মার্টিন বিক্রেমাসিংহের বাড়িতে নিমন্ত্রণ
লা ভেরান্দা ডি সেরেনা!
কটেজের নাম শুনেই প্রেমে পড়ে গেলাম। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠার সময় হঠাৎ কোত্থকে আসা পানির ছিটে এসে শরীরে লাগল। চমকে উঠে পেছন ফিরতেই দেখি-ওমা, নিচেই সমুদ্র, এ যে তারই জলছাপ!
-ওয়েল কাম ড্রিঙ্ক, নাকি?
কটেজের মালিক চান্দানা আমার কথায় হো হো হাসিতে ফেটে পড়লেন! গলের লা ভেরান্দা ডি সেরেনা কটেজ এভাবেই স্বাগত জানাল।
হোটেলের দেয়ালে আছড়ে পড়ছে সমুদ্রের পানি। জলের হালকা বিন্দু বিন্দু ছোঁয়া দিয়ে যাচ্ছে দোতলার বারান্দায়! কটেজের গা ঘেঁষে কয়েক সারিতে দাঁড়ানো নারিকেল গাছ। হেলে পড়া সেই গাছের শাখার একাংশ বাতাসে দোল খেয়ে দোতলার কার্নিশের সঙ্গে যেন লুকোচুরি খেলছে। গাছের ডালের গর্ত থেকে কাঠবেড়ালী একবার মাথা বের করছে, সামনে কাউকে দেখতে পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে আবার ভেতরে মুখ লুকিয়ে ঢুকে যাচ্ছে। কাঠবেড়ালীর এই লুকোছাপা দেখে ছোটবেলার টিলো এক্সপ্রেস খেলা মনে পড়ে গেল!
আপনি হোটেলের বারান্দায় আধশোয়া হয়ে আছেন ইজি চেয়ারে। সামনে চোখ যতদূর যায় ফেনিল সমুদ্র। জেলেদের মাছধরার ইঞ্জিনচালিত বড় নৌকা ভাসছে। বাতাস একটু বেশি হতেই সমুদ্রে ঢেউ এর তোড় বাড়ছে। দক্ষ সাঁতারু হয়ে সেই তরঙ্গমালা ফিনিসিং লাইন স্পর্শ করছে কটেজের নিচের শক্তপোক্ত দেয়ালে, শেষ ধাক্কায় আছড়ে পড়ছে লাগোয়া নারিকেল গাছের গোড়ালির অংশে। আর সেই শক্তিতে তৈরি জলকণা সমর্পিত হওয়ার ভঙ্গিতে গায়ে-গালে আদরের ছাঁচ বুলিয়ে দিচ্ছে!
এমন সমুদ্র সুখ নিতে চাইলে গলে আপনার জন্য পারফেক্ট ঠিকানা লা ভেরান্দা ডি সেরেনা। হোটেল বললেও এটি এক অর্থে কটেজ।
কটেজ মালিক চান্দানা নিজেই বোর্ডারদের সবার দেখাশোনা করেন। বয়সে তরুণ। প্রতিদিন খোঁজ নেন। কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা- দেখা হওয়া মাত্রই প্রতিদিন তার প্রথম প্রশ্ন এটাই।
সকালে নাস্তার টেবিল আর রাতে ফেরার সময় কাউন্টার থেকে চাবি নেওয়া- এই দুই সময় ছাড়া চান্দানার সঙ্গে আমার আর দেখা হয় না।
-তুমি কি সারাদিন ক্রিকেট মাঠেই কাটাও। গলের আর কোথায়ও যাও না?’
স্টেডিয়াম থেকে রাতে কটেজে ফেরার পর রুমের চাবি চাইতে চান্দানার প্রশ্ন। প্রতিদিন সকালে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে যাই। দিনের খেলা শেষে ফিরতে ফিরতে রাত। সকাল থেকে রাত অব্দি আমার কাজটা ঠিক কি তা জানার কৌতূহল থেকেই চান্দানার এই প্রশ্ন।
-যাব, কিভাবে বল? সকাল ১০টায় খেলা শুরু। শেষ হয় সন্ধ্যায়। তিন-চারটা রিপোর্ট লিখে কটেজে ফিরতে ফিরতে সেই রাত ১০টা। একে তো টানা পরিশ্রম। রাতের খাওয়ার পর আর পা চলে না। আলো আতশবাজি ও উদ্দাম মিউজিকের উনাবাটুনা বিচের নাইট আউট হাতছানি দিলেও পরদিন সকালে আবার ঘুম থেকে উঠতে হবে এই চিন্তার কাছে সেই স্বপ্নের আত্মসমর্পণ!
আমার সূচি দেখে চান্দানা সহানুভূতি জানাল। সেই সঙ্গে পরামর্শও দিলো।
-তুমি তো সকালটা কাজে লাগাতে পার। কোগ্গালা লেক ঘুরে আসতে পার। স্পিডবোটিংও করা যায়। আর হ্যাঁ, ওখানে গেলে অবশ্যই মার্টিন বিক্রেমাসিংহের বাড়ি ঘুরে এসো। একটা ফোক জাদুঘরও আছে। শ্রীলঙ্কার লোক ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত হতে চাইলে ওটা তোমার অনেক কাজে লাগবে।’
শ্রীলঙ্কায় এর আগে দুবারের সফরে লেখক, ইতিহাসবিদ, ঔপন্যাসিক, চিন্তাবিদ মার্টিন বিক্রেমাসিংহের নাম জেনেছিলাম। কিন্তু এর আগে কোনোবারই গলে আসা হয়নি। এবার শ্রীলঙ্কা সফরই শুরু করেছি গল থেকে। তাই আর আফসোস নিয়ে ফিরতে চাইলাম না।
ম্যাচের তৃতীয় দিনের সকালে মাঠে যাবার আগে সকাল ৮টায় উঠে কোগ্গালা রওয়ানা হলাম। গুগল ম্যাপ নির্দেশনা দিচ্ছে- আমার কটেজ থেকে কোগ্গালা লেকের দূরত্ব এগার কিলোমিটার। তবে কোগ্গালা লেকে গিয়ে স্পিডবোটে করে পুরো লেক ঘুরে দেখতে গেলে খেলা শুরুর আগে মাঠে ফেরা যাবে না। তাই স্পিডবোটে লেক ঘোরার পরিকল্পনা বাদ। শুধু মার্টিন বিক্রেমাসিংহের আদি নিবাস ও লোকজ জাদুঘর দেখে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম।
কিন্তু এখানে টুকটুক থেকে নেমে পড়লাম নতুন সমস্যায়। ঘড়িতে তখনো সকাল ৯টা বাজেনি। গার্ড জানাল- জাদুঘরের দরজা ৯টার আগে খুলে না। ২০০ রুপি দিয়ে টিকিট কেটে ৯টার অপেক্ষায় থাকলাম। ৯টা বাজার মিনিট পাঁচেক আগে গাড়ি থেকে এক ভদ্রলোক এসে জাদুঘরের সামনে নামলেন।
আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিজেই এগিয়ে এসে পরিচয় দিলেন জাদুঘরের প্রশাসক জে. জয়ানেত্তি। বাংলাদেশি মিডিয়া শুনে ভীষণভাবে আপ্যায়নে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন জয়ানেত্তি। টেলিফোনে অন্যপ্রান্তে গুরুত্বপূর্ণ কারো সঙ্গে কথা বলার পর আমার হাতে থাকা টিকিট চেয়ে নিলেন। জানালেন- ‘প্লিজ, বাংলাদেশি সাংবাদিক, এতদূর থেকে এসেছেন- আপনি আমাদের মেহমান। টিকিট লাগবে না। আজ আপনি মার্টিন বিক্রেমাসিংহের বাড়িতে অতিথি।’
ভদ্রলোকের সঙ্গে জোরাজুরি করা গেল না। ২০০ রুপি ফেরত নিতেই হলো।
লোকজ জাদুঘরের বড় ঘরে যাবার আগে পাশের দেয়াল জুড়ে মার্টিন বিক্রেমাসিংহের লেখা এবং বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত বইয়ের মলাট শোভা পাচ্ছে। শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা তার জনপ্রিয় উপন্যাস মাদল ডুভা (ম্যানগ্রোভ আইল্যান্ড) ইংরেজি, বুলগেরিয়ান, রুমানিয়ান, ডাচ, ফ্রেঞ্চ ও জাপানি-এই ছয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে। পাশের ছোট কাউন্টারে সুলভ মূল্যে বিক্রমাসিংহের বই বিক্রিও হচ্ছে। অনেক বইয়ের তালিকা থেকে ইংরেজিতে অনূদিত ‘সর্ট স্টোরিস অব বিক্রেমাসিংহে’ বইটি সংগ্রহে রাখলাম।
লোকজ জাদুঘরে পুরোটা সময় জয়ানেত্তি সঙ্গে রইলেন। প্রতিটি সেলফের পাশে গিয়ে শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন লোকজ শিল্প, বাদ্য-বাজনা, কৃষিকাজের জন্য প্রায় শতাব্দি পুরনো লাঙ্গল, জোয়াল, মাছ ধরার জাল, ঝুড়ি, কামারের হাপর- ঐতিবাহী সবকিছুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। কবে কোথা থেকে প্রাচীন এসব দ্রব্যাদি এই জাদুঘরে এসেছে- তার সংক্ষিপ্ত একটা বর্ণনা দিয়ে গেলেন একেবারে মুখস্থ কায়দায়।
জাদুঘরের এক কোনায় অনেক মুখোশ দেখে এগিয়ে গেলাম। শ্রীলঙ্কায় যাচ্ছি শুনে সতীর্থ সাংবাদিক মাসুদ পারভেজ মুখোশ নিয়ে আসার অনুরোধ করেছিলেন।
তোমার এখানে রাবণের মুখোশ নেই?
সায় দেওয়ার ভঙ্গিতে মাথা দুলিয়ে জয়ানেত্তি জানালেন- আসলে এখানে সুপারন্যাচারাল এবং ন্যাচারাল উভয় ধরনের মুখোশই রয়েছে। এসব সুপারন্যাচারাল মুখোশ পরে নাটকের বিভিন্ন দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হতো। কিন্তু ওগুলো এখনো শুধু প্রদর্শনীর জন্য রাখা। বিক্রির জন্য নয়।
যাক ঢাকায় ফিরে মাসুদকে এই যুক্তি দেখানো যাবে!
বাংলাদেশের গ্রাম বাংলার মতো পুতুল নাচ শ্রীলঙ্কার সংস্কৃতিরও অংশ। লোকজ জাদুঘরের একটা বড় অংশ জুড়ে পুতুল নাচের বিভিন্ন কলাকৌশলের একটা কর্নারও দেখা গেল। ক্যান্ডিয়ান সময়ের (প্রায় দুশো বছর আগের) বিভিন্ন ধরনের হাত পাখা, বৌদ্ধমূর্তি, সন্ন্যাসীদের পানির পাত্র, তাদের ব্যবহৃত বিভিন্ন দ্রব্যাদি, হস্তলিপি, তৈলচিত্র, সিংহলি ভাষার উৎপত্তি-ক্রমবিকাশ-আধুনিকরূপের ক্রমবর্ণনাও মিলল এখানে। ওপন্যাসিক মার্টিন বিক্রেমাসিংহের ব্যক্তিগত ইচ্ছে এই লোকজ জাদুঘর তৈরি হয়েছিল। শ্রীলঙ্কার সরকার পরে তার বাড়ির সামনের কয়েক একর জায়গা অধিগ্রহণ করে জাদুঘরটা আরও বিস্তৃতি ঘটায়।
লোকজ জাদুঘর পরিদর্শন শেষ করে আরও একটু সামনে বাড়তেই মার্টিন বিক্রেমাসিংহের পূর্বপুরুষের নিবাসের প্রবেশদ্বার মিলল। বাড়ির বিভিন্ন কক্ষে মার্টিন বিক্রেমাসিংহের ব্যবহৃত দ্রব্যাদি পরম যত্নের সঙ্গে পরিপাটি করে রাখা। চশমা, কলম, আতস কাঁচ, টোব্যাকো পাইপ, লুঙ্গি, কোট-প্যান্ট, জুতো, তার লেখার টেবিল-চেয়ার, ফুলদানি- এমনকি পায়ের চটি পর্যন্ত প্রদর্শনীর জন্য গুছিয়ে রাখা হয়েছে।
বাড়ির দ্বিতীয় কক্ষের ওপরে ইংরেজিতে লেখা- এই কক্ষে মার্টিন বিক্রেমাসিংহে জন্মেছিলেন। জন্মসাল: ২৯ মে, ১৮৯০। সেই ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে নজর পড়তেই দেখি সবুজ ঘাসে মোড়া একটা চারকোনা জায়গা একটু উঁচু করে পাথরে বাঁধানো। সবুজের সেই গালিচার এক কোনে একটা বড় কালো পাথর। পাশেই সাইনবোর্ডে ছোট্ট করে লেখা- বিক্রেমাসিংহের সমাধি! ১৯৭৬, ২৩ জুলাই।
জন্মস্থান থেকে হাত বাড়ানো দূরত্বেই চিরনিদ্রায় শ্রীলঙ্কার ইতিহাসের সেরা ওপন্যাসিক।
জীবন শুরু ও শেষের কি অদ্ভুত সমীকরণ!
পরের গল্প : হাতিদের এতিমখানা!