টেস্ট অভিষেক; আজ থেকে ২০ বছর আগে...
এক) ১০ নভেম্বর, ২০০০ সাল।
২০ বছর পুরনো দিনের সকালবেলার একটা ছবি এখনো খুব স্পষ্ট। বাংলাদেশ খেলছে অভিষেক টেস্ট। ব্যাটিং ওপেন করছেন মেহরাব হোসেন অপি ও শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ। আর বাংলাদেশের ড্রেসিংরুমের দরজায় হেলান দিয়ে মাঠের দিকে তাকিয়ে সেই দৃশ্য দেখছেন জাভেদ ওমর বেলিম গুল্লু। চোখে অসহায় চাহনি। তার সেই দৃষ্টিতে অনেক কিছু হারানোর কষ্ট। বঞ্চিতের বেদনা!
এই টেস্টের ওপেনার যে তারই হওয়ার কথা।
বাংলাদেশ দলের ড্রেসিরুমের আড্ডা মানেই জাভেদ ওমরের কৌতুক-হাসি আনন্দের ছড়াছড়ির গল্প। অথচ বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টে তাকেই দেখাল সবচেয়ে বেশি অসহায় এবং অধিকার বঞ্চিত।
-অধিকার বঞ্চিত?
এই প্রশ্নের উত্তরও সহজ। বাংলাদেশ তখনো টেস্ট ক্রিকেট যুগে প্রবেশ করেনি। সেইসময় আন্তর্জাতিক ম্যাচ বলতে গেলে শুধু ওয়ানডে ক্রিকেট খেলার সুযোগ। কিন্তু সেই ওয়ানডে ক্রিকেটেও দল গড়ার সময় জাভেদ ওমরের নামটা সামনে এলে নির্বাচক থেকে শুরু করে একনাগাড়ে সবারই একই রায়- ‘জাভেদ একটু স্লো ব্যাটিং করে। ওয়ানডেতে এমন ব্যাটিং চলে না। ও আসলে টেস্টের খেলোয়াড়!’
ব্যস এই যুক্তিতে ওয়ানডে দলে জাভেদের ওপর খড়গ!
সেই বাংলাদেশই যখন প্রথম টেস্ট খেলতে নামল তখন সেই একাদশে জাভেদ ওমর নেই! অথচ যাকে বাংলাদেশ টেস্ট খেলার আগেই বলা হতো ‘টেস্ট ব্যাটসম্যান!’
দুই) অভিষেক টেস্টে শুধু ক্রিকেটারদের নয়, বাংলাদেশের বেশির ভাগ ক্রীড়া সাংবাদিকদেরও টেস্ট ম্যাচ রিপোটিংয়ের অভিষেক হলো ২০ বছর আগে ১০ নভেম্বর। ঐতিহাসিক সেই টেস্টের আগে ক্রিকেটারদের মতো ক্রিকেট রিপোর্টারদেরও সেকি উত্তেজনা! নতুন রিপোর্ট খোঁজার লড়াই। স্কুপের জন্য ছোটাছুটি। ক্রিকেট সংশ্লিষ্টদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা। ২০ বছর আগের সেই সময়টায় বেসরকারি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল ছিল হাতে গোনা। দেশি অনলাইনের তখনো জন্মই হয়নি। গণমাধ্যমের বেশিরভাগ জায়গা জুড়ে পত্রিকা। টেস্ট ম্যাচের সপ্তাহ দুয়েক আগে থেকেই প্রতিদিন পত্রিকার খেলার পাতা জুড়ে শুধু ঢাকা টেস্টের খবর। আর ম্যাচ শুরুর আগের দিন দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রায় সব দৈনিক বিশেষ সাপ্লিমেন্ট প্রকাশ করে। আমি তখন দেশের প্রথম ট্যাবলয়েড দৈনিক মানবজমিনের ক্রীড়া সম্পাদক। প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী দারুণ খেলাপ্রেমী। মাঠে বসে বিশ্বকাপ ফুটবল কাভার করা বাংলাদেশের প্রথম সাংবাদিক মতি ভাই। তাই খেলার পাতার প্রতি তার ভালবাসা একটু বেশি। স্পষ্ট মনে আছে মানবজমিন টেস্ট অভিষেক উপলক্ষে ১০ পাতার বিশেষ সাপ্লিমেন্ট প্রকাশ করেছিল।
এখন প্রেসবক্সে বসে আন্তর্জাতিক ম্যাচ কাভার করা সব সাংবাদিক ল্যাপটপে কাজ করেন। ২০ বছর আগের এদিনে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের পুরো প্রেসবক্সে কোনো ল্যাপটপের দেখা মেলেনি। প্রেসবক্সের মাঝামাঝি জায়গায় শুধু একজনের সামনে দেখা গেল বিশাল আকৃতির টাইপরাইটিং মেশিন। উনি এনামুল হক চৌধুরী। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার হয়ে অভিষেক টেস্ট ম্যাচ কাভার করছেন। প্রেসবক্সের বাকি সবাই লম্বা কাগজে লিখে অফিসে ফ্যাক্স করে দেন। অথবা খেলা শেষে অফিসে ফিরে রিপোর্ট লেখেন। মাঠে ফটো সাংবাদিকদের ভিড়েও তেমন লম্বা লেন্সওয়ালা ক্যামেরার ছোটাছুটি ছিল না।
প্রেসবক্সে রিপোর্ট লিখে উপরের তলায় ছুটতে হতো অফিসে ফ্যাক্স করতে। ফ্যাক্স মেশিনের সামনেও লম্বা লাইন। কারো ফ্যাক্স ঠিক মতো অফিসে না পৌঁছালে টেনশনে বেচারার মুখ ঝুলে যেত। স্টেডিয়ামে ফ্যাক্সের লাইনেই ম্যাচের কোনো একদিন পেয়ে গেলাম মাইকেল হোল্ডিংকে। উনি এসেছেন ফটোকপি করতে। একটা রঙিন ম্যাগাজিনে নিজের লেখাটার ফটোকপি করার জন্য লাইনে দাঁড়ানো হোল্ডিং। ধারাভাষ্যকার হোল্ডিংকে পেয়ে তার কাছ থেকে টুকরো কিছু মন্তব্য জানার চেষ্টাও চলল। তার আগে আলাপ জমানোর তরিকা।
- তোমার রঙিন ম্যাগাজিন কিন্তু ফটোকপি তো বেরুবে সাদাকালো। এখানে রঙিন ফটোকপি নেই।
হোল্ডিংয়ের উত্তরটা আমার আজও মনে আছে- ‘নো প্রবলেম ম্যান, আই অ্যাম অলসো অফ কালার!’
তিন) অভিষেক টেস্টের দ্বিতীয় দিনে লাঞ্চের আগেই সেঞ্চুরি পেলেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল। ২০০০ সালের ১১ নভেম্বর শবে-ই-বরাত উপলক্ষে সংবাদ পত্রে ছুটি। দেশের হয়ে প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি, আর সেই খবর পরদিনের পত্রিকায় ছাপা হবে না; তা কি করে হয়? প্রেসবক্সে বসেই সিনিয়র কয়েকজন ক্রীড়া সাংবাদিক সিদ্ধান্ত নিলেন এই সেঞ্চুরি আনন্দের খবর ছাপতেই হবে। খেলার ভুবনের সম্পাদক সারোয়ার ভাই, ক্রীড়াজগতের সম্পাদক দুলাল মাহমুদ ভাই, ইত্তেফাকের ক্রীড়া সম্পাদক দিলু খন্দকার ভাই’রা মিলে দারুণ একটা উদ্যোগ নিলেন। ফকিরেরপুলের প্রেস থেকে বিকেলের মধ্যেই বুলেটিন বের করার সিদ্ধান্ত হলো।
- লেখা আসবে কোথা থেকে?
- কেন, প্রেসবক্সে এত সাংবাদিক থাকতে লেখার আবার অভাব হবে নাকি?
সঙ্গে সঙ্গে সবাই আমিনুল ইসলাম বুলবুলের সেই সেঞ্চুরি নিয়ে ঝটপট লেখা জমা দিলেন। বিকেলের মধ্যেই কয়েক পৃষ্ঠার সেই বুলেটিন হাতে পাওয়ার পর প্রেসবক্সে বসে নিজেকেও সেঞ্চুরিয়ান মনে হলো; আমার লেখাও যে আছে ওখানে!
চার) টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের সেরা উইকেটকিপারের তালিকা তৈরি করলে সেখানে মুশফিকের সঙ্গে লড়াইটা হবে খালেদ মাসুদ পাইলটের। অভিষেক টেস্টের দল তৈরির সময় নির্বাচকরা সম্ভবত সবচেয়ে কম সময় নিয়েই উইকেটকিপারের জায়গায় খালেদ মাসুদ পাইলটের নাম লিখেছিলেন। দারুণ অ্যাক্রোবেটিক এই উইকেটকিপার বাংলাদেশকে লম্বা সময় সেবা দিয়েছেন। বেশকিছু রেকর্ড গড়েছেন। তবে অবাক করা তথ্য হলো টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রথম ডিসমিসাল (ক্যাচ অথবা স্ট্যাম্পিং) কিন্তু খালেদ মাসুদের না, সেই কৃতিত্ব শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুতের!
-কিভাবে?
অভিষেক টেস্টে ভারতীয় ইনিংসের মাঝামাঝি সময় খালেদ মাসুদ আম্পায়ারের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে বাথরুম ব্রেক নিয়ে ড্রেসিংরুমে ছুটেন। আধঘণ্টার মতো মাঠের বাইরে ছিলেন খালেদ মাসুদ। উইকেটকিপারের দায়িত্ব সামাল দেন ওপেনার শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ। স্পিনার মোহাম্মদ রফিকের বলে ঠিক সেই সময়টায় সাবা করিম সামনে বেড়ে খেলতে গিয়ে বিট হন। দারুণ দক্ষতায় শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ তাকে স্ট্যাম্পিং করেন।
ব্যস, বাংলাদেশের হয়ে টেস্টে প্রথম ডিসমিসালে তার নামটাই লেখা হয়ে গেল!
পাঁচ) অভিষেক টেস্টের প্রথম ইনিংসেই আমিনুল ইসলাম বুলবুলের ১৪৫ রানের সেঞ্চুরি, হাবিবুল বাশার সুমনের ৭১ হাফসেঞ্চুরির কল্যাণে বাংলাদেশের সংগ্রহ ৪০০ রান। প্রথম ইনিংসে এত বড় সংগ্রহের পরও ম্যাচটা হেরে গেল বাংলাদেশ দ্বিতীয় ইনিংসের ব্যর্থতায়। দ্বিতীয় ইনিংসে ৯১ রানে গুটিয়ে যায় বাংলাদেশ। প্রথম ইনিংসে ৪২৯ রান করা ভারতের ম্যাচ জিততে শেষ ইনিংসে প্রয়োজন দাঁড়ায় মাত্র ৬৩ রানের। তখন ম্যাচের চতুর্থ দিনের শেষ প্রহরের খেলা চলছে। দিনের খেলার সময়ও প্রায় শেষ। কিন্তু টার্গেট খুবই সামান্য দেখে আম্পায়াররা ফ্লাডলাইট জ্বালিয়ে খেলা শেষ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। ম্যাচটা আর পঞ্চম দিনে গড়াল না।
ফ্লাডলাইট জ্বালিয়ে খেলার সময় বাড়িয়ে চতুর্থ দিনেই ম্যাচ শেষ করার এই বিষয়টি দেখে বাংলাদেশ দলের দুই ক্রিকেটার নিজেদের মধ্যে এর কার্যকারণ উদ্ধারের জন্য আলাপ করছিলেন।
-জানিস কেন খেলা পঞ্চম দিনে নিল না আম্পায়াররা?
- কেন, তুই জানিস কারণটা?
অভিষেক টেস্টের নিয়মটাই এমন, পঞ্চম দিনে খেলা নেওয়া যায় না!
আলাপি সেই দুই ক্রিকেটার কে?
থাক, নামটা তো তারা জানেনই। ২০ বছর পর আমি আবার নতুন করে নাই বললাম!
শুধু ছোট্ট একটা হিন্টস দেই; দুজনেই ব্যাটসম্যান!