তিন দিনের ডেটা প্যাক বন্ধে কার ক্ষতি, কার লাভ!
মোবাইল ফোন গ্রাহকদের কাছে জনপ্রিয় তিন দিনের ডেটা প্যাকেজ আগামী ১৫ অক্টোবর থেকে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা (বিটিআরসি) গেল মাসে নতুন এই নিদেশিকা জারি করেছে। এই নিদেশিকায় মোবাইল ফোন গ্রাহকদের জন্য প্যাকেজ সংখ্যা সবোচ্চ ৪০টি নিধারণ করা হয়েছে। এতে ডেটা প্যাকেজের মেয়াদ ৭ দিন, ৩০ দিন এবং অনলিমিটেড করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
গ্রাহকদের মধ্যে বহুল ব্যবহৃত এই প্যাকেজ বন্ধের পক্ষে-বিপক্ষে নানাবিধ যুক্তি-তর্ক চলছে। একদিকে রয়েছে বিটিআরসি অন্যদিকে মোবাইল ফোন অপারেটর।
বিটিআরসি বলছে, গ্রাহকদের স্বার্থ বিবেচনা করর তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এজন্য তারা একটি জরিপ করেছেন। ১৬৭৫ জন গ্রাহকের ওপর পরিচালিত সেই জরিপে ৬১.৪ শতাংশ গ্রাহক ৪০ থেকে ৫০টি প্যাকেজের পক্ষে মত দিয়েছেন। গত ২৫ মে থেকে ১২ জনু অনলাইনে পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী, মেয়াদ ৭ ও ৩০ তিন এবং আনলিমিটেড করার পক্ষে ছিলেন ৫৪.৬ শতাংশ গ্রাহক। আর ৩, ৭, ১৫, ৩০ ও আনলিমিটেড করার পক্ষে ছিলেন ৪১.৩ শতাংশ গ্রাহক।
এখন প্রশ্ন উঠছে, শুধুমাত্র এই জরিপের ওপর ভিত্তি করে গ্রাহকদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় ৩ দিনের এই ডেটা প্যাকেজটি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত কতটুকু যৌক্তিক। যখন সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ করার অঙ্গীকার করেছে তার সাথে এই ধরনের সিদ্ধান্ত সাংঘর্ষিক। কারণ দেশের অধিকাংশ ৭০ শতাংশ মানুষ এখনও ইন্টারনেটের আওতার বাইরে রয়েছে। সাধারণত স্বল্প আয়ের মানুষ কিংবা শিক্ষাথীরা এ ধরনের প্যাকেজ নিয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে কেউ কেউ সুনির্দিষ্ট একটি দিনে কোনো সিনেমা দেখার জন্য স্বল্প মেয়াদী এই প্যাকেজটি কিনে থাকেন। এই ডেটা প্যাকেজটি বন্ধ করে দিলে স্বল্প আয়ের মানুষেরা ইন্টারনেটের আওতায় আসতে নিরুৎসাহিত হবে। কারণ তিন দিনের প্যাকেজ বন্ধ হলে অনেকেই ৭ দিনের প্যাকেজে আসতে চাইবে না।
রবি আজিয়াটা লিমিটেডর চিফ কর্পোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম বলেন, বাংলাদেশে বর্তমানে অপারেটর ভেদে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ গ্রাহক ৩ দিন বা তারও কম মেয়াদের ইন্টারনেট প্যাকেজ ব্যবহার করেন। এ অবস্থায় প্যাকেজ সংখ্যা ৪০ এ বেধে দেওয়া হলে তা প্রায় ১২ কোটি গ্রাহকের পছন্দ অনুযায়ী প্যাকেজ বেছে নেওয়ার স্বাধীনতাকে ক্ষুন্ন করবে। আমরা মনে করি, গ্রাহকের নিজস্ব চাহিদা ও ব্যবহারের ওপর ভিত্তি করে প্যাকেজ সংখ্যা নির্ধারণে কোনো সীমা থাকা উচিৎ নয়। এটি বাজার প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নির্ধারিত হলে গ্রাহকদের জন্য তা সবচেয়ে লাভজনক হবে।
অপারেটরদের প্রধান নির্বাহীরা শুরু থেকেই তিন দিনের ডেটা প্যাকেজ বন্ধের বিরোধীতা করে আসছিলেন। নাম না প্রকাশের শর্তে মোবাইল অপারেটরের একজন কর্মকর্তা বলেন, বিটিআরসি যখনই কোনো বিষয়ে আমাদের মতামতের জন্য ডাকেন সেখানে তারা আগে থেকে নেওয়া সিদ্ধান্তটিই শেষ পযন্ত বাস্তবায়ন করে থাকেন। তাই আমাদের মতামত কখনোই মূল্যায়িত হয় না।
অন্যদিকে বিটিআরসি বলছে, গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষা করার দায়িত্ব থেকেই তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেছন, মেয়াদের চক্র ও প্যাকেজের চক্র করা হয়েছে বাড়তি মুনাফার জন্য। মুনাফা কমে যাচ্ছে বলেই মোবাইল ফোন অপারেটরেরা তিন দিনের মেয়াদের ডেটা প্যাকেজ চাইছে। তাছাড়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মেয়াদ, অসংখ্য প্যাকেজে গ্রাহকরা বিভ্রান্ত হয়েছেন বলেই নতুন নির্দেশিকা দেওয়া হয়েছে যা গ্রহনযোগ্য।
বাংলালিংকের চিফ কর্পোরেট ও রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স অফিসার তাইমুর রহমান বলেন, আমাদের হিসাব অনুযায়ী, প্রায় ৬০% গ্রাহক ৩ দিনের ইন্টারনেট ডেটা প্যাক ব্যবহার করেন, কারণ এটি তাদের জন্য অপেক্ষাকৃত সাশ্রয়ী। মুদ্রাস্ফীতির চলমান পরিস্থিতিতে এই ধরনের প্যাক সীমিত আয়ের গ্রাহকদের জন্য উপযোগী। তাই এমন অবস্থায় এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের ডিজিটাল অগ্রযাত্রায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। আমরা বিষয়টি পুনরায় বিবেচনার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে অনুরোধ জানিয়েছি। আমাদের উদ্দেশ্য হল গ্রাহকদের কাছে সাশ্রয়ী মূল্যের সেবা পৌঁছে দেওয়া। যেকোনো খাতেই বেশি পরিমাণ (ভলিউম) পণ্য বা সেবার গড় মূল্য স্বল্প পরিমাণ পণ্য বা সেবার গড় মূল্য থেকে বেশি হয়ে থাকে। ডেটার মেয়াদ বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও এটি ঘটতে পারে।
গত ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিল মাসের তথ্য বিশ্লেষণ করে বিটিআরসি দেখেছে যে, দেশে গ্রাহকদের ৬৯.২৩ শতাংশ ৩ দিনের প্যাকেজ, ১৬.৮৪ শতাংশ ৭ দিনের প্যাকেজ, ৩.৮২ শতাংশ ১৫ দিনের প্যাকেজ এবং ১০.১১ শতাংশ ৩০ দিনের প্যাকেজ ব্যবহার করছেন।
তিন দিনের প্যাকেজে যে পরিমাণ ডেটা দেওয়া হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে গ্রাহক নিদিষ্ট সময়ের মধ্যে তা ব্যবহার করতে পারে না। এতে গ্রাহকদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হচ্ছে। অন্যদিকে অপারেটরেরা বলছে, মানুষের পছন্দের সুযোগ যদি কমে তাহলে খরচ বাড়বে আর এতে গ্রাহকরা ডেটা ব্যবহারে অনাগ্রহী হয়ে উঠবেন, যা রাজস্ব আয়ের ওপরেও প্রভাব পড়বে।
মোবাইল ফোন অপারেটরদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস বাংলাদেশ (অ্যামটব) তিন দিনের ডেটা প্যাকেজ বাদ দেওয়ার বিষয়ে প্রথম থেকেই বিরোধিতা করে আসছে।
এমটব মহাসচিব লে কর্নেল মোহম্মদ জুলফিকার (অব:) বলেন, আমরা জানি যে, নিয়ন্ত্রক সংস্থার সিদ্ধান্ত অনুসারে ৩ দিন, ৭ দিন, ১৫ দিন ও ৩০ দিনের ডেটা প্যাকের পরিবর্তে আগামীতে শুধু ৭ দিন ও ৩০ দিনের ডেটা প্যাক চালু থাকবে। এই সিদ্ধান্ত গ্রাহকদের নিজস্ব চাহিদা অনুযায়ী ডেটা প্যাক বেছে নেওয়ার সুবিধাকে হ্রাস করবে। আমাদের হিসাব অনুযায়ী, প্রায় ৬০% গ্রাহক ৩ দিনের ইন্টারনেট ডেটা প্যাক ব্যবহার করেন, কারণ এটি তাদের জন্য অপেক্ষাকৃত সাশ্রয়ী। মুদ্রাস্ফীতির চলমান পরিস্থিতিতে এই ধরনের প্যাক সীমিত আয়ের গ্রাহকদের জন্য উপযোগী। তাই এমন অবস্থায় এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের ডিজিটাল অগ্রযাত্রায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। আমরা বিষয়টি পুনরায় বিবেচনার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে অনুরোধ জানিয়েছি। আমাদের উদ্দেশ্য হল গ্রাহকদের কাছে সাশ্রয়ী মূল্যের সেবা পৌঁছে দেওয়া। যেকোনো খাতেই বেশি পরিমাণ (ভলিউম) পণ্য বা সেবার গড় মূল্য স্বল্প পরিমাণ পণ্য বা সেবার গড় মূল্য থেকে বেশি হয়ে থাকে। ডেটার মেয়াদ বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও এটি ঘটতে পারে।
আমরা এই কারণে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও সরকারকে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না করার অনুরোধ জানিয়েছি। তবে বর্তমান পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকলে আমাদেরকে আগামী ১৫ অক্টোবর এটি বাস্তবায়ন করতে হবে। আমরা আশা করি, নিয়ন্ত্রক সংস্থা তাদের সিদ্ধান্ত গুরুত্বের সাথে পুনর্বিবেচনা করবে।