স্বপ্ন আর বাস্তবতাকে পাশাপাশি রেখে হাঁটতেন স্টিভ জবস

  • আইসিটি ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

‘মৃত্যু অবধারিত, আমিও খুব তাড়াতাড়ি মারা যাব, আর এটাই আমার জীবনের সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। কারণ যখন আমি মৃত্যু সম্পর্কে ভাবি তখন সমস্ত গৌরব, প্রত্যাশা এবং ব্যর্থ হওয়ার ভয় নিঃশেষ হয়ে যায়’। ঠিক যেন স্বপ্ন আর বাস্তবতাকে পাশাপাশি রেখে হাঁটতেন প্রযুক্তি দুনিয়ার অন্যতম সফল কারিগর স্টিভ জবস।

তবে অন্যান্য সব কিংবদন্তিদের মত তার জীবনের চলার পথও ছিল অমসৃণ। কিন্তু তাই বলে তিনি থেমে যান নি, বা দমে যান নি। তার একাগ্রতা, পরিশ্রম, দক্ষতা এবং সৃজনশীল চিন্তাধারায় তার প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি অ্যাপেলকে তিনি নিয়ে গেছেন বিশ্বের একনম্বর টেকনোলোজি কোম্পানির কাতারে।

বিজ্ঞাপন

মহান এই প্রযুক্তি নির্মাতা কারিগরের জন্ম আমেরিকার সানফ্রানসিসকোতে ১৯৫৫ সালে। রিফিউজির সঙ্গে মা জোয়ান শিবো প্রেমের সম্পর্কের পরিণতি স্টিভ জবস। পরে জোয়ান শিবো পল জবস আর ক্লারা জবস নামে এক দম্পতিকে তাকে দত্তক দেন। জবসকে তারা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেন। আর জবস তাদেরকেই তার বাবা-মা হিসেবে জানতেন।

আর সেই শৈশব থেকে বাবার সাথে গ্যারেজে ইলেকট্রিক যন্ত্রাংশ নিয়ে কাজ করতেন। সেই থেকে তার প্রযুক্তির সাথে সখ্যতা। ছাত্র হিসেবে তিনি ছিলেন খুব মেধাবী।

বিজ্ঞাপন

৪র্থ ক্লাসে পড়ার সময় তার পরীক্ষার রেজাল্ট দেখে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে হাই স্কুলে ভর্তি করার কথা জানালে তার বাবা-মা তাতে মত দেন নি। তারা চাইতেন তাদের ছেলে ক্রমান্বয়ে পড়াশুনা শেষ করুক।

এরপর শিক্ষাজীবনে ‘রিড কলেজে’ ভর্তি হন। কিন্তু কলেজের খরচ জোগাতে তার বাবা-মাকে তাদের সব অর্থ তার পিছনে দিতে হত। তখন স্টিভ তার খরচ চালানোর জন্য কোকের খালি বোতল বিক্রি করা শুরু করে। সপ্তাহে একদিন রোববারে ভাল খাওয়ার জন্য হরিকৃষ্ণ মন্দিরে ৭কিলোমিটার হেঁটে যেতেন। ঘুমানোর জায়গা ছিল না বলে বন্ধুর বাসার মেঝেতে ঘুমাতেন স্টিভ।

আর কলেজে ভর্তির ৬ মাস পড়ে পড়াশুনা ছেড়ে দেন। তবে যেই বিষয়টি তার ভাল লাগে শুধু সেই বিষয়ে পড়াশুনা করেন। ক্রিয়েটিভ ক্লাস করেন ক্যালিগ্রাফিতে। ক্যালিগ্রাফি তার কাছে পছন্দের বিষয় ছিল। তিনি মনে করেন এটি ছিল তার জীবনের সেরা সিদ্ধান্ত।

তার প্রথম কাজ শুরু করেন ‘আতারি কম্পিউটারস’এর সাথে। তখন তার সাথে পরিচয় স্টিভ ওয়াজনিয়াক এর সাথে। পরে তারা ভাল বন্ধু হয়ে যান।

১৯৭৬ সালে ওয়াজনিয়াক নিয়ে আসে প্রথম ‘অ্যাপেল১’ কম্পিউটার। আর ইতিহাসের পাতায় নতুন দিগন্ত উন্মোচনকারী এই কম্পিউটারের বিক্রি শুরু হয় স্টিভের বাবার গ্যারেজ থেকে। ১৯৭৮ সালে এর সফল বিপণনের ফলে তিনি ২৩ বছর বয়সেই বনে যান লাখপতি।

১৯৮৪ সালে জবস প্রথম ম্যাকিনটোশ আবিষ্কার করেন, যা ছিল সবচেয়ে সফল বাণিজ্যিকভাবে একটি কম্পিউটার। মূলত এই কম্পিউটারের গ্রাফিকাল ইউজার ইন্টারফেস স্ক্রিন, মাউস এবং তার শেখা ক্যালিগ্রাফি এর আকর্ষনীয় ব্যবহার সবাইকে মুগ্ধ করে। যা এখন আমাদের কাছে পিসি বা পারসোনাল কম্পিউটার হিসেবে পরিচিত।

অ্যাপেল কোম্পনির যাত্রা শুরু হয় ২ জন কর্মকর্তা নিয়ে। পরবর্তীতে কোম্পানির প্রসারের জন্য পেপসি’র সাবেক প্রধান নির্বাহীকে তাদের কোম্পানির সিইও করা হয়। আর এর ১ বছর পরে কোম্পানির দূরদর্শিতা নিয়ে মত বিরোধ হলে ৩০ বছরের স্টিভকে তার তৈরি প্রতিষ্ঠান থেকে বের করে দেয়া হয়।

সেই সময়টাতে তিনি নেক্সট এবং পিক্সার নামে দুটি প্রতিষ্ঠান বানায়, আর সেই পিক্সার কোম্পানি তখন আমেরিকার সর্বপ্রথম আনিমেশন মুভি ‘টয় স্টোরি’ বানায়। যা ব্যাপক সুনাম ও সফলতা অর্জন করে। পরবর্তীতে অ্যাপেল পিক্সারকে কিনে নেয় এবং স্টিভ কে আবারও অ্যাপেলের সিইও পদে নিয়োগ দেয়।

২০০১ সালে অ্যাপেল পরিচয় করিয়ে দেয় গান শোনার জন্য একটি পোর্টেবল ডিভাইস আইপড। আর এর জনপ্রিয়তা ছড়ায় বিশ্বব্যাপী। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে হলিউডের শিল্পী গোষ্ঠীদের মাঝেও ছিল আইপডের ব্যাপক চাহিদা। পরবর্তীতে ‘আইটিউনস’ যা অনলাইন মিডিয়া হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করে।

মোবাইল ফোন বাজারে অ্যাপেল প্রবেশ করে ২০০৭। আর যা ছিল অ্যাপেলের ‘আইফোন’সে সময়ের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচনকারী মাল্টিপল টাচ স্ক্রিন মোবাইলফোন। এতে ছিলো অ্যাপেলের আইপড, আইটিউনস , একটি ফোন এবং সেলুলার ডাটা ইন্টারনেট মোবাইল সুবিধা । যা মোবাইল বাজারের সবচেয়ে বড় প্রতিযোগি হিসেবে নিজের অবস্থান করে নেয়।

২০১০ সালে ‘আইপ্যাড’ তৈরি করে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। যা কম্পিউটারকে হাজির করে সম্পূর্ণ নতুন রূপে, যাকে বলা হত ট্যাবলেট স্টাইলের কম্পিউটার। আর তার কর্ম পরিচালনায় ২০১১ সালে অ্যাপেল অর্জন করে বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রযুক্তি নির্মাতা কোম্পানির খেতাব।

তিনি বলতেন, “আমি তা ই করি যা আমি ভালবাসি। আর তোমাকে খুঁজে নিতে হবে তুমি কি ভালবাসো। যদি না জান তাহলে খুঁজতে থাক। নিজের মনের ইচ্ছাকে প্রথম প্রাধান্য দাও এবং বাকিসব কিছুকে এর পরে রাখ”।

ব্যক্তিগত জীবনে ক্রিসেন ব্রেনান কে বিয়ে করলে সেই ঘরে জন্ম নেয় লিসা বার্নান-জবস। তবে তিনি তার এই কন্যার পরিচয় দিতেন না। কিন্তু এক সময় বিষয়টি যখন গণমাধ্যমে আলোচিত হয় পড়ে তিনি তাকে মেয়ে হিসেবে গ্রহণ করে নেন।

এরপর ১৯৯১ সালে লরেন পাওয়েলকে বিয়ে করেন এবং তাদের তিনজন সন্তান ইভি জবস, ইরিন সিয়েনা জবস, রিড জবস।

২০০৯ সাল থেকে এই প্রযুক্তি কারিগর ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। চিকিৎসা এবং অপারেশনের পরে আবার অ্যাপেলের সাথে কাজ করতে থাকেন। কিন্তু পরবর্তীতে ২০১১ সালের ২৫ অক্টোবর সেই ক্যান্সারই স্টিভকে নিয়ে যায়-না ফেরার দেশে।