‘কিশোরগঞ্জের বেগম রোকেয়া’ শাহনাজ কবীর

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

নিজ কার্যালয়ে 'কিশোরগঞ্জের বেগম রোকেয়া’ শাহনাজ কবীর/ ছবি: সংগৃহীত

নিজ কার্যালয়ে 'কিশোরগঞ্জের বেগম রোকেয়া’ শাহনাজ কবীর/ ছবি: সংগৃহীত

একই সঙ্গে তিনি লড়ছেন শরীরের ঘাতক ব্যাধি ক্যান্সার এবং সমাজের অন্ধকার ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। জীবনের প্রদীপ হাতে আলোর শিখা নিয়ে ছুটে চলেছেন প্রতিনিয়ত। তিনি যুদ্ধ করছেন নারীর স্বাস্থ্য, স্বীকৃতি, শিক্ষা, প্রগতি ও আত্মোন্নয়নের জন্য।

কিশোরগঞ্জের শিক্ষা ও উন্নয়নের ইতিহাসে নারী জাগরণের উজ্জ্বল মুখচ্ছবি তিনি। লড়াকু শিক্ষয়েত্রী, লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট শাহনাজ কবীর হার-না-মানা সংগ্রামশীলতার পথে চলে স্থাপন করেছেন অনন্য দৃষ্টান্ত। তাকে সবাই শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায় সম্বোধন করেন ‘কিশোরগঞ্জের বেগম রোকেয়া’ নামে।

বিজ্ঞাপন

আদর্শবান পুলিশ অফিসার পিতার কাছ থেকে তিনি পেয়েছেন লড়াকু মনোবৃত্তি, নীতি-নৈতিকতা, অধ্যবসায়, নিয়ম ও নিষ্ঠা। বৃহত্তর ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ-নেত্রকোণার সীমানায় বৃহত্তর সিলেটের হবিগঞ্জের জলমগ্ন হাওরের জন্মভূমি থেকে পেয়েছেন মানবিক উদারতা।

পিতার কর্মসূত্রে নৈসর্গিক বাংলাদেশের বহু স্থানে বসবাসের অভিজ্ঞতায় অর্জন করেছেন মানুষ ও প্রকৃতির প্রতি অসীম ভালোবাসা। গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পেয়েছেন উচ্চশিক্ষা। দেশ-বিদেশ থেকে নিয়েছেন শিক্ষণ-প্রশিক্ষণ। দিনে দিনে নিজেকে তৈরি করেছেন আদর্শ শিক্ষকের অবয়বে।

বিজ্ঞাপন

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Mar/18/1552906112571.jpg

সুগভীর মমতা নিয়ে শাহনাজ কবীর শিক্ষকতার মহৎ পেশা গ্রহণ করে কঠোর শ্রম ও কর্মনিষ্ঠায় আরোহণ করেছেন উচ্চতম সম্মানের আসনে। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা নিয়ে শতবর্ষস্পর্শী কিশোরগঞ্জ এস.ভি. সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষয়েত্রী হয়ে তিনি যখন এলেন, তখন ঐতিহ্যবাহী বিদ্যালয়টি অবক্ষয়ের মুখে।

কিন্তু অতি অল্প সময়ে ঐতিহ্য ও সুনামের দিক থেকে অস্তগামী একটি স্কুলকে অলৌকিক জাদুবলে হৃত-মর্যাদার আসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন শাহনাজ। স্কুলের সাফল্যের সূত্রে সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে ‘কিশোরগঞ্জের বেগম রোকেয়া’ শাহনাজ কবীরের সুখ্যাতি।

নিজের পেশাগত সুনাম ও প্রতিষ্ঠানের সুখ্যাতি সমুন্নত রাখতে শাহনাজ কবীর পালন করেন চ্যালেঞ্জিং ভূমিকা। ছাত্রী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের নিয়ে পরিবারের মতো গড়ে তুলেন স্কুলকে। ফলও পান হাতেনাতে। শুধু জেলা বা বিভাগের মধ্যেই নয়, দেশের সেরা স্কুলের কাতারে চলে আসে এস.ভি. স্কুল। তার নিজের নামও চলে আসে দেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের তালিকায়।

শুধু পড়াশোনা নয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক কাজেও তিনি নিজে ও প্রতিষ্ঠানকে নিয়োজিত করেছেন সাফল্যের সঙ্গে। গান, বাজনা, আবৃত্তি, নৃত্য, বিতর্ক, বিজ্ঞানমেলার মাধ্যমে বিকশিত করেছেন বহু শিক্ষার্থীর সুপ্ত প্রতিভা। বৃক্ষরোপণ ও পরিবেশ প্রীতির ফলিত দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন তিনি বিদ্যালয় প্রাঙ্গণকে সবুজে শোভিত করার মাধ্যমে। তপোবন-সদৃশ এস.ভি. স্কুলের ক্যাম্পাসের প্রতিটি কোণে কোণে ও শিক্ষার্থীদের হৃদয়ের গোপন অলিন্দে তিনি কর্ম ও কীর্তির মাধ্যমে জীবন্ত করে রেখেছেন নিজেকে। কিশোরগঞ্জবাসীর কাছে হয়েছেন আদর্শ শিক্ষকের আলোকিত মডেল। 

সমাজের আলোকিত গুণিজনদের বিদ্যালয়ে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়মিত আলাপচারিতা ও সভার মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করেছেন শিক্ষার্থীদের। শ্রেণী কক্ষের সীমিত পরিসর ডিঙিয়ে শিক্ষার্থীরা যেন সফল মানুষের কথা শুনে জীবন সংগ্রামের কঠিন পথ পাড়ি দিতে পারেন, শাহনাজ কবীর সেই চেষ্টাই অব্যাহত রেখেছেন। 

জীবনমুখী ও সজীব শিক্ষয়েত্রী শাহনাজ কবীর কর্মকে মনে করেন ধর্মের মতো পবিত্র। কাজের ব্যস্ততায় টের পান না নিজের ভেতরের অসুস্থতা। অবস্থা খারাপের দিকে চলে গেলে চিকিৎসার মাধ্যমে জানতে পারেন, তার ক্যান্সার হয়েছে, রোগটির নাম ‘মাল্টিপল মাইলোমা’। 

মোটেও ভেঙে পড়েননি তিনি। সৃষ্টিকর্তা ও নিজের সুকর্মের প্রতি ভরসা রেখে লড়াই শুরু করেন ক্যান্সারের বিরুদ্ধে। কেমোথেরাপি আর কঠিন চিকিৎসা, নিয়মানুবর্তিতা ও লড়াকু-সাহসী মনোবৃত্তির মাধ্যমে নিজেকে সচল ও কর্মমুখর রাখতে সচেষ্ট হন তিনি। প্রিয় শিক্ষাঙ্গন ও শিক্ষার্থীদের মাঝে কর্মনিষ্ঠ থেকে উপভোগ করেন জীবনকে এবং জীবনের প্রতিটি মূল্যবান সময়।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Mar/18/1552906133135.jpg

শাহনাজ কবীর ব্যক্তিগত যন্ত্রণা, কষ্ট ও পরিশ্রমকে হাসিমুখে বরণ করে শিক্ষা ও নারী উন্নয়নের পথে চলতে চলতে এক সময় কলম হাতে তুলে নেন। রচনা করেন ‘ক্যান্সার ও ভালোবাসা’ নামের জীবনঘনিষ্ঠ গ্রন্থ। যে সাহস ও লড়াইয়ের চেতনা তিনি সারা জীবন লালন করেছেন, ক্যান্সারের সঙ্গে লড়তে লড়তে সেই অকুতোভয় কথাগুলোই মানুষকে জানিয়ে যান তিনি বেদনার্ত অক্ষরে। 

ব্রহ্মপুত্র আর মেঘনার দুহিতা নরসুন্দা নদী তীরের প্রাচীন জনপদ কিশোরগঞ্জের মাটি ও মানুষকে অবলম্বন করে পুরো দেশবাসীকে শাহনাজ জানিয়ে যান তার সংগ্রাম ও লড়াইয়ের কথা, নারীর শিক্ষা ও অগ্রগতির সংগ্রামের কথা। ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতাকে জয় করে সমাজের জন্য নিবেদিত হওয়ার কথা। 

একদা তিনি যখন থাকবেন না, তখন তার কর্ম ও লেখনি অনাগতকালের মানুষকে মনে করিয়ে দেবে ‘কিশোরগঞ্জের বেগম রোকেয়া’ নামে পরিচিত লড়াকু শিক্ষয়েত্রী শাহনাজ কবীরকে। সবাই জানবে, নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার মতো শাহনাজ কবীর নামে একজন লড়াকু শিক্ষয়েত্রী এসেছিলেন এই জনপদে, ভাটিবাংলার জলছলছল শ্যামলিমাময় ভূগোল কিশোরগঞ্জে।

এই লেখাটি লেখার সময়ও শাহনাজ কবীর বিদেশে একটি হাসপাতালে ক্যান্সারের চিকিৎসা নিচ্ছেন। সেখান থেকে এই কঠিন পরিস্থিতিতেও তিনি প্রতিদিন তার প্রিয় বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের খোঁজ নেন বলে জানা গেছে।