মনে পড়ে তাদের কথা?
রোমান্টিক জুটি ছাড়া কি আর বাংলা সিনেমা হয়? মোটেই না। প্রায় সবক’টা বাংলা সিনেমার কেন্দ্রই যেখানে প্রেম, জুটি ছাড়া উপায় কী! বাংলা চলচ্চিত্রের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত অনেক জুটি দেখেছে দর্শক। কতজনকেই বা মনে রেখেছে? সেটা যে যার মতন ভেবে নিক।
আপাতত জেনে নেওয়া যাক পাঁচটি উল্লেখযোগ্য জুটি সম্পর্কে।
রাজ্জাক-কবরী
সময়কাল ১৯৬৭।
সুভাষ দত্তের পরিচালনায় মুক্তি পায় ‘আবির্ভাব’। এর মাধ্যমেই রূপালী পর্দায় আসেন রাজ্জাক-কবরী। শুরু হয় তাদের সফলতা, দর্শকপ্রিয়তা।
দেখুন, চিরসবুজ নায়ক জাফর ইকবাল
১৯৬৯ সালে কাজী জহিরের ‘ময়নামতি’ ও মিতার ‘নীল আকাশের নিচে’, ১৯৭০ সালে নজরুল ইসলামের ‘দর্পচূর্ণ’, মিতার ‘দীপ নেভে নাই’, কামাল আহমেদের ‘অধিকার’ চলচ্চিত্রে রাজ্জাক-কবরী জুটির প্রেমের অনবদ্য উপস্থাপন দর্শকের মনে তুমুলভাবে স্থান করে নেয়।
সে সময় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল উত্তাল। একদিকে পাকিস্তানী শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় উর্দু সিনেমার রমরমা বাজার, অন্যদিকে পূর্ববাংলার জনগণের মধ্যে জেগে উঠছে বাংলাভাষার প্রতি ভালবাসা ও দেশপ্রেম, বাঙালীর মধ্যে বিকশিত হচ্ছে অসাম্প্রদায়িক জাতীয় চেতনা।
দেখুন, আসিফকে নিয়ে কেন ছবি বানাচ্ছেন সৈকত নাসির?
সেই পরিস্থিতিতে উর্দু সিনেমার জনপ্রিয় জুটি শবনম-রহমান ও শাবানা-নাদিমের বিপরীতে পাল্লা দিয়ে এগুতে থাকে রাজ্জাক-কবরী জুটি। স্বাধীনতার পরেও সমানতালে জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে রাজ্জাক-কবরী জুটির।
তাদের অভিনীত ‘রংবাজ’ ছবিটিকে ‘ট্রেন্ড সেটার’ হিসেবে ধরা হয়। সে সিনেমায় লাস্যময়ী কবরীর দেখা পায় দর্শক। সুপারহিট হয় সিনেমাটি।
দেখুন, সেক্সি জয়া!
এ ছবির ‘সে যে কেন এল না, কিছু ভাল লাগে না’ গানটি দর্শকের মুখে মুখে ফেরে। প্রেমিক-প্রেমিকা জুটি হিসেবে আজও নক্ষত্রসম রাজ্জাক-কবরী। তারা ষাটের অধিক সিনেমায় এক সঙ্গে অভিনয় করেন।
শাবানা-আলমগীর
পরিচালক এহতেশামের হাত ধরে বাংলা চলচ্চিত্রে পদার্পণ করেন মিষ্টি মেয়ে ‘রত্না’।
দেখুন, নতুন ছবির ‘পুরনো’ প্রচার
পরিচালক সেই ‘রত্না’ নাম বদলে নাম দিলেন ‘শাবানা’। সেই থেকে শুরু হলো বাংলা চলচ্চিত্রের এক লক্ষ্মীদেবীর যুগ, যা ছিল একটানা ’৭০-৯০ দশক পর্যন্ত দুর্দান্ত প্রতাপে। শাবানা বেশ কয়েকজন নায়কের সঙ্গে জুটি বেঁধে অভিনয় করেছেন। তবে, সবাইকে ছাপিয়ে গেছেন আলমগীর।
আলমগীর-শাবানা জুটি এখন পর্যন্ত গ্রামবাংলা ও নগরের প্রায় সবার কাছেই সামাজিক ও পারিবারিক ছবির জনপ্রিয় জুটি। দেশীয় চলচ্চিত্রের জুটি প্রথার ইতিহাসে ‘আলমগীর-শাবানা’ জুটি হয়ে সর্বাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন।
তাদের অভিনীত ছবি ১২৬টি, যার বেশিরভাগই ব্যবসাসফল। এসব ছবিতে কখনও গরিব-দুঃখী এক নারী, কখনও শহরের আধুনিক মেয়ে, কখনও স্বামীভক্ত বাংলার চিরচেনা স্ত্রী, কখনও ভাবি, কখনও মা, কখনও এক প্রতিবাদী নারী- এমন সব চরিত্রে অভিনয় করে পুরোটা সময় দর্শকদের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতেন শাবানা।
দেখুন, মাইকেল জ্যাকসনের যে বারোটি বিষয় কম জানে মানুষ।
তিনি এমনই এক দুর্দান্ত অভিনেত্রী ছিলেন, যিনি সব অভিনেত্রীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পুরস্কৃত হয়েছেন। আলমগীরও কোন অংশে কম যাননি। সহকর্মী অনেকের কাছেই ভাললাগার অভিনয় শিল্পীদের মধ্যে আলমগীরের নামটাই উচ্চারিত হয় আগে। তাদের কাছে আলমগীর মানেই অভিনয়ে ভিন্নতা, পর্দায় প্রাণবন্ত উপস্থিতি।
নাঈম-শাবনাজ
তখন ১৯৯০।
প্রয়াত বরেণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা এহতেশাম তাঁর নতুন চলচ্চিত্র ‘চাঁদনী’র জন্য দুজন নতুন মুখ বাছাই করেন। সেই দুজনই হলো নবাব পরিবারের ছেলে নাঈম আর বিক্রমপুরের মেয়ে শাবনাজ। প্রথম ছবিতেই জুটি হিসেবে ব্যাপক সাড়া ফেলেন নাঈম-শাবনাজ।
দেখুন, জ্যোতিকা জ্যোতির গ্রাম ও সংগ্রামের গল্প
এরপর তারা একের পর এক অভিনয় করেন ‘লাভ’, ‘চোখে চোখে’, ‘দিল’, ‘টাকার অহঙ্কার’, ‘ঘরে ঘরে যুদ্ধ’, ‘সোনিয়া’ ও ‘অনুতপ্ত’সহ আরও বেশ কয়েকটি ছবিতে। প্রতিটি ছবিই জনপ্রিয় ও ব্যবসাসফল হয়েছিল।
নাঈম-শাবনাজের মাধ্যমেই নব্বই দশকের বাংলা চলচ্চিত্র আবার মাথা তুলে দাঁড়ায়। শুরু হয় চলচ্চিত্রের নতুন স্বর্ণযুগের। যার রেশ ধরে আগমন সালমান শাহ, মৌসুমী ও শাবনূরের মতো মহাতারকার। চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে গিয়েই ঘনিষ্ঠ হন নাঈম-শাবনাজ। শুরু থেকেই তাদের প্রেম কাহিনী মিডিয়ায় আসে।
দেখুন, নতুনদের জন্য ফারুকের পরামর্শ
কিন্তু প্রথা অনুযায়ী সেসব অস্বীকার করলেও অবশেষে সব জল্পনা-কল্পনা ভেঙে ১৯৯৬ সালে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন এ জুটি। এরপর ২০০০ সালের প্রথম দিকে চলচ্চিত্রে অশ্লীলতা শুরু হলে নীরবে এ জগত থেকে আড়ালে চলে যান তারা।
সালমান-মৌসুমী
নব্বইয়ের দশক।
বাংলাদেশী চলচ্চিত্র তখন সর্বজনীনতা হারিয়ে শ্রেণী বিশেষের বিনোদন মাধ্যমে পরিণত হয়। চলচ্চিত্রের অক্সিজেন বলে খ্যাত বাংলার মধ্যবিত্ত সমাজ মুখ ফিরিয়ে নেয় সিনেমা হল থেকে।
দেখুন, পরিচালকের ছবি ছিনতাই!
হঠাৎ করেই নব্বইয়ের শুরুর দিকেই আবির্ভাব হয় বাংলা চলচ্চিত্রের প্রবাদ পুরুষ সালমানের। তার হাত ধরে চলচ্চিত্র আবার গতি পায়, পরিচালকরা নতুনভাবে লড়াইয়ে নামে, ইন্ডাস্ট্রিও লাভের মুখ দেখতে থাকে।
শুরুর দিকে সালমানের সঙ্গী ছিল মৌসুমী। মাত্র চারটি ছবিতে একসঙ্গে অভিনয় করেছেন সালমান-মৌসুমী জুটি। তবুও অভিনয় দক্ষতা, সৌন্দর্য, ফ্যাশন সচেতনতা ও ব্যক্তিত্ব গুণে এ জুটি আজও সমান জনপ্রিয়।
দেখুন, চিরকুটের লন্ডন কনসার্ট
সালমানকে যেমন ‘স্টাইল অবতার’ হিসেবে স্বীকার করা হয়, মৌসুমীও তেমনি এখনও দ্যুতি ছড়াচ্ছেন। তাদের প্রথম ছবি ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ মুক্তির পর পরই তারা হয়ে উঠেছিলেন দর্শকদের কাম্য জুটি।
এ ছবিটি মূলত ভারতের আমির-জুহির ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’ ছবির বাংলা সংস্করণ। ছবিটি মূল ছবির প্রযোজক ও পরিচালকের অনুমতি নিয়েই তৈরি করা হয়েছিল।
দেখুন, মুকুটহীন সম্রাটের চলে যাওয়ার পঞ্চম বছর
‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছিল তোজাম্মেল হক বকুলের ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’ ছবির পর রেকর্ড করা ব্যবসা সফল ছবি, যা দেখতে সারা বাংলার সব মানুষ হলে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল।
সালমান-শাবনূর
‘তুমি আমার (১৯৯৪)’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে সালমানের সঙ্গে জুটি বাঁধেন শাবনূর।
প্রথম ছবিতেই ব্যাপক সফলতা পায় এ জুটি। যার ফলে পরিচালক-প্রযোজকরা একের পর এক ছবিতে নিতে থাকেন তাদের। সালমান অভিনীত ২৭টি ছবির মধ্যে ১৪টি ছবিতেই তার বিপরীতে অভিনয় করেছেন শাবনূর।
দেখুন, জন্মদিনে কালিকাপ্রসাদ
ঢাকাই ছবির জগতে অন্যতম সফল এই মহাকাব্যিক রোমান্টিক জুটি ভক্তদের কতটা ভেতরে প্রবেশ করতে পেরেছিল, তা তো সবাই-ই জানেন। তরুণদের পোশাকে সালমানের কালোত্তীর্ণ ফ্যাশন, কণ্ঠে সালমানের সিনেমার গান।
সালমানের মাথায় কাপড় প্যাঁচানো, হ্যাট, চশমা, গেঞ্জি- কী নকল হয়নি না তখন তরুণদের মাঝে! সবাই ভাবত তাদের মধ্যে বাস্তবেও বোধহয় ভিন্নরকম সম্পর্ক ছিল। এসব নিয়ে কম কথাও রটেনি সিনেমাঙ্গনে।
দেখুন, সাঞ্জু ছবির অজানা সাত
কিন্তু শাবনূর জানালেন, ‘সালমান শাহ আমার খুবই প্রিয় ছিল। সে আমাকে পিচ্চি বলে ডাকত। আমি তো তখন অনেক ছোট ছিলাম। সালমান বলত- এই পিচ্চি এদিক আয়, আমার তো কোন বোন নেই। এই পিচ্চি তুই আমার ছোট বোন।’
সালমান বেঁচে থাকলে হয়ত আরেকটি উত্তম-সুচিত্রা জুটি হতে পারত সালমান-শাবনূর জুটি। তাদের দিয়ে বানানো যেত ‘হারানো সুর’, ‘সাগরিকা’, ‘সপ্তপদী’র মতো অনেক কালজয়ী চলচ্চিত্র।
আরও পড়ুনঃ