মব লিঞ্চিংয়ের ইতিহাস ও আমাদের মনোবৈকল্যের প্রতিচ্ছবি
রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় ছেলেধরা হিসেবে চিহ্নিত করে উন্মত্ত জনতা পিটিয়ে মেরেছে তাছলিমা বেগম রেনু নামে এক নিরপরাধ মাকে। জুলাইয়ের ২০ তারিখের এই মর্মান্তিক ঘটনায় মা-হারা করে দেওয়া হয়েছে তার ৪ বছরের শিশুকন্যা তুবাকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারাই এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডটির ছবি বা ভিডিও দেখেছেন, তারাই আঁতকে উঠেছেন।
কোনো প্রত্যন্ত গ্রামে নয়। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার বুকে ঘটেছে এই বর্বরতা। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, এই ঘটনার আগে ও পরে, সপ্তাহখানেকের কম সময়ের ব্যবধানে, ‘ছেলেধরা সন্দেহে’ নিহত হয়েছে কমপক্ষে ৭ জন এবং আহত হয়েছে অনেকেই। তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে ৫ জন এনজিও কর্মীকে ও প্রেমপত্র দিতে গিয়ে ধরা খাওয়া এক তরুণকে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি দেওয়ার মতো হাস্যকর ঘটনাও এতে রয়েছে।
বাংলাদেশে গণপিটুনিতে নিরপরাধ মানুষ হত্যার মতো ঘটনা আগেও ঘটেছে অনেক। কেমন করে মানুষ ভুলতে পারবে ২০১১ সালে ঢাকার আমিনবাজারে ডাকাত সন্দেহে ছয় তরুণকে ও ২০১৫ সালে ডাকাতির অপরাধে কিশোর মিলনকে পুলিশের গাড়ি থেকে নামিয়ে পুলিশের সামনেই মিটিয়ে পারার মতো হৃদয়বিদারক ঘটনাগুলো? কিন্তু জুলাই ২০১৯-এর তৃতীয় ও চতুর্থ সপ্তাহে যে উন্মত্ত জনতার বিস্ফোরণ বাংলাদেশ দেখছে, এমন কিছুর অভিজ্ঞতা আগে লাভ করেনি দেশের মানুষ। যেন উন্মাদ হয়ে গিয়েছে পুরো দেশের মানুষ।
এসব গণপিটুনি বা মব লিঞ্চিংয়ের বেশিরভাগ ঘটনাই গুজবতাড়িত। ‘চিলে কান নিয়েছে’ শুনে বেশিরভাগ লোকজনই উন্মত্ত হয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নিতে এগোয়। আবার, কখনো কখনো সমাজের কোনো হীন স্বার্থান্বেষী হীন চক্র সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করার জন্য অদ্ভুত ও আতঙ্কজনক গুজব ছড়িয়ে লোকজনকে উস্কে দেয়। পদ্মাসেতু নির্মাণে মানুষের মাথা ও রক্ত লাগার গুজব দিয়ে শুরু। সেই আগুনে ঘি ঢেলেছে ছেলেধরার গুজব, সেই ছেলেধরার গুজবের আগুনে হাওয়া দিয়েছে চট্টগ্রামের ইসকন-হেফাজত, সেই গুজবের সর্বশেষ পরিণতি ট্রাম্পের কাছে প্রিয়া সাহার তথ্যবিকৃতি। সবমিলে সারাদেশ এখন পাকা-গুজবের কারখানা! এধরনের ঘটনার কারণেই হয়তো দশের মানুষ আরো বেশি গুজব নির্ভর হয়ে পড়ছে, প্রভাবিত হচ্ছে গুজবে। সত্যিই এক অস্থির ও কাল্পনিক সময়ে যেন বাস করছে দেশের মানুষ।
শুধু বাংলাদশই নয়, এরকম ঘটনা ঘটে চলেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। তবে, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতেই সাধারণত এই ঘটনা বর্তমানে ঘটতে দেখা দেখা যায়। যেমন, ২০০১ সাল থেকে ভারতে গরুর মাংস খাওয়া বা ‘গো-হত্যা’র অভিযোগে যেভাবে নিরপরাধ মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করছিল উন্মত্ত জনতা, তা নিঃসন্দেহে সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের ভিত্তিমূল। জুলাই ২০১৯-এ, দেশটির পূর্বাঞ্চলে গরু চুরির অভিযোগে পিটিয়ে মারা হয়েছে তিনজনকে। ভারতে এর আগেও 'গো রক্ষকদের' দ্বারা পরিচালিত এ ধরনের হামলায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং সামাজিকভাবে নিম্নবর্ণ হিসেবে বিবেচিত গোষ্ঠীর সদস্যদের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা গরুকে পবিত্র প্রাণি হিসেবে মনে করে এবং গো হত্যা সেখানে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়।
ভারতে ডাটা জার্নালিজমের ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানীয় সংস্থা ইন্ডিয়াস্পেন্ডস’র সমীক্ষা বলছে ২০১২ ও ২০১৩ সালে যেখানে দুবছরে সারা দেশে এই ধরনের মাত্র দুটো ঘটনা ঘটেছিল, সেই জায়গায় ২০১৪ সালের পর থেকে এখনো পর্যন্ত এরকম ঘটনা ঘটেছে আরো অন্তত ৯২টি।
ভারতে গত চার-পাঁচ বছরে যে সব ‘মব লিঞ্চিং’ বা গণধোলাইয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে, তার বেশির ভাগের মূলেই গরু রক্ষার ইস্যু আছে বলে জানাচ্ছে একটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন।
শুধু ভারত নয়, প্রতিবেশি দেশ পাকিস্তানেও এধরনের নির্মম জনতার উন্মত্ততা বা গণপিটুনির ঘটনার উদাহরণ রয়েছে। ২০১৭ সালের এপ্রিলে পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় খাইবার পাখতুনখা প্রদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে কয়েকশ ছাত্র মাশাল খানকে ইসলাম অবমাননার অভিযোগে তার ছাত্রাবাস থেকে টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে এনে নৃশংসভাবে পেটায় এবং পরে গুলি করে হত্যা করে।
গণ-উন্মত্ততা বা মব লিঞ্চিংয়ের ইতিহাসটা অবশ্য পুরনো। লিঞ্চিং বা মব লিঞ্চিং শব্দটা এসেছে চার্লস লিঞ্চ নামে এক আমেরিকান নাগরিকের নাম থেকে। তিনি অষ্টাদশ শতকের লোক। ভার্জিনিয়া প্রদেশে তুলোর ক্ষেতের মালিক ছিলেন। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ব্রিটেনের অনুগামীদের শাস্তি দিতেন। বিচারের তোয়াক্কা করতেন না। কাউকে স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধী মনে হলেই সঙ্গে সঙ্গে মারতেন ফাঁসিতে ঝুলিয়ে।
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায় মব লিঞ্চিং-এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, তা হলো এক ধরনের দলবদ্ধ হিংসার বহিঃপ্রকাশ। ন্যায়বিচারের নামে কাউকে যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করা। ধরে নেওয়া হয়, সেই লোকটি কোনো অপরাধ করেছে। যদিও তার বিচার হয় না। লোকটি সত্যিই অপরাধ করেছিল কিনা, তা প্রমাণ করার দায় থাকে না কারো।
মধ্যযুগে জার্মানিতেও একরকমের মব লিঞ্চিং-এর ঘটনা জানা যায়। তখন কোনো বিশেষ ধরনের অপরাধীকে জনতার হাতে তুলে দেওয়া হতো। জনতা তাকে হত্যা করত। ইংল্যান্ডের কোনো কোনো জায়গায় এবং স্পেনেও ওই ধরনের শাস্তি চালু ছিল। মধ্যযুগের ইউরোপে অনেক দেশে মানুষ মনে করত ইহুদিরা বিধর্মী, পাপী। তাই জনতার হাতে তাদের অনেকে মারা পড়ত। এমন হত্যাকাণ্ড ঘটত প্রায়ই স্পেন, রাশিয়া ও পোল্যান্ডে।
মব লিঞ্চিং-এর জন্য সবচেয়ে কুখ্যাত আমেরিকা।
সেখানে একসময় তুলোর ক্ষেতে বড় সংখ্যক কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিক কাজ করত। তুলো চাষের অর্থনীতিই নির্ভরশীল ছিল কৃষ্ণাঙ্গদের শ্রমের ওপরে। তাদের কেউ অবাধ্য হলে বা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে জনতা পশুর মতো তাড়া করত তাকে। তারপর যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করত। অন্য কৃষ্ণাঙ্গদেরও শাসিয়ে রাখা হতো, তোমরাও যদি মালিকের কথা না শোনো, এরকম বীভৎস মৃত্যু আছে কপালে।
ইতিহাসবিদদের ধারণা, ১৮৮১ থেকে ১৯৬৮-র মধ্যে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে অন্তত ৪৭৪৩ জনকে মব লিঞ্চিং করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৩৪৪৬ জন কৃষ্ণাঙ্গ। দক্ষিণের ১২টি প্রদেশে ১৮৭৭ থেকে ১৯৫০-এর মধ্যে এইভাবে মারা হয়েছে ৪০৮৪ জনকে। বাকি ৩০০ জন মরেছে অন্যান্য প্রদেশে।
আমেরিকার দক্ষিণের রাজ্যগুলোতেই একসময় কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের দিয়ে তুলো চাষ করানো হতো। এখনো সেখানে বর্ণবৈষম্য বেশি। মব লিঞ্চিং-এর ঘটনাও সেখানেই বেশি। উন্মত্ত জনতার এমন আচমকা বিস্ফোরণের মানসিকতা নিয়ে গবেষণা হয়েছে অনেক, এখনো হচ্ছে। অনেকেই অনেক ধরনের কারণ চিহ্নিত ও বর্ণনা করেছেন। তবে মব ভায়োলেন্সের কারণ হিসাবে কয়েকটি বিষয়ে তাঁরা একমত।
প্রথমত, দেশের এক বড় অংশের মানুষ প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় আস্থা রাখে না। তাদের মতে, কোর্টে গেলে বৃথা সময় নষ্ট হবে। অপরাধীরা টাকার জোরে বা প্রভাব খাটিয়ে ছাড়া পেয়ে যাবে ঠিক। এই ভাবনা থেকে আইন হাতে তুলে নেওয়ার মানসিকতা সৃষ্টি হয়।
দ্বিতীয়ত, কোনো ধর্ম বা বর্ণের মানুষকে অপরাধী বলে ধারাবাহিকভাবে প্রচার করা হয়েছে জনতার মধ্যে। তাতে দেশের এক বড় অংশের মানুষ বিশ্বাসও করেছে। ফলে সেই সম্প্রদায়ের মানুষকে দেশের যে কোনো দুর্গতির জন্য দায়ী ভাবছে অনেকে। তাদের কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে প্রমাণ ছাড়াই বিশ্বাস করে ফেলছে।
তৃতীয়ত, আর্থিক ও সামাজিক বিপর্যয়ের মধ্যে মানুষ বড় একা হয়ে পড়েছে। সে চাইছে কোনো একটা গোষ্ঠীতে যোগ দিতে। সেই গোষ্ঠীর কাজকর্মকে নির্বিচারে সমর্থন করছে। তাদের হয়ে নানা হিংসাত্মক ঘটনায় অংশ নিচ্ছে।
চতুর্থত, জনতা ব্যক্তিরা এরূপ আচরণ করে যে তাদের কোনো প্রকার দায়িত্ববোধ আছে বলে মনে হয় না। দায়িত্ববোধের অভাব থাকায় জনতাভুক্ত ব্যক্তিরা অন্যের সুবিধা-অসুবিধা, অধিকার, অনুভূতি প্রভৃতি কোনো কিছুর তোয়াক্কা করে না৷ এজন্য জনতা মারপিট, ভাঙচুর, লুটতরাজ, অগ্নি-সংযোগ প্রভৃতি অসামাজিক কাজে সহজেই লিপ্ত হয়।
পঞ্চমত, জনতাভুক্ত ব্যক্তিরা নিজেদেরকে অসীম ক্ষমতার অধিকারী মনে করে। তারা মনে করে তাদের অসাধ্য কিছু নেই ৷ তাদের বাধা দিতে পারে এমন কোনো শক্তিও তারা স্বীকার করে না৷ তাই অনেক সময় দেখা যায় জনতা নিরস্ত্র হয়েও সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে ৷
ষষ্ঠত, জনতার মাঝে প্রতিটি ব্যক্তিই ভাবে সে যে আচরণ করছে তার জন্য সে একা দায়ী নয়, বরং গোটা জনতারূপ গোষ্ঠীই দায়ী| ব্যক্তি মনে করে সে তো একা করছে না। সবাই যে কাজটি করেছে তাতে সে অংশ নিচ্ছে মাত্র৷ কাজেই সে বিশ্বাস করে কৃতকর্মের জন্য তাকে কোন ঝুঁকি বহন করতে হবে না৷ তাছাড়া সে মনে করে ভিড়ের মধ্যে তাকে চিনবেই বা কে৷ নাম-ধাম, পরিচয় গোপন থাকার সুযোগ যেখানে রয়েছে সেখানে উচ্ছৃঙ্খল হতে বাধা কোথায়?
এইরকম গোষ্ঠীর মধ্যে ঢুকলে মানুষ ব্যক্তিগত স্বভাব-চরিত্র, রুচি, যুক্তিবোধ হারিয়ে ফেলে কিছুক্ষণের জন্য। হয়তো দেখা যাবে, যে লোকটা একটা কুকুরকেও কখনো ঢিল ছুঁড়ে মারেনি, সেই দাঙ্গার সময় মানুষ খুন করছে ঠান্ডা মাথায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মব ভায়োলেন্সে অংশগ্রহণকারীদের কোনো শাস্তি দেওয়া হয় না। প্রথমত অত লোককে শাস্তি দেওয়া এমনিতেই মুশকিল। তার ওপরে এই সব ক্ষেত্রে মানুষের সেন্টিমেন্ট কাজ করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, গণধোলাইয়ে অংশগ্রহণকারীদের কড়া শাস্তি দিয়ে মানুষের কাছে বিরাগভাজন হতে চায় না কোনো সরকারও।
তবে, আশার কথা হলো, এসব মব লিঞ্চিং বা সমষ্টিগত উন্মত্ততার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় প্রতিটি দেশের শান্তিকামী, সুস্থ চিন্তাধারণার মানুষগণ। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। বর্তমানে দেশে বিরাজমান গুজবের মহামারি ও জনতার উন্মত্ততার বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে দেশের জনগণ। গড়ে উঠছে সামাজিক প্রতিরোধ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও কঠোর ও সতর্ক অবস্থান গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ পুলিশের আইজিপি স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন, গুজব সৃষ্টি করবে ও আইন নিজের হাতে তুলে নিবে যারা, তাদেরকে কোনোরকম ছাড় দেওয়া হবে না। ধীরে ধীরে কমে আসছে এই নৃশংস ঘটনা। তবে, দেশের নাগরিকেরা চায় এসব গণ-নিষ্ঠুরতার সুষ্ঠু ও ত্বরিৎ বিচার করে করে অপরাধীদের দ্রুত শাস্তির ব্যবস্থাটি দেখতে। আর, যখন এধরনের কোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি যখন আর হবে না, তখনই বলা যাবে জাতি হিসেবে আমরা আসলেই সভ্য, সহিষ্ণু ও আধুনিক হতে পেরেছি।