প্রশান্ত পশ্চিম

  • মাহমুদ হাফিজ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

পর্ব ৯

সকালে উঠে দেখি গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। পূবের জানালায় সূর্যের দেখা নেই। রাস্তায় গাড়িও নেই তেমন। যে বাড়িতে এসে উঠেছি, এর পূর্বদিকে উত্তর-দক্ষিণ লম্বা রাস্তা। রাস্তা ডিঙিয়ে পূর্বদিকে তাকালে কয়েকটি ডুপ্লেক্স বাড়ি। আমাদের দেশের বাংলো প্যাটার্নের । ছাদগুলো চারচালা। করোগেট টিনের বাড়ি স্টাইলের, ওপর থেকে নিচের দিকে নামানো। শীতকালে বরফ পড়ে বলে কোন ছাদই আমাদের মতো সমান নয়, চারচালা ঘরের মতো বাঁকানো। কোন স্থপতি আমেরিকানদের এই্ বাড়ি বানানো শিখিয়েছে আল্লাহ মালুম। বাড়ির কাঠামো ভিন্ন হলেও দেখতে প্রায় একই রকম । বিস্তীর্ণ সবুজের মধ্যে এসব সাদা, ছাই বা হাল্কা খয়েরি রঙের বাড়ি নজর কাড়ে বড়। শান্ত সকালে যতোদূর চোখ যায়, সবুজের মধ্যে বাড়িগুলো আমার চোখে প্রশান্তি দেয়  সিয়াটলে দ্বিতীয় দফা ভ্রমণের এই প্রথম সকালটিতে। 

বিজ্ঞাপন

পাহাড়, টিলা ও সবুজ বনানীময় লিনউইড এলাকাটিই দৃষ্টিনন্দন। এর পেছন দিয়ে চলে গেছে ফোর ও ফাইভ ফ্রি ওয়ে।  অদূরেই মিলেছে তা আই ফাইভে। এই আই ফাইভ বা ইন্টারস্টিট ফাইভ রাস্তাটি আমেরিকার সঙ্গে মেক্সিকো ও কানাডার মতো প্রতিবেশি  দেশকে যুক্ত করেছে। মেক্সিকো সীমান্তের চুলাভিস্তা থেকে শুরু হয়ে প্রশান্ত পশ্চিমের সব উপকূলীয় শহর ছুঁয়ে কানাডার ভ্যাঙ্কুভার গিয়ে পৌঁচেছে। পথে সান্দিয়েগো, লস এঞ্জেলেস, সানফ্রানসিস্কো, স্যাকরামান্টো, ইউজিন, পোর্টল্যান্ড, সিয়াটলকে ছুঁয়ে গেছে। একটা রাস্তা দিয়ে উত্তরে কানাডায় আর দক্ষিণে মেক্সিকোয় যাওয়ার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের সড়ক নেটওয়ার্কের ঘনবন্ধনকে প্রমাণ করে।

পাকা ফল খাওয়ার লোক নেই

নিচে আসি। আস্তে আস্তে বাড়ির সবা্‌ই ওঠে। রসুইঘর থেকে শব্দ আসে: ‘ নো অনিয়ন, নিড অনিয়ন’ মানে বাড়িতে পিঁয়াজ নেই বলে। গৃহকর্তা গাড়ি বের করেন। গৃহকর্তা লা জওয়াব। বাড়িতে প্রার্থিত অতিথি। গুঁড়িবৃষ্টির সকালে আলস্য ভেঙে তাঁকে গাড়িতে বেরুতেই হয় বাজারে। বাজার বলতে চটের হাতে কাওরান বাজার বা মালিবাগ বাজার নয়, সুপার মার্কেট। এশিয়ার সঙ্গে পুঁজির প্রতাপশালী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফারাকটি চোখে লাগে। এশিয়ায় পথে ঘাটে দোকান বাজার। অনায়াস জীবনযাপনের জন্য যত্রতত্র থেকে রসদ সংগ্রহ চলে। এখানে ব্যাংকের ডেবিট ক্রেডিট কার্ড নিয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে দৌড়াতে হবে চেইন সুপারশপে।

গৃহকর্তা বাড়ির সম্মুখভাগে গ্যারাজের অটোমেটেড দরজা মোবাইল টিপে খোলেন। আস্তাবল থেকে হোন্ডা নামের ঘোঁড়াটি বের করেন। আমাকে বাজারে যাওয়ার আহবান জানালে গাড়িতে উঠে বসি। বুদ্ধিবৃত্তিক জীবন ও আলু পটল কেনার আটপৌরে সাংসারিকজীবনের মধ্যে সমতাবিধানে বাজার করাকেই জীবনের সখ হিসাবে বেছে নিয়েছি। বাজারে যাওয়ার আহবানকে তাই লুফে নিই। গৃহকর্তার ঘোঁড়াটি মসৃণ সড়ক ধরে দৌড়াতে থাকে। আবিষ্কার করি, আমাদের হোস্টের বাড়িটি পাহাড়-টিলার ওপর এক চমৎকার লোকেশনে। বাড়িটির সামনে উত্তর দক্ষিণ লম্বা রাস্তার দু’দিক থেকে বের হয়ে আশপাশের শপিং ও রিক্রিয়েশন এরিয়াগুলোতে যাওয়া যায়। দুদিক দিয়েই গাড়িতে ৪/৫ মিনিটের দূরত্ব। বাড়ি থেকে বামে গেলে পাহাড়ি ঢালু রাস্তায় দু’দিকের নয়ানাভিরাম বাড়িগুলোকে গুডবাই জানিয়ে নেমে যেতে হয় লুকাস্টওয়েতে, তারপর ফিলবার্ট রোড নামের বনানীময় এক নেইবারহুডের সড়ক। ডানে গেলে সামান্য ঢালুতে নেমে ড্যামসন সড়ক হয়ে ওঠা যায় অন্য সড়কে।  জায়গাটি পকেট মতো হওয়ায়  নিরিবিলি, শান্ত ও চাপমুক্ত।

জানালা দিয়ে আনবাড়ি

গাড়িতে উঠে বুঝতে পারি মার্কিনীদের মতোই এখানে রাস্তা গাড়ির গতি আমাদের দ্বিগুনেরও বেশি। নেইবারহুডের রাস্তাতেই তা চলে কমপক্ষে ৭০ কিলোমিটার বেগে। বড় রাস্তায় গেলে কমবেশি ১৩০ কিলোমিটার বেগ পায় গাড়ির। মোদ্দাকথা, এরা নতুন গাড়ি ব্যবহার করে, রাস্তায় ব্রেক করার প্রয়োজন হয় না তাই এই খরগোশগতি। আমি সীটবেল্ট বেঁধে তৈরি হয়ে বসি।

এশিয়ান -বিশেষ করে মসলাদার খাদ্যরসিক অতিথি  এলে গৃহকর্তা আপামর মার্কিনীদের বাজারগন্তব্য ‘কস্টকো হোলসেল’য়ে যান না, চলে যান এশিয়ান মাছ মসলা শাকসব্জি পাওয়া যায় এমন সুপারশপে। সিয়াটলে জাপানী-কোরিয়ানরা এইচ মার্কেট, এশিয়ান মার্কেট নামে এশিয়ান খাদ্যসম্ভারে এন্তার সুপারশপ গড়ে তুলেছে। ভারতীয়রাও কম যায় না। এ নগরে ভারতীয় মসলা মাছের জন্য প্রসিদ্ধি লাভ করেছে ‘ময়ূরী’নামের সুপারশপ। এতে শুধু ভারত পাকিস্তান নয়-  বাংলাদেশের মাছ, মশলা, নাড়ু, চানাচুর সবই মেলে। বাসায় এখন যেহেতু পিঁয়াজ দরকার, গৃহকর্তা স্বগতোক্তিতে বললেন-‘ময়ূরীতেই আজ যাই’। 

গৃহকর্ত্রীর সখের গোলাপ

পৌঁছে দেখি এলাহী কাণ্ড। ইচ্ছে থাকলে এখানে হয়তো মুক্তাগাছার মন্ডা, কুমারখালীর দই আর কুমিল্লার রস মালাইও মেলানো যায়। পিঁয়াজ, বিস্কুট, বেগুনসহ কিছু সবজি চটজলদি কিনে নেন গৃহকর্তা। একই পথে ফিরে আসি।  এখানে একটু বেলা করে নাস্তা খাওয়ার চল। দিনে রাতে মেইন কোর্সটি এক বা দু’বার খাওয়া হয়। দিনমান চলে শুকনো খাবার, ফলমূল।আমরা ফিরে এসে নাস্তা খাই। বৃষ্টি ধরে এলেও আকাশ মেঘমুক্ত হতে চায় না। বৃষ্টি চলে গেলে সবাই ব্যাকইয়ার্ড বা গৃহঅন্দরে হাটাহাটি করে। এ বাড়ির ব্যাকইয়ার্ডটি একটু বেশিই বড়। আমাদের হিসাবে কমপক্ষে আটকাঠা আয়তনের। সবুজ ঘাসে ছাওয়া। একপাশে গৃহকর্ত্রী জেরিনের সখের গোলাপফুলের তিনটি টব। একপাশে বুনোফুলের ঝোঁপ। বড় একটা বৃক্ষও আছে ব্যাকাইয়ার্ডে।

কাঠের সীমানা প্রাচীরে ফলভারে নত ব্লবেরি

সীমানাদেয়ালের পিছন বা পশ্চিম দিকের বাগানে থোকায় থোকায় ব্লবেরি ঝুলছে। তার শাখা বিস্তৃত হয়েছে কাষ্ঠনির্মিত সীমানা দেয়ালের ওপরে। রসভারে নত টসটসে ঘন বেগুণী রঙ ফলপ্রিয়কে হাতছানি দেয়। মার্কিনমুলুকে ট্রেসপাসিং বা অনঅধিকার প্রবেশ নাজায়েজ। বাড়ি বা জমিওলা গুলিও করে দিতে পারে। স্পর্শরহিত ফলবৃক্ষের বাগানটি এ্যাজমালি বলে তাতে সবারই অধিকার। তাই হাতছানি দেয়া রসমঞ্জুরি যদি কেউ কব্জাও করে কারও কিছু বলার কিছু । আমার গৃহবন্ধু জলি দেখি গৃহকর্ত্রীর সঙ্গে পাকাফল তুলে এ নিয়ে আনন্দে মাতোয়ারা। এতো দামি ফল যেচে বাড়ির সীমানা দেয়ালে এসে রসভার মেলে ধরেছে। হাত দিয়ে পেড়ে ফল খাওয়ার আনন্দ আলাদা। আমি দূর থেকে বলি ধুয়ে নাও। আর আল মাহমুদ এর কবিতার ভাষায় বলি ‘ তুমি যদি খাও তবে আমাকেও দিয়ো সেই ফল’ উচ্চারণ করি। মুহুর্তেই আমার হাতে চলে আসে দুয়েকটি। খেয়ে দেখি, টকমিষ্টি। বলি আরও কয়েকটি দাও। ভাবি এই ফলের নামেই বুঝি বৃটিশ ফোন কোম্পানির নাম হয়েছিল ব্লবেরি। আজকাল অবশ্য ওই নামটি কম শোনা যায়।

ব্লবেরি

বিলগেটস এর কোম্পানি মাইক্রোসফট এর পক্ষ থেকে উইন্ডোজ ১১ প্রকল্প কমপ্লিট করায় ইডেন নামে একটি দামি ড্রিংক এসেছে গৃহকর্তার নামে।  ভারমন্ট আইস সিডার। হানি ক্রিসপ। গৃহকর্তা আমাকে ও তুসুকে অফার সামান্য করে। আমরা চুমুক দিয়ে বড় মজা পাই। দামি আপেল থেকে নাকি তৈরি। সারসগলা বোতলটি দেখতেও বেশ।

দুপুর গড়াতেই সূর্য সমস্ত অভিমান ত্যাগ করে হেসে ওঠে। বাড়ির সামনে ও গৃহঅন্দর তীর্যক আলো পড়লে চারপাশ ঝলমলিয়ে ওঠে। সবুজ ব্যাকইয়ার্ড হয়ে ওঠে কাকলিময়।