রাজকোটে পা রেখেই নিজের ‘রাজত্ব’ হারালাম!
রাজকোটে যাচ্ছেন কেন? সেখানে দেখার কী আছে?
-মুম্বাইয়ের ছত্রপতি শিবাজি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন অফিসারের কথাটা শুনে চমকে গেলাম! আতঙ্ক ভর করছিল মনে তাহলে দিল্লির মতো গুজরাটের এ শহরে না জানি কি অপেক্ষা করছে? ১ নভেম্বর রাতে পা রেখেছিলাম ভারতের রাজধানীতে। তারপর ৪ নভেম্বর ভোরে শহর ছেড়েছি। এরমধ্যে অসুস্থ হওয়াটাই শুধু বাকি ছিল।
দিল্লির পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে ঢের লেখালেখি হয়েছে। হবেই না কেন? বিশ্বের শীর্ষ তিন দূষিত নগরীর একটি যে এটি। দিওয়ালির রঙ উৎসবের পরই পা রাখায় দুঃসহ এক অভিজ্ঞতা সঙ্গী হয়েছে। ৩ নভেম্বর, রোববার রাতে বাংলাদেশ ঐতিহাসিক জয়টা না পেলে 'দিল্লিতে কেন গেলাম' সেই আক্ষেপ নিয়েই হয়তো ফিরতে হতো!
কিন্তু আজীবন মনের ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখার মতো একটা জয় সঙ্গী করেই ফিরলাম। তবে কে জানতো এমন চমক অপেক্ষায় ছিল রাজকোটে?
প্রথমবারের মতো গুজরাটের চতুর্থ বৃহত্তম শহরে এসেছি। রাজকোট বিমানবন্দরের সীমানা ছাড়াতেই কেমন যেন মফস্বল শহরের আমেজ! ভিড় নেই তেমন! পার্কিংয়ের ঠিক সামনেই রাম নাম জপছিলেন তার ভক্তরা।
রাজকোটে আমাদের ঠিকানা নতুন প্রেস রোডের জন্য ট্যাক্সি ঠিক করতে গিয়ে অবশ্য বুঝলাম, বাংলাদেশের সিএনজি ড্রাইভারদের সমস্যাটা এখানেও আছে। মানে বিপাকে পড়লে একটু বেশি টাকা হাতিয়ে নেয়া আর কী! যে রাস্তাটুকু আসতে ট্যাক্সি ড্রাইভার চাইলেন ৪০০ রূপি, সেটাই' ওলা ক্যাবসে নিলো ২০০ রূপি!
অ্যাপস ভিত্তিক পরিবহনের সেই চালকের কাছে জানতে চাইলাম, শহরটা এমন নীরব কেন? একদমই ভিড় নেই। খোদ নরেন্দ্র মোদির রাজ্যের এই অংশে উন্নতির ছোঁয়াটাও তেমন চোখে পড়ল না। সর্দার বাজারের পথ ছাড়িয়ে যাওয়ার সময় তিনি বলছিলেন, 'এখানে যতোই আমরা মোদিজি মোদিজি করছি, কাজ হচ্ছে না। গরিব আরও গরিব হচ্ছে!' কথাটা বলেই জিভে কামড় দিলেন। একজন ভিনদেশির কাছে এভাবে নিজেদের কথাটা বলে যেন মহা ভুল করে ফেলেছেন তিনি।
তবে আমার কিন্তু বেশ লাগছিল। বিমানবন্দর থেকে ফিরতি পথে শেষ বিকেলে মুগ্ধতা ছড়িয়ে থাকল। দিল্লির গ্যাস চেম্বার থেকে রাজকোটের বিশুদ্ধ বাতাস জানিয়ে দিচ্ছিল শীত আসছে। মফস্বল শহরে বুঝি একটু আগেই শীত জাঁকিয়ে বসে।
এমন কি দ্রুত রাতও নেমে আসে। হোটেলে চেক ইন করতে করতেই ঘড়িতে রাত ন’টা। তারপরও ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে বাধ্য হয়েই বেরোতে হলো। কেন, সেই উত্তরে পরে আসছি। কিন্তু এই সন্ধ্যা রাতেই ঘুমিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল শহর। তবে স্ট্রিট ফুডের দোকানো টুকটাক ভিড়! নানারকম মশলা দিয়ে ডিমের ওমলেট তৈরি হচ্ছে। ডাবল ডিম দিয়ে তৈরি করা বিশেষ এই খাবার ৫০ টাকা। একই দামে মিলছে চিকেন শর্মাও।
এখানকার দোকান, হোটেল আর অফিসের সাইনবোর্ড দেখেও খটকা লাগল। ঠিক হিন্দি নয়। বাবার সঙ্গে খাবারের দোকান সামলাচ্ছিলেন, পনের বছর বয়সী বালক রাম নরেশ। সেই জানাচ্ছিল, হিন্দি নয়, লেখাগুলো গুজরাটি। এটিই এখানকার প্রধান ভাষা। পশ্চিমবঙ্গের যেমন বাংলা হুমকির মুখে, গুজরাটেও অনেকটাই তাই। এখানে হিন্দি, উর্দু, ইংরেজি, সিন্ধি, তামিল, মারাঠির সঙ্গে ১৪ লাখের শহরে কিছু বাংলা ভাষাভাষীও রয়েছেন!
প্রথম দিনে যা বুঝলাম, নানা বৈচিত্রের শহর রাজকোট। এর বড় কারণটা মনে হয় এটি বাপুর শহর।
-বাপুকে চিনলেন তো? মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধী। মানে মহাত্মা গান্ধী, ভারতের জাতির জনক! আজি ও নয়ারি নদীর তীরে গড়ে উঠা জনগোষ্ঠী একটা ব্যাপার নিয়ে গর্ব করতেই পারে! ভারতের পরিষ্কার শহরের মধ্যে নবম এটি।
এমন কী ঐতিহ্যটাকেও লালন করার চর্চারও দেখা মিলল শহরের এ মাথা থেকে ও মাথায়। রাতে ঘুরতে ঘুরতে চোখে পড়ল একটা ডাকবাক্স। গোটা বিশ্ব যখন ইমেইল আর সোশ্যাল মিডিয়াকেই যোগাযোগের বড় মাধ্যম বানিয়ে ফেলেছে সেখানে তারা পড়ে আছে সেই চিঠি চালাচালির যুগে! ব্যাপারটায় অবশ্য নস্টালজিক হয়ে উঠতে পারেন যে কেউ!
তাই বলে আধুনিকতায় যে পিছিয়ে তা বলারও উপায় নেই। যেখানে উঠেছি সেই নতুন প্রেস রোডের আশপাশে দেখা মিলল নারী দোকানির আধিক্য। মেয়েরা স্কুটি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন পুরো শহর। আবার পরিচিত কারও সঙ্গে দেখা হলে দাঁড়িয়ে জুড়ে দিচ্ছেন আড্ডা। ছোট শহরের অন্তরঙ্গতা বলে কথা! রাস্তার পাশের ছোট্ট দোকান ঘিরে নির্মল কথোপথন এখন তো আর দেখাই যায় না!
এতো ভালো লাগার মাঝে মন কিছুটা বিষাদ হয়েই আছে। এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট থেকে নেমে লাগেজ নিতে এসে যখন শুনতে হলো দুঃসংবাদটা! এয়ারপোর্টের বেল্টে নিজের লাগেজটা দেখতে পেলাম না! যেখানে ঢাকা থেকে নিয়ে আসা আমার সব জামা-কাপড়! ভারতের সরকারি উড়ানের এক নারী কর্মী অবশ্য অভিযোগ লিখে আশ্বাস দিলেন, হারানো লাগেজটা ফিরেও পেতে পারি।
কিন্তু, সেটা কবে কে জানে? আদৌ মিলবে কীনা তারও গ্যারান্টি কোথায়? মাহমুদউল্লাহদের ভারত সফর কাভার করতে এসেছি। আমাকে তো ছুটতে হবে সৌরাষ্ট্র স্টেডিয়ামে। তাই অনেক ঘুরেও শহর জুড়ে তেমন কোন দোকানের দেখাই পেলাম না। একজন জানিয়ে দিলেন ৯টার পর এখানে সবাই ঘুমিয়ে পড়ার প্রস্ততি নেয়, এমন সময় কিছুই পাবেন না!
আশ্চর্য হতেই হলো, তাই বলে রাত নয়টাতেই ঘুম!
স্বাস্থ্য সচেতনরা 'আর্লি টু বেড আর্লি টু রাইজ' সূত্রটা মেনে চলেন, রাজকোট তাহলে সুখী নগরী! যান্ত্রিকতায় সব হারানো আমাদের জন্য এই শহর শুধু দেখার নয় শেখারও আছে অনেক কিছু !