মেঘপাহাড়ের ডাক-১১

চেরাপুঞ্জিতে খাসি আতিথেয়তা



মাহমুদ হাফিজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

মধ্যাহ্নভোজ ও চা পানের বিরতির জন্য স্ট্রিমলেট ডেখারের বোন ভিক্টোরিয়া কারশিংতোর বাসার দিকে গাড়ি ছুটে চললো। আমি আর জলি পেছনের সিটে। জলি ফিস ফিস অনুযোগ করলো ‘তোমার খবর আছে, কতবার বলেছি মেঘের আবছা আঁধারে আমার ছবি তুলে দিতে, তুমি কানে তুললে না’।

বললাম- ‘হবে হবে’।

তার সাফ জবাব- ‘কই, এখন তো আকাশে মেঘ বৃষ্টি কিছুই নেই। মেঘ পাবা কোথায়?’

দীর্ঘদিন বাচ্চাদের পড়িয়ে পড়িয়ে মনটি নরম মেঘের মতো হয়ে যাওয়া এই ভদ্রমহিলা মেঘ, বৃষ্টি, ফুল, পাখি, কোলের শিশু দেখলে ছবি তুলতে ব্যগ্র। ‌আমার তা জানা থাকলেও যতোটা মনোযোগ স্ত্রীরা সাধারণত: পেয়ে থাকে, দল বেঁধে ভ্রমণে তা পায় না এবং এই ভ্রমণে সে নিশ্চিতভাবেই বঞ্চিত হচ্ছে সন্দেহ নেই। দর্শনীয় স্থানে নেমে সবাই ছবি, সেলফি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। কারও প্রতি কারও বিশেষ মনোযোগ দেয়ার সুযোগ কম। কয়েকবার মেঘবৃষ্টির দেখা পাওয়া গেলেও মনের মতো ছবি তুলতে না পারায় আমাকে ক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছে।

ঘটনা মিরাকলের মতোই। সেভেন সিস্টার্স ভিউপয়েন্ট থেকে যাত্রা শুরুর পরই মেঘবৃষ্টি উধাও। রোদ না উঠলেও চারদিক পরিষ্কার। তবে আমি চিন্তিত না। চেরাপুঞ্জিতে প্রথম এলেও জানি এখানে এই রোদ, এই মেঘ, এই বৃষ্টি। দেখা যাবে আমাদের গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই হয়তো মেঘ বৃষ্টির দেখা পাওয়া যাবে। সময়ের ফারাক তিন মিনিট হোক আর তিরিশ মিনিট।

মেঘপাহাড়ের ডাকের আরও নিউজ পড়তে ক্লিক করুন: 'মেঘপাহাড়ের ডাক'

ডেখারের বোনের বাসা চেরাপুঞ্জির ডুকান রোডে। চেরাপুঞ্জির একদম কেন্দ্র বলতে যা বোঝায়, সেখানে। সোহরা-শেলা সড়ক থেকে বাঁয়ে সোহরা-লেইটকিনসো সড়কে ঢুকে দ্বিতীয় গলিটিই ডুকান রোড। গাড়ির ভেতর থেকে স্ট্রিমলেট এর আরেক বোন- আমাদের আজকের সহযাত্রী ‘ডোডো’ নির্দেশনা দিতেই গলির দু’তিনটি বাড়ির পরে সুদৃশ্য একটি বাড়ির সামনে গাড়ি থেমে গেল। ওপরে টিন, নিচে কংক্রিটের দৃষ্টিনন্দন বাড়ি। সামনে মধ্যবয়স্ক মার্জিত রুচির সুশ্রী এক ভদ্রমহিলা দু’হাত উঁচিয়ে সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছে। সবাই নেমে দ্রুত গেট দিয়ে ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি ও জলি পেছনের আসন থেকে পরে নামতেই দেখি স্বাগত জানাতে এসেছে মেঘদল। এতক্ষণ বুঝতে পারিনি। প্রধান সড়ক দিয়ে আসার সময়ও চারদিক পরিষ্কার ছিল। আকস্মিক ডুকান রোডে ভিড় করেছে দুনিয়ার সব মেঘদল। চারদিক অন্ধকার। ঠাণ্ডা তুলতুলে মেঘ ও কুয়াশা আমাদের ছুঁয়ে চলে যাচ্ছে ধীরে। কিংবা আমরাই মেঘের ভেতরে ঢুকে পড়েছি। ভাবলাম, ‘বাঁচা গেল’।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Jun/23/1561292847594.jpg

খাসি-গৃহে

 

সহসাই ভেতরে না ঢুকে ফটোসেশন কিংবা পুরোবস্তুর শুটিংয়ে লেগে গেলাম। জলিকে বললাম, গলির মাথায় হেঁটে গিয়ে আমার দিকে আস্তে আস্তে ফিরে আসতে। জলি সেভাবে এলো। আমি বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ক্লিকের পর ক্লিক করে যাচ্ছি। মেঘ ঘন ছিল। দৃশ্যমানতার হেরফেরে অপস্রিয়মাণ মেঘের বহুমাত্রিক ছবি এলো। প্রথম খুব ঝাপসা, তারপর আস্তে আস্তে পরিষ্কার ছবি।

ঘনমেঘের আস্তরণের মধ্যে কিছুক্ষণ দাঁড়ালেই কাপড়চোপড় ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে মেঘ। ঠাণ্ডাও লাগছে বেশ। এই না হলে চেরাপুঞ্জি! ‘আমি আসছি’ বলে তাকে দ্রুত বাড়ির ভেতরে পাঠালাম।

শুটিংয়ে এবার আমার পালা। ভেতরের দিকে আগুয়ান পুত্রধন তুসুকে ডেকে নিলাম। তার প্রযুক্তিজ্ঞান টনটনে। ছবিও তোলে ভাল। আমিও দূরে গলির মুখে গিয়ে আবার ফিরে আসতে লাগলাম। মেঘের ঘনত্ব মাঝে মাঝে কমবেশি হয়। তাই ঘনমেঘে উড়ে আসার আশায় এরকম কয়েকবার করলাম। আমি ঘনমেঘের আবছা আঁধার থেকে হেঁটে ক্রমশ: বের হয়ে আসি ক্যামেরার দৃশ্যমানতায়। তুসু ক্লিক করতে থাকে পটাপট। মনে হচ্ছে, হিন্দু সিনেমার কোন নায়ক গল্পের প্রয়োজনে মেঘের ভেতর থেকে পরিচালকের নির্দেশে ক্যামেরার দিকে এগিয়ে আসছে। টেক ওয়ান, টেক টু, টে থ্রি আওয়াজে চলছে শুটিং।

ডুকান রোডটি এসময় বড় নির্জন। কদাচিৎ দুয়েকটি গাড়ি চলে। বিকেলের দিকে বলে হয়তো এই নির্জনতা। গলির মাথায় বসতি ঘন নয়। রাস্তার নির্জনতা পেয়ে ফটো শুটিং নির্বিঘ্নেই চললো। ছবি দেখে নিজের গোবেচারা চেহারা নিজেই চিনতে পারছি না। ছবি ফেসবুকে পোস্ট হলে একজন কমেন্টবক্সে লিখলেন ‘হিরো নাম্বার ওয়ান’। লাজুক ভঙ্গিতে অস্ফুট ধ্বনি করলাম- যাহ।

গেট পেরিয়ে খোলা বারান্দা। বারান্দার পেছনে ড্রইংরুম। ঢুকে দেখি আধুনিক ও শহুরে পরিবেশ। বেত ও কাঠের ডাবল সোফা সেট। মেঝেতে কাঠস্টাইলের রেক্সিন। দেয়ালগুলো ডিজাইন করা কাঠে মোড়ানো। দেয়ালে বসানো শোকেসের মধ্যে কাঁসাপিতলের আসবাব। খাসি আতিথ্যগ্রহণে এসে শহুরে আধুনিকতা দেখে একরকম হতাশ হতে যাচ্ছি, তখন স্ট্রিমলেট বললেন, এই বাড়ি খাসি ঐতিহ্যের ছোঁয়া রেখেই সাজানো। শো কেসে প্রাচীন খাসিদের ব্যবহার করা কাঁসা পিতলের বাসন, ছাদ বা চাতালের দিকটা শীতলপাটির বুনন, দেয়ালসজ্জিত কাঠের আবরণে। শিলং শহরের খাসি বাড়িগুলোতেও আজকাল এগুলো নেই।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Jun/23/1561292963647.jpg
খাসি পরিবারের সঙ্গে মেয়েদের গ্রুপ ছবি

 

কিছুক্ষণ পর খাবার খাওয়ার জন্য ভেতরে ডাক পড়লো। ছোট্ট করিডোর পেরিয়ে ডাইনিং রুমে গিয়ে দেখি দেয়ালঘেষে চারদিকে চেয়ারপাতা। গৃহকর্তা ডেরিয়াস অটোমেটিক ইলেকট্রিক ওভেনে হাত-পা গরম করছেন। বাইরে থেকে আসায় তার হাত পা ঠাণ্ডা। জানা গেল, এখানে সংবছরই ঠাণ্ডা থাকে। আগুনের শেক দিয়ে হাত পা উষ্ণ রাখা বাসিন্দাদের অভ্যাস। পাশের চেয়ারে ডেরিয়াসের স্ত্রী ভিক্টোরিয়া। দু’জনের আয়েশি ভঙ্গির পাশে বসেছেন আমাদের মেজবান দলনেতা স্ট্রিমলেট ডেখার। আমরা আসন নিতে নিতেই পাশের টেবিলে বসে প্লেটে প্লেটে খাবার পরিবেশন শুরু করেছে ভ্রমণসঙ্গী বাখিয়া মুন। প্লেটে প্লেটে ভাত, ডিমসেদ্ধ, বানানা বল ওরফে কলা ভর্তা, আচার, ডাল।

গত কয়েকদিনে পরিচয় পাওয়া গেছে ভ্রমণসঙ্গী বাখিয়া মুনের। বয়সে অনেকটাই নবীন কলেজ শিক্ষক মুন সংসারী, করিৎকর্মা ও বন্ধু প্রিয়। বাড়ি থেকে নিজ হাতে রান্না করে মধ্যাহ্ন খাবার নিয়ে এসেছে। সঙ্গে প্লেট, চামচ আনতেও ভুল করেনি। তার ধারণা ছিল, ঝর্ণা, পার্কের উন্মুক্ত জায়গায় বনভোজন হতে পারে, তাই সব ব্যবস্থা। গাড়ির বুটে কয়েক ব্যাগে এসব রাখা ছিল। বনের বদলে বাড়িতে খাওয়ার আয়োজন হওয়ায় চালকের সহায়তায় ব্যাগগুলো ভেতরে আনা হয়েছে। ভাবলাম, একে বলে বরাত। পেটে ক্ষুধা আর খাবার দুটিই সঙ্গে করে নিয়ে এতক্ষণ ঘুরে বেরিয়েছি আমরা, ওপরের নির্দেশ আসেনি উদরপূর্তিরও ফুরসত মেলেনি।

ডাইনিং লাগোয়া রান্না ঘরের বেসিনে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা। কবি কামরুল হাসান আগে আগে গিয়ে হাত ধুয়ে নোটবুক বের করেছেন। পাশের উনুনে চা বানানোয় নিয়োজিত লাজুক স্বভাবের তরুণীর নাম জিজ্ঞেস করে টুকে নিচ্ছেন। সে পরিষ্কার হিন্দিতে বলছে, মেরা নাম দয়া।

আমি, কবি কামরুল হাসান আর ডেরিয়াস কাছাকাছি চেয়ারে বসেছি। চা পানের সময় স্ট্রিমলেট বললেন, ডেরিয়াস চেরাপুঞ্জির নামকরা টেইলরিং মাস্টার। স্যূট- কমপ্লিট এর স্পেশালিষ্ট। চেরাপুঞ্জিতে স্যূট-কোট বলতেই ডেরিয়াস। পোশাক আর মানুষ সিনোনিমাস হয়ে গেছে।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Jun/23/1561293618658.jpg

একথা শুনে ভ্রমণদলের কামরুল হাসান নড়েচড়ে বসলেন। ডেরিয়াসের সঙ্গে আগ্রহভরে আলাপ জমালেন। পেশায় এই বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকের সিগনেচার ড্রেস স্যূট টাই। এখানে এ্যাডেভেঞ্চার ট্যুরিজমে এসেও নিজের ড্রেসকোড থেকে বিচ্যুত হননি। ভারত বা চেরাপুঞ্জিতে এর দামদর, ফেব্রিক ইত্যাদি নিয়ে নানা প্রশ্ন করে ঝালিয়ে নিচ্ছেন।

খাসি, বাঙালি, শিলং, চেরাপুঞ্জি, বৃষ্টি মুখরতা নানা বিষয় নিয়ে অনেকক্ষণ আড্ডা চললো। বিদায়বেলায় গ্রুপ ফটো তোলার পর আবিষ্কৃত হলো ‘দয়া’র চেহারারই আরেক তরুণীর ছবি গ্রুপ ফটোতে। মনে হচ্ছিলো যমজ দু’জন। জিজ্ঞেস করে জানা গেল তার নাম ইভা। দয়া’র ছোট। সেও লেখাপড়া করছে। দুই মেয়ে নিয়ে ডেরিয়াস-ভিক্টোরিয়ার সুখের সংসার।

খাসি আতিথ্যে আমাদের মন উঠলো। চেরাপুঞ্জি গিয়ে দর্শনীয় স্থানকে ব্যাকগ্রাউন্ড করে ছবি তোলে অনেকেই, খাসি আতিথেয়তা ক’জন পায়!

   

আমার হাতের পাখা যেন তাদের আরাম দিচ্ছে!



মৃত্যুঞ্জয় রায়, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, সাতক্ষীরা
ছবি: বার্তা২৪, তালপাতার পাখা বিক্রি করছে পাঁচ বছরের শিশু মাহমুদুল্লাহ

ছবি: বার্তা২৪, তালপাতার পাখা বিক্রি করছে পাঁচ বছরের শিশু মাহমুদুল্লাহ

  • Font increase
  • Font Decrease

আবু বক্কর (৬২)। বয়সের ভারে অসুস্থ হয়ে তিনি এখন পাকা বিক্রেতা। প্রচণ্ড তাপদাহে মানুষ যখন ঠান্ডা বাতাসের প্রশান্তি খুঁজছে, তখন তিনি গ্রামে গ্রামে গিয়ে তালপাতার পাখা বিক্রি করছেন।

আবু বক্কর বার্তা২৪.কমকে বলেন, স্ত্রীসহ ছয় মেয়ে নিয়ে আমার সংসার। তবে মেয়েদের বিয়ে দিতে পেরেছি। কিন্তু বয়সের ভারে ঠিকই আমরা একা থেকে গেলাম। শেষ বয়সে গ্রামে গ্রামে তালপাতা পাখা বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছি। শুধু সংসার না, এই টাকায় আমার পায়ের শিরার ব্যথার ওষুধও কিনতে হয়। একবেলা ওষুধ না খেলে চলতে পারি না।

এদিকে, পুরনো ব্যবসার ঋণের বোঝা আর অন্যদিকে অসুস্থ হয়ে ওষুধসহ সংসারের খরচ। শেষ বয়সে তালপাতার পাখাই আমার একমাত্র জীবনসঙ্গী বলেন আবু বক্কর।

তালপাতার পাখা বিক্রি করছেন আবু বক্কর, ছবি- বার্তা২৪.কম

বুধবার (২৪ এপ্রিল) সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার কলাগাছি গ্রামের কবিগানের অনুষ্ঠানে সরেজমিন দেখা যায়, একপাশে তালপাতার পাখা বিক্রি করতে ব্যস্ত ছোট্ট পাঁচ বছরের শিশু মাহমুদুল্লাহ। এই গরমে যখন তার ঘরে থাকার কথা, তখন সে নানা-নানীর সঙ্গে এসে তালপাতার পাখা বিক্রি করছে। কবিগানে বসে থাকা সব শ্রোতার কাছে গিয়ে বলছে, পাখা লাগবে, পাখা! কথা বলতে চাইলেও এ পাশ ওপাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে, ক্রেতার কাছে।

এক ফাঁকে তাকে কাছে পেয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়, এই বয়সে পাখা বিক্রি করছো কেন! এ প্রশ্নের উত্তরে বার্তা২৪.কমকে মাহমুদুল্লাহ বলে, প্রচণ্ড গরমে স্কুল ছুটি। তাই, নানা-নানীর সঙ্গে চলে এসেছি মেলায় পাখা বিক্রি করতে। মানুষজন আমার কাছ থেকে যেন বেশি পাখা কেনে (ক্রয়), তাই আমি মেলায় তাদের সঙ্গে এসেছি।

অনেক উৎসাহের সঙ্গে সে বলে, গরমে আমার হাতের পাখায় যেন তাদের আরাম দিচ্ছে! মেলা হলে আমি সেখানে চলে যাই পাখা বিক্রি করতে। ঘোরাঘুরিও হয় আর টাকা ইনকামও হয়। টাকার জন্য বের হয়ে পড়েছি। আমরা পাখা বিক্রি করে পেট চালাই। নানা-নানী বুড়ো হয়ে গেছে। তাই, আমি সঙ্গে এসে তাদের কষ্টটাকে একটু ভাগাভাগি করে নিচ্ছি।

যেখানে প্রচণ্ড তাপে মানুষজন নাজেহাল, সেখানে ছোট্ট মাহমুদুল্লাহ ছুটে চলেছে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পাখা বিক্রি করতে। ছোট্ট শিশু হলেও গরম যেন তার কাছে কিছু না, পেটের তাগিদে!

আরেক পাখা বিক্রেতা তালা উপজেলার হরিণখোলা গ্রামের বাসিন্দা ভদ্রকান্ত সরকার (৭০)। ১২-১৪ বছর ধরে এই পেশায় আছেন তিনি।

চলছে তালপাতার পাখার বিকিকিনি, ছবি- বার্তা২৪.কম

শেষ বয়সে পাখা কেন বিক্রি করছেন এমন প্রশ্নের উত্তরে বার্তা২৪.কমকে ভদ্রকান্ত বলেন, চাল কিনে খেতে হয়। খুব কষ্টের সংসার! ছেলে-মেয়ে আছে। তারা তাদের মতো কাজ করে খায়। মা বাবার বয়স হয়ে গেলে ছেলে আর আমাদের থাকে না। আমরা বৃদ্ধ বয়সে কেমন আছি, সেটা জানার সুযোগ তাদের থাকে না। শেষজীবনটা এভাবে পাখা বিক্রি করে কাটিয়ে দেবো। কী আর করবো! কপালে যা আছে, শেষপর্যন্ত তাই হবে। কপালে ছিল, এমন বৃদ্ধ বয়সে গ্রামে গ্রামে পাখা বিক্রি করতে হবে!

;

৪ লাখ বছর আগে আদিম মানুষের যাত্রা শুরু



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত, নিউ সায়েন্টিস্ট থেকে

ছবি: সংগৃহীত, নিউ সায়েন্টিস্ট থেকে

  • Font increase
  • Font Decrease

৪ লাখ বছর আগে রাশিয়ার সাইবেরিয়া থেকে আদিম মানুষের যাত্রা শুরু হয়েছিল বলে নতুন এক গবেষণা থেকে জানা গেছে। এখান থেকে যাত্রা শুরু করে এই গোত্রের মানুষ পরে উত্তর আমেরিকায় পৌঁছে যায়।

নতুন এক গবেষণা জানাচ্ছে, সাইবেরিয়ায় নতুন একটি এলাকার সন্ধান পাওয়া গেছে, যেখানে ৪ লাখ ১৭ হাজার বছর আগে হোমিনিনস (Hominins) গোত্রের মানুষের উপস্থিতি ছিল। এই গোত্রের মানুষ ডিরিং ইউরিআখ এলাকায় বাস করতেন। সেখান থেকে তারা উত্তর আমেরিকায় পৌঁছে যায় বলে জানিয়েছেন চেক প্রজাতন্ত্রের এক গবেষক।

১৬ এপ্রিল চেক অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেসের গবেষক জন জেনসেন এক সংবাদ সম্মেলন করে নতুন এ তথ্য প্রকাশ করেন। গবেষণাবিষয়ক সংবাদ সাময়িকী নিউ সায়েন্সটিস্ট এ বিষয়ে একটি খবর প্রকাশ করেছে।

সংবাদ সম্মেলনে জন জেনসেন বলেন, আমরা আগে যে ধারণা করতাম, তারও আগে থেকে হোমিনিনস গোত্রের মানুষ সাইবেরিয়ার ডিরিং ইউরিআখ এলাকায় বসবাস করতেন। ৪ লাখ ১৭ বছর আগে থেকেই তারা এই এলাকায় বসবাস করতে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাদের অবস্থান ছিল উত্তর অক্ষাংশে।

তিনি বলেন, আরেকটি আদিম গোত্রের মানুষের সন্ধান পাওয়া যায়, যারা আর্কটিক অঞ্চলে বাস করতেন। ৪৫ হাজার বছর আগে তাদের সন্ধান পাওয়া যায়নি।

 

;

উদাল: রাস্তায় বিছিয়ে দেয় ফুলের গালিচা



মবিনুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
উদাল: রাস্তায় বিছিয়ে দেয় ফুলের গালিচা

উদাল: রাস্তায় বিছিয়ে দেয় ফুলের গালিচা

  • Font increase
  • Font Decrease

উদাল, সোনালি হলুদ সৌন্দর্যে মুগ্ধতা ছড়ানো মাঝারি সাইজের বৃক্ষ। পত্রঝরা উদাম শরীরে পুরো গাছজুড়ে শুধুই সোনালি হলদে রঙের ফুল। বসন্তে হলদে পাপড়ি ঝরে রাস্তায় বিছিয়ে দেয় ফুলের গালিচা। প্রকৃতির এক অপর সৌন্দর্য উদাল বৃক্ষ ও তার ফুল।

উদাল আমাদের দেশীয় উদ্ভিদ। এদের প্রিয় আবাস পাহাড়ি এলাকা হলেও আগে সারাদেশেই কমবেশি দেখা যেত। নির্বিচারে গাছ উজাড় হতে থাকায় অন্য গাছের সাথে এ দেশী গাছটিও বিপন্ন। ঢাকার মিরপুর জাতীয় উদ্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেন, বাংলা একাডেমি, ঢাকার রমনা পার্ক, ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র তীরের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন পার্কসহ সমতলের অনেক স্থানে উদাল দেখা যায়। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিশেষ করে বান্দরবান ও কক্সবাজারের মিশ্র চিরসবুজ বন এবং গাজীপুর, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলের পাতাঝরা শালবনের স্যাঁতসেঁতে জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে উদাল গাছ দেখা যায়।


উদালের বৈজ্ঞানিক নাম স্টারকুলিয়া ভেলোসা। ইংরেজিতে এটিতে হেয়ারি স্টারকুলিয়া বা এলিফ্যান্ট রোপ ট্রি নামে ডাকা হয়। এ গাছের বাকল থেকে এক প্রকার উন্নতমানের তন্তু পাওয়া যায়। এ তন্তু দিয়ে হাতি বেঁধে রাখার দড়ি বানানো হতো বলেও ইংরেজিতে এমন নামকরণ। আমাদের দেশে স্থানীয়ভাবে এটি চান্দুল নামেও পরিচিত। এই উদ্ভিদ মগ ও মারমাদের কাছে ফিউ বান, গারোদের কাছে উমাক এবং ম্রোদের কাছে নাম সিং নামে পরিচিত।

উদাল ২০ মিটার বা ততোধিক লম্বা হয়। এদের বাকল সাদাটে রঙের। এদের পাতার বোঁটা লম্বা, ফলক বড় ও পাতা খাঁজকাটা, পাতার প্রশাখার আগায় পাতা ঘনবদ্ধ। ফুলগুলি সোনালি হলুদ রঙের, ফুলের ভেতর বেগুনি। এর ফল কাঁচা অবস্থায় সবুজ থাকলেও পাকলে গাঢ় লাল রঙের হয়। বীজের রং কালো। বীজ স্বাদ অনেকটা বাদামের মতো হওয়ায় কাঠবিড়ালীর প্রিয় খাবার। তবে মানুষও এর ফল খেয়ে থাকে। বাকল থেকে আঁশ পাওয়া যায়। এ আঁশ দিয়ে দড়ি তৈরি হয়। কাঠ বাদামি রঙের, সাধারণত নরম ও হালকা হয়। এই গাছের কাঠ দিয়ে চায়ের বাক্স বানানো হয়।

উদাল ফল খাচ্ছে ইরাবতী কাঠবিড়ালি। ছবি: তবিবুর রহমান

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বার্তা২৪.কম-কে জানান, এ গাছ দেশের বন-জঙ্গলে প্রচুর হতো। এ গাছের পাতার বোঁটা দিয়ে শরবত বানানো হয়। উঁচু গাছ থেকে পাতার বোঁটা সংগ্রহ করা কষ্টসাধ্য হওয়ায় বড় বড় গাছ কেটে ফেলা হয়। এরপর এর গোড়া থেকে অনেক নতুন নতুন ডালপালা গজালে সেখান থেকে পাতার বোঁটা সংগ্রহ করা হয়। এছাড়াও উদাল গাছ থেকে স্বচ্ছ আঠা পাওয়া যায়। যা দিয়ে কনফেকশনারিসহ নানাবিধ কাজে ব্যবহার করা হয়।

তিনি আরও বলেন, এ উদ্ভিদ বর্তমানে বিপন্ন প্রজাতির। গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগ তিনশ উদাল গাছের চারা বিভিন্ন স্কুল কলেজে বিতরণ করেছে। এবারও প্রায় পাঁচশ চারা বিতরণ করা হবে।


ড. জসীম বলেন, উদলের বাকলের শরবত খেলে শরীর ঠান্ডা থাকে। ফুলের বৃন্ত ছেঁচে জলের সঙ্গে চিনি দিয়ে শরবত করে খেলে প্রস্রাবের সমস্যা ও বাতের ব্যথা দূর হয়। তবে খাওয়ার আগে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

রাঙ্গামাটি বনবিভাগের এসিএফ তবিবুর রহমান জানান, উদালের বীজের স্বাদ অনেকটা বাদামের মতো হওয়ায় কাঠবিড়ালির খুব প্রিয়। তবে এ বীজ মানুষও খেয়ে থাকে।

তিনি আরও জানান, ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের তফসিল ৪ অনুযায়ী উদালকে বাংলাদেশের ‘মহাবিপন্ন’ প্রজাতির তালিকাভুক্ত উদ্ভিদ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

;

বরিশালের শত বছরের ঐতিহ্যের স্মারক শীতলপাটি



এস এল টি তুহিন, করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, বরিশাল
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রামের পাটিকররা তাদের নিপুণ হাতের তৈরি শীতলপাটির জন্য বিখ্যাত।

উপজেলার দাড়িয়াল ইউনিয়নের কাজলাকাঠী গ্রাম, রঙ্গশ্রী ইউনিয়নের কাঠালিয়া, রাজাপুর গ্রাম ও গারুড়িয়া ইউনিয়নের সুখী নীলগঞ্জ ও হেলেঞ্চা গ্রামে এখনো তৈরি হয়, ঐতিহ্যের অনন্য স্মারক দেশ বিখ্যাত শীতলপাটি।

এই উপজেলায় এখন এক হাজারের বেশি পরিবার শীতলপাটি তৈরি করে সংসার চালাচ্ছে।

উপজেলার রঙ্গশ্রী ইউনিয়নের কাঁঠালিয়া গ্রামে প্রবেশ করে যতদূর দু’চোখ যায়, দেখা মেলে পাইত্রাগাছের বাগান। গ্রামীণ সড়কের দুই পাশে দেখা মেলে বড় বড় পাইত্রা বা মোর্তাগাছের ঝোপ। বাড়ির আঙিনা, পরিত্যক্ত ফসলি জমি, পুকুর পাড়, সব জায়গাতেই বর্ষজীবী উদ্ভিদ তরতাজা পাইত্রাগাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। গ্রামীণ জনপদের আভিজাত্যের স্মারক শীতলপাটি তৈরি হয়, এই পাইত্রাগাছের বেতি দিয়ে।

জানা গেছে, এসব গ্রামে পাইত্রাগাছের আবাদ হয়ে আসছে শত শত বছর ধরে। পাটিকরদের পূর্বপুরুষেরা যে পেশায় নিয়োজিত ছিলেন, আজও সেই পেশা ধরে রেখেছেন বাকেরগঞ্জের পাটিকররা।

এখনো এই সব গ্রামে ‘পাটিকর’ পেশায় টিকে আছে প্রায় এক হাজার পরিবার। আর তাদের সবার পেশাই শীতলপাটি বুনন। ফলে, উপজেলার এসব গ্রাম এখন ‘পাটিকর গ্রাম’ নামে পরিচিত।

সরেজমিন দেখা যায়, কাঁঠালিয়া, রাজাপুর ও গারুড়িয়া ইউনিয়নের সুখী নীলগঞ্জ ও হেলেঞ্চা গ্রামে এখনো গ্রামীণ সড়ক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই ছোট ছোট টিনশেড ও আধাপাকা ঘরগুলোর বারান্দায় নারী-পুরুষ ও শিশুরা মিলে নানান রঙের শীতলপাটি বুনতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

কাঁঠালিয়া গ্রামের সবিতা রানীর পরিবারের সবাই মিলে দিনরাত ব্যস্ত সময় কাটান শীতলপাটি তৈরি করতে। একটু সামনে এগুতেই কথা হয়, প্রিয়লাল পাটিকরের সঙ্গে।

তিনি বলেন, পরিবারের পাঁচ সদস্য মিলে একটি পাটি তৈরি করতে কয়েকদিন চলে যায়। প্রতিজনের দৈনিক মজুরি ১০০ টাকা করেও আসে না। তারপরেও কিছু করার নেই। বাপ-দাদার পেশা হিসেবে এখনো শীতল পাটি বুনে যাচ্ছি। একদিকে, এখন গরম বেড়েছে, অপরদিকে, বৈশাখ মাস চলছে। দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় বৈশাখী মেলায় শীতলপাটির চাহিদা থাকে। তাই, পাইকাররা এসে আমাদের এলাকা থেকে পাটি কিনে নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্রি করেন।

স্থানীয় পাটিকররা জানান, এখানকার তৈরি শীতলপাটি আন্তর্জাতিক মানের। কিন্তু প্লাস্টিক পাটির কারণে বাজারে শীতলপাটির চাহিদা কমে গেছে। সে কারণে সরকারিভাবে বিদেশে শীতলপাটি রফতানির কোনো ব্যবস্থা করা হলে পাটিকরদের জীবন-জীবিকা ভালো চলতো।

পাশাপাশি শীতলপাটি টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারের ক্ষুদ্রঋণ দেওয়া উচিত বলেও মনে করেন তারা। নয়ত এই পেশায় টিকে থাকা দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন কেউ কেউ।

এ বিষয়ে বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইফুর রহমান বলেন, উপজেলা প্রশাসন, মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তাসহ জাইকা সংস্থার মাধ্যমে উপজেলার পাটিকরদের মধ্যে বিভিন্ন রকম প্রশিক্ষণ প্রদান অব্যাহত রয়েছে। ফলে, নতুন নতুন ডিজাইনের শীতলপাটি তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে। পাশাপাশি আমরা তাদের সরকারি বিভিন্ন রকম সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করছি।

;