লেক কিভু থেকে লেক টাঙ্গানিকার বিচে: কঙ্গো-বুরুন্ডি (পর্ব ২)
রুসিজি, কঙ্গো-রুয়ান্ডা বর্ডার: পরদিন সকাল বেলা নাস্তা সেরে কঙ্গো রুয়ান্ডা বর্ডারে চলে এলাম। জায়গাটার নাম রুসিজি-১ দুই দেশের সীমান্ত চেক পোস্ট এখানে। ইমিগ্রেশন শেষ করে রুসিজি নদীর উপরের ব্রিজ পার হয়ে রুয়ান্ডার চেকপোস্টে গেলাম। রুয়ান্ডার দিকে রাস্তা বেশ ভাল। এই দিকে পাহাড় একটু বেশি। ছোট রুসিজি নদী দুই দেশকে আলাদা করে রেখেছে।
রুসিজি একটা ছোট পাহাড়ি নদী, নদী না বলে এটাকে একটা খাল কিংবা নালা ও বলা যেতে পারে। এই নদী লেক কিভুর পানি নিয়ে লেক টাঙ্গানিকার দিকে বয়ে চলছে। লেক কিভু সাগর সমতল থেকে প্রায় পনের’শ মিটার উঁচুতে আর লেক টাঙ্গানিকা সাগর সমতল থেকে প্রায় সাতশত পঞ্চাশ মিটার উপরে। গোমা এলাকার আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের ফলে এত উঁচুতে এই মিষ্টি পানির লেকগুলো সৃষ্টি হয়েছে। এই অঞ্চলে এখনও জীবন্ত আগ্নেয়গিরি আছে।
বুকাভু থেকে রুয়ান্ডা কঙ্গো সীমান্ত রুসিজি-১ ও রুসিজি-২ চেক পয়েন্টে পনের বিশ মিনিটে যাওয়া যায়। তাই বুকাভুর বেশির ভাগ মানুষ রুয়ান্ডার কামিম্বি বিমানবন্দর দিয়ে দেশের বাহিরে যাতায়াত করে। ব্যবসায়ীক দৃষ্টিকোণ থেকে রুয়ান্ডা সীমান্তের কাছে এই বিমানবন্দর বানিয়েছে। এখান থেকে রুয়ান্ডা এয়ার যাত্রীদেরকে কিগালি নিয়ে যায়, সেখান থেকে সারা পৃথিবীর যে কোন গন্তব্যে যাওয়া যায়।
রুয়ান্ডার এই অংশের কাছেই কামিম্বি শহর। এটা একটা ছোট সীমান্ত জনপদ। বিমানবন্দর থাকার কারণে এখানে অনেক বিদেশীর আনাগোনা আছে। কঙ্গোর ভেতরে বুকাভু শহর ও তার আশেপাশে অনেক বিদেশী এন জি ও কাজ করে। তারা নিজদেশে যাতায়াতের জন্য কামিম্বি বিমানবন্দর ব্যবহার করে। বুরুন্ডির রাজধানী বুজুম্বুরার উদ্দেশ্যে যাওয়ার জন্য আমরা একটা ট্যাক্সি ঠিক করলাম। ট্যাক্সি ড্রাইভারের বাড়ি কামিম্বি শহরে। আমরা ট্যাক্সিতে করে বুজুম্বুরা যাব একরাত সেখানে থেকে পরদিন আবার রুসিজি -১ চেকপোস্টে ফিরে আসব। যাওয়ার পথে একটু ঘুরে রুয়ান্ডার কামিম্বি শহরেটা দেখে যাব।
ইমিগ্রেশন ফর্মালিটিজ শেষ করে ট্যাক্সিতে করে রওয়ানা হলাম। পাহাড়ি পথে আমরা চলছি। পাহাড়ের গা বেয়ে আঁকাবাঁকা পথ পাহাড়ের চূড়ার দিকে উঠে গেছে। পাহাড়ের পর পাহাড় ডিঙ্গিয়ে এই রাস্তা বুরুন্ডির দিকে চলে গেছে । দশ মিনিট চলার পর আমরা কামিম্বি শহরে পৌঁছালাম। যে কোন সাধারণ মফস্বল শহরের মত শহর। ব্যাংক, দোকানপাট সবই আছে এখানে। বিদেশী জিনিসপত্র পাওয়া যায় এখানে। রুয়ান্ডা এখন ফ্রেঞ্চ ভাষা বাদ দিয়ে ইংরেজির দিকে জোর দিয়েছে। আমাদের ড্রাইভার কিন্তু ইংরেজি বোঝে না। অল্প অল্প ফ্রেঞ্চ ভাষা জানা থাকাতে তার সাথে মাঝে মাঝে কিছু কথা বলা যায়।
রুয়ান্ডার এই অঞ্চলে বেশ কয়েকটা মসজিদ দেখলাম, আমাদের ড্রাইভার ও মুসলিম, সে এখানকার অনেক মানুষকে চেনে। কামিম্বি শহরে দেখার কিছু নেই। শহরে প্রাণকেন্দ্রে রাস্তার মোড়ের আইল্যান্ডে একটা বড় ঘড়ি সময় জানিয়ে দিচ্ছে। এখানে ট্রাক, বাস ট্যাক্সি সবই পাওয়া যায়। বিমান বন্দরের কারণে প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই শহরটাতে বেশ প্রাণ চাঞ্চল্য দেখা যায়। এখানে কিছুক্ষণ থেকে আবার আমরা বুজুম্বুরার পথে রওয়ানা হলাম। রুসিজি ১ থেকে বুজম্বুরা প্রায় ১২৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৪০ কিলোমিটার রুয়ান্ডাতে আর বাকী পথ বুরুন্ডির ভেতরে। রুয়ান্ডার ভেতর রাস্তা পাহাড়ি হলেও বেশ সুন্দর এবং উন্নত।
রাস্তা থেকে নীচে পাহাড়ের উপত্যকাতে মাঝে মাঝে ঘরবাড়ী দেখা যায়। পাহাড়ের মাঝের পথ দিয়ে রুসিজি নদী একে বেঁকে লেক তাঙ্গানিকার দিকে চলছে। এদিকে গ্রাম অঞ্চল, মানুষজন মাঠে কাজ করছে কেউবা ঘরে ফিরছে। হাঁটা কিংবা সাইকেলেই তাদের যাতায়াত। আনায়াসে পাহাড়ি পথে তারা তাদের গন্তব্যে চলছে। মাঝে মাঝে কয়েকজন হাত দিয়ে ট্যাক্সিতে লিফট নিতে চাইছে এরা ট্যাক্সি কিংবা মাইক্রোতে করে আশেপাশের জনপদে যাবে। বুরুন্ডি সীমান্তের কিছু আগে ড্রাই ভার একটা ছোট শহরের মানি এক্সচেঞ্জে গাড়ি থামাল। আমরা নেমে একটু হাঁটাহাঁটি করলাম। মানুষজন বেশ বন্ধুভাবাপন্ন, ভালই লাগল। এক ঘণ্টা চলার পর আমরা রুয়ান্ডা বুরুন্ডির সীমান্ত জনপদ রুয়া বর্ডারে পৌঁছে গেলাম।
রুয়া এলাকায় রুয়ান্ডা সরকার নিজ খরচে সুন্দর বর্ডার চেকপয়েন্ট বানিয়েছে। এখানে রুয়ান্ডা আর বুরুন্ডির পতাকা বাতাসে খেলা করছে। দুদেশের কাস্টম ও ইমিগ্রেসান অফিসারদের জন্য পাশাপাশি ডেস্ক, কাঁচের পার্টি শান দিয়ে আলাদা। ব্যাঙ্কের জন্য ও জায়গা করা আছে। ফর্ম ফিলাপ করার জন্য চেয়ার টেবিল আছে। হাত মুখ ভিজিয়ে নেয়ার জন্য পরিস্কার টয়লেট আছে দুইদিকেই। একটু দূরে কাস্টম ও ইমিগ্রেসান অফিসারদের জন্য বাংলো বানানো হয়েছে। এই কমপ্লেক্সে সব ধরনের সুবিধা আছে। এলাকাটা চারিদিকে দেয়াল দিয়ে ঘেরা। দুই দিকে সীমান্তের প্রহরাতে পুলিস আছে।
আমাদের পাসপোর্ট চেক করে দেখল রুয়ান্ডার পুলিশ। তারপর পারকিং লটে গাড়ি পার্ক কাস্টম ও ইমিগ্রেসান অফিসের ভেতরে গেলাম। মানুষজন তেমন নেই। দু একটা গাড়ি আছে, সেগুলোর মানুষজন ফর্ম ফিলাপ করে কাউনটারে জমা দিচ্ছে। আমাদের পাসপোর্টে রুয়ান্ডার এক্সিট সিল দিয়ে পাশের বুরুন্ডির অফিসারকে এগিয়ে দিল। অফিসার পাসপোর্ট দেখে আবার বুরুন্ডির এন্ট্রি সিল দিয়ে দিল। কাজ শেষে আবার আমরা পথে নামলাম। এখান থেকে বুরুন্ডি ৮০ কিলোমিটার।বুরুন্ডির রাস্তা উপত্যকার মধ্যে, দূরে অনেক উঁচু পাহাড়ের সারি যেন মেঘের সাথে মিশে আছে।দুপাশে ফাঁকা তৃণভূমি, মাঝে মাঝে ঝোপ গাছ। কিছু কিছু চাষ হয় এই মাঠে।
পথের এক জায়গাতে তুলার ক্ষেত, অনেক এলাকা নিয়ে সাদা হয়ে আছে সারা মাথ।মানুষজন মাঠে কাজ করছে, সাইকেল এখানকার অন্যতম বাহন, মাঝে মাঝে মোটর সাইকেল ও গাড়ি দেখা যায়। রাস্তার অবস্থা বেশী ভাল না তবে চলাচল করা যায়।পথের পাশে হঠাৎ এক জায়গাতে অনেক এলাকা জুড়ে বিশাল ক্যাকটাসের বন। রুয়ান্ডার পথে এধরনের দৃশ্য দেখা যায়নি। রাস্তা মাঝে মাঝে চড়াই উৎরাই পেরিয়ে চলছে। নীচে রুসিজি নদী মাঝে মাঝে এঁকে বেঁকে চলছে দেখলাম। কিছু জায়গাতে বেশ স্রোত ও আছে এই ছোট নদীতে।
এরপর রাস্তার দুপাশে অনেক অর্ধসমাপ্ত ঘরবাড়ী দেখলাম ।বাড়ীগুলো বানানো প্রায় শেষ কিন্তু জানালা দরজা লাগানো হয়নি, কেউ সেখানে থাকে না। এর থেকে একটু দূরে ছোট গ্রামের কুঁড়ে ঘর দেখা যায়, হয়ত ভবিষ্যতে গ্রামের মানুষ এসব ঘরে থাকবে। রাস্তার পাশে ছোট ছোট জনপদ আছে। খুব সাধারণ মানের ঘরবাড়ী, মানুষ জন সরল জীবন যাপনেই অভ্যস্ত। মসজিদ দেখলাম কয়েকটা, সীমান্তের এই দিকে মুসলিম জনবসতি আছে বেশ কিছু।
বুজুম্বুরার কাছে রাস্তার মান একটু ভাল, প্রায় ঘন্টা খানেক আমরা খারাপ রাস্তায় চলেছি। শহরের বাহিরে বুজুম্বুরা বিমানবন্দর। এই বিমানবন্দর দিয়ে ও বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মী এবং এন জি ও কর্মীরা আশেপাশের দেশে যাতায়াত করে। আমরা শহরের ভেতরে ঢুকে গেলাম। রাস্তা বেশ খোলামেলা, ট্রাফিক জ্যাম তেমন নেই শহরের এই অংশে। শহরের ভেতরের রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে আমরা ডাউন টাউনে চলে এলাম। এর পাশেই মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা। আমাদের ড্রাইভার ও রুয়ান্ডিজ মুসলিম। শহরে মোটামুটি ট্রাফিক জ্যাম আছে। দুপুর হয়ে গেছে, আমরা একটা হোটেলে এলাম। মোটামুটি থাকা যায়। হোটেলে ব্যাগ রেখে আবার পথে বের হলাম।
বুজুম্বুরা শহরে অনেক মানি এক্সচেইঞ্জ আছে, হোটেল থেকে বের হয়ে বেশ জ্যামে পড়লাম। তারপর বড় একটা বাজার এলাকাতে এলাম। এখানে প্রচুর ফল ও তাজা সবজি পাওয়া যায়। গাড়ি পার্ক করে আমরা টাকা বদলে নিলাম। ডলারের বিনিময়ে প্রায় ১৬৫০ ফ্রা পাওয়া গেল। মোটামুটি জমজমাট শহর। মানুষজন তাদের নিত্য দিনের কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত। আমরাও দেরি না করে টাঙ্গানিকা লেকের উদ্দেশে রওয়ানা হলাম।
চলবে......