‘গলা কাটা পাসপোর্ট’ আর ‘নীতি ভ্রষ্ট নেতা’র রাজনীতি

  • স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

'গলা কাটা পাসপোর্ট’ আর ‘নীতি ভ্রষ্ট নেতা’র রাজনীতি। ছবি: সংগৃহীত

'গলা কাটা পাসপোর্ট’ আর ‘নীতি ভ্রষ্ট নেতা’র রাজনীতি। ছবি: সংগৃহীত

ডিজিটাল হওয়ার আগে পাসপোর্টের কথা মনে আছে? সেটা ছিল সত্তর ও আশি দশকের ঘটনা। বিদেশ থেকে একজনের নামে ভিসা বা ওয়ার্ক পারমিট এলে পাসপোর্টের গলা থেকে মুণ্ডুটুকু কেটে বদল করে আরেক জনকে পাঠিয়ে দিত আদম ব্যবসায়ীরা। এই রকম ‘গলা কাটা পাসপোর্ট’ নিয়ে বহু মানুষ ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যে চলে গেছে।

ডিজিটাল যুগে এমনটি আর সম্ভব হচ্ছে না। তবে রাজনীতিতে ‘গলা কাটা পাসপোর্ট’-এর আদলে ‘নীতি ভ্রষ্ট নেতা’ এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাওয়ার মতো এক দল থেকে আরেক দলে আসা-যাওয়া করছে। কোনো আইন বা নীতিবাক্য তাদের এই স্বার্থবাদী যাতায়াত বন্ধ করতে পারছে না।

বিজ্ঞাপন

নির্বাচনের আগে উৎসবের মতো এমনটিই হচ্ছে বাংলাদেশে। বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা ও জয়ের পদতলে ছবি দিয়ে পোস্টার ছাপানো লোকটিই গলা বা মুণ্ডু বদল করে জিয়া, খালেদা ও তারেকের পদতলে ঠায় নিয়েছে। জাস্ট সিনেমার পোস্টারের পাত্র-পাত্রী বদলের মতো। নায়ক বা ভিলেন বদল করে যেন একই সিনেমা চলছে বাংলাদেশে। আর দর্শক বোকার মতো সে ছবি দেখছে।

পার্থক্য হলো, এই বদল সিনেমার পর্দায় নয়, বাস্তব রাজনীতির জীবনে। একই ব্যক্তি আজ মীরজাফর তো কাল ক্লাইভের চরিত্রে অভিনয় করে চলেছে বাস্তব রাজনৈতিক জীবনে।

বিজ্ঞাপন

সিনেমা বা রূপকথাকেও হার মানানো অভিনয় চলছে এখন বাংলাদেশের সমাগত নির্বাচনকে সামনে রেখে। এমপির নমিনেশন পাওয়ার জন্য দল, চরিত্র, আদর্শ বদল করা হচ্ছে জামা, জুতার মতো। প্রয়োজন মতো সকালে মুজিব কোট পড়ছে বা সেটা খুলে বিকালে জিয়া ও এরশাদের প্রিয় পোশাক সাফারি গায়ে দিচ্ছে। লোক-লজ্জা, আর্দশ, নীতি এসব তুচ্ছ করে এদের চরম বেহায়াপনায় রাজনীতি দূষিত হয়ে গেছে। এবং এরাই টাকা বা শক্তি দিয়ে এমপি হয়ে জনতার মাথার উপর সওয়ার হওয়ার জন্য রণ হুঙ্কারে মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।

এদের নাম উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। এদের নাম একটি নয়, একাধিক। টিভি টক শো যারা দেখেন বা বাংলাদেশের রাজনীতির খবর যারা রাখেন, তারা এদেরকে চেনেন। কে কবে কি বলেছিল, আজ কি বলছে, সেটাও জানেন। কে কোন কোন রাজনীতি ও দল বদল করে এখন কোথায় এসেছে সেটাও মানুষের অজানা নয়। ‘চোরের মার বড় গলা’র মতো এরা কতো কথাই না চিৎকার করে বলেছে। আর এখন কাজ করছে কথাগুলোর ঠিক উল্টা! চোখের পর্দা বা জিহ্বার লাগাম বলে এদের কিছু নেই।

তাহলে এদের কি আছে? তাদের আছে ক্ষমতার উন্মাদনা। টাকা ও শক্তির মোহ। কেন এরা মোহগ্রন্থ? কারণ, এরা রাজনীতির মাঠে বিনাশ্রমে অনেক কিছু পেয়েছে। রাজনীতি করেই সেটা ধরে রাখতে হবে তাদেরকে। ফাউল করলে লাল কার্ড দেখিয়ে খেলার মাঠ থেকে বের করে দেওয়া যায়, দুই নম্বরী করলে রাজনীতিতে তো আর কার্ড দেখানো যায় না! মনে হয় এদেশের রাজনীতিতে এই স্বার্থবাদী গোষ্ঠীকেও কার্ড দেখানোর প্রয়োজন এসে গেছে।

কার্ড দেখানোর প্রয়োজন রাজনীতিতে কেন এসেছে, এর কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ফরিদপুরের গামছাওয়ালার ছেলে পটুয়াখালীতে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছে ‘গলা কাটা পাসপোর্ট’র মতো ‘নীতি ভ্রষ্ট’ রাজনীতি করে। একই পথে টাঙ্গাইলের বীর বাহাদুর ব্রিজ, রাস্তা, দালান গিলে খেয়েছে। বৃহত্তর নোয়াখালীর প্রত্যন্ত লক্ষ্ণীপুরের চরের বাসিন্দা মহাঘোষক পৃথিবীর সবশ্রেষ্ঠ বিরোধী দলের নেতা সেজে টাকার বটগাছ হয়েছে। বগুড়ার ছদ্ম-বামপন্থী ‘গলা কাটা পাসপোর্ট’ আর ‘নীতি ভ্রষ্ট নেতা’র আর্দশ স্বরূপ ঐক্য ঐক্য বলে চেঁচিয়ে মতাদর্শে নয়, টাকায় লাল হয়েছে। এমন উদাহরণ একটি নয়, বহু।

নির্বাচনের আগে ভাগাড়ের উচ্ছিষ্টভোগীদের দাপট দেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি মোক্ষম কথা বলেছেন। তিনি নীতিহীনদের জন্য মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবাদী দলের দরজা চিরতরে বন্ধ ঘোষণা করেছেন। কিন্তু তাই বলে তো এদের গতায়ত থামানো যায় নি। ‘মানি ইজ নো প্রব্লেম’ বলে বাংলাদেশের রাজনীতিকে কলুষিত করেছিলেন যিনি, তার দল ফুল, চন্দন দিয়ে এদের বরণ করে নিয়েছে। নির্বাচনে জয় হোক না হোক, এদের মতো বিকৃত আর কালা-টাকাওয়ালাদের সঙ্গে দহরম-মহরম করে নেতা-পাতি নেতারা নিজের পকেট ভরে নিয়েছে। নেত্রী জেলে, উপ-নেতা ফেরারী তো কি হয়েছে, দলের সাইন বোর্ড ও প্যাডবাহীদের ব্যক্তিগত লাভের রাজনীতি ঠিকই পোয়া বারো।

মনোনয়ন বাণিজ্যের কতো খবর মিডিয়ায় আসছে এখন। প্রতিনিয়ত দল ও নীতি বদলের রোমাঞ্চকর তথ্য বের হচ্ছে বাংলাদেশে। অবৈধ সম্পদ, কালো টাকা ও পেশী শক্তির অধিকারীরা মনোনয়ন হাসিল করে একদল লাঠিয়াল নিয়ে মাঠে নেমেছে। জয় না হলেও মাঠে থাকা তাদের জন্য জরুরি। রাজনীতির একটি টিকেট নিয়ে দলবলসহ এদেরকে সরব থাকতে হচ্ছে অবৈধভাবে কামাই করা টাকা ও সম্পদ রক্ষা করার প্রয়োজনে। মিঠা মিঠা নীতি কথা বলা আন্তর্জাতিক লুটেরার আইনজীবী মহাশয় প্রবীণ বয়সে এদেরকে রাজনৈতিক বৈধতা দেওয়ার ওকালতনামায় স্বাক্ষর করেছেন। এহেন বয়েসী ও অবসরপ্রাপ্ত রাজনীতিবিদ তথা ঘাগু আইনজীবীর ব্যাঙ্ক একাউন্টেও টাকার স্রোত বইয়ে চলার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে।

গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য নিয়ম ও সময় মতো নির্বাচন হতেই হবে। কিন্তু এ নির্বাচনী সুযোগকে কালোকে সাদা করার, অবৈধকে বৈধ করার মতলব হিসাবে ব্যবহার করছে কোনো কোনো দল, নেতা ও চিহ্নিত ব্যক্তিবর্গ। আদর্শের হাওয়াই-চাদরের নিচে এমন ভেলকি দেখালে ‘গলা কাটা পাসপোর্ট’-সদৃশ্য ‘নীতি ভ্রষ্ট নেতা’গণের রাজনৈতিক দৌরাত্ম্যের কবল থেকে দেশ ও জাতি রক্ষা পাবে না। সাম্প্রদায়িকতা, মানবতা বিরোধী অপরাধ, জঙ্গিবাদ ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের লুটপাটে বিরুদ্ধে জাতি যেভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, সেভাবেই কালোটাকা ও ভ্রষ্টদের বিরুদ্ধে এক হতে হবে। নইলে নির্বাচনী রাজনীতির সুযোগে এই অপশক্তি গণতন্ত্রের বারোটা বাজাবে।

কারণ গণতন্ত্র মানে অবশ্যই সুষ্ঠু নির্বাচন, যা অবৈধ ও ভ্রষ্টদের উচ্ছেদের মাধ্যমে জনশক্তির বিজয়ের পথ ধরে পরিপুষ্ট হয়। গণতন্ত্র মানে যেমন সুষ্ঠু ভোটাধিকার, তেমনি গণতন্ত্র মানে আদর্শিক প্রার্থীও। প্রার্থী হবে ভ্রষ্ট ও অবৈধ পথে সম্পদ অর্জনকারী আর জনগণের ভোট হবে সুষ্ঠু, তাতে গণতন্ত্র সফল হয় না। একদিকে সুষ্ঠু ভোট এবং অন্যদিকে সুষ্ঠু-আদর্শবাদী প্রার্থী হলেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে, যা গণতন্ত্রের জন্য সহায়ক। ব্যক্তির লুণ্ঠন বন্ধ করে জাতীয় উন্নয়নের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে হলে জনগণের ভোটের শক্তিতে ‘গলা কাটা পাসপোর্ট’র আদলে ‘নীতি ভ্রষ্ট নেতা’দের সমূলে উৎপাটিত করতে হবে।

বাংলাদেশের তরুণ, মেধাবী, পরিশ্রমী, শিক্ষিত নতুন প্রজন্মের ভোটারদের সামনে সুযোগ এসেছে নিজেদের গণতান্ত্রিক ভাগ্য ও উন্নয়নমুখী ভবিষ্যত দৃঢ়তর করার জন্য অবৈধ ও ভ্রষ্টদের পদানত করার। প্যারাসাইট বা পরজীবীর মতো সম্পদ শোষণকারী রাজনৈতিক ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়াগুলোকে ভোটের কামান দেগে উড়িয়ে দিতে হবে বঙ্গোপসাগরের অতলান্ত জলরাশিতে। একবিংশ শতকের স্বচ্ছ, উন্নত, ও সম্মানজনক বাংলাদেশের রূপকল্প বির্নিমান করতে হলে আসন্ন নির্বাচনে এই অপশক্তিকে ভোটের মহাশক্তিতে প্রতিহত করার মাধ্যমেই তা সফল করা সম্ভব হবে।