'ইনফোডেমিক’ বা ‘তথ্যের মহামারি'র কারণে আসন্ন বিপদ!

  • মায়াবতী মৃন্ময়ী, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ইনফোডেমিক’ বা ‘তথ্যের মহামারি'র কারণে আসন্ন বিপদ!

ইনফোডেমিক’ বা ‘তথ্যের মহামারি'র কারণে আসন্ন বিপদ!

একবিংশ শতকের বিশ্বায়ন প্লাবিত মানবজীবন অভিনব প্রযুক্তি ও মসৃণ যোগাযোগের কারণে বহুবিধ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করলেও যাপনের পরিসরে ভিড় করেছে একগাদা বিপন্নতা। বিপদ বাড়ছে বৈশ্বিক উষ্ণতা, জলবায়ুর পরিবর্তন এবং ক্রমবর্ধমান মহামারির হাতছানিতে। বিশেষত, চলমান কোভিডকে মোটামুটি সামলানো গেলেও ভবিষ্যতে নতুন ও ভয়ঙ্কর মহামারি ধেয়ে আসতে পারে পৃথিবীতে, এমনই সতর্কতা জারি করেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-র এক প্রাক্তন প্রধান বিজ্ঞানী।

বিশ্বব্যাপী কোভিড-মহসমারির প্রকোপ যে কমিয়ে আনা গিয়েছে তা নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু অন্য এক মহামারি এখনও আশঙ্কা ও আতঙ্কের কারণ বলে জানা গেছে, যা একবিংশের জীবনযাপনকে চরমভাবে বিপন্ন করবে।

বিজ্ঞাপন

আসন্ন বিপদের পূর্বাভাষ দিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-র প্রাক্তন প্রধান বিজ্ঞানী সৌম্যা স্বামীনাথন। তাঁর ভাষায়, অনাগত বিপদটি হলো
'ইনফোডেমিক’ বা ‘তথ্যের মহামারি’। প্রযুক্তি তথা আন্তর্জাল ও মূলত সমাজমাধ্যম বেয়ে বিপুল পরিমাণ তথ্যের বিশ্বময় বিস্তারের ফলেই ঘটবে এহেন বিপদ। বলা হচ্ছে, সেসব তথ্যের বহুলাংশই হবে অপতথ্য তথা মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর।

চলমান বৈশ্বিক মহামারি করোনাকালে সৌম্যা কাজ করেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডিরেক্টর জেনারেল টেড্রস গেব্রিয়াসেস-এর সহযোগী হিসেবে। কোভিড ছড়িয়ে পড়ার গোড়ার দিকে, ২০২০-এর ফেব্রুয়ারিতে, টেড্রস-ও বলেছিলেন এই ইনফোডেমিক-এর কথা: ভুয়ো তথ্য ও বিভ্রান্তিমূলক খবরের স্রোত কী ভাবে কোভিডের মতো জনস্বাস্থ্য বিপর্যয়কে করে তুলেছিল ‘গভীর অসুখ’, মানুষের মনে ঢুকে গিয়েছিল প্রবল ভয় ও সন্দেহ, সামাজিক আচরণে এসেছিল বিবিধ অসঙ্গতি।

বিজ্ঞাপন

দেশে দেশে সরকার, বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীরা যখন কোভিড রোগীদের ন্যূনতম পরিষেবাটুকু দিতে হিমশিম খাচ্ছেন, তখন এই ইনফোডেমিক তাঁদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল আরও বড় এক চ্যালেঞ্জের সামনে: প্রায় অজানা এক ভাইরাস এবং তখনও পর্যন্ত প্রতিষেধকহীন এক অসুখকে ঘিরে যে অপতথ্যের স্রোত বইছিল, তার মোকাবিলা করার বিষয়টিও আসলে কঠিন।

কোভিডকে সামলানো গিয়েছে, কিন্তু ভবিষ্যতেও যে নতুন অতিমারি-মহামারি আসতে পারে, তাকে মোকাবেলা দুষ্কর বলেও সতর্ক করেছেন সৌম্যা। একই সতর্কবার্তা প্রযোজ্য ইনফোডেমিক-এর ক্ষেত্রেও। সে জন্যই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইটে এখনও বিশদে লেখা রয়েছে তথ্যের মহামারি কী, কী ভাবে তা সামলাতে হবে, সংস্থাটি এর মোকাবিলায় কী কর্মসূচি নিয়েছে, ভবিষ্যতেও কোন পদক্ষেপ করবে ইত্যাদি নিয়ে।

তথ্যের মহামারি রুখতে দেশে দেশে সরকার ও প্রশাসনের দায়িত্ব অনেকখানি, কারণ ইনফোডেমিক আজ শুধু জনস্বাস্থ্য-সঙ্কটেই নয়, জনজীবনে তীব্র অভিঘাত বা প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে এমন যে কোনও ঘটনার ক্ষেত্রেও সমান প্রাসঙ্গিক।

রাজনীতি ও ধর্মের পরিসরে এই তথ্য-মহামারি ভয়ঙ্কর হয়ে দাঁড়াতে পারে। সাম্প্রতিক নানা ঘটনা-দুর্ঘটনাই সাক্ষ্য দেবে, রাজনীতিতে হিংস্র রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতে কিংবা দুই ভিন্ন জাতি, গোষ্ঠী বা ধর্মের মানুষের মধ্যে বিদ্বেষবিষ ছড়াতে প্রযুক্তি-বাহিত অপতথ্যের এক বিরাট কুপ্রভাব রয়েছে।

কারণ, আন্তর্জাল ও প্রযুক্তির সহজপ্রাপ্যতা সমাজের একটি বড় অংশের কাছে এক ধরনের নিষ্প্রশ্ন বিশ্বাসযোগ্যতার জন্ম দিয়েছে, তারই সুযোগ নিচ্ছে রাজনৈতিক, ধর্মীয়, গোষ্ঠীগত, বাণিজ্যিক বা অন্যান্য স্বার্থ হাসিল করতে চাওয়া দুর্বৃত্তের দল। ভয়ানক ভূমিকম্প, তুষারধস, বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের আবহে জনমানসে ছড়িয়ে পড়ছে নানা ভুল তথ্য, হিংসা, বিদ্বেষ, বিপর্যয় মোকাবিলার কাজকেই যা কঠিন করে তুলছে ও পারস্পরিক লড়াইকে উস্কে দিচ্ছে। স্রেফ আইন করে বা শাস্তির ভয় দেখিয়ে এই মহামারি রোধ করা যাচ্ছে না, হাঙ্গামা এড়াতে প্রশাসন অনেক সময় আন্তর্জাল সংযোগ বন্ধ করে দিচ্ছে, তাতে ব্যাহত হচ্ছে অন্য জরুরি পরিষেবা, লঙ্ঘিত হচ্ছে মানবাধিকারও।

যে তথ্য-প্রযুক্তি এক দিকে জীবনের সুরক্ষা দিচ্ছে, তারাই অন্য দিকে হয়ে উঠছে জনজীবনে শান্তি, সম্প্রীতি, স্থিতি ও স্বস্তির পরিপন্থী। তথ্যের মতো সদ্ব্যবহারে অতি কল্যাণকর একটি বস্তুকেও কী ভাবে ভয়ঙ্কর করা যায়, তা নিয়েও তৎপর নিকৃষ্ট ও ধ্বংসাত্মক মনোভাবাপন্ন কতিপয় মানুষই। আর মানুষকেই সচেতনতা ও শুভবোধের মাধ্যমে ঠেকাতে হবে 'ইনফোডেমিক’ বা ‘তথ্যের মহামারি'র মাধ্যমে সৃষ্ট মিথ্যা ও বিভ্রান্তির বিপদ।