সম্প্রতি, কোক স্টুডিও বাংলা থেকে প্রচারিত হয়েছে ‘মা লো মা’ গানটি। গানটি প্রচারের পর পর থেকেই এর প্রকৃত স্বত্ব নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্কের ঝড়। কোক স্টুডিওতে গানটি পরিবেশনের সময় বাউল সাধক খালেক দেওয়ানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এই গান প্রকাশ এবং নাম উল্লেখ করার পর থেকেই বাউল সাধক রশিদ উদ্দিনের অনুসারীরা দাবি করছেন, গানটি রশিদ উদ্দিনের রচিত।
এখন কথা হচ্ছে, ‘মা লো মা’ গানটির একটি ভার্সন আমি প্রয়াত খালেক দেওয়ানের নিজের মুখের শুনেছি। সেখানে তিনি এই গানকে নিজের লেখা গান বলে উচ্চারণ করেছেন। বাউল সাধক রশিদ উদ্দিনের লেখা গানটিও শুনেছি। গান দুটির কথার মধ্যে সম্পূর্ণ মিল নেই। দুটির মধ্যে কিছুটি ভিন্নতা দৃশ্যমান।
এখনো আমাদের দেশে কয়েক প্রজন্মের মানুষ আছেন, যারা জ্ঞানী- গুণী, সাধক শ্রেণি। তাদের থেকে শুরু করে অনেক প্রবীণ ও বিজ্ঞজনদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি, বাউল সাধক রশিদ উদ্দিন যে গানটি লিখেছেন এবং বাউল সাধক খালেক দেওয়ান যে গানটি লিখেছেন, দুটি গানের কথায় বেশ ভিন্নতা রয়েছে। গানের ভেতর অনেক কথা ও ভাষারও ভিন্নতা রয়েছে।
তারা বলছেন, তৎকালীন সময়ে ‘মা লো মা ঝি লো ঝি’ বা ‘মাগো মা ঝিগো ঝি’ এগুলো প্রচলিত বাগধারা বা শ্লোকের মতো ছিল। অনেকেই এই শ্লোক ব্যবহার করে গান লিখতেন, কবিতা লিখতেন। সেক্ষেত্রে ‘মা লো মা’ বা ‘মাগো মা’ থাকলেই সে গান শুধুমাত্র একজনেরই, এটা দাবি করার কোনো সুযোগ নেই।
বাউল সাধক খালেক দেওয়ান নিজের প্রকাশিত যে গীতবিতান রয়েছে, সেখানেও তাঁর এই গানটি রয়েছে। তাঁর সমসাময়িক অনেক প্রবীণ ব্যক্তি জানিয়েছেন, গানটি তাঁর নিজের লেখা এবং তিনি এটি অনেকবার অনেক স্থানে গেয়েছেন বলে ব্যক্ত করেছেন। আবার অনেক প্রাজ্ঞজন বলেছেন, এই গানটির বাউল সাধক রশিদ উদ্দিনের রচিত একটি ভার্সনও রয়েছে, যেখানে ভাষাগত কিছু ভিন্নতা রয়েছে। রশিদ উদ্দিনের গানটি মূলত ‘মাগো মা ঝি গো ঝি’ কিন্তু খুবই সাদৃশ্যপূর্ণ!
আবার অনেক গবেষক বলছেন যে, সংগীতের ক্ষেত্রেও অনেক কাকতালীয় বিষয় থাকে। সেক্ষেত্রে এখানেও হয়ত এই গান রচনার ক্ষেত্রে এমন কিছু ঘটেছে বা ঘটে থাকতে পারে। যেমন- একজনের ভাবের সঙ্গে আরেকজনের ভাব মিলে যেতে পারে বা কারো গানের কথার সঙ্গে আরেকজনের কথাও মিলে যেতে পারে কাকতালীয়ভাবেই, যেটা আমাদের সম্পূর্ণভাবে বিচার করার সুযোগ নেই।
এবার মূল কথায় আসা যাক। গানটি নিয়ে যে দুজন রচয়িতা সম্পর্কে যে বিতর্ক হচ্ছে, তাঁরা দুজনই এখন প্রয়াত। তাঁরা দুজনই ছিলেন বাউল সাধক। এখন তাঁরা আর কেউ এই পৃথিবীতে বেঁচে নেই। তৎকালীন সময়ে এই সাধক ও সংগীত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের গুরুভিত্তিক চর্চার ব্যবস্থা ছিল। সেখানে একে অপরের সঙ্গে দেখা হতো। কথা হতো। বিভিন্ন অঞ্চলের গান ও সুর নিয়ে একে অপরের সঙ্গে বাক্য ও ভাব বিনিময় হতো। তৎকালীন সময়ে একজন সাধক বা বাউল আরেকজনের সঙ্গে মিলেমিশে গান রচনা করতেন।
একজন আরেকজনের সঙ্গে আত্মিক মিলনে আবদ্ধ থাকতেন। তাঁরা নিজেদের অভিন্ন সত্তা বলে মনে করতেন। বাউল সাধক রশিদ উদ্দিন এবং বাউল সাধক খালেক দেওয়ান দুজনই ২০ বছরের ছোট বড়। তাঁদের ভেতরে যে সম্পর্কের গভীরতা হৃদয়ের তলদেশকে স্পর্শ করেনি, সেটা আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না! কিন্তু একটু অনুধাবন করতে পারি, যেহেতু তাঁরা দুজনই বাউল সাধক, সেহেতু তাঁদের ভেতর একটি আত্মিক বন্ধন ছিল, এটা অনিবার্য হয়ত!
তাঁরা বেঁচে থাকলে হয়ত এই বিষয় নিয়ে কোনো বিতর্কই হতো না। কারণ, তাঁরা এই জাগতিক নাম ও নিজস্বতার অনেক ঊর্ধ্বের মানুষ। তাঁদের মধ্যে হয়ত ভিন্ন শরীরে অভিন্ন আত্মার যোগসূত্র ছিল। যেহেতু, তাঁরা দুজনই শ্রদ্ধেয় এবং দুজনই প্রয়াত, তাঁদের কারো সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলার আর কোনো সুযোগ নেই। সেক্ষেত্রে এটা আমরা অনুমান করে নিতে পারি যে, এক্ষেত্রেও কাকতালীয়ভাবে এমনটাই ঘটেছে হয়ত।
খালেক দেওয়ান এবং রশিদ উদ্দিন সাহেব দুজনই আমাদের বাংলার সুফি জগতের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। তাঁদের কাছ থেকে আমরা অনেক অনেক মূল্যবান সংগীত ও জ্ঞানের আলোর সন্ধান পেয়েছি। তাঁরা দুজনই আবহমান বাংলার আকাশে আলোর প্রদীপ স্বরূপ!
কোনো বিষয় নিয়ে বিতর্ক করলে সারাদিনই করা যায়। কিন্তু বিতর্কের সমাধানের পথের সন্ধান বেশি জরুরি। কারণ, অযথা ও অযাচিত বিতর্কে সমাজ পিছিয়ে যায়। আমরা সংগীত ও সংস্কৃতিতে এমনিতেই দিনে দিনে পিছিয়ে যাচ্ছি। তার ভেতর যদি নিজেদের আত্মিক বন্ধনের জায়গায় এমন ফাটল বা বিচ্ছেদের সূত্রপাত হয়, তাহলে আমরা ডুবে যাবো খুব দ্রুতই।
আমি কোক স্টুডিও’র গানটি শুনে দেখলাম, কোক স্টুডিও খালেক দেওয়ানের ভার্সনটিই করেছে। এখানে কণ্ঠ দিয়েছেন একজন আরিফ দেওয়ান এবং অন্যজন শরফুউদ্দিন দেওয়ান ওরফে সাগর দেওয়ান। গানটির সার্বিক কম্পোজ করেছেন প্রীতম হাসান।
আমাদের এই প্রযুক্তির নতুনত্বের ভিড়ে ধীরে ধীরে আমরা হারিয়ে ফেলছি, আমাদের ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত সব বিষয়, আঞ্চলিক বিষয়। আমাদের সেই আব্বাস উদ্দিন, বিজয় সরকার, জসিমউদ্দীন, খালেক দেওয়ান, রশিদ উদ্দিন, উকিল মুন্সি, যারা হচ্ছেন, বাংলার গানের ভুবনের প্রাণ ভ্রমর অথচ তাদের গান এখন আর কেউ শোনে না, গায়ও না। কারো মুখে এখন আর এই সব গান শোনা যায় না।
যখন কোনো বিষয়ের অনুশীলন বন্ধ হয়ে যাবে, তখন সে বিষয়টিও আমাদের থেকে ধীরে ধীরে বিলুপ্তির দিকে অগ্রসর হবে। তাই, অবশ্যই আমাদের সবাইকে সম্মিলিতভাবে কোক স্টুডিও’র এই প্রচেষ্টার সঙ্গে সহমত সমেত মানসিক সহযোগিতা প্রদান করতে হবে, যাতে গানগুলো আবার নতুন করে প্রাণ ফিরে পাওয়ার সুযোগ পায়।
এক্ষেত্রে কোক স্টুডিও এবং প্রীতম হাসান একটি অনন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তারা সম্মিলিতভাবে বাংলার ঐতিহ্যবাহী ও আঞ্চলিক গানগুলোকে নতুন করে মানুষের মুখে মুখে রটানোর ব্যবস্থা করেছেন।
আমাদের যে নতুন প্রজন্ম, তারা মূলত আমাদের জারি, সারি, বিচ্ছেদ, ভাটিয়ালি, এসব গানের সঙ্গে খুব একটা পরিচিত নন। আমাদের এই নতুন প্রজন্মকে ওই সব গান ও গানের রচয়িতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়াটাকে আমি সম্মানের সঙ্গে স্বাগত জানাই।
এখন তরুণদের মুখে মুখে বেজে উঠেছে, ‘মা লো মা’ গানটি। তারা গাইছেন। তারা বুঝতে পারছেন, তাদেরও এমন সংগীতের গুরুত্বপূর্ণ ভাণ্ডার রয়েছে। সেক্ষেত্রে প্রীতম হাসান অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
‘মা লো মা’ গানটির ভেতর সাগর দেওয়ান নামে প্রয়াত খালেক দেওয়ানের বর্তমান প্রজন্মের একজন কণ্ঠ দিয়েছেন। সাগর দেওয়ানের কণ্ঠ গানটিকে একটি অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তার কণ্ঠে সুরের যে মনিহারখচিত হীরা বসানো রয়েছে, সেটা ওই গানের ভেতর দিয়ে তার কণ্ঠের মুগ্ধতায় ছুঁয়ে গেছে ভক্তদের হৃদয়। সাগর দেওয়ানের কণ্ঠের নাগপাশে আবদ্ধ হয়েছেন সব সংগীত অনুরাগীরা।
কোক স্টুডিও এই যে, একটি ধারার প্রচলন করেছে, তারা নতুন ও প্রতিভাবান শিল্পীদের খুঁজে খুঁজে বের করে তাদের নিয়ে কাজ করা, এটি অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। এর আগেও আমরা ‘দেওরা’ গানে ইসমাইল উদ্দিনসহ আরো অনেক নিভৃত প্রতিভাকে নিয়ে কোক স্টুডিওকে কাজ করতে দেখেছি, যা অবশ্যই কষ্টসাধ্য অনুসন্ধানের ফলেই সম্ভব হয়েছে।
পৃথিবীতে আর যত আনন্দ ও মুগ্ধতার বিষয় রয়েছে, তার মধ্যে সংগীত সর্বশেষ্ঠ। সংগীত সম্পর্কে জার্মান কবি ও দার্শনিক ফেডরিক নীৎসে বলেছেন, ‘আমি যখন নিজেকে হারিয়ে ফেলি তখন আমি গুন গুন করে গান গাই। গানের মধ্যে ডুবে গিয়ে আমি আবার নিজেকে খুঁজে পাই’!
গান সম্পর্কে সাধক রামপ্রসাদ বলেছেন, ‘গান হচ্ছে, এমন সুবাস, যা আমাদের সকল প্রাণকে এক অদৃশ্য সুতোয় বেঁধে রাখে। গান আমাদের সকল প্রাণের অনুভূতির একত্রিত জাগরণ’!
সর্বোপরি, আমাদের অঞ্চলে কোক স্টুডিও বাংলার হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী সংগীত ও সংস্কৃতিকে নতুনভাবে টেনে তোলার জন্য যে আপ্রাণ চেষ্টা করছে, তা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে।
আমরা যে তর্কে জড়িয়ে পড়েছি, এই তর্কের আসলে প্রকৃত ও নির্দিষ্ট কোনো সমাধান নেই। আমাদের দুই বাউল সাধক পরিবারের উভয়েরই উভয়ের প্রতি সহমর্মিতা সমেত বিষয়টি গ্রহণ করতে হবে। কারণ, কপিরাইট অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রশিদ উদ্দিনের ‘মাগো মা’ কিংবা খালেক দেওয়ানের ‘মালো মা’—কোনো গানই কপিরাইট অফিসে নিবন্ধন করা নেই। ফলে, গানটির মূল স্রষ্টা কে, তা কপিরাইট অফিস সঠিকভাবে বলতে পারছে না।
আবার লোকসংস্কৃতি–গবেষক সাইমন জাকারিয়া বলেন, ‘বাংলা লোকসংগীতের অনেক গান খুবই সমস্যাপূর্ণ। এসব নিয়ে আলাপ করতে গেলে এই নিয়ে অনেক বিতর্ক হবে’।
তাহলে এই যখন অবস্থা, সেক্ষেত্রে আমাদের সহমর্মিতা সমেত বিষয়টিকে গ্রহণ ছাড়া এই বিতর্ক বা দ্বন্দ্বের কোনো সঠিক সমাধানের পথ নেই। এক্ষেত্রে দুপক্ষেরই উচিত হবে, বিষয়টিকে সহজভাবে গ্রহণ করে এই অযাচিত, অনির্দিষ্ট এবং সমাধানহীন তর্কের অবসান ঘটিয়ে সহজভাবে গ্রহণ করে একে অপরের সহযোগী হিসেবে কাজ করা। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একত্রে সংগীতের এই পুনরুদ্ধারের কাজে সবাই মিলে একে অপরকে সহযোগিতা করে পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী গানের ভুবনকে উজ্জীবিত করবো বলে আশা করি!
কাজী বনফুল: লেখক ও কলামিস্ট