বিপন্ন বিশ্বে ‘সার্বজনীন মানবাধিকারে’র ৭০ বছর

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে টিভি, কম্পিউটারের পর্দায় ভেসে আসছে আতঙ্কের ছবি। শোনা যাচ্ছে গুলির শব্দ, বোমা বর্ষণের লাইভ। দেখা যাচ্ছে পঙ্গপালের মতো মানুষ ছুটে বেড়াচ্ছে। এক দেশ থেকে নানা দেশে শরণার্থীরা পালাচ্ছে।

এখানেই শেষ নয়। তারপর সারি সারি লাশ ও বীভৎসতার স্টিল ছবিতে প্রতিদিনের অনলাইন, অফলাইন, প্রিন্ট মিডিয়া ভরে যাচ্ছে। মানবতার তন্ত্রীতে বাজছে বিনাশের করুণ সুর।

বিজ্ঞাপন

মানবতা ও মানবাধিকারে চরম পতনে মনে পড়ে ঐতিহাসিক একটি কবিতা:

‘আমি এখানে কাঁদতে আসিনি,
যেখানে ওরা
মুখ থুবড়ে পড়েছে।
তোমরা যারা বেঁচে আছো,
আমি শুধু তাদের সঙ্গেই
কথা বলতে এসেছি।
বৃক্ষহীন সমতল থেকে দ্বীপপুঞ্জ পর্যন্ত
অনেক অনেক মানুষকে খুন করা হয়েছে
আমাদের এই মৃতদের নামে আমি দাবি করছি শাস্তি।’

বিজ্ঞাপন

বিপ্লবী-কবি পাবলো নেরুদার মতো আজ সবাই উগ্র ও হত্যাকারীদের শাস্তি দাবি করছে। বিপণন বিশ্ব আর্তনাদ করে কাঁদছে মানবাধিকারের দাবিতে। যুদ্ধ, দাঙ্গা, সংঘাতে রক্তাক্ত বিশ্ববাসী অধিকারের জন্য চিৎকার করছে।

অথচ আজ থেকে ৭০ বছর আগে বিশ্ব ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল শান্তি ও মানবাধিকার রক্ষায়। ১০ ডিসেম্বর ১০৪৮ সালে জাতিসংঘের পক্ষে উচ্চারিত হয়েছিল ‘সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণা’। বলা হয়েছিল: মানব পরিবারের সকল সদস্যের সহজাত মযাদা ও সমানাধিকারের স্বীকৃতি বিশ্বে স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার ও শান্তির ভিত্তি। মানবিক অধিকারসমুহের প্রতি অবজ্ঞা ও ঘৃণা মানবজাতির বিবেকের পক্ষে অপমানজনক ও বর্বরোচিত কাযকলাপ।

জাতিসংঘের মানবাধিকারের ঘোষণায় এমন একটি পৃথিবীর সূচনা ঘোষিত হয়েছে, যেখানে মানুষ বাক ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা এবং ভয় ও অভাব থেকে নিষ্কৃতি পাবে। মানবিক অধিকারসমূহ অবশ্যই আইনের শাসনের দ্বারা সংরক্ষিত হবে। মানুষের মর্যাদা ও মূল্য, নারী ও পুরুষের সমানাধিকার নিশ্চিত হবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমাজে মানুষের নিরাপত্তা ও অধিকার সুনিশ্চিত হবে।

দুটি ভয়াবহ বিশ্বযুদ্ধের তাণ্ডবের ফলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জাতিসংঘ। বিশ্বনেতৃত্ব ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল শান্তি ও নিরাপত্তার মোহনায়। এর ফলেই ১০ ডিসেম্বর ১৯৪৮ সালে ঘোষিত হয়েছিল সার্বজনীন মানবাধিকারের অঙ্গীকার।

কিন্তু যুদ্ধবাজরা শান্তি, নিরাপত্তা ও মানবাধিকারকে বার বার ভূলুণ্ঠিত করেছে। নারী, শিশু, ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিধনযজ্ঞ চালিয়েছে। পৃথিবীর কেন্দ্রস্থল ও প্রান্তে প্রান্তে বইয়ে দিয়েছে রক্তের গঙ্গা ও মৃত্যুর মহোৎসব।

আজ পৃথিবীর দেশে দেশে সুপ্ত ও প্রকাশ্য যুদ্ধক্ষেত্রে লঙ্ঘিত হচ্ছে মানবাধিকার। স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল ও শরণার্থী শিবিরেও রক্ষিত হচ্ছে না মানুষের মৌলিক অধিকার। পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় ও অনিরাপদ প্রাণির নাম এখন 'মানুষ'।

মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, এশিয়ার মধ্য, দক্ষিণ ও পশ্চিমাংশে চলছে অন্তহীন সংঘাত। লেবানন, সিরিয়া, ইরাক, ইয়ামেন, আফগানিস্তান, মায়ানমার বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে। পক্ষ ও প্রতিপক্ষের হানায় অকাতরে মরছে মানুষ। লাঞ্চিত হচ্ছে নারী ও শিশুরা। পৃথিবী ভরে গেছে মানবিক অধিকারহীন, গৃহহারা, উদ্বাস্ত, শরণার্থীতে।

কেউ কি জানতো, ঘোষণার ৭০ বছরের মধ্যে চরমভাবে লঙ্ঘিত হবে সার্বজনীন মানবাধিকার? সৃষ্টি হবে চরম মানবিক নিরাপত্তাহীনতা ও বিপর্যয়? কে জানতো, শান্তিবাদী মানবিক বিশ্বকে আবারও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে মানবতা ও মানবাধিকার রক্ষায়?

আজ বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে নতুন শপথে বিশ্বকে এক হতে হবে। হিংসা, বিদ্বেষ, যুদ্ধ ও সংঘাতের কবল থেকে মানুষকে বাঁচাতে শান্তিবাদীদের হাতে হাত মেলাতে হবে। উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করতে হবে মানুষের নিরাপত্তা ও অধিকারের প্রত্যয়।