রিয়ালকে গুঁড়িয়ে ইউরোপকেও বার্তা দিল বার্সা

  • নেয়ামত উল্লাহ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি- সংগৃহীত

ছবি- সংগৃহীত

অনেক ম্যাচের আগে এমন ‘প্রিভিউ’ লেখা হয়ে থাকে, যার জন্য অনেক অনেক অ্যাঙ্গেল বের করে আনা হয়, সে ভিতের ওপর দাঁড় করানো হয় হাজারে-হাজারে শব্দ। তবে তার পুরোটাই বিফলে যায় ম্যাচের প্রথম বল বা প্রথম মিনিট শেষেই! ম্যাচের প্রিভিউর অ্যাঙ্গেলের সঙ্গে ম্যাচের ‘অ্যাঙ্গেল’টা তখন দাঁড়ায় ১৮০ ডিগ্রিতে!

সদ্যসমাপ্ত এল ক্লাসিকোটাকেও তাহলে তেমন একটা ম্যাচ আর প্রিভিউর যুগলবন্দি হিসেবে ধরে নিতে পারেন চাইলে। একটা অ্যাঙ্গেল ধরিয়ে দেওয়া যাক চলুন। কিলিয়ান এমবাপের ক্যারিয়ারের প্রথম এল ক্লাসিকো ছিল এটা, তাও আবার নিজ মাঠ সান্তিয়াগো বের্নাবিউতে। বার্সেলোনা তার প্রিয় প্রতিপক্ষ, চ্যাম্পিয়ন্স লিগে দলটার বিপক্ষে একটা হ্যাটট্রিকও আছে তার। ম্যাচের আগে মনে হচ্ছিল, মঞ্চটা তার জন্যই প্রস্তুত।

বিজ্ঞাপন

সে মঞ্চে দাঁড়িয়ে কি-না প্রলয়নাচনটা তুললেন যিনি প্রতিপক্ষের জার্সিতে এমবাপের নম্বর ৯ পরে আছেন, তিনি রবার্ট লেভান্ডভস্কি। না, শুধু তার নামটা বললে বাকিদের প্রতি অনেকটা অবিচার করা হয়ে যায়; লামিন ইয়ামালের সস্পর্ধ, কিংবা রাফিনিয়াদের বুদ্ধিদীপ্ত পদচারণাকেও বোধহয় তাতে খানিকটা ছোট করা হয়! এই তিনের যুগলবন্দিতে বার্সেলোনা রিয়াল মাদ্রিদকে তাদেরই মাঠে ডুবিয়েছে ৪-০ গোলের গ্লানিতে।

নাহ! লেভা, ইয়ামাল, রাফিনিয়াদের নাম নিলেও নৈবেদ্যটা সবার কাজের প্রতি সুবিচার করে না। আসল কাজটা তো করেছে বার্সেলোনার রক্ষণ! ম্যাচের শুরুর দিকে ৩৫ কিলোমিটার বেগে বল নিয়ে দৌড়িয়ে কিলিয়ান এমবাপে হুঁশিয়ারি দিচ্ছিলেন তাকে সমঝে চলতে! বার্সেলোনা সেটা করেছে, তবে কড়া ম্যান মার্ক করে নয়, তাকে মুক্ত পাখির মতো ছেড়ে দিয়ে। 

কীভাবে? উঁচু রক্ষণরেখা সাজিয়ে। বাকি কাজটা সেরেছেন সাইডলাইনের বাইরে থাকা লাইন্সম্যান ভদ্রলোক। এমবাপে বল নিয়ে ছিটকে বেরিয়ে গেছেন, আর তখনই লাইন্সম্যান উঁচিয়ে ধরেছেন পতাকা।

বার্সার জালে এমবাপের বল জড়ানোর অভ্যাসটা পুরোনো। ৩০ মিনিটে তিনি কাজটা আবারও করলেন। এবার লাইন্সম্যানের হাতও রইল নীচে। তবে শেষ রক্ষা হলো না শেষমেশ। পথ আগলে দাঁড়াল ভিএআর, অফসাইডের কাটায় গোলটা আর উঠল না এমবাপের খাতায়। এই ম্যাচের আগে লা লিগায় সব মিলিয়ে সর্বোচ্চ ৬৫ বার প্রতিপক্ষকে অফসাইডের ফাঁদে ফেলেছে দলটা। 

তবে বের্নাবিউতে সব সীমা ছাড়িয়ে গেল যেন, ওই না হওয়া গোলের আগে এক এমবাপেই অফসাইডের কাটায় পড়লেন ৪ বার। সংখ্যাটা স্রেফ এখানেই থামেনি। দ্বিতীয়ার্ধেও চলেছে ওই একই দৃশ্য। প্রথমার্ধের বাঁশি বাজার আগ পর্যন্ত লড়াইটা এই অর্ধেই হয়েছে বেশি, কাজটায় বার্সেলোনা সফল, কারণ স্কোরলাইনে যে কোনো পরিবর্তন আসেনি। 

এতক্ষণ অফসাইডের গল্প শুনতে শুনতে আপনার মনে হতে পারে, এ আর এমন কী! রক্ষণব্যূহ ওপরে তুলে দিলেই তো কেল্লাফতে! ঘণ্টার কাটা পেরোনোর আগে তার জবাবটা দিয়ে দিলেন এডার মিলিতাও। মার্ক কাসাদোর পাস রিয়ালের রক্ষণ ছত্রখান করে গিয়ে পড়ল লেভার পায়ে, কাসাদো যখন থ্রু বলটা বের করে দিচ্ছেন, তখন লেভা ছিলেন অনসাইডে, তাকে বৈধ অবস্থানে রেখেছিলেন মিলিতাও। 

রক্ষণ ভেঙে গোলরক্ষককে যখন একা পেয়ে যান লেভার মতো কেউ, তখন যা হওয়ার তাই হয়, বলটা গিয়ে জালে আছড়ে পড়ে। এর ১৪০ সেকেন্ড পর আবারও লেভার উৎসব, এবার অবশ্য অফসাইডের ফাঁদ এড়ানোর কোনো বালাই ছিল না, অ্যালেক্স বালদের ক্রসে মাথা ছুঁইয়ে রিয়ালের জালে আবারও বল আছড়ে ফেললেন। 

এরপর লেভান্ডভস্কির হ্যাটট্রিকটাও হতে পারত। রাফিনিয়া নিঃস্বার্থভাবে বল বাড়িয়ে দিলেন তাকে, তবে তার শটটা গিয়ে লাগে বারপোস্টে। একটু পর ইয়ামালের ক্রস তাকে খুঁজে পেল বক্সে, তবে তার সে শট গোল পেতে হলে গোলপোস্টটা রাগবির গোলপোস্টের সমান উঁচু হতে হতো। 

এমন সব পরিস্থিতি মাদ্রিদের সৌভাগ্যের দিকেও কিন্তু ইঙ্গিত দিচ্ছিল। বড় ম্যাচে এমন সব পরিস্থিতিতে বহু বার পড়েছে রিয়াল, এভাবে মোমেন্টাম পেয়ে গিয়ে ম্যাচ নিয়ে বের হয়ে যাওয়া, এমন ‘দ্য গ্রেট এসকেপের’ গল্প ইতিহাসে বহুবার লিখেছে রিয়াল মাদ্রিদ। এই তো গেল ম্যাচেই তো বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের বিপক্ষে সবশেষ গল্পটা লেখা হয়েছিল!

তার গন্ধ পেয়েই মাদ্রিদ এরপর উজ্জীবিত ছিল বেশ কিছুক্ষণ। এমবাপে আরও একবার বল জালে জড়ালেন। এবারও বিধিবাম! অফসাইডের কাটায় পড়ল এই চেষ্টাটাও। কোচ হানসি ফ্লিকের কৌশলটা এবারও নিখুঁতভাবে বাস্তবে রূপ দেন তার শিষ্যরা। 

মাদ্রিদের বিপক্ষে দুই গোলের লিড নিরাপদ নয় আদৌ। ক্রিকেটের মাঠে একটা উইকেট যেমন আরও উইকেটের নাগাল পাইয়ে দেয়, ফুটবলে একটা গোলও কিন্তু আরও গোলের ফ্লাডগেট খুলে দেয়। ম্যাচটা তাই শেষ করা প্রয়োজন ছিল বার্সার। 

কাতালানরা সেটা করল গিয়ে ৭৭ মিনিটে। প্রতি আক্রমণ থেকে রাফিনিয়ার বাড়ানো বল লামিন ইয়ামাল তীব্র স্পর্ধায় নিয়ে আছড়ে ফেললেন মাদ্রিদের গোলপোস্টের ছাদে। গোল করেই উদযাপন করতে পাশে ছুটে যাওয়া লামিন পিঠে লেখা নামটা দেখালেন, অনুচ্চারে বললেন, ভুলোনা যেন!

এরপরের গোলটা করলেন রাফিনিয়া। রক্ষণ থেকে ইনিগো মার্তিনেজের বাড়ানো লং বলে প্রতিপক্ষ গোলরক্ষক আন্দ্রেভ লুনিনকে একা পেয়ে আলতো চিপে বলটা ফেললেন গোললাইনের ওপারে। আগের তিন গোল যদি মুখরোচক ভুড়িভোজ হয়ে থাকে, তাহলে এই গোলটা শেষের ডেজার্টের মতো, মুখে একটা তৃপ্তির ছাপ রেখে যায়। 

লা লিগায় সবচেয়ে বেশি ম্যাচ অপরাজিত থাকার রেকর্ডটা বার্সেলোনার। ২০১৭ ও ২০১৮র মধ্যবর্তী সময়ে ৪৩ ম্যাচ না হেরে ছিল কোচ এর্নেস্তো ভালভের্দের দল। তবে সেটা এবার রিয়াল মাদ্রিদ ছুঁয়ে ফেলার খুব কাছাকাছি ছিল। বার্সা রিয়ালকে স্রেফ সে রেকর্ডটা থেকেই বঞ্চিত করেনি, রীতিমতো ভূপাতিত করেই ছাড়ল।

লা লিগার পয়েন্ট তালিকার শীর্ষে বার্সার আধিপত্যটা এ ম্যাচের পর আরও সুসংহত হলো। দুইয়ে থাকা রিয়ালের সঙ্গে তাদের ব্যবধান এখন ৬ পয়েন্টের। তবে এ ব্যবধান, বা রেকর্ড ধরে রাখার তৃপ্তি, এসব কিছুই নয়, এ ম্যাচ থেকে বার্সাকে সবচেয়ে বেশি স্বস্তি দেবে এ অনুভূতিটা, এখন আর কোনো দলই অধরা নয়!

সবশেষ ম্যাচে বার্সেলোনা তাদের ইউরোপীয় দুঃস্মৃতি পেছনে ফেলেছিল বায়ার্ন মিউনিখকে ৪-১ গোলে উড়িয়ে, যা দলটার বিপক্ষে ৯ বছর পর বার্সার প্রথম জয়। এর ঠিক পরের ম্যাচে রিয়াল মাদ্রিদের জালেও জড়াল সমান সংখ্যক গোল, এবার গোল হজম করল না একটাও। টানা দুই ম্যাচে এমন পারফর্ম্যান্স ইউরোপের প্রতি বার্সার বার্তাও। নিখুঁত এই সপ্তাহে বার্সা জানান দিল, আমরা আসছি আবারও, আমাদের সমঝে চলো হে!