'এক বর্ষার বৃষ্টিতে যদি মুছে যায় নাম'
বাংলার আকাশে মেঘ থাকবেই। ষড়ঋতুর দেশে বৃষ্টিও হারিয়ে যাবে না। যদিও আসছে বুধবার (১৫ আগস্ট মোতাবেক ৩১ শ্রাবণ) পঞ্জিকা ও ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে বিদায় নেবে বর্ষাকাল। বর্ষাবিদায়ের ক্ষণে মনে পড়ছে একটি কবিতার প্রথম লাইন: 'এক বর্ষার বৃষ্টিতে যদি মুছে যায় নাম/এত পথ হেঁটে এত জল ঘেটে কি তবে পেলাম?'
বর্ষাকে সামনে রেখে নিজের জীবনকে নিয়ে এ প্রশ্নটি করেছিলেন আধুনিক কালের কবি নরেশ গুহ, 'বর্ষার বৃষ্টিতে' শিরোনামের কবিতার মাধ্যমে। নরেশ গুহ (১৯২৪-২০০৯) কবি ও প্রাবন্ধিক। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক। ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন কবিতা পত্রিকার সম্পাদনায়। পেয়েছেন পশ্চিম বঙ্গের সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার। ছিলেন বুদ্ধদেব বসুর প্রিয়ভাজন।
নরেশ গুহ বর্ষাকে যেভাবে দেখেছেন, প্রাচীন কবিরা তেমন দৃষ্টিতে দেখেন নি। অনাগতকালে বর্ষাকে কিভাবে দেখা হবে উত্তরাধুনিক নাগরিক জীবনে, সেটাও এক বড় প্রশ্ন। 'নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে/ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে', রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই উপদেশ মেনে ঘরে থাকা বর্তমানের বর্ষায় আদৌ সম্ভব নয় বিশ্বায়নের স্রোতেভাসা মানুষের পক্ষে। নাগরিক যন্ত্রণা ও পীড়ন রূপী বর্ষার জলে নাম, যশ, কীর্তি, পেশা, ভবিষ্যৎ মুছে ফেলাও অসম্ভব বাংলাদেশের সংগ্রামশীল মানুষের পক্ষে। লড়াইয়ের পথেই দীর্ঘতম বর্ষাকে বরণ করতে হচ্ছে মানুষকে।
কারণ, বর্ষাকাল বাংলাদেশের প্রকৃতির এক প্রলম্বিত ঋতু। বসন্তের অর্ধেক থেকে (চৈত্র মাসেই শুরু হয় ঝড় ও বৃষ্টি) হেমন্তের শুরু পর্যন্ত চলে বৃষ্টির দাপট। কখনোও শীতে অকস্মাৎ ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ে শীতার্ত বাংলায়
এটা ঠিক যে, চিরায়ত বাংলার স্মৃতিপটে যে বর্ষার ছবি আঁকা রয়েছে, বাস্তব জীবনে বর্ষার চিত্র তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখন বর্ষা ঋতুর আসা-যাওয়ার সময়ই টের পাওয়া যায় প্রকৃতি, পরিবেশ, মানুষ, মানুষের অভ্যাস সময়ের হাত ধরে কেমনে বদলে গেছে! প্রকৃতি উপভোগের বর্ষা হয়ে গেছে নাগরিক সংগ্রামের নামান্তর।
অথচ বৈচিত্র ও রোমাঞ্চে ভরা বর্ষাকে নিয়ে কবিতা রচনা করেছেন প্রাচীন কালিদাস। রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান আর কবিতা দখল করে রেখেছে কবির সৃষ্টিভান্ডারের সিংহভাগ। কল্পনায়, আবেগে বর্ষার যে চিরায়ত রূপ বাংলার প্রায়-প্রতিটি কবিই এঁকেছেন দরদ ভরা অক্ষরে, প্রেমে, স্মৃতিকাতরতায়, তা যেন ক্রম-অপস্রিয়মাণ।
সেই আদি ওও অকৃত্রম বর্ষাকে একবিংশ শতকের প্রথমভাগের এই সময়ে যদি চিত্রিত্র করতে হয়, তবে তা প্রাচীন বর্ণনার চেয়ে অন্য রকম হয়ে যাবেই। ফলে অনাগতকাল সম্ভবত দেখতে পাবে বর্ষার অন্য রকম রূপ। সে চিত্র আনন্দ বা উপভোগের হবে, নাকি কষ্ট ও বেদনার হবে, সে প্রশ্নও থাকবে।
বর্ষা ঋতুর বিদায়কালে ভয় হয়, বাংলার প্রকৃতি থেকে চিরন্তনী বর্ষার বিভা ও সৌন্দর্য যেন ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে পদ্মপুকুর, টুইটুম্বুর নদী, শাপলা-শালুকের বিল-ঝিল। হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের বৃষ্টিগন্ধী স্মৃতির টাপুরটুপুর।
আধুনিকতা আমাদের যা দিচ্ছে, হয়ত নিচ্ছে অনেক বেশি। কিন্তু মানুষের সুন্দর ও অগ্রসর বেঁচে থাকার জন্য আধুনিকা চাই, প্রকৃতিও চাই। চাই প্রকৃত বর্ষার জীবনদায়ী বারিপাত।
অতএব, চিরায়ত বর্ষা হারিয়ে যাক, চাই না। চাই না, এক বর্ষার বৃষ্টিতেই নাম, যশ, স্মৃতি, সত্ত্বা, অর্জন মুছে যাক। বরং বার বার ফিরে ফিরে আসুক বর্ষা। আবার বৃষ্টির উল্লাসে জাগ্রত করুক প্রাণ ও প্রকৃতি।
বর্ষা, নেভার সে য়ু গুডবাই!