অন্তরঙ্গ আবদুল্লাহ খালিদ
২০ মে এলে মনে পড়ে, শিল্পীবন্ধু সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ নাই আজ দু'বছর। কিন্তু কি দুর্ভাগ্য আমার, এপর্যন্ত এক কলম লিখতে পারিনি ওর জন্য। দেশে এত আজেবাজে ঘটনা ঘটতে থাকে যে, আজেবাজে মানুষ আর আজবাজে খবর নিয়ে লিখতে লিখতেই যেন সময় ফুরিয়ে যায়, এমনি একটা সময় এখন।
অথচ অপরাজেয় বাংলার স্রষ্টা সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ শুধু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব নয় বাংলাদেশের এক শ্রেষ্ঠ সন্তান। ঢাকা আর্ট কলেজে শিল্পকলায় হাতেখড়ি হলেও পড়ালেখা শেষ করেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রয়াত রশীদ চৌধুরী, দেবদাস চক্রবর্তী, মুর্তজা বশীরের মত বরেণ্য শিল্পীরা ছিলেন তার শিক্ষাগুরু।
আর তাদের যোগ্য উত্তরসুরী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের শ্রেষ্ট স্মারক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবনের সম্মুখে অপরাজেয় বাংলা দিয়েই তার শিল্পী জীবন শুরু এবং এটাই তাকে অমর করে রাখবে বহুদিন।
এ কাজটি করতে এখন একজন শিল্পী বা ভাস্কর কমপক্ষে দশ লক্ষ টাকা নিবে। কিন্তু খালিদ এক পয়সাও নেয়নি এবং মুক্তিযুদ্ধের নামেই তার এই অমরকীর্তিকে উৎসর্গ করেছেন।
এ কাজটি সম্পন্ন করতে খালিদকে তিনটি বছর অমানুষিক কষ্ট করতে হয়েছে। শিল্পীরা সাধারণতঃ এ ধরনের বিশাল ভাস্কর্য নির্মানে বিভিন্ন ধরনের ক্লে বা মাটি, সিরামিকস ইত্যাদি ব্যবহার করে থাকে কিন্তু খালিদ পাথরের উপর কাজ করেছে। তিনটি বছর অনবরত পাথরের উপর হাতুড়ি-বাটালি-খন্তা চালিয়ে নিজের দু'হাতকে রক্তাক্ত করেছে। এই ভয়ংকর ব্যাপারটি নিয়ে কেউ প্রশ্ন করলে সে বলত, "আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারিনি, যেখানে লাখো মানুষ জীবন দিয়েছে, অতএব এটা আমার যৎসামান্য ঋণশোধের চেষ্টা মাত্র।"
এমন একজন মহৎপ্রাণ মানুষ তার জীবদ্দশায় কতটুক সম্মান পেয়েছে জানিনা। তবে ক্ষমতাসীনদের থেকে সবসময় কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে চলত বলে খালিদ অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হয়েছে। মাত্র কয়েক বছর আগে বন্ধু নাট্যকর্মী ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের আপ্রাণ চেষ্টায় একুশে পদক তার কপালে জুটেছিল, যদিও অনেকের মতে, আজকাল এটা আর কোন সম্মানজনক পদক নয়।
'অপারেজেয় বাংলা' ছাড়াও তার আরো অনেক উল্লেখ্যোগ্য শিল্পকর্ম রয়েছে। যার মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সৌধ, নেভাল একাডেমির ডলফিন, মিলিটারি একাডেমিতে গল্ফারের ভাস্কর্য এবং জয়দেবপুর সহ ঢাকা ও ঢাকার বাইরে কিছু কাজ।
বছর খানেক আগে ঢাকা হাইকোর্টের সামনে থেকে বিশিষ্ট শিল্পী মৃণাল হকের সেই বিখ্যাত নারী মুর্তি 'লেডি জাস্টিস' সরিয়ে ফেললে শিল্পী কেঁদেছিল এবং সেই ছবি নিয়ে ব্যাঙ্গ করেছিল কিছু নিচু মনের মানুষ। একজন শিল্পীর সঙ্গে তার শিল্পকর্মের কি ধরনের আবেগমিশ্রিত সম্পর্ক থাকে, তা আবদুল্লাহ খালিদের ক্ষেত্রে আমি খুব কাছ থেকেই দেখেছি। বিশেষ করে কোন মহৎ কর্ম শেষ হুওয়ার মুহুর্তে শিল্পী তার সৃষ্টির সংগে এমন একাত্ম হয়ে যায় যে, তখন সে অন্য মানুষ হয়ে যায়। সারাদিনের কাজ শেষে সে সব সহকারী বা ছাত্রছাত্রীদের বিদায় দিয়ে নিজে একা পড়ে থাকত তার শিল্পকর্মের সঙ্গে, যেন একটি মহৎ সৃষ্টির প্রসব বেদনা শুরু হয়েছে। শিল্পী নিজেই বেদনাতুর হয়ে পড়ত এবং তাবু থেকে বেরিয়ে এসে তার সন্তানবৎ শিল্পকর্মটির সংগে বিড়বিড় করে কি যেন বলত, গায়ে হাত বুলাত, চারদিকে কিছুক্ষণ হাটত।
মাঝে মাঝে খালিদ নিকটতম কোন বন্ধুকে সাথে রাখতে, অন্ততঃ দু'রাত আমিও তার সংগী ছিলাম। একবার নেভাল একাডেমিতে খালিদ মধ্যরাতে ডলফিনের কাজ প্রায় শেষ করার মুহুর্তে আনমনে হাঁটতে হাঁটতে কর্ণফূলীর দিকে যেতে থাকে। অবচেতন মনে সে নিজেই তখন ডলফিন হয়ে গিয়েছিল এবং খুব ইচ্ছে হচ্ছিল ডলফিনের মত নিজেও নদীতে ঝাঁপ দিয়ে একটু সাঁতার কাটবে। কিন্তু তার সেই ভয়ংকর ইচ্ছে আর পূর্ণ হয়নি তাকে অনুসরন করা নেভাল গার্ডদের হস্তক্ষেপের কারণে।
এজন্য তাকে কেউ কেউ পাগলা খালিদ বলত। কিন্ত এই পাগলের মাঝে যে কি ছিল তা কয়জনেই জানে! হাঁ, জিনিয়াসদের যা হয়, খালিদ ছিল তেমনি। এক দারুণ আত্মভোলা ও ছন্নছাড়া মানুষ এবং সুখ নামক সোনার হরিণ কখনো তাকে ধরা দেয়নি। প্রকৃতপক্ষে তার দ্বিতীয় ছেলে অহীর অকাল মৃত্যুই ছিল খালিদের মৃত্যুর কারণ। ছেলেকে অনুসরণ করে অল্পদিনের মধ্যে বাবাও চলে যায় সেই অচেনা জগতে দু'বছর আগের আজকের এই দিনে (২০ মে)। বন্ধু হিসেবে তার স্মৃতিকে স্মরণ করছি। তার স্মৃতি আমরণ বুকে ধরে রাখার চেষ্টা করব।