‘সিরাজগঞ্জ শপ.কম’র বিরুদ্ধে ৪৭ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ
সিরাজগঞ্জে আলাদিনের প্রদীপ নামে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান খুলেই, রাতারাতি আলাদিনের চেরাগ হাতে পেয়ে গেছেন কয়েক যুবক। একই অভিযোগ উঠেছে সিরাজগঞ্জ শপ.কম এর মালিক জুয়েল রানার বিরুদ্ধে প্রতারণামূলকভাবে প্রায় ৪৭ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। এই ঘটনায় মোবাইল ব্যাংকিং সেবা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে বনানী থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়।
ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জের মত চটকদার বিজ্ঞাপন ও বিশাল ছাড়ের ফাঁদে ফেলে, লুটে নিয়েছেন গ্রাহকদের কোটি কোটি টাকা। অফিসে তালা দিয়ে টাকা নিয়ে লাপাত্তা প্রতিষ্ঠান দুটির মালিক।
জানা যায়, শহরের এম এ মতিন সড়ক ও কাঠেরপুল এলাকায় দুটি অফিস নিয়ে চটকদার বিজ্ঞাপন ও বিশাল ছাড়ের লোভ দেখিয়ে, অর্ডারের বিপরীতে শুরু করেন অগ্রিম অর্থ আদায়। দুটি প্রতিষ্ঠান প্রায় সোয়া চার লাখ অর্ডারের বিপরীতে সংগ্রহ করে অগ্রিম ২০৫ কোটি টাকা। অল্প সময়ে কোটিপতি বনে বিলাসী জীবনযাপন শুরু করেন প্রতারকরা।
সোমবার (২০ সেপ্টেম্বর) সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, সিরাজগঞ্জ ডটকমের মালিক জুয়েল রানা এরই মধ্যে ৪৭ কোটি ৪৩ লাখ ১৮ হাজার ৯৬৩ টাকা প্রতারণা করে হাতিয়ে নিয়েছেন।
এই মামলায় উল্লেখ আছে, সম্প্রতি সিরাজগঞ্জ ডটকমের রিফান্ড রিকোয়েস্ট অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি নগদ এর নিকট ধরা পড়ে। এ ছাড়া একই পরিমাণ টাকা একই হিসাব নম্বরে বারবার দেওয়ার জন্য রিকোয়েস্ট (অনুরোধ) করা হচ্ছিল। অদ্ভুত বিষয় হলো, সফলভাবে পণ্য ডেলিভারি হয়ে গেছে-এমন অর্ডারের বিপরীতেও রিফান্ড রিকোয়েস্ট আসছিল।
এ ছাড়া অর্ডার অ্যামাউন্টের সঙ্গে রিফান্ড অ্যামাউন্টের গরমিল। গভীর রাতে রিফান্ড রিকোয়েস্ট আসতে থাকে প্রচুর। এ বিষয়টি ধরা পড়ার পর 'নগদ' সিরাজগঞ্জ ডটকমের সঙ্গে তাদের সব লেনদেন স্থগিত করে। তবে অল্প সময়ের মধ্যে ই-মানি আকারের ৪৭ কোটি ৪৩ লাখ ১৮ হাজার ৯৬৩ টাকা প্রতারণামূলকভাবে নিয়ে যায়। এরপর নগদের পক্ষ থেকে সিরাজগঞ্জ ডটকমকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। গত ২ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে নগদকে একটি চিঠি দেওয়া হয়। এরপর থেকে সিরাজগঞ্জ ডটকমের মালিক জুয়েল রানার ফোন বন্ধ। এমনকি তাদের পক্ষ থেকে নগদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করা হচ্ছে না।
এই ঘটনায় পর থেকে সিরাজগঞ্জ শহরের বাহিরগোলা ও এমএ মতিন সড়কে সিরাজগঞ্জশপ ডটকমের প্রধান ও আঞ্চলিক অফিস দুটি দুই সপ্তাহ ধরে তালাবদ্ধ। প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টসহ আসবাব সরানো হয়েছে। কোম্পানির ডেলিভারি গাড়িগুলোও রহস্যজনকভাবে লাপাত্তা।
সিরাজগঞ্জ শপের মালিক ও প্রধান নির্বাহী জুয়েল রানা এবং আলাদিনের প্রদীপ এসপিসি ওয়ার্ল্ডের মো. আলামিনকে আইনের আওতায় আনতে তৎপর রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এদের মধ্যে চিশতি যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে গেছেন বলে একটি সূত্র জানায়। আর জুয়েল ও আলামিন দেশেই পলাতক রয়েছে আছে।
সিরাজগঞ্জ এগ্রো লি: ও সিরাজগঞ্জ ফিস এন্ড হ্যাচারির একটি ইউনিট ঘুরে দেখা যায়, স্বল্পশিক্ষিত এই তরুণ ২০১৭ সালে এটুআই প্রজেক্টের আওতায় সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসন আয়োজিত লার্নিং এন্ড আনিং প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেন সদর উপজেলার বহুলী ইউনিয়নের বেড়াবাড়ি গ্রামের ইসমাইল হোসেনের ছেলে জুয়েল রানা।
ট্রেনিং শেষে গড়ে তোলেন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান সিরাজগঞ্জ শপ.কম। এই প্রতিষ্ঠানটির পাশাপাশি ইসেলার বাজার লি: নামে আরও একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার। মূলত অনলাইন ভিত্তিক এই দুটি প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী কাঙ্খিত মানের পণ্য সরবরাহের চিন্তা থেকে গরু ও মাছের খামার তৈরি করে।
সিরাজগঞ্জ এগ্রো লিঃ ও সিরাজগঞ্জ ফিস এন্ড হ্যাচারি নামে গড়ে তোলা ৩টি খামারে মোটাতাজা করা হচ্ছে ছোট-বড় প্রায় ৩শ ষাঁড়, খামারের বায়োফ্লক ট্যাংকে প্রতি ৬ মাসে উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ১২৫ টন শিং ও কই মাছ। অনলাইনে বিক্রির পাশাপাশি অফলাইনে বিক্রির ব্যবস্থাও রয়েছে খামারগুলোতে। এবং তাড়াশে ২টি খামারের বর্তমানে একই মাপের ষাঁড় মোটাতাজাকরণ ও মাছ উৎপাদন করছে। এছাড়াও সিরাজগঞ্জ শহরের জায়গাসহ ৩টি বাড়ী নিজের নামে ক্রয় করছে।
সম্প্রতি, সিরাজগঞ্জ শপ.কম এর গ্রাহক সরকার বাপ্পা, সাদ্দাম হোসেন, আরিফুল ইসলাম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেসবুক আইডি থেকে পোস্ট দিয়েছে সিরাজগঞ্জ শপ আমাদের শেষ করে দিয়েছে। রাকিব হাসান নামের এক আইডি থেকে পোষ্টে লেখা হয়েছে ভাউতাবাজি করার জায়গা পাস না। বালের ব্যাবসা করোশ। ৬ মাস ধরে টাকা আটকিয়ে রেখে এখন রিফান্ড মারাও। তাও আবার যে টাকা দিয়েছি সেই টাকা রিফান্ড মারাবা। সাইমুন ইসলাম নিরব তার ফেসবুকে লিখেছে আমার টাকা ফিরিয়ে দেন। কাবিল হোসেন লিখেছে আমাদের কত কষ্ট হচ্ছে জুয়েল রানা কি খবর রাখে। সে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে।
ফেসবুকের মাধ্যমে জানা যায়, নানা সময়ে বিভিন্ন ধরণের পণ্য কেনার জন্য টাকা জমা দেয় গ্রাহকরা। যা একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের পর সরবরাহ করার কথা ছিল। কিন্তু সিরাজগঞ্জ শপ.কম প্রায় ১ হাজার ভুক্তভোগীর সঙ্গে প্রতারণা করে যাচ্ছে। ভুক্তভোগীরা সিরাজগঞ্জ শপ.কম অফিসে গিয়ে পণ্য সরবরাহ চাইলে জানানো হয়, কিছুদিনের মধ্যে পাবেন। কিন্তু গত (৬ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত কোনো পণ্য সরবরাহ করা হয়নি।
বাইক বিক্রেতাদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল হওয়ায় এগুলো সরবরাহ করতে সময় লাগবে ৪৫ থেকে ৬০ কর্মদিবস। অপেক্ষা না করলে টাকা ফেরত দেওয়া হবে, সে ক্ষেত্রে সময় লাগবে ২১ কর্মদিবস। করোনাকালে ভুক্তভোগীদের কষ্টার্জিত অর্থের নিশ্চয়তা না দিয়ে তারা এখন মানবেতর জীবন যাপন করছে।
বিশ্লেষকরা জানান, ই-কমার্স সাইট ডাবল, ট্রিপল লাভে ভাউচার বিক্রি করছে। সেটি আইন অনুযায়ী অপরাধ। আইন অনুয়াযী এভাবে পণ্য বিক্রি করার সুযোগ নেই। ভাউচারে এভাবে ভর্তুুকি দিয়ে পণ্য বিক্রি করতে পারে না। দেশের মধ্যে বসে এভাবে পণ্য বিক্রি করা যায় না। এতে বাজারে অসম প্রতিযোগিতা তৈরি হবে।
জানা যায়, অস্বাভাবিক মূল্যছাড়ের ঘোষণা দিয়ে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার পণ্য অর্ডার নিয়ে থাকে। কিন্তু বাস্তবে অর্ডার করা পণ্য সরবরাহ খুবই কম। কেউ কেউ মাত্র ১০ শতাংশ গ্রাহকের, বাকি গ্রাহকের পণ্য সরবরাহে গড়িমসি করে টাকা আত্মসাৎ করে। ভুক্তভোগীরা সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসনের নিকট এর সুষ্ঠু তদন্ত করে গ্রাহকদের হয়রানী থেকে মুক্ত করার আকুল আবেদন জানান।
এ বিষয়ে সিরাজগঞ্জ শপ.কমের চিফ টেকনোলজি কর্মকর্তা আইদুল আব্দুল্লাহ জানান, আমাদের প্রায় ১ লাখ গ্রাহক রয়েছে। আমাদের ২টি অফিসে ১৪০ জন স্টাফ রয়েছে। যাদের প্রতিমাসে ২৫ লাখ টাকা বেতন দেওয়া হয়। তিনি আরো জানান, আমাদের গ্রাহকরা প্রায় ৩০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে।
এ ব্যাপারে সিরাজগঞ্জ শপের মালিক ও প্রধান নির্বাহী জুয়েল রানার পলাতক থাকায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।