নেটওয়ার্ক বিপর্যয়: গ্রামীণফোনের গোঁজামিল!
দেশের সবচেয়ে বড় মোবাইল অপারেটর গ্রামীণফোনের নেটওয়ার্ক বিপর্যয়ের কারণে দু’ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চরম ভোগান্তির শিকার হন গ্রাহকরা। বৃহস্পতিবার বেলা পৌনে ১২টা থেকে পৌনে ২টা পর্যন্ত দেশজুড়ে গ্রামীণফোনের নেটওয়ার্ক বিপর্যয় ঘটে। এই সময় গ্রাহকরা ভয়েস কল, এসএসএস ও ইন্টারনেট সেবা থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। ব্যাহত হয় অপারেটরটির নেটওয়ার্কের ওপর নির্ভরশীল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনলাইন সেবা। বিঘ্নিত হয় মোবাইল ব্যাংকিং, রাইড শেয়ার, অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোর কার্যক্রম। এতে সীমাহীন ভোগান্তির শিকার হন গ্রাহকরা।
তবে এত বড় নেটওয়ার্ক বিপর্যয়ের ঘটনার পরও গ্রামীণফোন কোন সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দিতে পারেনি গ্রাহকদের। প্রযুক্তিখাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, ফাইবার কাটা পড়ার ঘটনা বলে গ্রামীণফোন আসল কারণ ধামাচাপা দিচ্ছে।
নেটওয়ার্ক বিপর্যয়ের দিন তাৎক্ষণিক মন্তব্যে ও অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে গ্রামীণফোন দাবি করে, ঢাকা থেকে গাজীপুর সড়কে, অ্যালেঙ্গা থেকে জামালপুর সড়কের মধ্যে এবং টাঙ্গাইল থেকে সিরাজগঞ্জ রেলপথে কেবল তিনটি কাটা পড়ে, যেগুলোর তিনটিই ব্যাকবোন ফাইবার কেবল। ওই কেবলগুলো কাটা পড়ায় এই বিপর্যয় ঘটে। তবে সংশ্লিষ্ট সড়ক ও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ গ্রামীণফোনের এ অভিযোগ নাচক করে দিয়েছে।
অন্যদিকে একাধিক সূত্রের দাবি, গ্রামীণফোন শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করছে। নেটওয়ার্ক উন্নয়নের নামে হুয়াওয়ের ডাটা সেন্টারের সঙ্গে সংযোগ বসানোর সময় তাদের মূল কার্যালয়ে নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্নের ঘটনা ঘটে।
জানা গেছে, গ্রাহকদের উন্নতমানের টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক পরিষেবা দিতে গ্রামীণফোন ও হুয়াওয়ের মধ্যে একটি চুক্তি রয়েছে। সেই চুক্তির আওতায় গ্রামীণফোন তার নেটওয়ার্ক উন্নয়নের কাজ করছে। হুয়াওয়ের নেটওয়ার্ক ডাটা সার্ভারে সঙ্গে গ্রামীণফোনের নেটওয়ার্ক বসানোর কাজ হচ্ছে। হুয়াওয়ের সার্ভার ডাউন হওয়ায় গ্রামীণফোনের নেটওয়ার্ক বিভ্রাট শুরু হয়।
নেটওয়ার্ক বিপর্যয় নিয়ে প্রযুক্তিবিদদের মধ্যেও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তারা বলছেন, দেশের মাত্র ৩টা জায়গায় ফাইবার কাটা পড়ায় সারা দেশের নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঘটনা অস্বাভাবিক। তাদের আভ্যন্তরীণ জটিলতার কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। প্রতিষ্ঠানটি বিপর্যয়ের যে কারণ দেখিয়েছে তা গ্রহণযোগ্য মনে হয় না।
গ্রামীণফোনের সঙ্গে নেটওয়ার্ক উন্নয়নের কাজের কারণে নেটওয়ার্ক বিপর্যয়ের বিষয়টি অস্বীকার করেছে হুয়াওয়ে। তারা ‘বিষয়টিকে বিভ্রান্তিমূলক মিথ্যা তথ্য’ বলে দাবি করেছে।
এদিকে, বৃহস্পতিবার নেটওয়ার্ক সচল হওয়ার পর গ্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সিইও ইয়াসির আজমান স্যোশাল মিডিয়ায় অপারেটরটি হয়ে দুঃখ প্রকাশ করে ভিডিও বার্তা দেন।
আরও পড়ুন: নেটওয়ার্ক বিভ্রাট: গ্রামীণফোনের শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা!
ঘটনাটিকে তিনি ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ অ্যাখ্যা দিয়ে তিনটি ফাইবার কেটে যাওয়ার কথা জানান। তবে ইয়াসির আজমান নেটওয়ার্ক বিপর্যয়ের কারণ সুনির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করেননি। তিনি তার বক্তব্যে কেন ফাইবার কাটা পড়ল, কোন বিভাগের সংস্কার কাজের জন্য ফাইবার কাটা পড়ল, সংস্কার কাজ কারা পরিচালনা করছিল; এসব কোন কিছু-ই উল্লেখ করেননি। দায়সারা একটি বক্তব্য দিয়ে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন।
ইয়াসির আজমান তার বক্তব্যে বলেন, আমাদের টেলিযোগাযোগ খাতে একটা বড় ঘটনা ঘটে গেছে। অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে, আয়ত্ত্বে থাকে না। আমরা আমাদের গ্রাহকদের যে বিটিএস (সাধারণ অর্থে টাওয়ার) দিয়ে কানেক্টেড করে থাকি সেই বিটিএসগুলো যার সাথে কানেক্টেড থাকে সেটাকে আমরা ফাইবার দ্বারা কানেক্টেড রাখি। এই ফাইবারগুলো রাস্তা ও রেললাইন দিয়ে যায়। আমরা এগুলো ভাড়া নিয়ে থাকি। অনেক সময়ই বিভিন্ন কারণে এগুলো কাটা পড়ে থাকে। আমাদের যেই ডেটা সেন্টার আমরা কয়েকটা ফাইবার দিয়ে সংযুক্ত রাখি। যেন একটা কেটে গেলে আরেকটা দিয়ে আমাদের নেটওয়ার্ক আপ রাখা যায়। এ রকম ফাইবার কাট অহরহই হয়ে থাকে বাংলাদেশে, যখন বিভিন্ন রকমের নির্মাণ কাজ চলে। শুধু বাংলাদেশে নয় পৃথিবীর সব জায়গাতেই। কিন্তু আমি বলেছি দুর্ভাগ্য কারণ একই সাথে তিনটা ফাইবার কেটে গিয়েছে। এরকম হওয়াটা খুবই অস্বাভাবিক, কিন্তু সেটাই হয়েছে। যার জন্যে নেটওয়ার্ক কানেকশনের বাইরে ছিল।
নেটওয়ার্ক বিপর্যয়ের ঘটনায় গ্রামীণফোন সত্য গোপন করে ভিন্ন ব্যাখ্যা দিচ্ছে বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, নেটওয়ার্ক বিপর্যয়ে জিপি’র খোড়া যুক্তি মোটেও বাস্তবসম্মত নয়। যদি টাঙ্গাইল এবং সিরাজগঞ্জে ফাইবার ক্যাবল বিচ্ছিন্ন হয় তাহলে সারা দেশে নেটওয়ার্ক বিপর্যয় হলো কেন। ওই ফাইবার যদি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সামিট অথবা ফাইবার অ্যাট হোম হয়ে থাকে তাহলে অন্য অপারেটরদের একইভাবে নেটওয়ার্ক সমস্যায় পড়ার কথা কিন্তু তা হয়নি। জিপি ৩৫ ভাগ ফাইবার কানেকশনের মাধ্যমে গ্রাহকদের সার্ভিস দিয়ে থাকে। তারা মাইক্রোওয়েভ ব্যবহার করে মোবাইল নেটওয়ার্ক সক্রিয় করে রাখে। যদি ধরে নিই সাময়িক সময়ের জন্য ফাইবার কানেকশন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে তাহলেও তারা মাইক্রোওয়েভ দিয়ে সার্ভিস দিতে পারতো।
মহিউদ্দীন আহমেদ বলেন, আমাদের ধারণা গ্রামীণফোন সত্য গোপন করেছে। হতে পারে তাদের সুইচিং অপারেশনে বড় কোনো বিপর্যয় ঘটেছে। কমিশনের উচিত দ্রুত একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে প্রকৃত সত্য বের করা। সেইসঙ্গে গ্রাহকদের ক্ষতি পুষিয়ে দেয়া।