প্রশান্ত পশ্চিম

  • মাহমুদ হাফিজ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

সানফ্রানসিস্কো এয়ারপোর্টের টার্মিনাল ২ থেকে সিয়াটলের উদ্দেশে আলাস্কা এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট নম্বর ৩১৪৮ ছেড়ে যাবে বেলা পৌণে তিনটায়। আড়াই মাস আগে টিকেট কেটে সেই ফ্লাইটের যাত্রীখাতায় নাম তুলেছি। এখন বেলা সোয়া বারোটা। হাতে আছে পাক্কা আড়াইঘন্টা। সীমান্তের ‘কাঁটাতার’ অতিক্রম সময়ের ব্যাপার! খোদা না খাস্তা কানেক্টিং ফ্লাইট যদি মিস করি! তাড়াহুড়োই্ করছি। জীবনে প্রথম বিমান মিসই হলো। দরজায় দাঁড়ানো পরাক্রান্ত সহিস ঘোড়ার পিঠে আমাদের না চড়িয়েই লাগাম ছেড়ে চলে গেছে। ভরঅপরাহ্নে বোর্ডিংগেটে কাকপক্ষীও নেই। টানা চল্লিশঘন্টার ভ্রমণক্লান্ত শরীর ফাঁকা সোফায় এলিয়ে এতোক্ষণ ঘটে যাওয়া ভজঘটের জাবর কাটছি। ভাবছেন- ‘ক্যামনে কী’!

আকাশের অসীম থেকে সানফ্রানসিস্কোর সীমান্ত সসীমে নেমেছি। ইমিগ্রেশন কাউন্টারের দিকে চাকাওলা লাগেজ টেনে হেটে যাই। মার্কিন মুলুকের সীমান্ত সুরক্ষক ফেডারেল সংস্থা ‘কাস্টমস এ্যান্ড বর্ডার প্রোটেকশন’-সিবিপি (আমাদের কমিউনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশ- সিপিবি নয়)। নীল ইউনিফর্ম আর কোমরের বেল্টে গোঁজা স্বয়ংক্রিয় রিভলবারে সিবিপি কর্মকর্তারা চৌকষ। কথাবার্তায় রোবটীয় গাম্ভীর্য, অভিজাত সেনাবাহিনীর জাঁদরেল অফিসারের মতো। হলের প্রবেশমুখ গ্রিণকার্ড ও ভিসাধারী নামে দুটি লাইন রিবনবিভক্ত। আমরা দাঁড়িয়েছি ভিসা লাইনে। পকেটে মার্কিন প্রবেশের সবুজ সঙ্কেত নেই।

বিজ্ঞাপন

‘আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনকালে সঞ্চয় করিনি’, অভিপ্রায়ণেচ্ছু হইনি কোনদিন। লাইনে দাঁড়িয়ে ভাবছি এরকম খাপছাড়া নানা কথা। ভরদুপুরে টার্কিশ এয়ারই শুধু উড়ে এসে এ পোতে নোঙর করেছে। অন্য কোন উড়োজাহাজের আগমন দেখিনি। হলঘরে যে শ’ তিনেক আবালবৃদ্ধবণিতা লাইনে দাঁড়ানো সীমান্ত অতিক্রমের অভিপ্রায়ে; তারা এখানে ইস্তাম্বুলের যাত্রী।

ইমিগ্রেশন হলে কাউন্টার আশিটির ওপরে। গোটা দশেক কাউন্টার খোলা রেখে টার্কিশ যাত্রীদের সীমান্তপ্রক্রিয়া সম্পন্নের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আগে সানফ্রানসিস্কো এয়ারপোর্টেই স্বয়ংক্রিয় মেশিনে ব্যক্তিগত তথ্যের ইনপুট দিয়ে চোখের পলকে পার হয়েছি। করোনাকোভিড বিশ্বকে এমন করুণ দিন উপহার দিয়েছে যে, প্রযুক্তিশীর্ষের দেশ আমেরিকাও যন্ত্রকে আপাত: গুডবাই বলে পাশে সরিয়ে রেখেছে। আমরা যেখানে লাইন দিয়েছি, তার অদূরের দেয়ালঘেঁষে মেশিনের সারি অলস ঝিমাচ্ছে। আগে মানুষের বদলে মেশিন বসেছিল, এখন মেশিনের বদলে মানুষ।

শ্লথগতিতে আগুয়ান লাইন থেকেই স্বচ্ছ কাঁচঘেরা কাউন্টারে বসা সিবিপি কর্মকর্তা আর মার্কিনযাত্রীর কথোপোকথন স্পষ্ট শোনা যায়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশাধিকার দেয়া না দেয়া সিবিপি কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত জুরিডিকশন ও অভিরুচি। ব্যক্তিভেদে সিদ্ধান্তের ইতিনেতির তথ্য প্রবেশেচ্ছুদের জানা। সিল দিয়ে ‘ওয়েলকাম টু ইউনাইটেড স্টেটস’ বললে হাসিমুখে যাত্রী বামদিকে হলঘরের দিকে লাগেজ সংগ্রহে যাচ্ছে। সিল না পড়লে ডানে হলঘরের শেষপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সবার মনে এখন একই উদ্বেগ-রোবটসদৃশ কর্মকর্তার বদলে ভাগ্যে যেন সহাস্যবদন কর্মকর্তা পড়ে। সিদ্ধান্ত সময়সাপেক্ষ ও জটিল না হয়ে সহজ হয়। ভাবি, জগতের আকাশ বাতাসে পশুপাখির উড়াল নিয়ে মানুষের মাথাব্যাথা নেই।

সীমান্তঅতিক্রমী নদীস্রোত পাড়ি দেয় এক দেশ থেকে আরেক দেশে, দুইদেশ বিস্তৃত একই বনের পশুপাখি অনায়াসে ভূগোল রেখা ভাঙে, যতো মাথাব্যথা কেবল সৃষ্টির সেরা মানুষের প্রবেশে! এ কোন কঠিন পৃথিবীতে আমাদের বসবাস? সীমান্ত নামের এই ধীরগতির লাইনে দাঁড়িয়ে মন তাই দুরু দুরু। এমন বিশ্ব ভ্রমণিয়া বোধ নেই, ইমিগ্রেশনে দাঁড়িয়ে যার চিন্তা হয়নি ভিতরের ঢুকতে দেবে তো! যে আমি একুশ বছর ধরে মার্কিন মুলুকের পূর্ব সাগরপ্রান্ত অতলান্ত আর পশ্চিমের প্রশান্ত পর্যন্ত যাওয়া আসা করছি, তার মধ্যেও আজ এক আসোয়াস্তি।

তুসু পাশের কাউন্টারে মহিলা সিবিপি কর্মকর্তার সামনে, আমি আর জলি একই বংশোদ্ভূত পুরুষের কাউন্টারে দাঁড়িয়েছি। পাসপোর্টে নাম দেখেই কর্মকর্তার জিজ্ঞাসা- মাহমুদ, তুমি টার্কি থেকে এসেছো?

জবাবের তোয়াক্কা না করেই আবার বলে – ‘তোমার কাছে খাবার, মসলা ও মিষ্টি আছে?’

সানফ্রানসিস্কো ডোমেস্টিক টার্মিনাল

ভাবলাম আমার লাগেজে কি আছে না আছে তা কে তুললো মার্কিন মুলুকের এই কর্মকর্তার কানে? ইমিগ্রেশনে বসে সে কাস্টমস কর্মকর্তার মতো প্রশ্ন করছেই বা কেন? আমার লাগেজে সবই আছে। এমনকি শুকনো করে গরুর মাংস রান্নাও থাকতে পারে স্ত্রীর লাগেজের গোপন কুঠরিতে। সরাসরি জবাব না দিয়ে একটু ডিপ্লোম্যাসির আশ্রয় নিলাম- ইউ সী, আই এ্যাম এ্যাওয়ার এ্যাবাউট ইওর বর্ডার রুলস। আই মে হ্যাভ সাম হাফ কুকড সী ফুড, ফিস, পিকেলস এটসেটরা-হুইচ আর এ্যালাওয়েবল।

কর্মকর্তার কম্পিউটার পর্দায় সিদ্ধান্ত লেখাই ছিল মনে হলো। সিল না দিয়ে সে দু’জনের চারটি পাসপোর্ট দু’টি স্বচ্ছ বক্সে ঢুকিয়ে তালা মারলো। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে তালামারা পাসপোর্ট বক্সটি বগলদাবা করে ‘প্লিজ, কাম উইথ মি’ বলে ডানদিকে হাঁটা শুরু করলো। ভাবলাম, ‘কাম উইথ মি’ বলে রিমান্ডে তলব করে কোথায় নিয়ে যেতে চায় এই মার্কিন সিবিপি স্টাফ! বুঝলাম, চলেছি সেদিকে, যেদিকে চলে গেছে পূর্ব ও উত্তরপুরুষগণ। পড়লাম-‘ ইহদিনাস সিরাত্বল মুস্তাকিম, সিরাত্বল লাজি না আনআ’মতা আলাইহিম’ ( প্রভু, সোজা পথ দেখাও, যে পথ তোমার অনুগ্রহপ্রাপ্তদের পথ)। মোদ্দাকথা, আজকের টার্কিশ এয়ারে নামা আড়াইশ’র মধ্যে একশ’য়ের মতো যাত্রীকে আমার মতো দক্ষিনপন্থী করা হয়েছে। সামনে যেন ‘পুলসিরাত’ অপেক্ষমান। যদিও দক্ষিনপন্থীদের পারের আশ্বাস স্পষ্ট। বিনাকথায় সিবিপি সিলটি মারলে বামপন্থী হতে পারতাম !

হলঘরের শেষপ্রান্তে ওয়েটিং এরিয়া। শেষপ্রান্ত লাগোয়া ছোট হলে চলছে তুসুর কাগজপত্র চেক। আমাদেরও সেই হলেই নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো, সে ঘরে লোকে টইটুম্বুর, ‘ঠাঁই নেই ঠাঁই নেই ছোট সে তরী’ অবস্থা বলে সামনের ওয়েটিং এরিয়াতেও সেকেন্ডারি ইন্টারভিউ’র ব্যবস্থা। কাগজপত্র ও পরিচয়ের অস্পস্টতা দূর ও সন্দেহভাজনদের ওপর থেকে সন্দেহ অপনোদনে এই কালক্ষয়ের এন্তেজাম। ইমিগ্রেশন হলের শেষ কাউন্টারের সামনে পাতা বড় বড় সোফা। বোঝাই যায়,প্রতিদিনই তাতে নিয়মিত ডেকে আনাদের বসানো হয়।  আমাদের বসানো হলো। আগের কর্মকর্তা তালামারা বক্স হস্তান্তর করলো কাউন্টারে বসা আরেক কর্মকর্তার হাতে। নতুনজন বেঁটেখাটো, পেশিবহুল। তার শারিরী ভাষায় দৃঢ় ও কঠোরতার ছাপ। তালা খুলে পাসপোর্ট বের করে আমার কাছ থেকে কিছু তথ্য নিলেন। মিনিট দশেক পর বললেন, ‘তোমার জন্ম তো বাঙ্গালোর’। হেসে বললাম, ‘বাংলাদেশ।  ড্রপডাউন মেন্যু স্ক্রল করতে গিয়ে তোমার ভুল হচ্ছে হয়তো’।  

কর্মকর্তা যখন চুলচেরা পরীক্ষা নিরীক্ষা করছেন, অন্য কর্মকর্তাকে ডেকে এনে কম্পিউটার স্ক্রিন দেখাচ্ছেন কিংবা ঘন ঘন ভেতরের হলে তার উর্ধ্বতন কর্মকতার কাছে যাওয়া আসা করছেন, তখন জলি উদ্বিগ্নকন্ঠে বার বার আমার দিকে তাকাচ্ছে। আমি বেশি উদ্বেগকে পাত্তা না দিয়ে কেউ না শোনে এমনভাবে গেয়ে চলেছি ‘আমি অপার হয়ে বসে আছি, ওগো দয়াময়…পারে লয়ে যাও আমায়….আমি একা রইলাম ঘাটে, ভানু সে বসিলো পাটে…তোমা বিনে ঘোর সঙ্কটে… না দেখি উপায়…পারে লয়ে যাও আমায়…।‘

বাউলভাবনা তাড়িত আমার সম্বিত ফেরালো ওই কর্মকর্তা। ‘নো ওয়ে, নো ওয়ে, ইউ ক্যান নট গো ইন’, ইউ ক্যান নট গো ইন’ বলে আমাদের দিকে এগিয়ে আসলেন তিনি। এ স্তরে আর্গু করতে থাকি এবং সফল হই। কর্মকর্তা সিল মেরে মার্কিন মাটিতে পদার্পণের অনুমতি দিলেও পাসপোর্টগুলো পূর্ববৎ তালা মেরে  কাস্টমসের ‘বি’ লাইন দিয়ে বেরিয়ে যেতে বলেন। হলঘরে তুসু ইন্টারভিউও শেষ। আমি তাদের নিয়ে হলঘর থেকে বিজয়ীর বেশে বাইরের কাস্টমস হলে যাওয়ার সরু প্যাসেজ দিয়ে হাঁটি। তালা মারা পাসপোর্টের বক্স আমার বগলদাবা। মেজাজ ফুরফুরে। গাইতে থাকি-

‘একটা চাবি মাইরা দিছে ছাইড়া জনম ভরে ঘুরতে আছে, মন আমার দেহঘড়ি সন্ধান করি কোন মিস্তরি বানাইয়াছে….মন আমার দেহ ঘ….ড়ি।‘

বাইরে এসে দেখি লাগেজগুলো বেল্টে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত শ্রান্ত। এরা বিমান চড়েছে দুদিন আগে ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে। কাপড় চোপড় ছাড়া বয়ে আনা খাদ্যের এখন চাই জিরো ডিগ্রির শীতলতা। ভাগ্যিস, পকেটে গুনে গুনে আট টাকা ছিল। তুসুর হাতে দিলে সে মেশিনে ফেলে একটা লাগেজ ট্রলি জোগাড় করে। এই ঝামেলা, যুক্তরাষ্ট্রে। লাখ লাখ ডলার কাটছে এয়ারপোর্ট খরচা বাবদ, বিনা অর্থে ট্রলির কোন ব্যবস্থা নেই। আর বাপু, এয়ারপোর্টে কি লোকজনের কাছে সে দেশের কড়ি থাকে?  তিনটি লাগেজ ট্রলিতে উঠিয়ে তুসু ঠেলতে থাকে, আমি দুটি আর জলি একটি নিয়ে অগ্রসর হই কাস্টমস হলের বি জোনে।

গানে গানে মেজাজ ফুরফুরেই ছিল। গোল বাধায় কাস্টমস কর্মকর্তারা। তিনজনের লাগেজের চালটা, মুলোটা, ডালটা, মাছ ভাজিটা, নাড়ু, বাতাসা, চানাচুর, আমসত্ত্ব যা আছে, ঘোষণা দিতে এক ফরমে। এ নিয়ে কালক্ষয় হলো অনেকখানি। এই ধাপ পেরুলে নাক বরাবর গাড়ি বারান্দা, বামে ডোমেস্টিক ট্রান্সফার ও কানেকশন্স। এবার বামপন্থী হয়ে লাগেজপত্র ঠেলেঠুলে অনেকটা পথ আসি। আলাস্কা বলতেই এক বিমানপোতকর্মী পথনির্দেশ করতে শাহাদত আঙুল ওঠায়। গিয়ে দেখি,লাগেজ ঠেলে পৌঁছে দেখি আসল আলাস্কামুখো ফ্লাইটের লাগেজ চেক ইন করছে ইএক এয়ারপোর্ট কর্মী। পরে আবার উল্টোপথে আধ কিলোমিটারে বেশি হেঁটে আলাস্কা এয়ারলাইন্সের কাউন্টারে পৌঁছি।   

নির্ধারিত ফ্লাইট টেকঅফ সময়ের তখনও কিছুটা বাঁকি। এটা তো আর বন্ধুর মোটরবাইক বা ‘পাঠাও’ না যে উঠলাম, স্টার্ট দিলাম আর পৌঁছে গেলাম। কাউন্টারকর্মী বললেন, তোমাদের ফ্লাইট মিস। ভাবতে হয়নি, কারণ একই রুটে আরও ফ্লাইট আছে কয়েকঘন্টা পর পর। পরবর্তী ফ্লাইটেও তিনজনের আসন হলো না। শেষ ফ্লাইট রাত পৌণে আটটায়। ঘন্টা চারেক এয়ারপোর্টবাস করতে হবে। আমাদের সঙ্গে প্যারিশেবল গুডস ফ্রিজের শীতলতা চাচ্ছে। যেসব মাছ মিষ্টি খাওয়া হবে সিয়াটলে। না হলে এয়ারপোর্ট থেকে সোজা আলামেদা আইল্যান্ডে সোজা বন্ধু আতিয়ার রহমান লাবুর বাড়িতে গিয়ে উঠতাম। শাহানা ভাবীর হেঁসেলের রান্নার কথা ভোলা যায় না।  

লম্বা সময় থাকার পরও কানেক্টিং ফ্লাইট মিস করায় ইমিগ্রেশন ও কাস্টসমস কর্মকর্তাদের ওপর অভিমান হলো বড়। আবার ভাবলাম, মার্কিন মুলককে সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব তো তাদের ওপরই, পেশাগত দায়িত্ব তো তারা সুচারুরূপেই পালন করবে। তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে যা পেশাদারিত্ব ও দক্ষতা বটে।

আর ঝুঁকি নিতে চাইলাম না। আমাদের বোর্ডিং গেট ডি ৭। সামনেই সিকিউরিটি চেক। নিরাপত্তা চেক করে ডোমেস্টিকে ঢুকতে জলির জন্য গোল বাধবে জানাই ছিল। ছোটবেলায় তার অপারেশন হওয়ার জেরে এয়ারপোর্টে ফুলবডি স্ক্যানিংয়ের সময় মেশিন ভুল রিডিং করে থাকে সবসময়। ম্যানুয়েল চেকিংয়ে ব্যাখ্যার পর সে  ছাড়া পায় বার বার। সেসব ঝক্কিশেষে স্ক্যানার পেরিয়ে ভেতরেই যেতেই  লাস্যময়ী হাস্যময়ীর ডাক-এই ব্যাগ কার? দেখি অধমের ব্যাগটিতেই পাশে নামিয়ে রাখা। লাস্যময়ী বলে, তোমার ব্যাগে লিকুইড আছে। আমি বলি নেই। সে বলে আছে। আমি বলি নেই। আছে নেই, আছে নেই করতে করতে কয়েক মিনিট কাটে। তারপর সে অনমুতি নিয়ে ব্যাগ খোলে। দেখা যায়, টার্কিশ এয়ারের সৌজন্য পাণীয় ব্যাগে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে এয়ারপোর্টে ঢোকার চেষ্টা করছে। এতোসব ভজঘটে ভুলেই গিয়েছিলাম তার্কিশ এয়ার পাণীয় উপহার দিয়েছিল, তা ব্যাগের কোটরে পুরেছি রেখেছি।

এবার লাস্যময়ী নিরাপত্তাকর্মীর অনুরোধ, ‘তুমি বাইরে যাও। এটা খাও, পেটে পুরে আবার স্ক্যানার দিয়ে ফিরে আসো।

তাকিয়ে দেখি পেছনে বেজায় লাইন। বেরিয়ে আবার ঢুকতে গেলে অনেক অপেক্ষার করতে হবে, এখন আর প্রহর গোণার অবস্থা শরীর ও মনের নেই।

ভ্রামণিক জাফর ভাই বলেছিলেন, এ ধরনের পরিস্থিতে আফ্রিকায় নাকি একটা টার্ম ব্যবহার হয়-‘প্লিজ মেক এ প্ল্যান’। এর পারিভাষিক অর্থ ‘একটা ব্যবস্থা করো’।

‘প্লিজ মেক এ প্ল্যান’ শব্দটি মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলে লাস্যময়ী চীৎকার করে ওঠে ‘হোয়াট’। কোমলকন্ঠে বলি-‘যদি এখানে এটা রেখে যাই, বা তোমাকে উপহার দিই….!’

আর বাক্যব্যয় করতে হয় না।

ক্ষুৎপিপাসায় কাতর সবাই। গেটমুখে যাওয়ার পথে ছোট ছোট কফিশপ- ভারী বা হালকা খাওয়ার আয়োজন। পকেটে প্রায়োরিটি পাস নামের যে সেবিকা রয়েছে, তার এস্তেমাল করতে ব্যর্থ হই। স্থান কাল ও পাত্র ঠিক নেই। জীবনে এ তিনটি জিনিসের মেলবন্ধন বড় প্রয়োজন। অগত্যা এক কফিশপে থেকে পানি কিনি, কিছু নাস্তা অর্ডার করি। পানি পিপাসায় জলি ছাতি ফাটছে। দোকানের সামনের  ফুডকোর্টে বসে আয়েশ করে খাই। গেটমুখে গিয়ে দেখি কাকপক্ষীও নেই। এখন চারটার মতো বাজে। বোর্ডিংগেটের কাউন্টার খুলবে ফ্লাইট ছাড়ার ঘন্টাকাল আগে, পৌণে সাতটায়। তার মানে আমাদের হাতে ঘন্টা তিনেক সময় আছে। জলি সোফায় ঘুমিয়ে পড়ে।সামনে উড়োজাহাজের ওঠানামা দেখতে দেখতে আমি গত কয়েকঘন্টায় ঘটনার কার্যকারণ বের করার জন্য স্মৃতির জাবর কাটি।

এ্ই স্মৃতির জাবরে ধরা পড়ে- আমি যে টেপে প্যাঁচানো বক্সে মাছ-মিস্টি এনেছি-তাই হয়তো আজকের ভজঘট-বিড়ম্বনার নেপথ্যে। ইস্তাম্বুল এয়ারপোর্টে মার্কিনমুখো ফ্লাইটে ওঠানোর সময় আমার প্রোফাইলে রেডফ্ল্যাগ পড়ে থাকতে পারে। মানে আমি এখানে পৌঁছানোর আগেই এখানে চলে আসছে লাগেজের বিবরণ। অতএব সাধু সাবধান! বিড়ম্বনার কথা ভেবে মন খারাপ না করে আমি বরং উড়োজাহাজ টেকঅফ ও ল্যান্ডিং দৃশ্যে মনোনিবেশ করি। ওসবের চেয়ে ভ্রমণের ইতিবাচক মজা নেয়া বড় প্রয়োজন।