প্রশান্ত পশ্চিম



মাহমুদ হাফিজ
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

সানফ্রানসিস্কো এয়ারপোর্টের টার্মিনাল ২ থেকে সিয়াটলের উদ্দেশে আলাস্কা এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট নম্বর ৩১৪৮ ছেড়ে যাবে বেলা পৌণে তিনটায়। আড়াই মাস আগে টিকেট কেটে সেই ফ্লাইটের যাত্রীখাতায় নাম তুলেছি। এখন বেলা সোয়া বারোটা। হাতে আছে পাক্কা আড়াইঘন্টা। সীমান্তের ‘কাঁটাতার’ অতিক্রম সময়ের ব্যাপার! খোদা না খাস্তা কানেক্টিং ফ্লাইট যদি মিস করি! তাড়াহুড়োই্ করছি। জীবনে প্রথম বিমান মিসই হলো। দরজায় দাঁড়ানো পরাক্রান্ত সহিস ঘোড়ার পিঠে আমাদের না চড়িয়েই লাগাম ছেড়ে চলে গেছে। ভরঅপরাহ্নে বোর্ডিংগেটে কাকপক্ষীও নেই। টানা চল্লিশঘন্টার ভ্রমণক্লান্ত শরীর ফাঁকা সোফায় এলিয়ে এতোক্ষণ ঘটে যাওয়া ভজঘটের জাবর কাটছি। ভাবছেন- ‘ক্যামনে কী’!

আকাশের অসীম থেকে সানফ্রানসিস্কোর সীমান্ত সসীমে নেমেছি। ইমিগ্রেশন কাউন্টারের দিকে চাকাওলা লাগেজ টেনে হেটে যাই। মার্কিন মুলুকের সীমান্ত সুরক্ষক ফেডারেল সংস্থা ‘কাস্টমস এ্যান্ড বর্ডার প্রোটেকশন’-সিবিপি (আমাদের কমিউনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশ- সিপিবি নয়)। নীল ইউনিফর্ম আর কোমরের বেল্টে গোঁজা স্বয়ংক্রিয় রিভলবারে সিবিপি কর্মকর্তারা চৌকষ। কথাবার্তায় রোবটীয় গাম্ভীর্য, অভিজাত সেনাবাহিনীর জাঁদরেল অফিসারের মতো। হলের প্রবেশমুখ গ্রিণকার্ড ও ভিসাধারী নামে দুটি লাইন রিবনবিভক্ত। আমরা দাঁড়িয়েছি ভিসা লাইনে। পকেটে মার্কিন প্রবেশের সবুজ সঙ্কেত নেই।

‘আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনকালে সঞ্চয় করিনি’, অভিপ্রায়ণেচ্ছু হইনি কোনদিন। লাইনে দাঁড়িয়ে ভাবছি এরকম খাপছাড়া নানা কথা। ভরদুপুরে টার্কিশ এয়ারই শুধু উড়ে এসে এ পোতে নোঙর করেছে। অন্য কোন উড়োজাহাজের আগমন দেখিনি। হলঘরে যে শ’ তিনেক আবালবৃদ্ধবণিতা লাইনে দাঁড়ানো সীমান্ত অতিক্রমের অভিপ্রায়ে; তারা এখানে ইস্তাম্বুলের যাত্রী।

ইমিগ্রেশন হলে কাউন্টার আশিটির ওপরে। গোটা দশেক কাউন্টার খোলা রেখে টার্কিশ যাত্রীদের সীমান্তপ্রক্রিয়া সম্পন্নের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আগে সানফ্রানসিস্কো এয়ারপোর্টেই স্বয়ংক্রিয় মেশিনে ব্যক্তিগত তথ্যের ইনপুট দিয়ে চোখের পলকে পার হয়েছি। করোনাকোভিড বিশ্বকে এমন করুণ দিন উপহার দিয়েছে যে, প্রযুক্তিশীর্ষের দেশ আমেরিকাও যন্ত্রকে আপাত: গুডবাই বলে পাশে সরিয়ে রেখেছে। আমরা যেখানে লাইন দিয়েছি, তার অদূরের দেয়ালঘেঁষে মেশিনের সারি অলস ঝিমাচ্ছে। আগে মানুষের বদলে মেশিন বসেছিল, এখন মেশিনের বদলে মানুষ।

শ্লথগতিতে আগুয়ান লাইন থেকেই স্বচ্ছ কাঁচঘেরা কাউন্টারে বসা সিবিপি কর্মকর্তা আর মার্কিনযাত্রীর কথোপোকথন স্পষ্ট শোনা যায়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশাধিকার দেয়া না দেয়া সিবিপি কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত জুরিডিকশন ও অভিরুচি। ব্যক্তিভেদে সিদ্ধান্তের ইতিনেতির তথ্য প্রবেশেচ্ছুদের জানা। সিল দিয়ে ‘ওয়েলকাম টু ইউনাইটেড স্টেটস’ বললে হাসিমুখে যাত্রী বামদিকে হলঘরের দিকে লাগেজ সংগ্রহে যাচ্ছে। সিল না পড়লে ডানে হলঘরের শেষপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সবার মনে এখন একই উদ্বেগ-রোবটসদৃশ কর্মকর্তার বদলে ভাগ্যে যেন সহাস্যবদন কর্মকর্তা পড়ে। সিদ্ধান্ত সময়সাপেক্ষ ও জটিল না হয়ে সহজ হয়। ভাবি, জগতের আকাশ বাতাসে পশুপাখির উড়াল নিয়ে মানুষের মাথাব্যাথা নেই।

সীমান্তঅতিক্রমী নদীস্রোত পাড়ি দেয় এক দেশ থেকে আরেক দেশে, দুইদেশ বিস্তৃত একই বনের পশুপাখি অনায়াসে ভূগোল রেখা ভাঙে, যতো মাথাব্যথা কেবল সৃষ্টির সেরা মানুষের প্রবেশে! এ কোন কঠিন পৃথিবীতে আমাদের বসবাস? সীমান্ত নামের এই ধীরগতির লাইনে দাঁড়িয়ে মন তাই দুরু দুরু। এমন বিশ্ব ভ্রমণিয়া বোধ নেই, ইমিগ্রেশনে দাঁড়িয়ে যার চিন্তা হয়নি ভিতরের ঢুকতে দেবে তো! যে আমি একুশ বছর ধরে মার্কিন মুলুকের পূর্ব সাগরপ্রান্ত অতলান্ত আর পশ্চিমের প্রশান্ত পর্যন্ত যাওয়া আসা করছি, তার মধ্যেও আজ এক আসোয়াস্তি।

তুসু পাশের কাউন্টারে মহিলা সিবিপি কর্মকর্তার সামনে, আমি আর জলি একই বংশোদ্ভূত পুরুষের কাউন্টারে দাঁড়িয়েছি। পাসপোর্টে নাম দেখেই কর্মকর্তার জিজ্ঞাসা- মাহমুদ, তুমি টার্কি থেকে এসেছো?

জবাবের তোয়াক্কা না করেই আবার বলে – ‘তোমার কাছে খাবার, মসলা ও মিষ্টি আছে?’

সানফ্রানসিস্কো ডোমেস্টিক টার্মিনাল

ভাবলাম আমার লাগেজে কি আছে না আছে তা কে তুললো মার্কিন মুলুকের এই কর্মকর্তার কানে? ইমিগ্রেশনে বসে সে কাস্টমস কর্মকর্তার মতো প্রশ্ন করছেই বা কেন? আমার লাগেজে সবই আছে। এমনকি শুকনো করে গরুর মাংস রান্নাও থাকতে পারে স্ত্রীর লাগেজের গোপন কুঠরিতে। সরাসরি জবাব না দিয়ে একটু ডিপ্লোম্যাসির আশ্রয় নিলাম- ইউ সী, আই এ্যাম এ্যাওয়ার এ্যাবাউট ইওর বর্ডার রুলস। আই মে হ্যাভ সাম হাফ কুকড সী ফুড, ফিস, পিকেলস এটসেটরা-হুইচ আর এ্যালাওয়েবল।

কর্মকর্তার কম্পিউটার পর্দায় সিদ্ধান্ত লেখাই ছিল মনে হলো। সিল না দিয়ে সে দু’জনের চারটি পাসপোর্ট দু’টি স্বচ্ছ বক্সে ঢুকিয়ে তালা মারলো। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে তালামারা পাসপোর্ট বক্সটি বগলদাবা করে ‘প্লিজ, কাম উইথ মি’ বলে ডানদিকে হাঁটা শুরু করলো। ভাবলাম, ‘কাম উইথ মি’ বলে রিমান্ডে তলব করে কোথায় নিয়ে যেতে চায় এই মার্কিন সিবিপি স্টাফ! বুঝলাম, চলেছি সেদিকে, যেদিকে চলে গেছে পূর্ব ও উত্তরপুরুষগণ। পড়লাম-‘ ইহদিনাস সিরাত্বল মুস্তাকিম, সিরাত্বল লাজি না আনআ’মতা আলাইহিম’ ( প্রভু, সোজা পথ দেখাও, যে পথ তোমার অনুগ্রহপ্রাপ্তদের পথ)। মোদ্দাকথা, আজকের টার্কিশ এয়ারে নামা আড়াইশ’র মধ্যে একশ’য়ের মতো যাত্রীকে আমার মতো দক্ষিনপন্থী করা হয়েছে। সামনে যেন ‘পুলসিরাত’ অপেক্ষমান। যদিও দক্ষিনপন্থীদের পারের আশ্বাস স্পষ্ট। বিনাকথায় সিবিপি সিলটি মারলে বামপন্থী হতে পারতাম !

হলঘরের শেষপ্রান্তে ওয়েটিং এরিয়া। শেষপ্রান্ত লাগোয়া ছোট হলে চলছে তুসুর কাগজপত্র চেক। আমাদেরও সেই হলেই নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো, সে ঘরে লোকে টইটুম্বুর, ‘ঠাঁই নেই ঠাঁই নেই ছোট সে তরী’ অবস্থা বলে সামনের ওয়েটিং এরিয়াতেও সেকেন্ডারি ইন্টারভিউ’র ব্যবস্থা। কাগজপত্র ও পরিচয়ের অস্পস্টতা দূর ও সন্দেহভাজনদের ওপর থেকে সন্দেহ অপনোদনে এই কালক্ষয়ের এন্তেজাম। ইমিগ্রেশন হলের শেষ কাউন্টারের সামনে পাতা বড় বড় সোফা। বোঝাই যায়,প্রতিদিনই তাতে নিয়মিত ডেকে আনাদের বসানো হয়।  আমাদের বসানো হলো। আগের কর্মকর্তা তালামারা বক্স হস্তান্তর করলো কাউন্টারে বসা আরেক কর্মকর্তার হাতে। নতুনজন বেঁটেখাটো, পেশিবহুল। তার শারিরী ভাষায় দৃঢ় ও কঠোরতার ছাপ। তালা খুলে পাসপোর্ট বের করে আমার কাছ থেকে কিছু তথ্য নিলেন। মিনিট দশেক পর বললেন, ‘তোমার জন্ম তো বাঙ্গালোর’। হেসে বললাম, ‘বাংলাদেশ।  ড্রপডাউন মেন্যু স্ক্রল করতে গিয়ে তোমার ভুল হচ্ছে হয়তো’।  

কর্মকর্তা যখন চুলচেরা পরীক্ষা নিরীক্ষা করছেন, অন্য কর্মকর্তাকে ডেকে এনে কম্পিউটার স্ক্রিন দেখাচ্ছেন কিংবা ঘন ঘন ভেতরের হলে তার উর্ধ্বতন কর্মকতার কাছে যাওয়া আসা করছেন, তখন জলি উদ্বিগ্নকন্ঠে বার বার আমার দিকে তাকাচ্ছে। আমি বেশি উদ্বেগকে পাত্তা না দিয়ে কেউ না শোনে এমনভাবে গেয়ে চলেছি ‘আমি অপার হয়ে বসে আছি, ওগো দয়াময়…পারে লয়ে যাও আমায়….আমি একা রইলাম ঘাটে, ভানু সে বসিলো পাটে…তোমা বিনে ঘোর সঙ্কটে… না দেখি উপায়…পারে লয়ে যাও আমায়…।‘

বাউলভাবনা তাড়িত আমার সম্বিত ফেরালো ওই কর্মকর্তা। ‘নো ওয়ে, নো ওয়ে, ইউ ক্যান নট গো ইন’, ইউ ক্যান নট গো ইন’ বলে আমাদের দিকে এগিয়ে আসলেন তিনি। এ স্তরে আর্গু করতে থাকি এবং সফল হই। কর্মকর্তা সিল মেরে মার্কিন মাটিতে পদার্পণের অনুমতি দিলেও পাসপোর্টগুলো পূর্ববৎ তালা মেরে  কাস্টমসের ‘বি’ লাইন দিয়ে বেরিয়ে যেতে বলেন। হলঘরে তুসু ইন্টারভিউও শেষ। আমি তাদের নিয়ে হলঘর থেকে বিজয়ীর বেশে বাইরের কাস্টমস হলে যাওয়ার সরু প্যাসেজ দিয়ে হাঁটি। তালা মারা পাসপোর্টের বক্স আমার বগলদাবা। মেজাজ ফুরফুরে। গাইতে থাকি-

‘একটা চাবি মাইরা দিছে ছাইড়া জনম ভরে ঘুরতে আছে, মন আমার দেহঘড়ি সন্ধান করি কোন মিস্তরি বানাইয়াছে….মন আমার দেহ ঘ….ড়ি।‘

বাইরে এসে দেখি লাগেজগুলো বেল্টে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত শ্রান্ত। এরা বিমান চড়েছে দুদিন আগে ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে। কাপড় চোপড় ছাড়া বয়ে আনা খাদ্যের এখন চাই জিরো ডিগ্রির শীতলতা। ভাগ্যিস, পকেটে গুনে গুনে আট টাকা ছিল। তুসুর হাতে দিলে সে মেশিনে ফেলে একটা লাগেজ ট্রলি জোগাড় করে। এই ঝামেলা, যুক্তরাষ্ট্রে। লাখ লাখ ডলার কাটছে এয়ারপোর্ট খরচা বাবদ, বিনা অর্থে ট্রলির কোন ব্যবস্থা নেই। আর বাপু, এয়ারপোর্টে কি লোকজনের কাছে সে দেশের কড়ি থাকে?  তিনটি লাগেজ ট্রলিতে উঠিয়ে তুসু ঠেলতে থাকে, আমি দুটি আর জলি একটি নিয়ে অগ্রসর হই কাস্টমস হলের বি জোনে।

গানে গানে মেজাজ ফুরফুরেই ছিল। গোল বাধায় কাস্টমস কর্মকর্তারা। তিনজনের লাগেজের চালটা, মুলোটা, ডালটা, মাছ ভাজিটা, নাড়ু, বাতাসা, চানাচুর, আমসত্ত্ব যা আছে, ঘোষণা দিতে এক ফরমে। এ নিয়ে কালক্ষয় হলো অনেকখানি। এই ধাপ পেরুলে নাক বরাবর গাড়ি বারান্দা, বামে ডোমেস্টিক ট্রান্সফার ও কানেকশন্স। এবার বামপন্থী হয়ে লাগেজপত্র ঠেলেঠুলে অনেকটা পথ আসি। আলাস্কা বলতেই এক বিমানপোতকর্মী পথনির্দেশ করতে শাহাদত আঙুল ওঠায়। গিয়ে দেখি,লাগেজ ঠেলে পৌঁছে দেখি আসল আলাস্কামুখো ফ্লাইটের লাগেজ চেক ইন করছে ইএক এয়ারপোর্ট কর্মী। পরে আবার উল্টোপথে আধ কিলোমিটারে বেশি হেঁটে আলাস্কা এয়ারলাইন্সের কাউন্টারে পৌঁছি।   

নির্ধারিত ফ্লাইট টেকঅফ সময়ের তখনও কিছুটা বাঁকি। এটা তো আর বন্ধুর মোটরবাইক বা ‘পাঠাও’ না যে উঠলাম, স্টার্ট দিলাম আর পৌঁছে গেলাম। কাউন্টারকর্মী বললেন, তোমাদের ফ্লাইট মিস। ভাবতে হয়নি, কারণ একই রুটে আরও ফ্লাইট আছে কয়েকঘন্টা পর পর। পরবর্তী ফ্লাইটেও তিনজনের আসন হলো না। শেষ ফ্লাইট রাত পৌণে আটটায়। ঘন্টা চারেক এয়ারপোর্টবাস করতে হবে। আমাদের সঙ্গে প্যারিশেবল গুডস ফ্রিজের শীতলতা চাচ্ছে। যেসব মাছ মিষ্টি খাওয়া হবে সিয়াটলে। না হলে এয়ারপোর্ট থেকে সোজা আলামেদা আইল্যান্ডে সোজা বন্ধু আতিয়ার রহমান লাবুর বাড়িতে গিয়ে উঠতাম। শাহানা ভাবীর হেঁসেলের রান্নার কথা ভোলা যায় না।  

লম্বা সময় থাকার পরও কানেক্টিং ফ্লাইট মিস করায় ইমিগ্রেশন ও কাস্টসমস কর্মকর্তাদের ওপর অভিমান হলো বড়। আবার ভাবলাম, মার্কিন মুলককে সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব তো তাদের ওপরই, পেশাগত দায়িত্ব তো তারা সুচারুরূপেই পালন করবে। তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে যা পেশাদারিত্ব ও দক্ষতা বটে।

আর ঝুঁকি নিতে চাইলাম না। আমাদের বোর্ডিং গেট ডি ৭। সামনেই সিকিউরিটি চেক। নিরাপত্তা চেক করে ডোমেস্টিকে ঢুকতে জলির জন্য গোল বাধবে জানাই ছিল। ছোটবেলায় তার অপারেশন হওয়ার জেরে এয়ারপোর্টে ফুলবডি স্ক্যানিংয়ের সময় মেশিন ভুল রিডিং করে থাকে সবসময়। ম্যানুয়েল চেকিংয়ে ব্যাখ্যার পর সে  ছাড়া পায় বার বার। সেসব ঝক্কিশেষে স্ক্যানার পেরিয়ে ভেতরেই যেতেই  লাস্যময়ী হাস্যময়ীর ডাক-এই ব্যাগ কার? দেখি অধমের ব্যাগটিতেই পাশে নামিয়ে রাখা। লাস্যময়ী বলে, তোমার ব্যাগে লিকুইড আছে। আমি বলি নেই। সে বলে আছে। আমি বলি নেই। আছে নেই, আছে নেই করতে করতে কয়েক মিনিট কাটে। তারপর সে অনমুতি নিয়ে ব্যাগ খোলে। দেখা যায়, টার্কিশ এয়ারের সৌজন্য পাণীয় ব্যাগে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে এয়ারপোর্টে ঢোকার চেষ্টা করছে। এতোসব ভজঘটে ভুলেই গিয়েছিলাম তার্কিশ এয়ার পাণীয় উপহার দিয়েছিল, তা ব্যাগের কোটরে পুরেছি রেখেছি।

এবার লাস্যময়ী নিরাপত্তাকর্মীর অনুরোধ, ‘তুমি বাইরে যাও। এটা খাও, পেটে পুরে আবার স্ক্যানার দিয়ে ফিরে আসো।

তাকিয়ে দেখি পেছনে বেজায় লাইন। বেরিয়ে আবার ঢুকতে গেলে অনেক অপেক্ষার করতে হবে, এখন আর প্রহর গোণার অবস্থা শরীর ও মনের নেই।

ভ্রামণিক জাফর ভাই বলেছিলেন, এ ধরনের পরিস্থিতে আফ্রিকায় নাকি একটা টার্ম ব্যবহার হয়-‘প্লিজ মেক এ প্ল্যান’। এর পারিভাষিক অর্থ ‘একটা ব্যবস্থা করো’।

‘প্লিজ মেক এ প্ল্যান’ শব্দটি মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলে লাস্যময়ী চীৎকার করে ওঠে ‘হোয়াট’। কোমলকন্ঠে বলি-‘যদি এখানে এটা রেখে যাই, বা তোমাকে উপহার দিই….!’

আর বাক্যব্যয় করতে হয় না।

ক্ষুৎপিপাসায় কাতর সবাই। গেটমুখে যাওয়ার পথে ছোট ছোট কফিশপ- ভারী বা হালকা খাওয়ার আয়োজন। পকেটে প্রায়োরিটি পাস নামের যে সেবিকা রয়েছে, তার এস্তেমাল করতে ব্যর্থ হই। স্থান কাল ও পাত্র ঠিক নেই। জীবনে এ তিনটি জিনিসের মেলবন্ধন বড় প্রয়োজন। অগত্যা এক কফিশপে থেকে পানি কিনি, কিছু নাস্তা অর্ডার করি। পানি পিপাসায় জলি ছাতি ফাটছে। দোকানের সামনের  ফুডকোর্টে বসে আয়েশ করে খাই। গেটমুখে গিয়ে দেখি কাকপক্ষীও নেই। এখন চারটার মতো বাজে। বোর্ডিংগেটের কাউন্টার খুলবে ফ্লাইট ছাড়ার ঘন্টাকাল আগে, পৌণে সাতটায়। তার মানে আমাদের হাতে ঘন্টা তিনেক সময় আছে। জলি সোফায় ঘুমিয়ে পড়ে।সামনে উড়োজাহাজের ওঠানামা দেখতে দেখতে আমি গত কয়েকঘন্টায় ঘটনার কার্যকারণ বের করার জন্য স্মৃতির জাবর কাটি।

এ্ই স্মৃতির জাবরে ধরা পড়ে- আমি যে টেপে প্যাঁচানো বক্সে মাছ-মিস্টি এনেছি-তাই হয়তো আজকের ভজঘট-বিড়ম্বনার নেপথ্যে। ইস্তাম্বুল এয়ারপোর্টে মার্কিনমুখো ফ্লাইটে ওঠানোর সময় আমার প্রোফাইলে রেডফ্ল্যাগ পড়ে থাকতে পারে। মানে আমি এখানে পৌঁছানোর আগেই এখানে চলে আসছে লাগেজের বিবরণ। অতএব সাধু সাবধান! বিড়ম্বনার কথা ভেবে মন খারাপ না করে আমি বরং উড়োজাহাজ টেকঅফ ও ল্যান্ডিং দৃশ্যে মনোনিবেশ করি। ওসবের চেয়ে ভ্রমণের ইতিবাচক মজা নেয়া বড় প্রয়োজন।

   

রমজানের লোকসান কাটিয়ে লাভের মুখে কুয়াকাটার পর্যটন শিল্প



কেএম শাহাবুদ্দিন শিহাব, উপজেলা প্রতিনিধি (কলাপাড়া-পটুয়াখালী)
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের লীলাভূমি পর্যটন নগরী কুয়াকাটায় ছোট বড় মিলিয়ে ১৮-২০টি পেশার ব্যবসায়ী রয়েছেন, যারা পর্যটন শিল্পের ওপর নির্ভরশীল।

দীর্ঘ এক মাস রমজান উপলক্ষে পর্যটকদের উপস্থিতি ছিল না বললেই চলে। আর এতে করে অর্থনৈতিক মন্দায় পড়তে হয়েছে কুয়াকাটার পর্যটকনির্ভর ব্যবসায়ীদের। রমজানের পর এই মন্দা এবার কাটতে শুরু করেছে। এবারের ঈদ ও বাংলা নববর্ষের দীর্ঘ ছুটিতে অর্থনৈতিক লোকসান কাটিয়ে লাভের মুখে কুয়াকাটার পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।

গত কয়েক দিনের মতো মঙ্গলবারও (১৬ এপ্রিল) দীর্ঘ ১৮ কিলোমিটার সমুদ্র সৈকতের বিভিন্ন জায়গায় পর্যটকদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। সৈকতের চায়ের দোকানি থেকে শুরু করে হোটেল-মোটেলসহ অন্যান্য ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর মধ্যে ছিল ব্যস্ততার ছাপ। দম ফেলানোর সময় নেই কারোরই। যে যার মতোন করে পর্যটকদের সেবায় সময় কাটাতে দেখা গেছে।

স্থানীয় শুঁটকি মাছ ব্যবসায়ী মো. রাসেল মৃধা বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘ঈদের আগে আমার দোকানে প্রায় ১০ লাখ টাকার মাছ উঠাইছি। রমজানে বেচাকেনা না হওয়ার কারণে কিছুটা চিন্তিত ছিলাম। আলহামদুলিল্লাহ, ঈদের দিন থেকে এই পাঁচ, ছয় দিনে আমার ৫ লাখ ৫০ হাজার টাকার মাছ বিক্রি হয়েছে! মহাজন কিছু টাকা পেতো দিয়া দিছি। এখন আমি চিন্তামুক্ত’!

এ রকমই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী রাসেল মৃধার পাশাপাশি ঝিনুক দোকানদার মো. শাহিন, আচারের মো. মহিবুল্লাহ, ফ্রাইয়ের মোহাম্মদ তৈয়ব আলিসহ সৈকতের ফটোগ্রাফার মোহাম্মদ শাওন দীর্ঘ ১ মাস পর লাভের মুখ দেখতে পারায় খুশি। আনন্দিত কুয়াকাটার ব্যবসায়ীরা।

সৈকতের ফটোগ্রাফার মো. শাওন আলী বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘আমি সৈকতের ছবি তুলে জীবিকা নির্বাহ করি। একমাস আয় বাণিজ্য বন্ধ ছিল। বাচ্চাদের জন্য ঈদের কেনাকাটা তেমন করতে পারিনি। যেটুকু কিনছিলাম, অর্ধেক টাকা বাকি রেখে আসছি। আলহামদুলিল্লাহ, ঈদের দিন থেকে এখন পর্যন্ত আমি প্রায় ৯ হাজার টাকা ইনকাম করেছি। দোকানে কিছু টাকা পেতো, পরিশোধ করেছি। এখনো কয়েকজন লোক আছেন। এখন যা ইনকাম করবো, তার থেকে কিছু সঞ্চয় করতে পারবো, ইনশাল্লাহ’!

ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি ব্যস্ত সময় পার করছেন আবাসিক হোটেল এবং খাবার হোটেলের কর্মচারীরা। শতভাগ বুকিং ছিল কুয়াকাটার ১ম শ্রেণির হোটেলগুলোতে এবং ২য় শ্রেণির হোটেলগুলোতেও ৬০ থেকে ৭০ পার্সেন্ট বুকিং ছিল।

আবাসিক হোটেল খান প্যালেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খান রাসেল বার্তা২৪.কে বলেন, রমজান মাস জুড়ে হোটেল খালি ছিল। রমজানে স্টাফ বেতন ও বিদ্যুৎ বিলসহ লাখ লাখ টাকা লোকসান। তবে ঈদের পরদিন থেকেই পর্যটকের সংখ্যা ছিল অনেক। ঈদের ছুটিতে আমাদের শত ভাগ রুম বুকিং হয়েছে। এ সপ্তাহের পুরোটাই শতভাগ বুকড।

হোটেল কানসাই ইনের ম্যানেজার মো. জুয়েল ফরাজী বলেন, ‘আমার হোটেলে সিঙ্গেল, ডাবল মিলিয়ে প্রায় ২০টি রুম রয়েছে। আমি ঈদের এই চার পাঁচদিনে গড়ে প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০ হাজার করে প্রায় ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা মালিক পক্ষকে দিয়েছি। এটা আমাদের ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে সাহায্য করবে’।

কুয়াকাটার সমুদ্র সৈকত, ছবি- বার্তা২৪.কম

ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব কুয়াকাটা’র (টোয়াক) সাধারণ সম্পাদক কে এম জহিরুল ইসলাম বলেন, পর্যটকদের আনাগোনা ছিল চোখে পড়ার মতো। পর্যটননির্ভর ব্যবসায়ীদের বিক্রি বেড়েছে। সবাই এখন লাভের মুখে।

কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. মোতালেব শরীফ বলেন, ‘প্রতিটি হোটেল- মোটেলের প্রায় ৮০ শতাংশ রুম বুকিং ছিল। রমজানের ঘাটতি শত ভাগ পুষিয়ে উঠতে না পারলেও আমরা শতকরা ৭০ ভাগ সমস্যা কাটিয়ে উঠছি। এখনো পর্যটকেরা ফোনে রুম বুকিং দিচ্ছেন। আশা করি, এ সপ্তাহেই দীর্ঘ এক মাস রমজানের সময়টাতে যে লোকসান ছিল, সেটা শত ভাগ কাটিয়ে উঠতে পারবে আমাদের হোটেল-মোটেলগুলো’।

পর্যটকদের নিরাপত্তায় ট্যুরিস্ট পুলিশ, থানা পুলিশ, নৌপুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো।

ট্যুরিস্ট পুলিশ কুয়াকাটা জোনের পুলিশ সুপার মো. আনসার উদ্দিন বলেন, ‘কুয়াকাটাতে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে আসা পর্যটকরা যাতে কোনো ধরনের সমস্যার সম্মুখীন না হন, সে ব্যাপারে আমরা সর্বদা সতর্ক অবস্থায় ছিলাম। যে সব পর্যটক কুয়াকাটাতে এসেছেন, তাদের জন্য নিশ্চ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। এখানে পোশাকে এবং সাদা পোশাকেও আমাদের লোকজন দায়িত্ব পালন করছেন। কুয়াকাটার সি-বিচকে (সমুদ্র সৈকত) সুরক্ষিত রাখার জন্য এবং পর্যটকদের সার্বিক নিরাপত্তার জন্য আমরা বদ্ধপরিকর’!

তিনি আরো বলেন, ‘ইতোপূর্বে, বিচ ম্যানেজমেন্টের (সমুদ্র সৈকত ব্যবস্থাপনা) একটু সমস্যা ছিল। আমরা সেটাকে সুন্দরভাবে ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট করেছি। আমরা পুরা বিচটাকে সিসি ক্যামেরার আওতায় এনে, নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছি।

এখানে যারা স্টেক হোল্ডার রয়েছেন, আমরা তাদের সুন্দর-সুশৃঙ্খলার ভেতরে নিয়ে এসেছি। দেশি-বিদেশি সব পর্যটককে নিরাপদ ভ্রমণের নিশ্চয়তায় কুয়াকাটায় আসার আহ্বান জানাচ্ছি’! 

;

অসাধারণ এক ভ্রমণক্লান্ত দিবসের কাহিনি



অঞ্জনা দত্ত
ব্লু টেম্পলের সামনে লেখক

ব্লু টেম্পলের সামনে লেখক

  • Font increase
  • Font Decrease

অবাক লাগছে নিশ্চয়ই। দু'দুটো বিপরীতমুখী বিশেষণ দেখে! আসলেই তাই ছিল যে। শুনুন তাহলে। সাধারণত ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর নিয়ে কিছু লিখি না। তার একটি কারণ আমাদের দেশ থেকে বলতে গেলে অনেকেই বিভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে সকাল-বিকাল ব্যাংককে আসেন। শুধু ব্যাংকক শহরেই নয়, থাইল্যান্ডের সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ অগুনতি  দ্বীপে বেড়াতে যান অনেকে। এবারে দীপ্ত (পুত্র) আর মাম্পির (পুত্রবধূ) সঙ্গে সময় কাটাতে এলাম সপ্তাহ তিনেকের জন্য। এর আগে এত লম্বা সময়ের জন্য ব্যাংককে কখনো আসা হযনি। মেয়ে জামাইও আমরা থাকাকালীন তাদের পরীদের নিয়ে এলো সপ্তাহখানেকের জন্য। অনেক বছর পর এক ছাদের নিচে দুর্দান্ত সময় কাটালাম পুরো পরিবার।  

ব্যাংকক বেশ গোছানো শহর। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। তবে একেক সময় রাস্তায় ট্র্যাফিক জ্যাম বিরক্তির উদ্রেক করে। অবশ্য  যারা ঢাকা থেকে আসেন, তাঁদের জন্য এই জ্যাম কিছুই না। বলতেই হয় থাইল্যান্ডের আসল সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে সহস্রাধিক দ্বীপে। তবে সব দ্বীপই এখনো বাসযোগ্য নয়। আবার বাসযোগ্য দ্বীপের সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়। এর বাইরে রয়েছে ব্যাংককের আশেপাশেই সুন্দর ছোটো ছোটো অতুলনীয় সৌন্দর্যমন্ডিত শহর। এইরকম দুই একটা শহরে গিয়ে সবুজের সমারোহ দেখে মোহিত হয়েছিলাম।

লিখছি এখানকার দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রদেশ চিয়াংমাই শহরের কথা। চিয়াংমাই পি কে ডি’র (প্রদীপ কুমার দত্ত) সঙ্গে আগেও একবার গিয়েছিলাম। তবে সময়টা কিছুতেই মনে করতে পারলাম না। কোথায় কোথায় গিয়েছিলাম তার কতক মনে আছে, আবার কিছু কিছু জায়গার কথা মনে নেই। গোল্ডেন ট্রায়াংগেল ট্যুর এবং অনিন্দ্যসুন্দর হোয়াইট টেম্পলের কথা ভুলিনি। এবার এর বাইরে যা দেখেছি সেটি যেন রূপকথাকেও হার মানায়।

মূল প্রসঙ্গে যাওয়ার পূর্বে চিয়াংমাই সম্পর্কে দু’এক কথা না বললে অবিচার করা হবে। চিয়াং মাই নামের অর্থ হলো নতুন শহর। এটি ব্যাংককের উত্তরে সাতশত কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। আবার দেশটির সর্বোচ্চ পর্বতমালার নিকটবর্তী। নতুন শহর মানে এই নয় যে, খুব বেশি সময় হয়নি শহরটির উত্থান ঘটেছে।  চিয়াংমাই প্রাক্তন রাজধানী চিয়াং রাইয়ের উত্তরসূরি, ল্যান না- এর নতুন রাজধানী হিসাবে ১২৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মূলত গ্রীষ্মমন্ডলীয় জলবায়ু অঞ্চল। এখানে সারা বছর তাপমাত্রা উষ্ণ থেকে গরমের হলকার মতো হয়ে থাকে। ব্যাংককেও যেমন দিনের বেলায় প্রচন্ড গরম থাকে, তবে অনেক সময় বিকেল হতে হতে তাপমাত্রা কমে আসে, চিয়াংমাইতেও অনেকটা তাই। এই গরমের কারণে প্রথমদিন দিনের প্রথমার্ধে বের হইনি। শ্বশুর আর পুত্রবধূ ঘুরে এসেছিল। পরে পি কে ডি জানাল ঐসব জায়গায় আগে যখন এসেছিলাম, তখন গিয়েছিলাম। আমার অবশ্য সেসব কিছুই মনে পড়েনি। গত বছর মাম্পিরা ইংরেজি নববর্ষের ছুটি কাটাতে গিয়েছিল। ওখানে পৌঁছানোর পরপরই দীপ্ত খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে। সে এক দুঃসহ সময় গিয়েছিল, যেমন ওদের জন্য চিয়াংমাইতে, তেমনি আমাদের নিজ বাসায়। দুইদিনের মধ্যে ওরা ফিরে এলো ব্যাংককে। সে এক বিরাট ইতিহাস।

ব্লু টেম্পলের অভ্যন্তরে প্রদীপ কুমার দত্তের সেলফোনে ফ্রেমবন্দি হচ্ছেন লেখক

ব্যাংকক থেকে চিয়াংমাই যেতে আকাশপথে লাগে ষাট মিনিটের কিছু বেশি। হোটেল আগেই বুকিং দেয়া ছিল। গোল্ডেন ট্রায়াংগেল, হোয়াইট টেম্পল, ব্লু টেম্পল মিলে একটা ট্যুরের বুকিংও দেয়া ছিল। এগুলো অবশ্য মাম্পির ডিপার্টমেন্ট। ওই গুগল ঘেঁটে কয়েকটা ট্যুর কোম্পানির ট্যুর প্ল্যান দেখে কনফার্ম করে নিল। যাওয়ার তারিখ ছিল ২২ মার্চ। শুক্রবার।  দীপ্ত অফিস করে ওখান থেকেই এয়ারপোর্টে চলে যাবে। আমরা বাসা থেকে চারটা নাগাদ বের হবো। কুড়ি তারিখে পি কে ডি হৈচৈ শুরু করে দিল। চিয়াংমাই তো একবার গিয়েছি। আবার যাওয়ার কী হলো? চব্বিশ তারিখ আমার ওয়েবিনার আছে। ঠিক সময়মতো যদি পৌঁছাতে না পারি তাহলে কী হবে? 

দীপ্ত জানাল টিকেট হয়ে গেছে। আর তোমার প্রোগ্রামের অনেক আগেই পৌঁছে যাব বাসায়। এই কথায় নটরাজ হতে গিয়েও হতে পারল না পি কে ডি। নির্দিষ্ট দিনে পৌঁছে গেলাম চিয়াং মাই’তে। হোটেলে যেতে যেতে মাম্পি পি’কে ডিকে বলছিল বাবা আগামীকাল সকালে ব্রেকফাস্ট করে আমি আর আপনি বের হয়ে যাব। ওদিকে একটা মন্দির আছে। অনেকগুলো সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হবে। মা পারবেন না ( আহা বধূ মাতা এত্তো ভালো! দারুণ হবে। ব্রেকফাস্ট সেরে আর এক রাউন্ড ঘুমিয়ে নেয়া যাবে)। দীপ্ত রয়ে গেল হোটেলে। তবে প্রথমদিনের আরাম বধূমাতা তুলে নিল পরের দিন সকাল সাড়ে ছয়টায় ট্যুর বুক করে। কেমন লাগে বলুন তো? 

রাতেই রিসেপশনে বলে রাখল সাথে ক্যারি করার মতো কিছু খাবার যেন আমাদের জন্য তৈরি করে রাখে। কেননা ব্রেকফাস্ট করার সময় পাওয়া যাবে না। জীবনে মনে হয় এই প্রথম সাড়ে পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে পড়লাম কোনোরকম ন্যাকামি ছাড়া বা গাল না ফুলিয়ে। নিজেই অবাক হলাম। স্নানটান সেরে পুরো তৈরি। পি কে ডি’কে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে। গোল্ডেন ট্রায়াংগেল এবং হোয়াইট টেম্পল আগেই দেখা ছিল। ব্লু টেম্পলের নামই শুনিনি। গাড়ি ডেকে আমরা ট্যুর কোম্পানির অফিসে গেলাম। বেশ ঝকঝকে দুটো গ্রে কালারের গাড়ি দেখলাম দাঁড়ানো। শুনলাম আমরা ছাড়াও আরও দুজন যাবে এই গাড়িতে। কেমন হবে সহযাত্রী কে জানে?

ট্যুর কোম্পানি আমাদের নাম ঠিকানা পাসপোর্ট নাম্বার লিখে রাখল। শেষ পর্যন্ত বাকি দুজন এলো না৷ এর আগেই আমরা গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ি দেখেই ভোরে ওঠার কষ্ট নিমেষে কেটে গেল৷ আর ভিতরে উঠে বসার পর তো মনে হলো আহা জীবন কী সুন্দর! দশ সিট বিশিষ্ট Hiace Microbus আমাদের দেশে যেমন দেখা যায়। এতবড়ো গাড়িতে আমরা চারজন। এখানে সব গাড়িই ঝাঁ চকচকে। কোনো গাড়ি দেখলাম না গায়ে দাগ বা থোবড়ানো দেহ নিয়ে। সামনে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসলেন ট্যুর গাইড। ভদ্রমহিলার বয়স পঞ্চাশও হতে পারে,আবার ষাটও হতে পারে। মঙ্গোলীয় বর্ণের মানুষদের এই এক সুবিধে। বয়স বোঝার উপায় নেই।

প্রথমেই দু'হাত জোড় করে নমষ্কার জানালেন থাই সিস্টেমে এবং বয়স ভেদে দু'হাত জোড় করে কোথায় আঙুল রাখতে হয় ...  আর মন্দিরে গৌতম বুদ্ধকে কীভাবে প্রণাম করতে হয় তার নিয়মও বিস্তারিত বললেন। গাড়ি ছুটে চলল নখের পিঠের মতো মসৃণ রাস্তা দিয়ে। আমার তো অস্বস্তিই লাগছিল গর্ত নেই, স্পিড ব্রেকারে ড্রাইভারের অসতর্কতার জন্য গাড়ি লাফিয়ে উঠছে না...  আমাদের মাথা ঠুকে যাচ্ছে না বা হার্ড ব্রেক করতে হচ্ছে না ...  এ কেমন দেশ! এই দেশের ইঞ্জিনিয়াররা কোথায় পড়াশোনা করেছে? কী পড়েছে ওরা? ধ্যাত্তেরিকা! কোনো মানে হয় এমন রাস্তা বানানোর? ঠিকাদাররাও কেমন পানসে টাইপের। সব কাজ ঠিকঠাক মতো করে রেখেছে! 

এখানে তৈরি হয় মহামতি গৌতম বুদ্ধের মূর্তিসহ নানা নন্দন সামগ্রী
 

ঘন্টা খানেক পরে থামলাম একটা জায়গায়। ওখানে হট স্প্রিং রয়েছে। সকালে জানাতে ভুলে গিয়েছিলাম। ও হ্যাঁ, আমাদের বাড়বকুন্ডে একটা মিহি বেগে নেমে আসা উষ্ণ প্রস্রবণ আছে কিন্তু। আমাদের আগে অনেক ট্যুরিস্ট ওখানে পৌঁছে গেছেন। আর সবাই জুতো খুলে গরম জলে পা ডুবিয়ে বসে আছে। এক যাত্রায় পৃথক ফল কেন হবে? আমরাও জুতো ছেড়ে ওখানে পা ডোবাতে বসে পড়লাম। আর আমার খুব ভালো লাগে গরম জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকতে। ভাইরে ঠ্যাকায় পড়ে রে। ঠ্যাকায় পড়ে। এমনি এমনি এমন রাজসখ জন্মায়নি। পায়ের আঙুলে ক্র্যাম্পে প্রায় কষ্ট পাই। এই কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে...  বেশ কিছুক্ষণ গরম জলের তাপ নিয়ে চনমনে মুড নিয়ে উঠলাম। ট্যুর গাইড পা মোছার জন্য টিস্যু পেপার এগিয়ে দিলেন।

গরম পা নিয়ে মনে বেশ একটা উৎসব উৎসব ভাব নিয়ে আবার গাড়িতে উঠে বসলাম। এবারের যাত্রা হোয়াইট টেম্পলের দিকে। হোয়াইট টেম্পল বা বাংলায় সাদা মন্দির, এই মন্দিরকে থাই ভাষায় বলা হয় 'ওয়াট রং খুন '। এটা চিয়াং রাই প্রদেশে অবস্থিত। চিয়াং মাই থেকে এর দূরত্ব ১৮৫ কিলোমিটার। উষ্ণ প্রস্রবণ থেকে যেতে দু'ঘন্টা সময় নিল। এই সাদা মন্দিরে অনেক বছর আগে এসেছিলাম। সূর্যের আলোয় পুরো মন্দির চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছিল।

এবারে ওয়ার্কশপে গিয়ে দেখলাম কীভাবে মন্দিরের স্ট্রাকচার বানানো হয়। কয়েকটি ছবি দিচ্ছি। সাদা সিমেন্ট দিয়ে পাতলা কাঠের ওপর ডিজাইন অনুযায়ী স্ট্রাকচার বানিয়ে নেয়। কাঠের পিছনে কয়েকটি জায়গায় এক ইঞ্চি করে কেটে রাখে। যখন সিমেন্ট শুকিয়ে যায় তখন ঐ কাঠের কাটা জায়গার ওপর চাপ দিয়ে সিমেন্টের স্ট্রাকচার আলাদা করে নেয়। (ক্রমশঃ)

লেখক: কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক 

;

সাজেদুর রহমান শাফায়েত ঘুরে দেখতে চায় দুনিয়া



বেলায়েত হুসাইন
ভ্রমণপিপাসু তরুণ সাজেদুর রহমান শাফায়েত, ছবি : সংগৃহীত

ভ্রমণপিপাসু তরুণ সাজেদুর রহমান শাফায়েত, ছবি : সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

ভ্রমণপিপাসু তরুণ সাজেদুর রহমান শাফায়েত। জন্ম চাঁদপুর জেলার কচুয়া থানায় রহিমানগরের সাত বাড়িয়া গ্রামে। সে ছোট থাকতেই ঢাকায় চলে আসে তার পরিবার। সেই থেকে ঢাকায় থাকা হচ্ছে। কথা প্রসঙ্গে জানা গেল, তার বাবাও ঘুরতে বেশ পছন্দ করেন, সেই অভ্যাসটা শাফায়েত পেয়েছেন। ভ্রমণ তার বেশ প্রিয়, পড়াশোনার পাশাপাশি বেড়ানোটা তার নেশা। ভ্রমণের নেশা থেকেই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ঘুরে চলেছেন বাংলাদেশি এই তরুণ।

পাহাড় তার বেশ প্রিয়, তাই অবসর পেলেই ছুঁটে যান খোলা আকাশের নীচে পাহাড়ের বুকে; যেখানে গেলে ছোঁয়া পাওয়া যায় মেঘেদের। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ হিসেবে স্বীকৃত তাজিংডং থেকে নিয়ে কেওকারাডং, মেরাইথং ও বান্দরবানের থানচিসহ আরও বহু জায়গা ঘুরে দেখেছেন।

ট্রেইলও করেছে বহু জায়গা। হরিণমারা ট্রেইল, হামহাম ঝর্ণা, বাঁশবাড়িয়া বিলাসী ট্রেইল, মধুখাইয়া ট্রেইল, বোয়ালিয়া ট্রেইল, ছোটো কমলদেহ ট্রেইল, বড় কমলদেহ ট্রেইল, মেলখুম ট্রেইলসহ আরও অনেকগুলো- যেগুলো নেট দুনিয়ায় খুব কমই দেখা যায়, সেসব জায়গাগুলোতেও বেশ ট্রেইল করেছেন।

দেখেছেন নানারকমের ঝর্ণা, আরও গিয়েছেন বহু জায়গায়। যেমন- চাঁপাইনবাবগঞ্জ, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, মাগুরা, খুলনা, ভোলা, বাগেরহাট, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, বান্দরবান, নাটোর, যশোর, ঝিনাইদহ, বরিশাল, সিলেট, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, ময়মনসিংহ, চাঁদপুর, ফেনী ও কুমিল্লাহসহ আরও অনেকগুলো জেলা ঘুরে দেখেছেন এই তরুণ।

দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এখনও তার ভ্রমণ করা হয়নি, তবে তার ইচ্ছা দেশের বাইরে ভ্রমণে। সেক্ষেত্রে প্রথম গন্তব্য হবে বায়তুল্লাহ। প্রাণভরে দেখা মক্কা-মদিনার অলি-গলি, যে মাটির পরতে পরতে রয়েছে ইতিহাসের নানা উপাদান।

শাফায়েতের ফেইসবুকে একটা পেইজ আছে, নাম ট্রাভেল বাই শাফায়েত। সেখানে সে ভ্রমণের স্মৃতিগুলো শেয়ার করে বন্ধুদের সঙ্গে। ভ্রমণের পাশাপাশি সাজেদুর রহমান শাফায়েত ব্যবসা করেন। লিবাসুস সুন্নাহ নামে রয়েছে তার একটি পাঞ্জাবির ব্র্যান্ড, সঙ্গে রয়েছে ইলেভেন নামে আরও একটি ব্র্যান্ড। এগুলো সব তার স্বপ্নের ব্র্যান্ড, অনলাইন এক্টিভিস্ট শাফায়েতের বেশ পরিচিতি রয়েছে।

ভ্রমণ আর নিজের ব্র্যান্ডগুলো সামলে বাবার ব্যবসাও দেখাশোনা করেন। তবে তার সঙ্গে কথা বলার পর মনে হবে, মানুষটি জন্ম নিয়েছেন শুধুই ঘুরাঘুরির জন্য। তার মন-মানসিকতা সবকিছুতেই ভ্রমণের নেশা। তার ঝুঁলিতে রয়েছে ভ্রমণকালীন সময়ের নানা রোমাঞ্চকর গল্প। জয়ের নেশায় ভ্রমণের কষ্ট জয় করা এই তরুণের জীবনে সব থেকে সেরা ট্রেইল ছিলো- নিষিদ্ধ আন্ধারমানিক। যেটা বান্দরবানে অবস্থিত। যেখানে ছিলো না কোনো নেটওয়ার্ক না ছিলো কোনো ইঞ্জিন চালিত গাড়ি। পাহাড় আর জিরি পথ সেখানে। ভ্রমণপিপাসু এই মানুষটির জন্য শুভ কামনা, এগিয়ে যাক বহুদূর। শাফায়েত ঘুরে দেখতে চায় দুনিয়া নিজের চোখে।

;

ইবনে বতুতার উক্তির প্রতিচ্ছবি দুসাই রিসোর্ট!



সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

মৌলভীবাজার থেকে ফিরে: ইবনে বতুতার সেই বিখ্যাত উক্তির প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে- ‘দুসাই রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা’! ইবনে বতুতা বাঙলাকে ‘ধনসম্পদে পরিপূর্ণ নরক’ বলে অভিহিত করেছিলেন।

‘দুসাই রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা’ এলাকায় অবস্থানকালে বারবার ইবনে বতুতার সেই বিখ্যাত উক্তির কথা মনে পড়েছে। প্রাকৃতিক প্রাচুর্যে ভরা নরকের সঙ্গে তুলনা করেছেন অনেকেই।

মৌলভীবাজারে অবস্থিত পাঁচতারকা মানের দুসাই রিসোর্ট বলতে গেলে এককাঠি সরেস! কতকগুলো টিলার সমন্বয়ে গড়া রিসোর্টটির নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও নান্দনিক ডিজাইনের স্থাপনা মুদ্ধতায় মেড়ানো। পরতে পরতে লুকিয়ে রয়েছে নানান উপভোগ্য উপাদান।

নিরিবিলি পরিবেশ, পাখির কলতান বাহারি বৃক্ষরাজি, সত্যিই মোহনীয় করে তুলেছে রিসোর্টটি! কিন্তু সেবার মান ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে যারপর নাই হতাশ ভ্রমণ পিপাসুরা! ক্ষেত্র বিশেষে তিন-তারকার চেয়েও খারাপ সেবার মান। আর স্টাফদের আচরণ এবং শব্দচয়ন বলাই বাহুল্য!

১৮ ফেব্রুয়ারি (২০২৪) রাত ৯টায় যখন রুমে ঢুকছি, পিছু পিছু হাজির রুম সার্ভিসের লোক। তার হাতে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন সাইজের কাগজ। বললেন, এখানে স্বাক্ষর দিয়ে দিতে হবে। হাতে নিয়ে দেখি, তাতে রুমের মধ্যে থাকা টাওয়েলের সংখ্যা তুলে ধরা হয়েছে। অনেকটা চুক্তিনামার মতোই কিছু শর্ত জুড়ে দেওয়া-

- চেক আউটের সময় টাওয়েল বুঝিয়ে দিতে বাধ্য থাকবেন অবস্থানকারী অতিথি

টাওয়েল হারিয়ে গেলে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য, সে কথাও স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে ওই কাগজে।

আমাদের দলে প্রায় ৪০ জনের মতো সদস্য ছিলেন। প্রায় সবাই খুবই বিরক্তি প্রকাশ করলেন। এটিএন বাংলার বিশেষ প্রতিনিধি ফজলে রাব্বী খানিকটা ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, ‘দুনিয়ার আর কোথাও কোনো হোটেলে এমন দেখিনি’!

হোটেল বয়টি জবাব দিলেন, ‘আমাদের কিছুই করার নেই! কর্তৃপক্ষ যেভাবে বলেছে, আমরা শুধু হুকুমের গোলাম’! রুম সার্ভিসের ছেলেটি নাছোড়বান্দা, স্বাক্ষর না নিয়ে ছাড়লেন না। ফজলে রাব্বী খানিকটা মজা করার জন্য বললেন, ‘আপনারা কোথায় টাওয়েল রেখেছেন এনে দেখান; তারপর আমি স্বাক্ষর দেবো। না দেখে তো স্বাক্ষর দিতে পারি না’! তখন হোটেল বয়টি বাথরুম থেকে টাওয়াল এনে দেখিয়ে স্বাক্ষর নেন।

বিষয়টি নিয়ে একচোট হাস্যরস হয়ে গেল। একজন তো টিপ্পনি কেটে বললেন, ‘ভাই, সাদা কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে কী লাভ হবে! স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। তখন কেউ অস্বীকার করলে, আইনগত পদক্ষেপ নিতে পারবেন’।

বিষয়টি নিয়ে এজিএম (ফুড অ্যান্ড বেভারেজ) নাজিম সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে, তিনি প্রথমে সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করলেন। এখানে নানান ধরনের লোকজন আসে তো, তাই!

ভদ্রলোকের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাইলে দেশের বাইরে বিশাল অভিজ্ঞতার কথা জানালেন। এবার তার কাছে প্রশ্ন ছিল, বিশ্বের আর কোনো হোটেলে এমন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় কিনা! জবাবে বললেন, আমার জানামতে কোথাও নেই। এখানে মালিকপক্ষ মনে করেছে, তাই বিষয়টি রেখেছে। আমাদের কিছুই করার নেই!

দৈনিক জনকণ্ঠের স্টাফ রিপোর্টার স্বপ্না চক্রবর্তী ও বাংলাদেশ প্রতিদিনের সিনিয়র রিপোর্টার জিন্নাতুন নূর সিনথিয়া ছিলেন সেই ট্যুরের সহযাত্রী।

সিনথিয়া বার্তা২৪.কমকে বলেন, ওদের স্টাফদের ম্যানার শেখানো উচিত।

কথিত 'পাঁচতারকা' মানের 'দুসাই রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা'-র জরাজীর্ণ ছাদ 

স্বপ্না চক্রবর্তীর ব্যাগে রুমের চাবিটি পাওয়া না গেলে স্টাফদের সাহায্য নিয়ে তালাটি ভাঙা হয়। রুমের তালা ভেঙে নিয়ে নিচে গিয়ে সে কী হাসাহাসি তাদের! একজন আরেকজনের সঙ্গে চর্চা শুরু করে দেন। তাদের সেই তাচ্ছিল্য কথাবার্তা রুম থেকেই কানে আসছিল। একবার মনে হয়ে, নিচে গিয়ে কষে থাপ্পড় দেওয়া উচিত!

সিনথিয়া বললেন, রুম থেকে খাবার অর্ডার দিতে যাবো। তাদের যে শব্দ চয়ন, কোনো পাঁচতারকা হোটেলের সঙ্গে যায় না! তাদের কথাবার্তায় কোনোরকম সৌজন্যতাবোধ পাইনি। রুমের মধ্যে যে আয়না রয়েছে, সেখানে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা থাকা উচিত। এখানে সেটি অনুপস্থিত।

বাথরুমের স্পেস কোনোভাবেই পাঁচতারকা কোয়ালিটির নয়। কমোডে বসলে কনুই ঠেকে যাবে বেসিনের ফিটিংসে!

পাঁচতারকা মানের হোটেলের কমোডে দুই কনুই পর্যন্ত ফ্রি আর গোসলের সময় দুই হাত প্রসারিত করার মতো পর্যাপ্ত স্পেস থাকতে হবে। যদি কমোডো বসে কনুই পর্যন্ত ফ্রি স্পেস এবং গোসলে দুই হাত প্রসারিত না করার মতো পর্যাপ্ত জায়গা না থাকে, তাহলে সেটিকে ‘পাঁচতারকা’ সনদ দেওয়া হয় না।

লাগেজ পেতে অনেককেই অপেক্ষা করতে হয়। লাগেজ রুমে দিয়ে যাওয়ার কথা।

লাগেজ না-পেয়ে ২০ মিনিট পরে ফোন করলে রিসিপশন থেকে উত্তর এলো- ‘একটু সময় লাগতেই পারে। এতে অস্থির হওয়ার কিছু নেই’!

পরদিনও লাগেজের ক্ষেত্রে একই ধরনের অভিজ্ঞতা শিকার হতে হলো, কাউকে কাউকে। দুপুর পৌঁনে ১২টার সময় চেক আউটের পর বলা হলো, ‘আপনি লাগেজ রেখে যান। আমরা রিসিপশনে পৌঁছে দেবো’।

দেড়টার দিকেও লাগেজ পৌঁছার নাম নেই। রিসিপশনে বলেও কাজ না হওয়ায় কেউ কেউ ফিরে গিয়ে লাগেজ নিয়ে এলেন। রিসিপশন ও কক্ষগুলো ভিন্ন ভিন্ন টিলায় হওয়ায় এগুলো টেনে নেওয়া কিছু কষ্টকর। গলফকারে যাত্রী ও তাদের লাগেজ আনা নেওয়া করা হয় এক টিলা থেকে অন্য টিলায়।

মনে হলো, দেখি তো অন্য ভ্রমণকারীরা কেমন রিভিউ দিয়েছেন, নাকি আমার কপালেই মন্দ ছিল।

কথিত 'পাঁচতারকা' মানের 'দুসাই রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা'-র সোফা! গা ঘিন ঘিন করা নোংরা সোফা

মো. মোতাল্লেব নামের একজন গুগলে রিভিউয়ে লিখেছেন- তাদের সার্ভিসগুলো খুবই বাজে! খুবই খারাপ! যে আকারে হোটেলটা আছে, সেই আকারে কোনো সার্ভিস পাওয়া যায় না! অনেক টাকা নেয়, সেই টাকা অনুযায়ী খাবার-দাবার একদম বাজে! খাবারের ভেতরে কোনো সুস্বাদু না। এই হোটেলের স্টাফ যারা আছে, তারা একবারও ভালো খাবার দেয় না। রুমে অন্ততপক্ষে এক জোড়া স্যান্ডেল থাকা দরকার…’

সেই রিভিউয়ে কর্তৃপক্ষ যে রিপ্লাই দিয়েছে, তাতে আরও বেশি অবাকই হতে হলো। লেখা হয়েছে- আপনার হোটেলের অতিথি হওয়ার কোনো রেকর্ড নেই। তবে আপনার নামের একজন অতিথির ড্রাইভার আমাদের রেকর্ডে রয়েছে। আমরা অতিথি ড্রাইভারের মন্তব্যকে আমলে নিই না!

কী সাংঘাতিক! একজন ড্রাইভারকে তারা মানুষ হিসেবেই গণ্য করছেন না!

লুৎফুন নাহার লিখেছেন- রিসোর্টটা ভালো। রিসিপশনের কর্মচারীদের আচরণ খুবই খারাপ! গেস্টদের সঙ্গে বাচ্চা দেখলে তাদের মাথা খারাপ হয়ে যায়। ছোট বাচ্চাদের জন্য আলাদা পেমেন্ট দিতে হয়। পছন্দের রুম চাইলে তারা দেয় অন্য রুম।

ডা. মো. আহসান হাবিব লিখেছেন- প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভালো দেখার মতো কিন্তু রুম থেকে টাকা চুরি হয়, যেটা মেনে নেওয়া যায় না! তাই যারা দুসাইতে যাবেন, একটু চিন্তা করে যাবেন অথবা টাকা-পয়সা বাসায় রেখে যাবেন! খুবই জঘন্য অভিজ্ঞতা হইয়াছে দুসাইতে বেড়াতে এসে… জঘন্য, জঘন্য…!

আরেকজন লিখেছেন- সিলেট অঞ্চলে একটি চমৎকার সম্পত্তি (অপেক্ষাকৃত ছোট এলাকায়)। পরিবেশ ভালো। খুব স্বাভাবিক। বুফে আইটেম সীমিত (দ্য প্যালেস, গ্র্যান্ড সুলতানের মতো কাছাকাছি অন্যান্য সম্পত্তির তুলনায়)। পুলের মধ্যে নোংরা জল এবং পোকামাকড় পাওয়া গেছে। আরো সতর্ক হওয়া দরকার। স্টাফ এবং এক্সিকিউটিভদের আরো শিখতে হবে। ভালো প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। দাম প্রত্যাশার সাথে মেলে না। আমরা উপভোগ করেছি, শুধু প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে। ব্যবস্থাপনার অনেক উন্নতি প্রয়োজন। আবার দেখার আশা করি এবং উন্নতি আশা করছি।

খাবারের দাম নিয়ে অনেক আপত্তি রয়েছে। দামও আবার বেশ চড়া। রুমে থাকা খাবারের মূল্য তালিকার ওপর কাগজ কেটে নতুন মূল্য বসানো হয়েছে। বারবিকিউ চিকেন অ্যান্ড চিজ আগে ছিল ৬৬০ টাকা। তার ওপরে কাগজ কেটে ৭৯৫ টাকা করা হয়েছে। প্রত্যেকটি খাবারের ওপরেই এভাবে নতুন দরের ট্যাগ বসানো। সঙ্গে দিতে হবে, ২০ শতাংশ সারচার্জ, ১০ শতাংশ সার্ভিস চার্জ এবং ১৫ শতাংশ ভ্যাট।

হোটেল-মোটেল, রিসোর্টে মানুষ কাড়িকাড়ি টাকা খরচ করেন। শুধু পরিবেশে উপভোগ্য হলেই পেট ভরে না; পরিবেশের পাশাপাশি প্রয়োজন মানসম্মত ও আন্তরিক সেবা। সেখানে ঘাটতি হলে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেন।

দীর্ঘ মেয়াদে ভালো করতে হলে সেবার মান বাড়ানো জরুরি বলে মতামত দিয়েছেন ভ্রমণকারীরা।

;