হত্যা, ধর্ষণ ও হিংস্রতার কবল থেকে শিশুদের বাঁচান!



ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম
ড. মাহফুজ পারভেজ, ছবি: বার্তাটোয়েন্টিফোর

ড. মাহফুজ পারভেজ, ছবি: বার্তাটোয়েন্টিফোর

  • Font increase
  • Font Decrease

কবি বলেছিলেন, 'যে শিশু ভূমিষ্ঠ হলো আজ রাতে, তার মুখে খবর পেলুম, সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক, নতুন বিশ্বের...।'

পরাধীন যুগের প্রেক্ষাপটে শিশুর সামনে অনেক অনাচার, শোষণ, নিপীড়ন ছিল। আর আজকে? স্বাধীন, অগ্রসর ও আধুনিক প্রেক্ষাপটে শিশু-কিশোররা হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনের শিকার।

বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দিনে কমপক্ষে দশটি ঘটনা ঘটছে, যাতে ছয় বছরের শিশু থেকে কিশোরদের নিয়মিত ধর্ষণ করা হচ্ছে। পাশবিক হিংস্রতায় শিশুকে যৌন নিপীড়ন করে লাশ ফেলে দেওয়া হচ্ছে। স্কুল, কলেজ, মাদরাসায় বছরের পর বছর এক বা একাধিক অবোধ শিশু-কিশোরকে যৌন লালসায় ক্ষত-বিক্ষত করা হচ্ছে।

এই ধর্ষণ উপত্যকাই আমার দেশ!
রাজধানী ঢাকা শহরেই শুধু নয়, শহরতলী, গ্রাম, গঞ্জ, মাঠ, ময়দান, পথঘাট, এমনকি পাড়া-মহল্লায় শিশুদের নিরাপত্তা নেই। ধরে নিয়ে ধর্ষণ এবং পরে মেরে ফেলার ঘটনা একাধিক। ভয়, ভীতি ও প্রলোভনের মাধ্যমে নাবালিকা শিশুকে দিনের পর দিন ধর্ষণ করার রোমহষর্ক ঘটনাও প্রকাশ পাচ্ছে।

সহজেই অনুমান করা যায়, যৌন নির্যাতনের খুব কম ঘটনাই জানা সম্ভব হয়। যেসব ঘটনা জানাজানি হয়নি তার সংখ্যা প্রচুর। আশ্চর্যজনকভাবে, আমরা জানাজানির ভয় পাই, লোকলজ্জাকে ডরাই, অথচ চাই শিশুর নিরাপত্তা!

কিন্তু বাস্তব অবস্থা হলো এই যে, বাংলাদেশে শিশু-কিশোরদের নিরাপত্তা তলানিতে এসে পৌঁছাতে আর বাকি নেই। অথচ শিশুদের অধিকার ও সুরক্ষা নিয়ে বিশ্বসমাজের চিন্তা অন্তহীন। বিষয়টি যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ তা মানুষ বুঝেছে ও মেনেছে সভ্যতার আদি লগ্ন থেকে। আর আমরা? শিশুর প্রতি চরম নিষ্ঠুরতা দেখেও নির্বিকার রয়েছি! সমাজ ও প্রশাসনের তীব্র সংক্ষোভ ও প্রতিরোধে এখনো ফেটে পড়ছি না।

ধর্ষণের বিভীষিকাময় সমাজে আমি লজ্জিত
বিবেচনা শক্তিতে সমর্থ ও ভাব প্রকাশের যোগ্য হয়ে ওঠেনি এবং চিন্তাশক্তির পূর্ণ বিকাশ ঘটেনি বলে ১৮ বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত সবাইকে শিশু বলে আমরা গণ্য করি। স্বার্থান্বেষী অংশ তার সুযোগ নেয়। কেউ কেউ না বুঝে, আপন অক্ষমতা/অজ্ঞানতার কারণেও শিশুর ওপর অত্যাচার করে, শিশুকে অবহেলা করে। শিশু শ্রমিক, বাল্যবিবাহ, শিশু ধর্ষণ, এসবের অন্যতম কারণ যেমন লোলুপতা, স্বার্থ ও হিংস্রতা, তেমন আমাদের অশিক্ষা ও কুশিক্ষা এবং শিক্ষার ছদ্মাবরণে ভণ্ডামি।

মনস্তাত্ত্বিক দিক দিয়ে, ছোটরা বড়দের নকল করে, অনুসরণের চেষ্টা করে, কিন্তু বড়রা শিশুমনের খবর রাখে রাখতেও চায় না। কারও চোখে তারা অবোধ বাচ্ছা, কেউ ভাবে তাদের ‘নাক টিপলে দুধ গলে’, কেউ ভালোবাসে বা সম্ভোগ করে, কেউ আদর করে। কেউ কেউ বা চায়- সন্তান তার যেন থাকে দুধে-ভাতে। ব্যস, যেন ওই পর্যন্ত।

কিন্তু কেউ ভাবে কি- স্বপ্নপূরণের উপায় কী? কী উপায়ে তাদের নিরাপত্তা বা সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিত করা যায়? কেমন করে শিশুদের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটানো যায়?

পণ্ডিত সমাজ শিশু নিরাপত্তা ও বিকাশের গুরুত্ব অনুধাবন করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগেই বিষয়টি নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু করেন। সুইডিস সমাজবিজ্ঞানী এলান কী (Allen Key) সেই ১৯০৯ সালে অনুমান করে বলেছিলেন যে, 'বিংশ শতাব্দী হবে শিশুদের শতাব্দী।' পোলান্ডের বিজ্ঞানী জানুস করজাক (Janusz Korczak) লিখলেন এক চমৎকার ম্যানুয়েল গ্রন্থ, যার নাম 'How to Love a Child' (1919)।

অন্যদিকে ব্রিটিশ স্কুলশিক্ষিকা ও সমাজকর্মী মিজ জেব স্পষ্ট জানালেন যে, 'সমস্ত যুদ্ধই কার্যত শিশুদের বিরুদ্ধে।' সদ্যজাত লিগ অফ নেশনসের অনুরোধে জেব, অন্যদের সাহায্য নিয়ে, তৈরি করলেন শিশু অধিকার সুরক্ষা সনদ, যা ১৯২৪ সালে লিগ অফ নেশনস দ্বারা স্বীকৃতও হল। তবে সে সনদ হয়ে রইল কেবল শিশু কল্যাণে একটি ঘোষণাপত্র, শিশু অধিকারের আইনি স্বীকৃতি এল অনেক পরে, অনেক পথ পার হয়ে ১৯৮৯ সালে। পাওয়া গেল UNCRC (United Nations Convention on the Rights of the Child)।

ততদিনে বিশ্ব বদলে গেছে। আন্তর্জাতিক পালাবদলের তোড়ে লিগ অব নেশনস অনেক শক্তি অর্জন করে হয়েছে রাষ্ট্রসংঘ। পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশ এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে সমর্থন করেছে। আমরাও এই উদ্যোগের শরিক।

শুধু তাই নয়, শিশুসুরক্ষায় এখন দেশে কত আইন, বিধি, নীতি, নিষেধের ছড়াছড়ি। তবু শিশুপাচার, ধর্ষণ, শিশুশ্রমিক, বাল্যবিবাহ ইত্যাদি আমরা চাই বা না চাই, সবই আছে এবং দিনে দিনে ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে। আমি জানি, আপনি জানেন, রাষ্ট্র জানে। জানি তো, কিন্তু শিশুর বিপদ ও নিরাপত্তাহীনতা মোটেও কমছে না কেন? কেন সমাজের সর্বস্তরের দাবি উচ্চকিত হয়ে বলছে, 'হত্যা, ধর্ষণ ও হিংস্রতার কবল থেকে শিশুদের বাঁচান!'

কোনও কোনও মর্মন্তুদ ও পাশবিক শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ ও নিপীড়ন-নির্যাতনের ঘটনায় সংক্ষুব্ধ-অশান্ত জনমতকে শান্ত করতে, প্রতিবাদকে সম্মান জানাতে সরকার নতুন আইন, নতুন বিধি অথবা নতুন প্রকল্প এনে প্রতিকারের আশা জাগাবে বলে প্রবলভাবে দাবি আসছে। শিশুর অধিকার ও তার সুরক্ষা প্রত্যাশা করে লাশ বা ধর্ষিতা নিরীহ শিশুটিকে নিয়ে দুয়ারে দুয়ারে হাহাকার জানানোর হৃদয় বিদারক পরিস্থিতির অবসান ঘটবে বলেও মানুষ প্রত্যাশা করছে।

ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলছে!
সাধারণ মানুষ দলমত নির্বিশেষে শিশুর নিরাপত্তা ও সুরক্ষা কামনা করছেন। শিশু নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণের দৃষ্টান্তমূলক সাজা ও প্রতিকার আশা করছেন। কায়মনোবাক্যে চাইছে শিশুবান্ধব, নিরাপদ সমাজ, যা সবার সহযোগিতা ও অংশগ্রহণে নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের।

যে শিশু ভূমিষ্ঠ হলো আজ রাতে, তার কাছে আমরা খবর পৌঁছে দিতে চাই- শিশুর জন্য নিরাপদ এক নতুন বিশ্বের।

   

‘মা লো মা’ বিতর্ক এবং সমাধানের পথ



কাজী বনফুল
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

সম্প্রতি, কোক স্টুডিও বাংলা থেকে প্রচারিত হয়েছে ‘মা লো মা’ গানটি। গানটি প্রচারের পর পর থেকেই এর প্রকৃত স্বত্ব নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্কের ঝড়। কোক স্টুডিওতে গানটি পরিবেশনের সময় বাউল সাধক খালেক দেওয়ানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এই গান প্রকাশ এবং নাম উল্লেখ করার পর থেকেই বাউল সাধক রশিদ উদ্দিনের অনুসারীরা দাবি করছেন, গানটি রশিদ উদ্দিনের রচিত।

এখন কথা হচ্ছে, ‘মা লো মা’ গানটির একটি ভার্সন আমি প্রয়াত খালেক দেওয়ানের নিজের মুখের শুনেছি। সেখানে তিনি এই গানকে নিজের লেখা গান বলে উচ্চারণ করেছেন। বাউল সাধক রশিদ উদ্দিনের লেখা গানটিও শুনেছি। গান দুটির কথার মধ্যে সম্পূর্ণ মিল নেই। দুটির মধ্যে কিছুটি ভিন্নতা দৃশ্যমান।

এখনো আমাদের দেশে কয়েক প্রজন্মের মানুষ আছেন, যারা জ্ঞানী- গুণী, সাধক শ্রেণি। তাদের থেকে শুরু করে অনেক প্রবীণ ও বিজ্ঞজনদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি, বাউল সাধক রশিদ উদ্দিন যে গানটি লিখেছেন এবং বাউল সাধক খালেক দেওয়ান যে গানটি লিখেছেন, দুটি গানের কথায় বেশ ভিন্নতা রয়েছে। গানের ভেতর অনেক কথা ও ভাষারও ভিন্নতা রয়েছে।

তারা বলছেন, তৎকালীন সময়ে ‘মা লো মা ঝি লো ঝি’ বা ‘মাগো মা ঝিগো ঝি’ এগুলো প্রচলিত বাগধারা বা শ্লোকের মতো ছিল। অনেকেই এই শ্লোক ব্যবহার করে গান লিখতেন, কবিতা লিখতেন। সেক্ষেত্রে ‘মা লো মা’ বা ‘মাগো মা’ থাকলেই সে গান শুধুমাত্র একজনেরই, এটা দাবি করার কোনো সুযোগ নেই।

বাউল সাধক খালেক দেওয়ান নিজের প্রকাশিত যে গীতবিতান রয়েছে, সেখানেও তাঁর এই গানটি রয়েছে। তাঁর সমসাময়িক অনেক প্রবীণ ব্যক্তি জানিয়েছেন, গানটি তাঁর নিজের লেখা এবং তিনি এটি অনেকবার অনেক স্থানে গেয়েছেন বলে ব্যক্ত করেছেন। আবার অনেক প্রাজ্ঞজন বলেছেন, এই গানটির বাউল সাধক রশিদ উদ্দিনের রচিত একটি ভার্সনও রয়েছে, যেখানে ভাষাগত কিছু ভিন্নতা রয়েছে। রশিদ উদ্দিনের গানটি মূলত ‘মাগো মা ঝি গো ঝি’ কিন্তু খুবই সাদৃশ্যপূর্ণ!

আবার অনেক গবেষক বলছেন যে, সংগীতের ক্ষেত্রেও অনেক কাকতালীয় বিষয় থাকে। সেক্ষেত্রে এখানেও হয়ত এই গান রচনার ক্ষেত্রে এমন কিছু ঘটেছে বা ঘটে থাকতে পারে। যেমন- একজনের ভাবের সঙ্গে আরেকজনের ভাব মিলে যেতে পারে বা কারো গানের কথার সঙ্গে আরেকজনের কথাও মিলে যেতে পারে কাকতালীয়ভাবেই, যেটা আমাদের সম্পূর্ণভাবে বিচার করার সুযোগ নেই।

এবার মূল কথায় আসা যাক। গানটি নিয়ে যে দুজন রচয়িতা সম্পর্কে যে বিতর্ক হচ্ছে, তাঁরা দুজনই এখন প্রয়াত। তাঁরা দুজনই ছিলেন বাউল সাধক। এখন তাঁরা আর কেউ এই পৃথিবীতে বেঁচে নেই। তৎকালীন সময়ে এই সাধক ও সংগীত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের গুরুভিত্তিক চর্চার ব্যবস্থা ছিল। সেখানে একে অপরের সঙ্গে দেখা হতো। কথা হতো। বিভিন্ন অঞ্চলের গান ও সুর নিয়ে একে অপরের সঙ্গে বাক্য ও ভাব বিনিময় হতো। তৎকালীন সময়ে একজন সাধক বা বাউল আরেকজনের সঙ্গে মিলেমিশে গান রচনা করতেন।

একজন আরেকজনের সঙ্গে আত্মিক মিলনে আবদ্ধ থাকতেন। তাঁরা নিজেদের অভিন্ন সত্তা বলে মনে করতেন। বাউল সাধক রশিদ উদ্দিন এবং বাউল সাধক খালেক দেওয়ান দুজনই ২০ বছরের ছোট বড়। তাঁদের ভেতরে যে সম্পর্কের গভীরতা হৃদয়ের তলদেশকে স্পর্শ করেনি, সেটা আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না! কিন্তু একটু অনুধাবন করতে পারি, যেহেতু তাঁরা দুজনই বাউল সাধক, সেহেতু তাঁদের ভেতর একটি আত্মিক বন্ধন ছিল, এটা অনিবার্য হয়ত!

তাঁরা বেঁচে থাকলে হয়ত এই বিষয় নিয়ে কোনো বিতর্কই হতো না। কারণ, তাঁরা এই জাগতিক নাম ও নিজস্বতার অনেক ঊর্ধ্বের মানুষ। তাঁদের মধ্যে হয়ত ভিন্ন শরীরে অভিন্ন আত্মার যোগসূত্র ছিল। যেহেতু, তাঁরা দুজনই শ্রদ্ধেয় এবং দুজনই প্রয়াত, তাঁদের কারো সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলার আর কোনো সুযোগ নেই। সেক্ষেত্রে এটা আমরা অনুমান করে নিতে পারি যে, এক্ষেত্রেও কাকতালীয়ভাবে এমনটাই ঘটেছে হয়ত।

খালেক দেওয়ান এবং রশিদ উদ্দিন সাহেব দুজনই আমাদের বাংলার সুফি জগতের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। তাঁদের কাছ থেকে আমরা অনেক অনেক মূল্যবান সংগীত ও জ্ঞানের আলোর সন্ধান পেয়েছি। তাঁরা দুজনই আবহমান বাংলার আকাশে আলোর প্রদীপ স্বরূপ!

কোনো বিষয় নিয়ে বিতর্ক করলে সারাদিনই করা যায়। কিন্তু বিতর্কের সমাধানের পথের সন্ধান বেশি জরুরি। কারণ, অযথা ও অযাচিত বিতর্কে সমাজ পিছিয়ে যায়। আমরা সংগীত ও সংস্কৃতিতে এমনিতেই দিনে দিনে পিছিয়ে যাচ্ছি। তার ভেতর যদি নিজেদের আত্মিক বন্ধনের জায়গায় এমন ফাটল বা বিচ্ছেদের সূত্রপাত হয়, তাহলে আমরা ডুবে যাবো খুব দ্রুতই।

আমি কোক স্টুডিও’র গানটি শুনে দেখলাম, কোক স্টুডিও খালেক দেওয়ানের ভার্সনটিই করেছে। এখানে কণ্ঠ দিয়েছেন একজন আরিফ দেওয়ান এবং অন্যজন শরফুউদ্দিন দেওয়ান ওরফে সাগর দেওয়ান। গানটির সার্বিক কম্পোজ করেছেন প্রীতম হাসান।

আমাদের এই প্রযুক্তির নতুনত্বের ভিড়ে ধীরে ধীরে আমরা হারিয়ে ফেলছি, আমাদের ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত সব বিষয়, আঞ্চলিক বিষয়। আমাদের সেই আব্বাস উদ্দিন, বিজয় সরকার, জসিমউদ্দীন, খালেক দেওয়ান, রশিদ উদ্দিন, উকিল মুন্সি, যারা হচ্ছেন, বাংলার গানের ভুবনের প্রাণ ভ্রমর অথচ তাদের গান এখন আর কেউ শোনে না, গায়ও না। কারো মুখে এখন আর এই সব গান শোনা যায় না।

যখন কোনো বিষয়ের অনুশীলন বন্ধ হয়ে যাবে, তখন সে বিষয়টিও আমাদের থেকে ধীরে ধীরে বিলুপ্তির দিকে অগ্রসর হবে। তাই, অবশ্যই আমাদের সবাইকে সম্মিলিতভাবে কোক স্টুডিও’র এই প্রচেষ্টার সঙ্গে সহমত সমেত মানসিক সহযোগিতা প্রদান করতে হবে, যাতে গানগুলো আবার নতুন করে প্রাণ ফিরে পাওয়ার সুযোগ পায়।

এক্ষেত্রে কোক স্টুডিও এবং প্রীতম হাসান একটি অনন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তারা সম্মিলিতভাবে বাংলার ঐতিহ্যবাহী ও আঞ্চলিক গানগুলোকে নতুন করে মানুষের মুখে মুখে রটানোর ব্যবস্থা করেছেন।

আমাদের যে নতুন প্রজন্ম, তারা মূলত আমাদের জারি, সারি, বিচ্ছেদ, ভাটিয়ালি, এসব গানের সঙ্গে খুব একটা পরিচিত নন। আমাদের এই নতুন প্রজন্মকে ওই সব গান ও গানের রচয়িতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়াটাকে আমি সম্মানের সঙ্গে স্বাগত জানাই।

এখন তরুণদের মুখে মুখে বেজে উঠেছে, ‘মা লো মা’ গানটি। তারা গাইছেন। তারা বুঝতে পারছেন, তাদেরও এমন সংগীতের গুরুত্বপূর্ণ ভাণ্ডার রয়েছে। সেক্ষেত্রে প্রীতম হাসান অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।

‘মা লো মা’ গানটির ভেতর সাগর দেওয়ান নামে প্রয়াত খালেক দেওয়ানের বর্তমান প্রজন্মের একজন কণ্ঠ দিয়েছেন। সাগর দেওয়ানের কণ্ঠ গানটিকে একটি অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তার কণ্ঠে সুরের যে মনিহারখচিত হীরা বসানো রয়েছে, সেটা ওই গানের ভেতর দিয়ে তার কণ্ঠের মুগ্ধতায় ছুঁয়ে গেছে ভক্তদের হৃদয়। সাগর দেওয়ানের কণ্ঠের নাগপাশে আবদ্ধ হয়েছেন সব সংগীত অনুরাগীরা।

কোক স্টুডিও এই যে, একটি ধারার প্রচলন করেছে, তারা নতুন ও প্রতিভাবান শিল্পীদের খুঁজে খুঁজে বের করে তাদের নিয়ে কাজ করা, এটি অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। এর আগেও আমরা ‘দেওরা’ গানে ইসমাইল উদ্দিনসহ আরো অনেক নিভৃত প্রতিভাকে নিয়ে কোক স্টুডিওকে কাজ করতে দেখেছি, যা অবশ্যই কষ্টসাধ্য অনুসন্ধানের ফলেই সম্ভব হয়েছে।

পৃথিবীতে আর যত আনন্দ ও মুগ্ধতার বিষয় রয়েছে, তার মধ্যে সংগীত সর্বশেষ্ঠ। সংগীত সম্পর্কে জার্মান কবি ও দার্শনিক ফেডরিক নীৎসে বলেছেন, ‘আমি যখন নিজেকে হারিয়ে ফেলি তখন আমি গুন গুন করে গান গাই। গানের মধ্যে ডুবে গিয়ে আমি আবার নিজেকে খুঁজে পাই’!

গান সম্পর্কে সাধক রামপ্রসাদ বলেছেন, ‘গান হচ্ছে, এমন সুবাস, যা আমাদের সকল প্রাণকে এক অদৃশ্য সুতোয় বেঁধে রাখে। গান আমাদের সকল প্রাণের অনুভূতির একত্রিত জাগরণ’!

সর্বোপরি, আমাদের অঞ্চলে কোক স্টুডিও বাংলার হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী সংগীত ও সংস্কৃতিকে নতুনভাবে টেনে তোলার জন্য যে আপ্রাণ চেষ্টা করছে, তা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে।

আমরা যে তর্কে জড়িয়ে পড়েছি, এই তর্কের আসলে প্রকৃত ও নির্দিষ্ট কোনো সমাধান নেই। আমাদের দুই বাউল সাধক পরিবারের উভয়েরই উভয়ের প্রতি সহমর্মিতা সমেত বিষয়টি গ্রহণ করতে হবে। কারণ, কপিরাইট অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রশিদ উদ্দিনের ‘মাগো মা’ কিংবা খালেক দেওয়ানের ‘মালো মা’—কোনো গানই কপিরাইট অফিসে নিবন্ধন করা নেই। ফলে, গানটির মূল স্রষ্টা কে, তা কপিরাইট অফিস সঠিকভাবে বলতে পারছে না।

আবার লোকসংস্কৃতি–গবেষক সাইমন জাকারিয়া বলেন, ‘বাংলা লোকসংগীতের অনেক গান খুবই সমস্যাপূর্ণ। এসব নিয়ে আলাপ করতে গেলে এই নিয়ে অনেক বিতর্ক হবে’।

তাহলে এই যখন অবস্থা, সেক্ষেত্রে আমাদের সহমর্মিতা সমেত বিষয়টিকে গ্রহণ ছাড়া এই বিতর্ক বা দ্বন্দ্বের কোনো সঠিক সমাধানের পথ নেই। এক্ষেত্রে দুপক্ষেরই উচিত হবে, বিষয়টিকে সহজভাবে গ্রহণ করে এই অযাচিত, অনির্দিষ্ট এবং সমাধানহীন তর্কের অবসান ঘটিয়ে সহজভাবে গ্রহণ করে একে অপরের সহযোগী হিসেবে কাজ করা। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একত্রে সংগীতের এই পুনরুদ্ধারের কাজে সবাই মিলে একে অপরকে সহযোগিতা করে পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী গানের ভুবনকে উজ্জীবিত করবো বলে আশা করি!

কাজী বনফুল: লেখক ও কলামিস্ট

;

সামাজিক যোগাযোগে প্রযুক্তির প্রভাব



মো. বজলুর রশিদ
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

আধুনিক যুগে প্রযুক্তি আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে। সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থা তার ব্যতিক্রম নয়। ইন্টারনেট এবং মোবাইল ফোনের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে, মানুষ একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করার, সংযোগ স্থাপন করার এবং তথ্য শেয়ার করার নতুন নতুন উপায় খুঁজে পেয়েছে।

প্রযুক্তি বিশ্বব্যাপী মানুষের সঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে এবং সহজেই যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব করে তুলেছে। ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপের মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে আমরা বন্ধু, পরিবার এবং পরিচিতদের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারি। এছাড়াও, নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয় হওয়া এবং নতুন সম্পর্ক গড়ে তোলা সহজতর হয়েছে।

প্রযুক্তি আমাদের জ্ঞান ও তথ্য দ্রুত এবং সহজেই শেয়ার করার সুযোগ করে দিয়েছে। সংবাদ, নিবন্ধ, গবেষণাপত্র, শিক্ষামূলক উপকরণ সহজেই অনলাইনে পাওয়া যায়। এছাড়াও, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে আমরা নিজেদের মতামত, ধারণা এবং অভিজ্ঞতা অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারি।

প্রযুক্তি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার এবং সচেতনতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে মানুষ বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে এবং তাদের উত্থাপন করতে পারে। প্রযুক্তি আমাদের বিনোদনের জন্য নতুন নতুন মাধ্যম সরবরাহ করেছে। অনলাইন গেমস, ভিডিও, সঙ্গীত, ই-বই ইত্যাদি আমাদের অবসর সময়কে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে।

প্রযুক্তি ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও বিপ্লব এনেছে। অনলাইন শপিং, সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং, ফ্রিল্যান্সিং ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষ সহজেই তাদের পণ্য ও সেবা বাজারে তুলে ধরতে পারে।

প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহার মানুষকে বাস্তব জগতের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করার ফলে মানুষের পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কের ক্ষতি হতে পারে।

গবেষণায় দেখা গেছে যে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহারের সঙ্গে বিষণ্ণতা, উদ্বেগ এবং নিম্ন আত্মসম্মানের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে। অন্যদের সঙ্গে তুলনা করা, নেতিবাচক মন্তব্য এবং অনলাইন হয়রানির মুখোমুখি হওয়ার ফলে মানসিক চাপ বৃদ্ধি পেতে পারে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুয়া খবর এবং ভুল তথ্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। এটি জনমতকে প্রভাবিত করতে এবং সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। ব্যক্তিগত তথ্য অনলাইনে শেয়ার করার ফলে গোপনীয়তা লঙ্ঘনের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। হ্যাকিং, ডেটা লিক এবং সাইবার অপরাধের মাধ্যমে ব্যক্তিগত তথ্য চুরি হতে পারে।

অনলাইনে হয়রানি ও হুমকির শিকার হওয়ার ফলে মানসিক ক্ষতি হতে পারে। বিশেষ করে শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের ক্ষেত্রে এর প্রভাব বেশি হতে পারে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে অসুস্থ আসক্তি দেখা দিতে পারে। এটি ব্যক্তির ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

প্রযুক্তির প্রভাব, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে, ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিকই রয়েছে। প্রযুক্তির সর্বোচ্চ সুবিধা লাভের জন্য এবং এর সম্ভাব্য ক্ষতির ঝুঁকি কমানোর জন্য আমাদের সচেতনভাবে এবং দায়িত্বশীলভাবে এটি ব্যবহার করা উচিত। আমাদের সময় ব্যবস্থাপনা, গোপনীয়তা সেটিংস এবং অনলাইন আচরণ সম্পর্কে সচেতন থাকা উচিত। এছাড়াও, আমাদের সন্তানদের ইন্টারনেটের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে আরও সহজ ও সমৃদ্ধ করে তুলতে পারে। তবে, আমাদের সচেতন থাকতে হবে যে প্রযুক্তি আমাদের নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত, আমাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত নয়।

মো. বজলুর রশিদ: সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা।

 

;

ভোটে ফেরাতে হবে মানুষকে



কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপের ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে। বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা বাদে নির্বাচন ছিল মোটামুটি শান্তিপূর্ণ। নির্বাচনে জাল ভোট হয়েছে, ক্ষমতাসীন দলের অনেকের প্রভাব ছিল সত্য, তবে মোটাদাগে বড়ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। এ-ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের সন্তুষ্টির কারণ রয়েছে। তবে বিব্রত হওয়ার প্রধান কারণ ভোটার উপস্থিতি। অনেক আলোচনার মধ্যেও এবারের নির্বাচনে আশানুরূপ ভোটার আসেননি।

ভোটগ্রহণের পরের দিন বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, প্রথম ধাপের নির্বাচনে ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ ভোট পড়েছে। ইলেকট্রেনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট হয়েছে ২২ উপজেলায় এবং বাকি ১১৭ উপজেলায় হয়েছে ব্যালট পেপারে। ইভিএমে ভোটের হার ৩১ দশমিক ৩১ শতাংশ আর ব্যালটে ৩৭ দশমিক ২২ শতাংশ। সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে সোনাতলা, মীরসরাই ও কুষ্টিয়া সদর উপজেলায়। সেসব জায়গায় ভোট পড়েছে মাত্র ১৭ শতাংশ। সর্বোচ্চ ভোট পড়েছে জয়পুরহাট জেলার ক্ষেতলাল উপজেলায়। সেখানে ভোট পড়েছে ৭৩ দশমিক ১ শতাংশ।

সবচেয়ে বেশি ভোট পড়া এলাকা জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলায় মোট ভোটার ৯৫ হাজার ১৯১ জন। এর মধ্যে ৬৪ হাজার ৭৩০ জন ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। ওখানে পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি দুলাল মিয়া সরদার ৩০ হাজার ৩৯০ ভোট পান। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ নেতা তাইফুল ইসলাম তালুকদার পান ২২ হাজার ৯০১ ভোট।

কম ভোট পড়া এলাকাগুলোর মধ্যে বগুড়া সোনাতলায় ভোটার ছিলেন ১ লাখ ৬৪ হাজার ৩৩২ জন। এর মধ্যে ভোট দিয়েছেন ২৮ হাজার ২৭৮ জন। ওখানে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মিনহাদুজ্জামান লিটন ২০ হাজার ৪৮৩ ভোট পেয়ে চেয়ারম্যান পদে পুনরায় বিজয়ী হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মো. জাকির হোসেন পান ৭ হাজার ৩৪৫ ভোট। মিনহাদুজ্জামান লিটন সংসদ সদস্য সাহাদারা মান্নানের ছোট ভাই। আওয়ামী লীগের এই এমপির ভাইই কেবল নির্বাচনে বিজয়ী হননি, জেলার অপর এক উপজেলা সারিয়াকান্দিতে বিজয়ী হয়েছেন তার ছেলে সাখাওয়াত হোসেন সজল।

কম ভোট পড়া আরেক উপজেলা কুষ্টিয়া সদর। এখানে ৪ লাখ ২০ হাজার ৮৩৩ জন ভোটারের মধ্যে মাত্র ৭৩ হাজার ২৯৯ জন ভোটার ভোট দেন। কুষ্টিয়া সদর আসনের সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফের চাচাতো ভাই আতাউর রহমান আতা ৬৭ হাজার ৪৮১ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। তার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী আবু আহাদ আল মামুন পেয়েছেন ৩ হাজার ৫৬৪ ভোট।

নির্বাচন কমিশনের (ইসি) দেওয়া তথ্যের আরেক কম ভোট পড়া উপজেলা হচ্ছে চট্টগ্রামের মীরসরাই। ৩ লাখ ৭২ হাজার ২৫৭ জন ভোটারের ওই উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে এনায়েত হোসেন নয়ন ৩৩ হাজার ৭০ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী শেখ মোহাম্মদ আতাউর রহমান পান ২০ হাজার ৭৬৭ ভোট।

নির্বাচন কমিশনের ভাষ্যমতে, ভোট কম পড়ার কারণ হচ্ছে ধান কাটার মৌসুম, ঝড়বৃষ্টি, জনপ্রিয় প্রার্থীর অভাব, শহর এলাকায় ছুটি থাকায় মানুষের বাড়ি চলে যাওয়া, এবং বড় রাজনৈতিক দলের ভোটে অংশগ্রহণ না করা। এগুলোকে কারণ হিসেবে বললেও এটা যে স্রেফ অজুহাত দাঁড় করানো সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। নির্বাচন কমিশন ভোট কম পড়ার যে ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছে সেটাই কি আসল কারণ মূলত? ধান কাটার মৌসুম, ঝড়বৃষ্টির ওপর মানুষের হাত নেই, কিন্তু বাকিগুলো নির্ভর করে মানুষের ওপরই। ইসি যেভাবে ঝড়বৃষ্টিকে কারণ হিসেবে দাঁড় করাতে চাইছে সেটা মোটেও মূল কারণের মধ্যে পড়ে না, কারণ নির্বাচনের দিন কোথাও উল্লেখের মতো ঝড়বৃষ্টি হয়নি। ধান কাটার মৌসুমেও মানুষ আগে ভোট দিয়েছে, নির্বাচনের দিন প্রতিবারই ছুটি থাকে, এবং একদিনের এই ছুটিতে সচরাচর মানুষ গ্রামে চলে যায় না, বিশেষত ঠিক পরের দিন যেখানে আর কোন ছুটি নাই।

ইসি বলতে চাইছে, জনপ্রিয় প্রার্থীর অভাব ছিল নির্বাচনে। এটা কীভাবে মেনে নেওয়া যায়? দলীয় প্রতীকে এবার নির্বাচন না হলেও ক্ষমতাসীন দলের নেতারাই নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, অংশ নিয়েছেন বর্তমান চেয়ারম্যানরাও। যে তিন উপজেলায় সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে বলছে ইসি, সেই তিন উপজেলার অন্তত দুই উপজেলায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলীয় দুই সংসদ সদস্যের নিকটাত্মীয় হয়েছেন বিজয়ী। তাহলে ইসি কি বলতে চায় নির্বাচন বর্জন করছে যে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নেতারাই মূলত কেন্দ্রে ভোটার টানার মতো প্রার্থী?

ইসিও বলছে, নির্বাচনে ভোটার স্বল্পতার অন্যতম কারণ বিএনপির অংশ না নেওয়া। এটা এমনই অপ্রিয় সত্য যা অস্বীকারের উপায় নাই। হ্যাঁ, নির্বাচনে অংশ নিলে বিএনপির সকল বা বেশিরভাগ নেতাই বিজয়ী হয়ে যেতেন এমন না, তবে তাদের নির্বাচন বর্জনের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় দলটির সমমনাদের কেউ অংশ নেয়নি। এমনকি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যে সকল রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছিল তাদের কেউও নির্বাচনে অংশ নেয়নি।

দলের মধ্যকার কোন্দলকে প্রকাশ্য রূপ না দিতে আওয়ামী লীগ না হয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীক দেয়নি; কিন্তু কোথায় জাতীয় পার্টি, কোথায় ১৪-দলের শরিক দলগুলো, কোথায় সেই ‘কিংস পার্টি’ যারা বিগত সময়ে হঠাৎ গজিয়ে ওঠে সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল? জাতীয় পার্টি জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধীদলের স্বীকৃতি পেলেও প্রান্তিক পর্যায়ে এই দলটির অস্তিত্ব যে আদতে নেই, এটা স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে তাদের অংশগ্রহণের ইতিহাস দেখলে সহজেই অনুমেয়। সরকারের অনুকম্পায় টিকে থাকা দলটি নেতাকর্মী সংকটে তা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। সদ্য সমাপ্ত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপ সেটা আরও একবার প্রমাণ করল।

প্রথম ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অনুমিতভাবে নির্বাচিতদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগের। স্থানীয় সরকারের নির্বাচন অথচ নির্বাচনে নেই উল্লেখের মতো ভোটার উপস্থিতি। এবারের ভোট প্রদানের হার বিগত সংসদ নির্বাচনের ভোটের হারের চাইতেও কম। এর দ্বারা কি প্রমাণ হচ্ছে না আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী-প্রার্থীরা ভোটারদের আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হচ্ছেন? এই ব্যর্থতা কি তবে অনাস্থার বিমূর্ত প্রকাশ?

ধান কাটা মৌসুম, ঝড়বৃষ্টিসহ হালকা-ঢঙের যতই অজুহাত দাঁড় করাক না কেন নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনের দিন পর্যন্ত সত্যি কি ভোটের হাওয়া বইছিল নির্দিষ্ট ওই ১৩৯ উপজেলাজুড়ে? বাস্তবতা বলছে, কখনই মনে হয়নি ভোট এসেছে। ভোটের প্রতি মানুষের এই অনাগ্রহ কী কারণে ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে সেটা বের করা জরুরি।

যারা ভোট দিতে যায়নি, তাদের সকলেই যে বিএনপির নেতাকর্মী-সমর্থক, এমনটা ভাবার কারণ নাই। দেশে এত এত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী তারাও কি ভোট দিতে গেছে? ভোটার উপস্থিতির হার বলছে, তারাও নির্বাচনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে বসেছে। মানুষ ভোট দিতে যায়নি মূলত ‘ভোট দিয়ে কী হবে’ এমন একটা ধারণা কিংবা বিশ্বাস থেকেই।

ব্যক্তিগতভাবে অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি, এবং বেশিরভাগেরই অভিন্ন মতামত। এটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকার-রাখার হুমকিসম। মানুষ দিন দিন ভোটে অনাগ্রহী হয়ে পড়ার কারণে ‘অন্ধকারের আততায়ীরাও’ যদি কখনও ক্ষমতার কেন্দ্রের কাছাকাছি পৌঁছায়, তবে এখান থেকে মুক্তির পথ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘায়ত হতে থাকবে। নির্বাচন এককালে ছিল আমাদের অন্যতম এক উৎসব। ভোট ও প্রার্থীদের নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলত সবখানে, কিন্তু এখন সে দিন হারিয়ে গেছে অনেকটাই।

ভোটবিমুখ মানুষকে ভোটে ফেরাতে হবে, দিতে হবে অভয়, গড়তে হবে সম-মর্যাদা ও সম-সুযোগের মাঠ। ভোট যে অধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার; এই বোধের জাগরণ দরকার। দরকার কেন্দ্র আর প্রান্তের মধ্যে যোগাযোগ ও আস্থার পরিবেশ। আস্থার পরিবেশ না ফিরলে মানুষ ভোট ও গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বিমুখ হতেই থাকবে!

;

স্বাধীন ফিলিস্তিন প্রশ্নে ছাত্র সংহতি: অন্যরা ঘুমিয়ে কেন?



আশরাফুল ইসলাম পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

পশ্চিমা মদদ আর আরব বিশ্বের আশ্চর্যজনক নীরবতায় ফিলিস্তিনের হতভাগ্য নাগরিকদের ওপর যুগ যুগ ধরে চলা ইহুদীবাদী ইসরায়েলের অব্যাহত বর্বরতায় বিশ্ব নতুন করে জেগে উঠেছে। এই ‘বিশ্ব’ বলতে আপামর বিশ্ববাসী বললে ভুল হবে, মূখ্যত সাম্প্রতিক সময়ের নজিরবিহীন নারকীয়তায় যারপারনাই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে বিশ্বের ছাত্র-তরুণ আর মুক্তিকামী মানুষদের একটি অংশ, যারা তাদের বিবেক দ্বারা চালিত হচ্ছেন। কৌশল বা কোন সমীকরণের ধার ধারছেন না তারা।

উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, বিশ্বজুড়ে মানবতার মেকি সবক দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর ছাত্র-তরুণরাও তাদের শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তীব্র ক্ষোভে মজলুম ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি প্রকাশে পথে নেমে এসেছেন। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে তীব্র উত্তেজনা বিরাজ করছে। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী-তরুণদের থামাতে বলপ্রয়োগ আর ভীতি প্রদর্শনের কিছুই অবশিষ্ট রাখছে না দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পরিণতিতে বহু ছাত্র-তরুণ এমনকি শিক্ষকরাও গ্রেপ্তারবরণ করছেন।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, মার্কিন মুলুকে ফিলিস্তিন সংহতির এই প্রকাশ ঘটছে ইউরোপসহ বিশ্বের নানাপ্রান্তে। ঐতিহাসিকভাবে ফিলিস্তিনের জনগণের পাশে থাকা বাংলাদেশের ছাত্র-তরুণরাও গেল কয়েকদিন ধরে ‘স্বাধীন ফিলিস্তিন’ এর পক্ষে ও ইসরাইলি বর্বরতা বন্ধের দাবিতে পথে নেমেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কয়েকটি সমাবেশের ধারাবাহিকতায় আজ বৃহস্পতিবারও একটি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।

নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জন্মলাভ করা বাংলাদেশের কাছে পরাধীনতার গ্লানি অচেনা নয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিসহ রাজনৈতিক মেরুকরণের নানা বাস্তবতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের মানুষের মনে পীড়িত ফিলিস্তিনের মজলুম জনতার জন্য ভালোবাসা আর সংহতির কোন কমতি নেই। আমরা লক্ষ্য করছি, বর্তমান সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারাও ফিলিস্তিনে বর্বরতার বিরুদ্ধে জোরাল অবস্থান নিয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতার জন্যই যে এই অবস্থান তা অনেকে বলবার চেষ্টা করলেও আমরা মনে করি, দলমত নির্বিশেষে নিপীড়িত ফিলিস্তিনের জন্য সকলের একাট্টা হওয়াই উচিত। অভ্যন্তরীণ রাজনীতির নিরিখে এই সংহতি প্রকাশে অবস্থান গ্রহণে তারতম্য থাকা উচিত নয়। সেই সঙ্গে সংহতি প্রকাশে কাজ করা উচিত নয় ধর্মীয় বিবেচনাও।

মুক্তিসংগ্রামের ঐতিহ্যিক পরম্পরাকে লালন করা একটি দেশ হিসাবে আমাদের বিশ্বের যেকোন প্রান্তের নির্যাতিত মানুষের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করাই কর্তব্য হওয়া উচিত। মুক্তিকামী মানুষের অনুভূতি যে অভিন্ন তা আমরা ১৯৪৭ সালে ১৫ আগস্ট মধ্যরাতে ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণার সময়ে ব্রিটিশ শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের কণ্ঠেও ধ্বনিত হতে শুনেছি। সেদিন তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাবে স্বীকার করেছিলেন, `Freedom Loving People Everywhere’.

কিন্তু আমরা লক্ষ্য করছি, অভ্যন্তরীণ রাজনীতির মেরুকরণে স্বাধীন ফিলিস্তিনের সংহতি প্রকাশে এখানকার রাজনৈতিক দলগুলির দ্বিধাবিভক্ত অবস্থান। সরকার বিরোধিতায় কোন কোন দলের পশ্চিমাশক্তির মদদপ্রাপ্তির আকাঙ্খা, ফিলিস্তিন নিয়ে তাদের আশ্চর্যরকম নীরবতার কারণ বলে অভিযোগ আছে। ধর্মীয় উন্মাদনার জিগির তুলে ইসলামী দলগুলো অনেক অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে তুলকালাম বাধিয়ে দিলেও ফিলিস্তিনের উপর চলমান বর্বরতায় তাদের উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি দৃশ্যমান নয়। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের এ নিয়ে মূল্যায়ন এরকম যে, দলীয় ও গোষ্ঠীগত স্বার্থে এসকল দল ও সংগঠন একাট্টা হলেও নিপীড়িত মানুষের জন্য তাদের অবস্থান অস্পষ্ট।

অন্যদিকে আমরা গভীর বেদনার সঙ্গে লক্ষ্য করছি, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি ফিলিস্তিনের উপর যুগ যুগ ধরে চলা বর্বরতার বিরুদ্ধে বিস্ময়কর নীরবতা প্রদর্শনের ধারাবাহিকতায় চলমান ইসরাইলি ধ্বংসযজ্ঞেও তাদের কৌশলগত রক্ষণশীলতা অব্যাহত। মুখে মুসলিম সংহতি, পশ্চিমাবিষোদগার আর ইসরাইলের নিন্দা করে গেলেও তাদের পক্ষ থেকে জোরাল কোন পদক্ষেপ নেই। দেশগুলি তাদের নিজস্ব ব্যবসায়িক ও নিরাপত্তা স্ট্রাটেজিকেই সর্বাগ্রে প্রধান্য দিয়ে চলছেন।

প্রতিদিন শত শত নিরীহ ফিলিস্তিনি শিশু, নারী-বৃদ্ধ এমনকি চিকিৎসাধীনরা ইসরাইলি হামলার নিশানা হলেও আরববিশ্বের ঘুম ভাঙছে না। ইরানের সক্রিয় অবস্থানে যখন ইসরাইলসহ পশ্চিমারা নড়েচড়ে বসছেন সেই সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি যদি মিনমিনে নিন্দার বদলে অস্ত্রের ভাষায় কথা বলতো তবে এক সপ্তাহে দৃশ্যপট বদলে যেতে পারত। মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির ওপর নজর রাখা বিশ্লেষকরা বলছেন, ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস যদি ইসরাইলি বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে না তুলতো তবে আরও বহুদূর বিস্তৃত হতো ইসরাইলি আস্ফালন ও ধ্বংসযজ্ঞ।

যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রসংবরণের যে আহ্বান তাকে যদি মেকিও ধরে নিই তারও যে একটা তাৎপর্য রয়েছে, বলা যায় স্পষ্টতই তা হামাসসহ অন্যান্য স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠনের জেগে উঠার ফলশ্রুতি। নানামূখি মেরুকরণে সুর মিলিয়ে কিংবা কৌশলী প্রতিবাদ-নিন্দায় যারা ‘ফিলিস্তিন সংহতি’তে সীমিত থাকছেন তাদের সেখান থেকে বেরিয়ে আসার বিকল্প নেই। বলাবাহুল্য, জোরদার বিশ্ব জনমতেরও একটি অবধারিত মূল্য রয়েছে। সব মতপার্থক্য ও ধর্মীয় পরিচয় ব্যতিরেকেই ফিলিস্তিনের জন্য নিরঙ্কুশ সংহতি সময়ের দাবি।

;