ফিরে দেখা প্রথম এভারেস্ট বিজয়: পর্ব- ৬
এভারেস্ট বিজয়ে বাঙালি
এক বাঙালির সৌজন্যে হিমালয় অঞ্চল ও এভারেস্ট এসেছিল জরিপের আওতায়। অজানা-অচেনা শৃঙ্গ সম্পর্কে পৃথিবী পেয়েছিল সঠিক তথ্য-উপাত্ত। যার ফলে অভিযান হয়েছিল সুনির্দিষ্ট এবং সম্ভব হয়েছিল শৃঙ্গ বিজয়। আরেকজন বাঙালিও এভারেস্ট বিজয়ের ঐতিহাসিক স্মৃতিতে পরিণত হয়েছিলেন। একজন ছিলেন প্রথম অভিযানের নেপথ্যে।
তেনজিং নিজেই জানিয়েছেন, তিনি সেদিন চূড়ায় ১৫ মিনিট ছিলেন, সেখানে পৌঁছে তেনজিং বরফে একটা লাল-নীল পেন্সিল পুঁতে দেন। দার্জিলিংয়ের শেরপা-বস্তি থেকে রওনা হওয়ার আগে ছোট মেয়ে নিমা তাকে পেন্সিলটা দিয়েছিল। তারপর পুঁতলেন আইস-অ্যাক্স’র হাতলে জড়ানো জাতিসংঘ, ব্রিটেন, নেপাল ও ভারতের পতাকা। তেনজিংয়ের বন্ধু দার্জিলিংয়ের ছাপাখানার মালিক রবীন্দ্রনাথ মিত্র শেষেরটি দিয়েছিলেন।
বিস্মৃতির অতলে উজ্জ্বল হয়ে আছেন আরেক বাঙালি। গত শতকের বিশের দশকে তিব্বতের দিক থেকে এভারেস্ট অভিযান শুরু হয়। কিন্তু অনুমতি নিয়ে হরেক টালবাহানা চলতে থাকে। ভারত সরকারের আন্ডার সেক্রেটারি লর্ড সতেন্দ্র প্রসাদ সিংহ নিজে উদ্যোগ নিয়ে ১৯২১ সালে ম্যালরি ও অন্যান্য অভিযাত্রীকে অনুমতির বন্দোবস্ত করে দেন।
সেটিই প্রথম এভারেস্ট অভিযান। প্রথম ভারতীয় লর্ডের এ কৃতিত্ব অনেকেই জানেন না। যেমন জানেন না, প্রথম এভারেস্ট অভিযাত্রী ম্যালরির কথাও।
আরেকজনের বিষয়ও বিস্মৃতির পথে। যে বাঙালি ভারতে প্রথম নিউটন ও লাপ্লাস’র গণিত রপ্ত করেন, তিনি রাধানাথ শিকদার। কোম্পানির আমলে একই সঙ্গে সার্ভে অফিসের চিফ কম্পিউটর এবং আবহাওয়া অফিসের প্রথম তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন তিনি।
তবে তাকে নিয়ে কিছু অতি কথাও রয়েছে। যেমন, রাধানাথ নাকি ভারতের সার্ভেয়ার জেনারেল হিসেবে জর্জ এভারেস্টের উত্তরসূরি অ্যান্ড্রু স্কট ওয়া’র ঘরে ছুটতে ছুটতে এসে বলেছিলেন, ‘স্যার, আমি শৃঙ্গ আবিষ্কার করেছি।’ ইংরেজরা তবু রাধানাথকে কৃতিত্ব না দিয়ে সার্ভেয়ার জেনারেল জর্জ এভারেস্টের নামে শিখরটির নাম দেন।
কিন্তু ঘটনাটির সত্যতা পরবর্তী ইতিহাসবিদরা মেনে নেননি। কারণ জর্জ এভারেস্ট তখন অবসর নিয়ে ইংল্যান্ডে। উপরন্তু, রাধানাথ কলকাতায় এবং অ্যান্ড্রু ওয়া দেরাদুনে। অতএব, রাধানাথ ‘স্যার, স্যার’ বলে ওয়া’র ঘরে ছুটবেন কীভাবে?
অন্যদিকে, জর্জ এভারেস্ট কোনও ভিলেন ছিলেন না। ছিলেন না হাত গুটিয়ে বসে থাকার মানুষ। ৭৮ ডিগ্রি দ্রাঘিমারেখা বরাবর উত্তর-দক্ষিণে ২৪০০ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত যে ‘মেরিডিয়ান আর্ক’, সেটির পরিমাপ তার অন্যতম অবদান। নতুন উপনিবেশকে ভালোভাবে চেনার স্বার্থে এসব ভূতাত্ত্বিক পরিমাপ তিনিই প্রথম ব্যবহার করেন। ওই কাল্পনিক মেরিডিয়ান আর্কই সটান হিমালয়ে পৌঁছাচ্ছে।
জর্জ এভারেস্টের নিয়ম ছিল, শৃঙ্গগুলোর স্থানীয় নামই থাকবে। কাঞ্চনজঙ্ঘা থেকে নন্দাদেবী, ত্রিশূল, কামেট, আজও সেই নীতি মেনে স্থানীয় নামেই পরিচিত হয়েছে তারই নির্দেশে। মৌসুরি থেকে ল্যান্ডো’র রাস্তার উল্টো দিকে আজও আছে জর্জ এভারেস্টের বাসগৃহ ‘পার্ক এস্টেট’। ভাঙাচোরা বাড়িতে অ্যান্টিক ফায়ারপ্লেস এবং কাঠের বিমগুলো অটুট।
নেটিভ সার্ভে-কর্মীদের বাড়ির বাগানে কুটির তৈরির অনুমতি দিয়েছিলেন এভারেস্ট। নিয়ম করেছিলেন, নিচুস্তরের কর্মীদের ‘কুলি’ বলা যাবে না, খালাসি বলতে হবে। নিয়মটি আজও বলবৎ।
এহেন এভারেস্টের অবসরের পর সার্ভে দফতরের প্রধান হলেন অ্যান্ড্রু ওয়া। তিনি খেয়াল করেন, সর্বোচ্চ শৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘার পিছনে ‘পিক ১৫’ নামে আরেকটি শিখর। বিভিন্ন জায়গা থেকে পরিমাপ নেওয়া হলো। ওয়া’র সন্দেহ জাগল, এটি কাঞ্চনজঙ্ঘার চেয়েও উঁচু নয় তো?
আরও পরিমাপ নেওয়া হলো। আর সন্দেহ নিরসনের ভার দেওয়া হলো সেরা গণিতজ্ঞ কলকাতা অফিসের রাধানাথ শিকদারের ওপর। ১৮৫২ সালে রাধানাথ দেখালেন, ওই শৃঙ্গটিই সবচেয়ে উঁচু, ২৯০০২ ফুট।
আরও পড়ুন: স্বপ্ন থেকে সাফল্যে
আরও পড়ুন: একজন অসামান্য পর্বতারোহী তেনজিং
আরও পড়ুন: বিজয়ের মাহেন্দ্রক্ষণ
আরও পড়ুন: ইভেন-বরিলিয়ান আউট, হিলারি-তেনজিং ইন
আরও পড়ুন: ১৬ বার ব্যর্থ হয়েছিলেন তেনজিং!