বাংলাদেশকে জানার সুযোগ তৈরি করছে জেলা ব্র্যান্ডিং
‘পদমদীতে (রাজবাড়ী) বসে কালজয়ী উপন্যাস বিষাদসিন্ধু রচনা করেছেন মীর মশাররফ হোসেন। এটা আমাদের রাজবাড়ীর অনেকেই জানেন না। নিজের জেলাকে ভালো করে না জানার এমন অনেক উদাহরণ পাওয়া যাবে।’
জেলা ব্র্যান্ডিং আমাদের দেশটাকে জানার সুযোগ তৈরি করবে। প্রত্যেকটি জেলার রয়েছে ভিন্ন রকম আকর্ষণ, ভিন্ন রকম ভূ-প্রকৃতি, জীব-বৈচিত্র্য ও সংস্কৃতি, রয়েছে নানা রকম লোভনীয় খাবার। এগুলো তুলে ধরা হয়েছে জেলা ব্র্যান্ডিংয়ে। সবাই যখন জেলাগুলো সম্পর্কে ভালোভাবে জানবে তখন একেকজন বিউটিফুল বাংলাদেশের দূত হয়ে উঠবে বলে মনে করেন পর্যটন করপোরেশনের চেয়ারম্যান রামচন্দ্র দাস।
জেলা ব্র্যান্ডিং যেমন দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে। একইসঙ্গে পযর্টনের সম্ভাবনাময় সময়ে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যটক বেড়ে যাবে বলে মনে করেন পর্যটন করপোরেশনের চেয়ারম্যান।
জেলা ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য সরকার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের রেজুলেশন গ্রহণ করে। প্রত্যেক জেলার পৃথক লোগো ও ট্যাগ লাইন রাখার সিদ্ধান্ত হয়। লোগো-ট্যাগ লাইনের ক্ষেত্রে জেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, জীব-বৈচিত্র্য ও ঐতিহ্যবাহী খাবারকে তুলে ধরার নির্দেশনা জারি করা হয়। যাতে করে প্রত্যেকটি জেলার স্বকীয়তা তুলে ধরা যায়। নির্দেশনা অনুযায়ী প্রত্যেক জেলায় পৃথক লোগো এবং ট্যাগ লাইন নির্বাচন করা হয়েছে।
চাঁদপুর জেলার ব্র্যান্ডিংয়ে শাপলা পাতায় ইলিশ ও কুঁড়ি দিয়ে খচিত লোগোতে ট্যাগলাইন নির্ধারণ করা হয়েছে ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর। নদী বেষ্টিত উপকূলীয় জেলা বরগুনার লোগোতে ঠাঁই পেয়েছে হরিণের চারণভূমি, নদী, নৌকা, সূর্যোদয়, মাছ ও নারিকেল জিঞ্জিরা। ট্যাগ লাইন করা হয়েছে সৈকত সৌন্দর্যে বরগুনা।
এরমধ্যে ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর অল্পদিনেই ব্যাপক পরিচিত লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। সুস্বাদু ইলিশের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ এই জেলা এরই মধ্যে পর্যটকদের টানতে শুরু করেছে। বর্তমান প্রজন্ম অনেকেই দলবেঁধে ছুঁটে যাচ্ছেন চাঁদপুরে ইলিশের স্বাদ পরখ করতে। অনেকে আবার মাছের স্বাদ নেওয়ার পাশাপাশি জেলেদের সঙ্গে মাছ ধরার কৌশল জানতে নৌকায় রাত্রিযাপন করছেন।
ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠান এক্সিলেন্স এশিয়ার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবি সিদ্দিক টিটো বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর ট্যাগলাইনে ব্যাপক সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়েছে। অনেক পর্যটক ছুটছেন এই জেলা সফরের জন্য। বিদেশি পর্যটরকরা আগ্রহী হয়ে উঠছেন। এটা ট্যুরিজমের জন্য খুবই ভালো ইঙ্গিত বহন করে।
জেলা ব্র্যান্ডিংয়ের ধারণাটি খুবই চমৎকার উদ্যোগ উল্লেখ করে টিটো বলেন, অন্য জেলাগুলো তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি। জেলা ব্র্যান্ডিংয়ের সুফল ঘরে তুলতে হলে সচেতনতা বাড়াতে হবে। প্রয়োজন ব্যাপক প্রচারণা। শুধু লোগো-ট্যাগলাইন নির্ধারণ উন্মোচন করে দায় সারলে এর থেকে ভালো ফল পাওয়া যাবে না।
তিনি বলেন, অভ্যন্তরীণ ট্যুরিজম অনেক বেড়েছে। ফেসবুক এবং ইউটিউব কেন্দ্রিক ট্যুরিজমে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তনকে আরও একটু ঘষামাজা করতে পারলে দারুণ ফলদায়ক হতে পারে।
বাংলাদেশের প্রায় সব বিষয়েই পক্ষে-বিপক্ষে মত থাকলেও জেলা ব্র্যান্ডিংকে সব পক্ষই স্বাগত জানিয়েছে। তবে লোগো-ট্যাগলাইন নির্ধারণ পরবর্তী প্রচারণাকে যথাযথ মনে করছেন না অনেকেই। তারা মনে করছেন, অনেক জেলায় দায়সারা গোছের ব্র্যান্ডিং হয়েছে। নিজের জেলার বাইরে ছড়িয়ে দিতে পারছে না। এ জন্য প্রচারণা বাড়ানো দরকার। না হলে ভালো ফলের জন্য কয়েক যুগ অপেক্ষায় থাকতে হতে পারে।
জেলা ব্র্যান্ডিং প্রসঙ্গে বরগুনার জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, আমরা জেলা ব্র্যান্ডিংকে ব্যাপকভাবে পরিচিত করার জন্য নানামুখী কার্যক্রম হাতে নিয়েছি। লোগো-ট্যাগলাইন রি-প্রিন্ট করা হচ্ছে। লিফলেট হ্যান্ডবিল, বিলবোর্ড তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সভা-সমাবেশে ব্র্যান্ডিংকে তুলে ধরা হচ্ছে। আশা করছি সৈকত সৌন্দর্যে বরগুনা দারুণ সাড়া ফেলবে। আর এই জেলার লোকজন খুবই অতিথি পরায়ণ। কেউ ঘুরতে এলে তারাও মুগ্ধ হবেন।
ট্যুর অপরেটরদের সংগঠন টোয়াব’র ডিরেক্টর ও পাটা (প্যাসিফিক এশিয়া ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশন) বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের সেক্রেটারি জেনারেল তৌফিক রহমান বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, জেলা ব্র্যান্ডিং করাটা খুবই জরুরি। সঠিকভাবে করতে পারলে দেশে এবং দেশের বাইরে প্রমোট করা সহজ হবে। ট্যুর অপরেটররাও সেভাবে মার্কেটিং প্ল্যানিং করতে পারবেন।
তবে এটা যেনতেনভাবে করলে চলবে না, পুরোপুরি প্রফেসনালি করতে হবে। ট্যুরিজম বোর্ডকে মিডিয়া হিসেবে কাজ করতে হবে। ট্যুরিজম বোর্ডের সঙ্গে জেলাগুলো সমন্বয় থাকা দরকার। জেলা প্রশাসনে ট্যুরিজমের জন্য দায়িত্বশীল কর্মকর্তা থাকা প্রয়োজন। এটা করা গেলে ভালো ফল পাওয়া যাবে বলে মনে করেন তৌফিক রহমান।
বাংলাদেশে পর্যটনের আকর্ষণের সাধারণ কয়েকটি ভাগ রয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, পাহাড় ও দ্বীপ, বন ও জলাবন, সমুদ্র সৈকত ও ঐতিহাসিক স্থান। জাতির পিতার সমাধিসৌধ, জাতীয় কবির সমাধিসৌধ, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ, কার্জন হল, বলধা গার্ডেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, পুরাতন হাইকোর্ট ভবন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাধি, সাগরদাড়ি, মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ, ত্রিশাল, গান্ধী আশ্রম, রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজড়িত শিলাইদহ কুঠিবাড়ীসহ অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনা রয়েছে।
প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনেও পিছিয়ে নেই বাংলাদেশ। সারা দেশজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে হাজারো নির্দশন। যা প্রত্নতত্ত্ববিদদের কাছে ভীষণ প্রিয়। লালবাগ কেল্লা, মুঘল ঈদগাহ, আহসান মঞ্জিল, পাহাড়পুর, কান্তজির মন্দির, মহাস্থানগড়, ষাট গম্বুজ মসজিদ, সোনারগাঁও, উয়ারী বটেশ্বর ও ময়নামতি উল্লেখযোগ্য ৷
পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের গর্বিত মালিকও বাংলাদেশ। ১২০ কিলোমিটার বিস্তৃত কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের পাশাপাশি পতেঙ্গা, টেকনাফ, সেন্টমার্টিন দ্বীপ, কুয়াকাটা, কটকা, কচিখালী একেকটি সৈকত আরেকটির চেয়ে সুন্দর ও জীব-বৈচিত্র্যময়।
দেশের উত্তরাঞ্চলে যেমন চোখ জুড়ানো সমতল ভূমি। তেমনি উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে রয়েছে বিশাল হাওড় ও পাহাড়ের মিতালি। আবার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে পাহাড় লেকের গলাগলি। বান্দরবান, খাগড়াছড়ি জেলার বিভিন্ন পর্যটন স্পট, রাঙামাটির কাপ্তাই লেক, কক্সবাজারের মহেশখালী, সুন্দরবন, টাঙ্গুয়ার হাওড়, বিছানাকান্দি, রাতারগুল জলাবন, সোনাদিয়া দ্বীপে দিন দিন আগ্রহ বাড়ছে দর্শনার্থীদের।
এ ছাড়া জাতীয় সংসদ ভবন, বঙ্গভবন, রমনা পার্ক, জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান, মাধককুণ্ড, জাফলং, সিলেট অঞ্চলের চা বাগান, বাইক্কা বিল, লাউয়াছড়া, সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান দেশ-বিদেশে মুগ্ধতা ছড়িয়ে যাচ্ছে।