হাতিদের এতিমখানায়!

  • এম. এম. কায়সার, স্পোর্টস এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

এলিফ্যান্ট পার্ককে ঘিরে পর্যটন বানিজ্য জমজমাট

এলিফ্যান্ট পার্ককে ঘিরে পর্যটন বানিজ্য জমজমাট

-কি হাতিদের এতিমখানা?

এতদিন তো জানি হাতি থাকে বনে বা চিড়িয়াখানায়। ঢাকায় আবার রাজপথেও মাঝে সাজে হাতি দেখা যায়, চাঁদা তোলার কাজে! কিন্তু অসহায় হাতিদের জন্য এতিমখানাও আছে শ্রীলঙ্কায় এটা জানার পর ক্যান্ডি থেকে কলম্বো ফেরার পথে আমাদের সবার দারুণ কৌতুহল।

বিজ্ঞাপন

সফরের পরিকল্পনায় যোগ হলো ‘হাতির এতিমখানা’ দেখে যাওয়ার। আর যেহেতু কলম্বো ফেরার পথেই পড়বে এটি, তাই সময় খরচের বাড়তি চিন্তাও নেই। 

ক্যান্ডিতে কুইন্স হোটেলের জেনারেল ম্যানেজার ভীষণ ভদ্রলোক। আমাদের পরিকল্পনা তাকে জানাতেই সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে মাইক্রোবাস ঠিক করেও দিলেন। সেই সঙ্গে তাড়াও দিলেন।

বিজ্ঞাপন
হাতির এতিমখানায় নিয়ে গেলেন এবার এম. এম. কায়সার

 

-সকাল সকাল আপনারা বেরিয়ে পড়বেন। তাহলে পিন্নাওয়ালায় এলিফ্যান্ট অরফানেজে দুপুরের মধ্যেই পৌছাতে পারবেন। দুপরের আগে হাতির দলকে নেয়া হয় হ্রদে গোসল করাতে।

সকালেই বেরিয়ে পড়তে হবে, তাই আগের রাতেই হোটেলের বিল সব মিটিয়ে দিয়ে কাজ এগিয়ে রেখেছিলাম আমরা। তারপরও ক্রিকেটহীন সকাল, তাই ঘুমের আনন্দে একটু দেরি হয়েই গেল!

তৈরি হয়ে সবাই নিচে নামতেই হোটেল ম্যানেজার জানালেন-গাড়ী পোর্চে। আপনারা বেরিয়ে পড়েন। পেছনে ব্যাগ রেখে গাড়ীতে উঠতে গিয়ে হঠাৎ দেখা গেল আমাদের একজন কম!

-কে নাই?

এহসান ভাই তখনো নিচে নামেননি! সেই ট্যুরে এহসান ভাই চ্যানেল আই’য়ের স্পোর্টস রিপোর্টারের দায়িত্বে (এখন একাত্তর টিভির স্পোর্টস এডিটর)। 

এলিফ্যান্ট অরফানেজে পা রাখতেই মুগ্ধতা ছড়িয়ে যাচ্ছিল

 

-কাম অন গাইস্, ইউ আর গোয়িং টু লেট-’ হোটেল ম্যানেজার আবার তাড়া দিলেন। আমাদের দেরি দেখে মোটাসোটা ভদ্রলোক টেনশনে ঘেমে উঠছেন ক্যান্ডির সকালের ঝলমলে রোদে।

-তোমরা কিন্তু সত্যিই দেরি করে ফেলছো। হাতির গোসল করার দৃশ্য মিস করবে কিন্তু। সকাল ১০টায় হাতির পাল একসঙ্গে বের হয়।

ক্যান্ডির হোটেল থেকে রওয়ানা হওয়ার ঘন্টা খানেক পরে যখন আমাদের মাইক্রোবাস পিনাওয়ালায় ‘এলিফ্যান্ট অরফানেজের’ এসে থামলো তখনই মনে হলো হোটেল ম্যানেজার কেন তাড়া দিচ্ছিলেন। আস্তানা থেকে বের হয়ে হাতির পাল রাস্তা পার হচ্ছে। একটা দুটো নয় পুরো একপাল হাতি! বিশালদেহী হাতির ভিড়ে বাচ্চা হাতিও আছে। এক দেখায় জীবনে এই প্রথম একসঙ্গে এত হাতি দেখা! এক দুই তিন করে ত্রিশ’টার মতো গোনার পর সিরিয়াল ঠিক রাখা গেল না আর। এসব ক্ষেত্রে পর্যটক দেখলে যা হয়, সুভেনির বিক্রেতা আমাদের গাইড বনে গেলেন। পুরোটা সময় জুড়ে গাইড সুরঙ্গা আমাদের সঙ্গে থাকলেন। ছবি তুললেন। এলিফ্যান্ট অরফানেজের সবকিছুই তার মুখস্থ।

কারো হয়তো এটা পা উড়ে গেছে মাইনের আঘাতে। কেউ বা অন্ধ হয়ে গেছে বোমার স্প্রিন্টারে!

 

-এখানে এই এলিফ্যান্ট অরফানাজে এখন সবমিলিয়ে ৮৪টি হাতি আছে। আগে আরও বেশি ছিল।

কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম-তোমরা এই হাতির চিড়িয়াখানাকে এতিমখানা কেন বলছো?

গাইড সুরাঙ্গা হাত পা নেড়ে যা বলল তাতে আরেকবার বুঝলাম মানুষই নিষ্ঠুর, মানুষই আবার সহায়!

-এখানকার যে হাতিগুলো তোমরা দেখছো তাদের অনেকেই আহত। কারো হয়তো এটা পা উড়ে গেছে মাইনের আঘাতে।  কেউ বা অন্ধ হয়ে গেছে বোমার স্প্রিন্টারে!

-বনের হাতিদের আবার বোমা আর মাইন দিয়ে কে মারে?

-পাহাড়ে এবং জঙ্গলে এলটিটিইরা যে মাইন ও বোমা পুঁতে রেখেছিল তাতেই এই হাতিদের এই অবস্থা। নিরীহ প্রানীগুলোতো আর কোনটা বোমা আর কোনটা মাইন-বুঝতে তো পারে না। সেই বিস্ফোরণে আহত হাতিদের এখানে রাখা হয়। তাদের যত্মআত্তি নেয়া হয়। জীবনের বাকি সময়টা তাদের এখানেই কাটে।

পর্যটকরা খাবার দিচ্ছেন হাতিকে

 

সুরঙ্গা আরেকটা ব্যাখা দিল-অনেক সময় হাতির পালের ভিড় থেকে বাচ্চা হাতি বিছিন্ন হয়ে পড়ে। লোকালয়ে চলে আসা বড় হাতির পাল আবার ফসলের ক্ষেত মাড়িয়ে দেয়। কৃষকদের তাড়ায় অনেক হাতি মারাও যায়। মা হারা বাচ্চা হাতি তখন অসহায় হয়ে পড়ে। দুধের শিশু সেই দল বিচ্ছিন্ন বাচ্চা হাতিদের খুঁজে এনে ভরণপোষন ও আশ্রয় দেয়া হয় এতিমখানায়। 

কোন সন্দেহ নেই পিন্নাওয়ালায় হাতিদের এই এতিমখানা শ্রীলঙ্কা সরকারের মানবিক উদ্যোগ। এই মহতী কার্যক্রমের শুরুটা হয়েছিল ১৯৭২ সালে। শুরুতে শ্রীলঙ্কার উইলপাত্তুর ন্যাশনাল পার্কে ছিল এই এতিমখানা। তিন বছর পর বন্যপ্রাণী বিভাগ পিন্নাওয়ালায় স্থায়ীভাবে এটি সরিয়ে আনে। মাত্র ৪টি হাতি নিয়ে শুরু হওয়া এই এতিমখানা একসময় শতাধিক হাতির আশ্রয়স্থল হয়। 

রাস্তার উল্টোধারের কাউন্টার থেকে আড়াইশ রূপির টিকিট কেটে এলিফ্যান্ট পার্কে ঢুকতে হলো। পার্কের গা ঘেঁষে থাকা পাশের পাহাড়ের ঝরনার পানিতে গোসল করছে একপাল হাতি। দক্ষ মাহুতের দল হাতিদের সামাল দিতে ব্যস্ত।

এক ফ্রেমে হাতির এতিমখানায় যাওয়া ঢাকার সাংবাদিকরা

 

এলিফ্যান্ট পার্ককে ঘিরে পুরো এলাকার পর্যটন বানিজ্যে জমজমাট। হাতিদের গোসল ও  বোতলে দুধ খাওয়ানোর এই দৃশ্য দেখতে প্রতিদিন এখানে শতশত পর্যটক আসেন। হাতির শুড় জড়িয়ে ধরে ছবি তোলা নিয়ে চারধারে দারুন উৎসাহ। গলায় জ্যান্ত সাপ জড়িয়েও ছবি তুলছেন অনেকে! আশপাশে রেস্টুরেন্টেও বেশ ভিড়। চামড়ার বাহারি পানামা হ্যাট, বেল্ট, মানিব্যাগ, পাথুরে হাতির সুভেনির কেনার দরদামের হল্লা হচ্ছে।

হ্রদের ছোট টিলায় দাড়িয়ে ব্যাকগ্রাউন্ডে হাতিকে রেখে ছবি তুলছেন পর্যটকরা। আমরাও ছবি তোলার সুযোগটা নিলাম।

 

পরের গল্প: শচীন’স সসেজ, গাঙ্গুলি’স গ্রিল, মিয়াঁদাদ ম্যাঙ্গো জুস...