয়ালি রেজিস্টার্ড কর্মী নয়। অনেকে রয়েছে, যাকে পছন্দ নয়, পয়সা দিয়েও তার বিরুদ্ধে এসব লেখালেখি করে। বাড়াবাড়ি পর্যায়ে গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।