কলড্রপের সমাধান নেই অপারেটরদের হাতে
কলড্রপ নিয়ে গ্রাহকের অভিযোগ বিস্তর। এসব অভিযোগের বেশিরভাগই মূলত মোবাইল ফোন অপারেটরদের ঘিরে। কিন্তু একটি কল গ্রাহক পর্যন্ত পৌঁছাতে অপারেটর ছাড়াও এনটিটিএন, আইআইজি, আইসিএক্স, আইজিডব্লিউসহ অনেকগুলো পক্ষ জড়িত থাকে। অথচ তাদের সেবার মান নিয়ন্ত্রণের কোনো ক্ষমতা অপারেটরদের নেই। তাই স্বাভাবিকভাবেই কলড্রপ সমস্যার পুরো সমাধান অপারেটরদের হাতে নেই।
মোবাইল অপারেটরদের সেবার মান নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা যতটা সোচ্চার, অন্য সব পক্ষের কোয়ালিটি অব সার্ভিসের বিষয়ে তেমনটা দেখা যায় না। এখন পর্যন্ত ভয়েস কলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত অন্য পক্ষ বা প্রতিষ্ঠানের কিউওএস বিষয়ে কোনো প্যারামিটার বা সূচক নির্ধারণ করা হয়নি।
মঙ্গলবার (৬ নভেম্বর) রাজধানীর একটি হোটেলে এসোসিয়শেন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অব বাংলাদেশ (এমটব) আয়োজিত এক কর্মশালায় তিন মোবাইল অপারেটর গ্রামীণফোন, রবি ও বাংলালিংকের কর্মকর্তারা এ কথা জানান। এতে অপাটেরটরদের হয়ে উপস্থিত ছিলেন রবির হেড অব কর্পোরেট এন্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স শাহেদ আলম, বাংলালিংকের হেড অব কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স তাইমুর রহমান ও গ্রামীণফোনের হেড অব রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স হোসেন শাহাদাত।
তারা বলেন, টেলিযোগাযোগ একটি ওয়্যারলেস প্রযুক্তির সেবা। কারিগরি সীমাবদ্ধতার কারণেই এখানে একটি নেটওয়ার্ককে সম্পূর্ণ কলড্রপ মুক্ত করা সম্ভব নয়। এসব কারিগরি সীমাবদ্ধতার মধ্যে রয়েছে তরঙ্গের স্বল্পতা, ঘন ঘন ফাইবার কেটে যাওয়া, নিম্নমানের হ্যান্ডসেট ও জনসংখ্যার ঘনত্বের মতো অনেকগুলো বিষয়। সম্প্রতি মোবাইল টেলিফোনে কলড্রপ নিয়ে জাতীয় সংসদে বাণিজ্য মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের ক্ষোভ প্রকাশ এবং পরবর্তীতে বিগত এক বছরে কলড্রপ নিয়ে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করে।
বাংলাদেশে তরঙ্গের উচ্চমূল্য কলড্রপ সমস্যার একটি অন্যতম কারণ। কারণ তরঙ্গ ব্যবহার করেই মূলত টেলিযোগাযোগ সেবা দেওয়া হয়। বাংলাদেশে প্রতি মেগাহার্টজ তরঙ্গের দাম এখন বিশ্বের সব দেশের অন্যতম সর্বোচ্চ, এর বিপরীতে গ্রাহক প্রতি আয় এখন মাত্র ১৩০ টাকা। তরঙ্গের উচ্চমূল্যের কারণে বিভিন্ন ব্যান্ডের ১৮৫ মেগাহার্টজ তরঙ্গ এখনো বাংলাদেশে অব্যবহ্নত রয়ে গেছে। বিপুল পরিমাণ এ অব্যবহৃত তরঙ্গের বিষয়ে সরকারের একটি নীতিমালা থাকা দরকার।
তারা মনে করেন, তরঙ্গের ন্যায্য দাম নির্ধারণ করে অপারেটরদের দেওয়া হলে কলড্রপের মতো সমস্যা সমাধানে তা খুবই কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। অপারেটরদের বাড়তি তরঙ্গের চাহিদা পূরণ করে বিটিআরসি প্রয়োজনে কোয়ালিটি অব সার্ভিসের বিষয়ে আরও কঠোর হতে পারে।
কলড্রপের সমস্যা সমাধানে তরঙ্গের পাশাপাশি ফাইবার অপটিক বা এনটিটিএন অপারেটরের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এনটিটিএন নীতিমালা অনুযায়ী, এনটিটিএন অপারেটরের কাছ থেকে মোবাইল ফোন অপারেটরদের ফাইবার লিজ পাওয়ার কথা। কিন্তু ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে এনটিটিএন অপারেটররা তাদের ফাইবার অপারেটরদের লিজ দেয় না। ঘন ঘন ফাইবার কাটা পড়া এবং নিজস্ব ফাইবার না থাকায় কলড্রপের হার নিয়ন্ত্রণে রাখা অপারেটরদের জন্য অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে।
মোবাইল ফোন অপারেটরদের জন্য বিটিএস স্থাপনের জায়গা পাওয়া এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রেডিয়েশন নিয়ে সাধারণ মানুষের নেতিবাচক ধারণার কারণে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় নতুন করে টাওয়ার বসাতে গিয়ে স্থান পাওয়া যাচ্ছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, মিরপুর ডিওএইচএস, বারিধারা ডিওএইচএস, কুড়িল, বনশ্রী, চট্টগ্রাম বন্দর, ডিওএইচএস, চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সল্টগোলা মোড়-সারা দেশে এমন অনেক এলাকায় বিটিএস স্থাপনে অপারেটররা অনুমতি পাচ্ছে না। সাভারের রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পরে অনেক গার্মেন্টস ভবনের ওপরে থাকা মোবাইল ফোন টাওয়ার অপারেটররা সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। নতুন লাইসেন্সপ্রাপ্ত টাওয়ার কোম্পানির জন্যও এ বিষয়গুলো সমাধান করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
তারা মানসম্পন্ন সেবা দিতে না পারার জন্য নিম্নমানের হ্যান্ডসেটকে দায়ী করে বলেন, বাংলাদেশে আমদানি হওয়া ৬০ শতাংশ হ্যান্ডসেটই অত্যন্ত নিম্নমানের। ফোরজি উপযোগী হ্যান্ডসেটের ব্যবহার একটি জায়গায় এসে আটকে গেছে। ফোরজি হ্যান্ডসেট আমদানিতে উচ্চ করের কারণে তা সাধারণ ব্যবহারকারীদের ক্রয় সীমার মধ্যে এখনো আসেনি।
অনেক সীমাবদ্ধতার পরেও তিন বেসরকারি মোবাইল ফোন অপারেটরের কলড্রপের পরিমাণ বিটিআরসির নির্ধারিত সীমার নিচে রয়েছে। বিটিআরসির মানদণ্ড অনুসারে, অপারেটরদের কলড্রপের হার মোট কলের ২ শতাংশের নিচে থাকতে হবে। তিন অপারেটরের কলড্রপের হার .৫ থেকে .৮ শতাংশের মধ্যে, অর্থাৎ ১ শতাংশের কম। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে কল সাকসেস রেটের হার ৯৯ শতাংশ। অর্থাৎ একজন গ্রাহক মোবাইলে ফোন করলে ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রেই তিনি কলটি সফলভাবে করতে পারেন।
কলড্রপ সমস্যার বিষয়টি তাই সার্বিকভাবে দেখতে হবে। এককভাবে শুধু মোবাইল ফোন অপারেটরদের দোষারোপ করে এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। টেলিযোগাযোগ ইকোসিস্টেমে যুক্ত সব পক্ষকে নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিভিন্ন সমস্যার বাস্তবভিত্তিক সমাধানের মাধ্যমে কলড্রপের মতো সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।