দাপুটে স্বৈরাচার থেকে রাজনৈতিক ভাঁড়



প্রভাষ আমিন
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ

  • Font increase
  • Font Decrease

একজন মানুষের অনেক রূপ থাকে। কিন্তু এরশাদের মত এমন বহুরূপী মানুষ ও রাজনীতিবিদ ইতিহাসে সত্যি বিরল। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন নিষ্ঠুর স্বৈরাচার; কিন্তু ভালোবাসতেন কবিতা ও নারী। এক সময়কার দাপুটে স্বৈরাচার এরশাদ শেষ জীবনে নিজেকে পরিণত করেছিলেন রাজনৈতিক ভাঁড়ে। এরশাদকে বলা হতো চিরকালীন সিএমএলএ। নব্বইয়ের আগে ছিলেন চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটের। আর নব্বইয়ের পরে ক্যান্সেল মাই লাস্ট অ্যানাউন্সমেন্ট। সকাল বিকাল সিদ্ধান্ত বদলের ব্যাপারে এরশাদের কোনো জুড়ি ছিল না।

১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই- এই সময়টা আরো অনেকের মত আমিও এরশাদকে নিবিড়ভাবে অনুসরণ করেছি। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বিএনপির মনোনয়নে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন বিচারপতি সাত্তার। অনেকে বিশ্বাস করেন জিয়াউর রহমানের হত্যার মাস্টারমাইন্ড ছিলেন এরশাদ। এটা যাতে জানাজানি না হয়, তাই জেনারেল মঞ্জুরকে ঠান্ডা মাথায় খুন করান এরশাদ। মঞ্জুর হত্যা মামলার আসামিও ছিলেন এরশাদ। তারমানে জিয়াউর রহমানকে সরিয়ে ক্ষমতায় আসার পরিকল্পনাটা তার পুরোনো ও সুদূরপ্রসারী। অথচ জিয়া এরশাদকে সেনা প্রধান করেছিলেন সেফ মনে করে। জিয়া ভেবেছিলেন, এরশাদ নারী আর কবিতা নিয়ে ব্যস্ত থাকবে; তার ক্ষমতার জন্য বিপদ হবে না। কিন্তু জিয়া এরশাদকে চিনতে পারেননি, আসলে কেউই পারেননি। এরশাদ খুব কৌশলে নিজেকে আড়ালে রেখে এক ঢিলে অনেক পাখি মারতে পেরেছিলেন। জিয়া, মঞ্জুর এবং পরে জিয়া হত্যার বিচারের নামে মেধাবী মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের হত্যা করে নিজের পথ পরিস্কার করে রেখেছিলেন এরশাদ। তাই নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি সাত্তার সরকারের বিরুদ্ধে যখন নানা দুর্নীতির অভিযোগ উঠতে থাকে, যখন সাত্তার সরকারের মন্ত্রীর বাসা থেকে সন্ত্রাসী আটক করা হয়; তখনই বোঝা আড়াল থেকে কেউ কলকাঠি নাড়ছেন।

এরশাদ অবশ্য বেশিদিন আড়ালে থাকেননি। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ বন্দুকের মুখে সাত্তারকে হটিয়ে দেশের সর্বময় ক্ষমতা দখল করেন এরশাদ। তারপর নয় বছর ছিল গোটা বাংলাদেশ ছিল তার ইচ্ছাধীন। এরশাদই ছিলেন শেষ কথা।

এরশাদ ক্ষমতায় আসেন ১৯৮২ সালের মার্চে। কিন্তু একবছরেরও কম সময়ের আগে ৮৩- এর মধ্য ফেব্রুয়ারিতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফুসে ওঠে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে। এরশাদ সে আন্দোলন দমন করেন নিষ্ঠুর কায়দায়। শহীদ হন জাফর, জয়নাল, কাঞ্চন, দীপালি সাহাসহ অনেকেই। পরের বছর ফুলবাড়িয়া ছাত্র মিছিলে ট্রাক তুলে দেয় এরশাদের পুলিশ। শহীদ হন সেলিম-দেলোয়ার। ৮৭এর ১০ নভেম্বর বুকে ‘স্বৈরাচার নীপাত যাক’, পিঠে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লিখে রাজপথে নেমেছিলেন যুবলীগ কর্মী নুর হোসেন। এরশাদের পুলিশ নুর হোসেনের বুকে টার্গেট প্র্যাকটিস করে। ৯০ এর ১০ অক্টোবর রাজপথে প্রাণ দেন ছাত্রদল কর্মী জেহাদ। জেহাদের মৃত্যুতেই শুরু হয় স্বৈরাচার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলন।  আর ২৭ নভেম্বর ডা. মিলনের মৃত্যুর মধ্য দিয়েই তা নিশ্চিত পরিণতিতে পৌছায়।

তারপরও এরশাদ দিন দশেক ক্ষমতা আকড়ে ছিলেন বটে, কিন্তু সেটা না থাকার মতই। এরশাদের শাসনের নয় বছরই ছিল আন্দোলন সংগ্রাম, আর বিদ্রোহের কাল। এরশাদের হাত ছিল শহীদদের রক্তে রঞ্জিত। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের ছাত্রনেতা মিন্টু আনোয়ারের বাবাও ছিলেন এরশাদ বিরোধী। একবার এরশাদ এক জনসভায় দুই হাত উচিয়ে বলেছিলেন, এই দেখুন আমার হাত পরিস্কার, আমার হাতে রক্তের কোনো দাগ নেই। এটা শুনে মিন্টু ভাইয়ের বাবা হাতে থাকা পেপারওয়েট ছুড়ে টিভি ভেঙে ফেলেছিলেন।

তবে একটা কথা মানতেই হবে, এরশাদের শাসনের নয় বছর ছিল বাংলাদেশের সৃজনশীলতারও স্বর্ণযুগ। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে সংবাদপত্রে, কার্টুনে, গানে, কবিতায় সৃজনশীলতার স্ফুরণ ঘটেছিল যেন। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট বা পেশাজীবীরাও ন্যায্য আন্দোলনে রাজপথে ছিলেন। জাতীয় কবিতা পরিষদ গঠিত হয়েছিলই এরশাদের রাজকীয় কাব্যচর্চার প্রতিবাদে।

পতনের পর বছর পাচেঁক কারাগারে ছিলেন এরশাদ। তারপর যখন মুক্তি পেলেন, তখন তার আরেক রূপ। কোথায় সেই দাপুটে ও নিষ্ঠুর স্বৈরশাসক। এ যেন এক অস্থির, সর্বদা সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা রাজনীতিবিদ। আজ আওয়ামী লীগের জোট করেন তো কাল বিএনপির সাথে। নয় বছর গোটা বাংলাদেশ ছিল এরশাদের যেমন ইচ্ছা লেখার কবিতার খাতা। আর পতনের পর জাতীয় পার্টি হলো সেই খাতা। যা ইচ্ছা, তাই সিদ্ধান্ত নিতেন। সকালে রুহুল আমিন হাওলাদার মহাসচিব তো বিকালে মসিউর রহমান রাঙা। আজ স্ত্রী রওশন এরশাদ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী তো কাল ছোট ভাই জি এম কাদের।

স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের দুই মূল দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে এরশাদের সাথে জোট করতে দেখে আমার সবসময়ই নিজেকে প্রতারিত মনে হয়েছে। কিন্তু একবারই এই সিদ্ধান্তকে আমার যৌক্তিক মনে হয়েছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে এরশাদের ভূমিকার কথা নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে। এরশাদ নির্বাচনে অংশ নিতে চাননি। এমনও হয়েছে, তিনি সাংবাদিকদের কাছে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে আত্মহত্যারও হুমকি দিয়েছিলেন। দাপুটে স্বৈরাচারের এমন অসহায় পরিণতি দেখে তার জন্য আমার করুণাই হয়েছে। শেষ পর্যন্ত এরশাদকে সিএমএইচে আটকে রেখে রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টিকে ২০১৪ সালের নির্বাচনে আনা হয়েছিল।

এরপর সিএমএইচ থেকে এরশাদ সরাসরি বঙ্গভবনে যান নতুন সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে। নির্বাচনে যেতে অনিচ্ছুক এরশাদ বঙ্গভবন থেকে বেরিয়েছিলেন মন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে। সিএমএইচ থেকে বঙ্গভবনে পৌছতে এরশাদের কিছুটা দেরি হয়েছিল। তিনি যখন পৌছান, তখন কানায় কানায় ভর্তি বঙ্গভবনের হলরুমের সবাই স্বতস্ফুর্তভাবে হেসে উঠেছিল। এরশাদকে হাস্যকরই লাগছিল। এক জীবনে দাপুটে স্বৈরাচার এরশাদকে যেমন দেখেছি, তেমনি দেখেছি হাস্যকর রাজনৈতিক ভাঁড় এরশাদকেও।

তবে এরশাদকে আপনি অপছন্দ করতে পারেন, ঘৃণা করতে পারেন, হাসতে পারেন; কিন্তু আপনি তাকে অস্বীকার করতে পারবেন না। এরশাদ বাংলাদেশের রাজনীতির এমন এক অধ্যায়, যাকে উপেক্ষা করা যাবে না।

প্রভাষ আমিন: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

   

সামাজিক যোগাযোগে প্রযুক্তির প্রভাব



মো. বজলুর রশিদ
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

আধুনিক যুগে প্রযুক্তি আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে। সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থা তার ব্যতিক্রম নয়। ইন্টারনেট এবং মোবাইল ফোনের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে, মানুষ একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করার, সংযোগ স্থাপন করার এবং তথ্য শেয়ার করার নতুন নতুন উপায় খুঁজে পেয়েছে।

প্রযুক্তি বিশ্বব্যাপী মানুষের সঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে এবং সহজেই যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব করে তুলেছে। ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপের মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে আমরা বন্ধু, পরিবার এবং পরিচিতদের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারি। এছাড়াও, নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয় হওয়া এবং নতুন সম্পর্ক গড়ে তোলা সহজতর হয়েছে।

প্রযুক্তি আমাদের জ্ঞান ও তথ্য দ্রুত এবং সহজেই শেয়ার করার সুযোগ করে দিয়েছে। সংবাদ, নিবন্ধ, গবেষণাপত্র, শিক্ষামূলক উপকরণ সহজেই অনলাইনে পাওয়া যায়। এছাড়াও, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে আমরা নিজেদের মতামত, ধারণা এবং অভিজ্ঞতা অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারি।

প্রযুক্তি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার এবং সচেতনতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে মানুষ বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে এবং তাদের উত্থাপন করতে পারে। প্রযুক্তি আমাদের বিনোদনের জন্য নতুন নতুন মাধ্যম সরবরাহ করেছে। অনলাইন গেমস, ভিডিও, সঙ্গীত, ই-বই ইত্যাদি আমাদের অবসর সময়কে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে।

প্রযুক্তি ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও বিপ্লব এনেছে। অনলাইন শপিং, সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং, ফ্রিল্যান্সিং ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষ সহজেই তাদের পণ্য ও সেবা বাজারে তুলে ধরতে পারে।

প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহার মানুষকে বাস্তব জগতের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করার ফলে মানুষের পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কের ক্ষতি হতে পারে।

গবেষণায় দেখা গেছে যে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহারের সঙ্গে বিষণ্ণতা, উদ্বেগ এবং নিম্ন আত্মসম্মানের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে। অন্যদের সঙ্গে তুলনা করা, নেতিবাচক মন্তব্য এবং অনলাইন হয়রানির মুখোমুখি হওয়ার ফলে মানসিক চাপ বৃদ্ধি পেতে পারে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুয়া খবর এবং ভুল তথ্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। এটি জনমতকে প্রভাবিত করতে এবং সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। ব্যক্তিগত তথ্য অনলাইনে শেয়ার করার ফলে গোপনীয়তা লঙ্ঘনের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। হ্যাকিং, ডেটা লিক এবং সাইবার অপরাধের মাধ্যমে ব্যক্তিগত তথ্য চুরি হতে পারে।

অনলাইনে হয়রানি ও হুমকির শিকার হওয়ার ফলে মানসিক ক্ষতি হতে পারে। বিশেষ করে শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের ক্ষেত্রে এর প্রভাব বেশি হতে পারে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে অসুস্থ আসক্তি দেখা দিতে পারে। এটি ব্যক্তির ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

প্রযুক্তির প্রভাব, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে, ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিকই রয়েছে। প্রযুক্তির সর্বোচ্চ সুবিধা লাভের জন্য এবং এর সম্ভাব্য ক্ষতির ঝুঁকি কমানোর জন্য আমাদের সচেতনভাবে এবং দায়িত্বশীলভাবে এটি ব্যবহার করা উচিত। আমাদের সময় ব্যবস্থাপনা, গোপনীয়তা সেটিংস এবং অনলাইন আচরণ সম্পর্কে সচেতন থাকা উচিত। এছাড়াও, আমাদের সন্তানদের ইন্টারনেটের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে আরও সহজ ও সমৃদ্ধ করে তুলতে পারে। তবে, আমাদের সচেতন থাকতে হবে যে প্রযুক্তি আমাদের নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত, আমাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত নয়।

মো. বজলুর রশিদ: সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা।

 

;

ভোটে ফেরাতে হবে মানুষকে



কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপের ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে। বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা বাদে নির্বাচন ছিল মোটামুটি শান্তিপূর্ণ। নির্বাচনে জাল ভোট হয়েছে, ক্ষমতাসীন দলের অনেকের প্রভাব ছিল সত্য, তবে মোটাদাগে বড়ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। এ-ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের সন্তুষ্টির কারণ রয়েছে। তবে বিব্রত হওয়ার প্রধান কারণ ভোটার উপস্থিতি। অনেক আলোচনার মধ্যেও এবারের নির্বাচনে আশানুরূপ ভোটার আসেননি।

ভোটগ্রহণের পরের দিন বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, প্রথম ধাপের নির্বাচনে ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ ভোট পড়েছে। ইলেকট্রেনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট হয়েছে ২২ উপজেলায় এবং বাকি ১১৭ উপজেলায় হয়েছে ব্যালট পেপারে। ইভিএমে ভোটের হার ৩১ দশমিক ৩১ শতাংশ আর ব্যালটে ৩৭ দশমিক ২২ শতাংশ। সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে সোনাতলা, মীরসরাই ও কুষ্টিয়া সদর উপজেলায়। সেসব জায়গায় ভোট পড়েছে মাত্র ১৭ শতাংশ। সর্বোচ্চ ভোট পড়েছে জয়পুরহাট জেলার ক্ষেতলাল উপজেলায়। সেখানে ভোট পড়েছে ৭৩ দশমিক ১ শতাংশ।

সবচেয়ে বেশি ভোট পড়া এলাকা জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলায় মোট ভোটার ৯৫ হাজার ১৯১ জন। এর মধ্যে ৬৪ হাজার ৭৩০ জন ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। ওখানে পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি দুলাল মিয়া সরদার ৩০ হাজার ৩৯০ ভোট পান। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ নেতা তাইফুল ইসলাম তালুকদার পান ২২ হাজার ৯০১ ভোট।

কম ভোট পড়া এলাকাগুলোর মধ্যে বগুড়া সোনাতলায় ভোটার ছিলেন ১ লাখ ৬৪ হাজার ৩৩২ জন। এর মধ্যে ভোট দিয়েছেন ২৮ হাজার ২৭৮ জন। ওখানে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মিনহাদুজ্জামান লিটন ২০ হাজার ৪৮৩ ভোট পেয়ে চেয়ারম্যান পদে পুনরায় বিজয়ী হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মো. জাকির হোসেন পান ৭ হাজার ৩৪৫ ভোট। মিনহাদুজ্জামান লিটন সংসদ সদস্য সাহাদারা মান্নানের ছোট ভাই। আওয়ামী লীগের এই এমপির ভাইই কেবল নির্বাচনে বিজয়ী হননি, জেলার অপর এক উপজেলা সারিয়াকান্দিতে বিজয়ী হয়েছেন তার ছেলে সাখাওয়াত হোসেন সজল।

কম ভোট পড়া আরেক উপজেলা কুষ্টিয়া সদর। এখানে ৪ লাখ ২০ হাজার ৮৩৩ জন ভোটারের মধ্যে মাত্র ৭৩ হাজার ২৯৯ জন ভোটার ভোট দেন। কুষ্টিয়া সদর আসনের সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফের চাচাতো ভাই আতাউর রহমান আতা ৬৭ হাজার ৪৮১ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। তার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী আবু আহাদ আল মামুন পেয়েছেন ৩ হাজার ৫৬৪ ভোট।

নির্বাচন কমিশনের (ইসি) দেওয়া তথ্যের আরেক কম ভোট পড়া উপজেলা হচ্ছে চট্টগ্রামের মীরসরাই। ৩ লাখ ৭২ হাজার ২৫৭ জন ভোটারের ওই উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে এনায়েত হোসেন নয়ন ৩৩ হাজার ৭০ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী শেখ মোহাম্মদ আতাউর রহমান পান ২০ হাজার ৭৬৭ ভোট।

নির্বাচন কমিশনের ভাষ্যমতে, ভোট কম পড়ার কারণ হচ্ছে ধান কাটার মৌসুম, ঝড়বৃষ্টি, জনপ্রিয় প্রার্থীর অভাব, শহর এলাকায় ছুটি থাকায় মানুষের বাড়ি চলে যাওয়া, এবং বড় রাজনৈতিক দলের ভোটে অংশগ্রহণ না করা। এগুলোকে কারণ হিসেবে বললেও এটা যে স্রেফ অজুহাত দাঁড় করানো সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। নির্বাচন কমিশন ভোট কম পড়ার যে ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছে সেটাই কি আসল কারণ মূলত? ধান কাটার মৌসুম, ঝড়বৃষ্টির ওপর মানুষের হাত নেই, কিন্তু বাকিগুলো নির্ভর করে মানুষের ওপরই। ইসি যেভাবে ঝড়বৃষ্টিকে কারণ হিসেবে দাঁড় করাতে চাইছে সেটা মোটেও মূল কারণের মধ্যে পড়ে না, কারণ নির্বাচনের দিন কোথাও উল্লেখের মতো ঝড়বৃষ্টি হয়নি। ধান কাটার মৌসুমেও মানুষ আগে ভোট দিয়েছে, নির্বাচনের দিন প্রতিবারই ছুটি থাকে, এবং একদিনের এই ছুটিতে সচরাচর মানুষ গ্রামে চলে যায় না, বিশেষত ঠিক পরের দিন যেখানে আর কোন ছুটি নাই।

ইসি বলতে চাইছে, জনপ্রিয় প্রার্থীর অভাব ছিল নির্বাচনে। এটা কীভাবে মেনে নেওয়া যায়? দলীয় প্রতীকে এবার নির্বাচন না হলেও ক্ষমতাসীন দলের নেতারাই নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, অংশ নিয়েছেন বর্তমান চেয়ারম্যানরাও। যে তিন উপজেলায় সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে বলছে ইসি, সেই তিন উপজেলার অন্তত দুই উপজেলায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলীয় দুই সংসদ সদস্যের নিকটাত্মীয় হয়েছেন বিজয়ী। তাহলে ইসি কি বলতে চায় নির্বাচন বর্জন করছে যে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নেতারাই মূলত কেন্দ্রে ভোটার টানার মতো প্রার্থী?

ইসিও বলছে, নির্বাচনে ভোটার স্বল্পতার অন্যতম কারণ বিএনপির অংশ না নেওয়া। এটা এমনই অপ্রিয় সত্য যা অস্বীকারের উপায় নাই। হ্যাঁ, নির্বাচনে অংশ নিলে বিএনপির সকল বা বেশিরভাগ নেতাই বিজয়ী হয়ে যেতেন এমন না, তবে তাদের নির্বাচন বর্জনের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় দলটির সমমনাদের কেউ অংশ নেয়নি। এমনকি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যে সকল রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছিল তাদের কেউও নির্বাচনে অংশ নেয়নি।

দলের মধ্যকার কোন্দলকে প্রকাশ্য রূপ না দিতে আওয়ামী লীগ না হয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীক দেয়নি; কিন্তু কোথায় জাতীয় পার্টি, কোথায় ১৪-দলের শরিক দলগুলো, কোথায় সেই ‘কিংস পার্টি’ যারা বিগত সময়ে হঠাৎ গজিয়ে ওঠে সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল? জাতীয় পার্টি জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধীদলের স্বীকৃতি পেলেও প্রান্তিক পর্যায়ে এই দলটির অস্তিত্ব যে আদতে নেই, এটা স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে তাদের অংশগ্রহণের ইতিহাস দেখলে সহজেই অনুমেয়। সরকারের অনুকম্পায় টিকে থাকা দলটি নেতাকর্মী সংকটে তা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। সদ্য সমাপ্ত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপ সেটা আরও একবার প্রমাণ করল।

প্রথম ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অনুমিতভাবে নির্বাচিতদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগের। স্থানীয় সরকারের নির্বাচন অথচ নির্বাচনে নেই উল্লেখের মতো ভোটার উপস্থিতি। এবারের ভোট প্রদানের হার বিগত সংসদ নির্বাচনের ভোটের হারের চাইতেও কম। এর দ্বারা কি প্রমাণ হচ্ছে না আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী-প্রার্থীরা ভোটারদের আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হচ্ছেন? এই ব্যর্থতা কি তবে অনাস্থার বিমূর্ত প্রকাশ?

ধান কাটা মৌসুম, ঝড়বৃষ্টিসহ হালকা-ঢঙের যতই অজুহাত দাঁড় করাক না কেন নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনের দিন পর্যন্ত সত্যি কি ভোটের হাওয়া বইছিল নির্দিষ্ট ওই ১৩৯ উপজেলাজুড়ে? বাস্তবতা বলছে, কখনই মনে হয়নি ভোট এসেছে। ভোটের প্রতি মানুষের এই অনাগ্রহ কী কারণে ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে সেটা বের করা জরুরি।

যারা ভোট দিতে যায়নি, তাদের সকলেই যে বিএনপির নেতাকর্মী-সমর্থক, এমনটা ভাবার কারণ নাই। দেশে এত এত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী তারাও কি ভোট দিতে গেছে? ভোটার উপস্থিতির হার বলছে, তারাও নির্বাচনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে বসেছে। মানুষ ভোট দিতে যায়নি মূলত ‘ভোট দিয়ে কী হবে’ এমন একটা ধারণা কিংবা বিশ্বাস থেকেই।

ব্যক্তিগতভাবে অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি, এবং বেশিরভাগেরই অভিন্ন মতামত। এটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকার-রাখার হুমকিসম। মানুষ দিন দিন ভোটে অনাগ্রহী হয়ে পড়ার কারণে ‘অন্ধকারের আততায়ীরাও’ যদি কখনও ক্ষমতার কেন্দ্রের কাছাকাছি পৌঁছায়, তবে এখান থেকে মুক্তির পথ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘায়ত হতে থাকবে। নির্বাচন এককালে ছিল আমাদের অন্যতম এক উৎসব। ভোট ও প্রার্থীদের নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলত সবখানে, কিন্তু এখন সে দিন হারিয়ে গেছে অনেকটাই।

ভোটবিমুখ মানুষকে ভোটে ফেরাতে হবে, দিতে হবে অভয়, গড়তে হবে সম-মর্যাদা ও সম-সুযোগের মাঠ। ভোট যে অধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার; এই বোধের জাগরণ দরকার। দরকার কেন্দ্র আর প্রান্তের মধ্যে যোগাযোগ ও আস্থার পরিবেশ। আস্থার পরিবেশ না ফিরলে মানুষ ভোট ও গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বিমুখ হতেই থাকবে!

;

স্বাধীন ফিলিস্তিন প্রশ্নে ছাত্র সংহতি: অন্যরা ঘুমিয়ে কেন?



আশরাফুল ইসলাম পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

পশ্চিমা মদদ আর আরব বিশ্বের আশ্চর্যজনক নীরবতায় ফিলিস্তিনের হতভাগ্য নাগরিকদের ওপর যুগ যুগ ধরে চলা ইহুদীবাদী ইসরায়েলের অব্যাহত বর্বরতায় বিশ্ব নতুন করে জেগে উঠেছে। এই ‘বিশ্ব’ বলতে আপামর বিশ্ববাসী বললে ভুল হবে, মূখ্যত সাম্প্রতিক সময়ের নজিরবিহীন নারকীয়তায় যারপারনাই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে বিশ্বের ছাত্র-তরুণ আর মুক্তিকামী মানুষদের একটি অংশ, যারা তাদের বিবেক দ্বারা চালিত হচ্ছেন। কৌশল বা কোন সমীকরণের ধার ধারছেন না তারা।

উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, বিশ্বজুড়ে মানবতার মেকি সবক দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর ছাত্র-তরুণরাও তাদের শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তীব্র ক্ষোভে মজলুম ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি প্রকাশে পথে নেমে এসেছেন। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে তীব্র উত্তেজনা বিরাজ করছে। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী-তরুণদের থামাতে বলপ্রয়োগ আর ভীতি প্রদর্শনের কিছুই অবশিষ্ট রাখছে না দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পরিণতিতে বহু ছাত্র-তরুণ এমনকি শিক্ষকরাও গ্রেপ্তারবরণ করছেন।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, মার্কিন মুলুকে ফিলিস্তিন সংহতির এই প্রকাশ ঘটছে ইউরোপসহ বিশ্বের নানাপ্রান্তে। ঐতিহাসিকভাবে ফিলিস্তিনের জনগণের পাশে থাকা বাংলাদেশের ছাত্র-তরুণরাও গেল কয়েকদিন ধরে ‘স্বাধীন ফিলিস্তিন’ এর পক্ষে ও ইসরাইলি বর্বরতা বন্ধের দাবিতে পথে নেমেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কয়েকটি সমাবেশের ধারাবাহিকতায় আজ বৃহস্পতিবারও একটি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।

নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জন্মলাভ করা বাংলাদেশের কাছে পরাধীনতার গ্লানি অচেনা নয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিসহ রাজনৈতিক মেরুকরণের নানা বাস্তবতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের মানুষের মনে পীড়িত ফিলিস্তিনের মজলুম জনতার জন্য ভালোবাসা আর সংহতির কোন কমতি নেই। আমরা লক্ষ্য করছি, বর্তমান সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারাও ফিলিস্তিনে বর্বরতার বিরুদ্ধে জোরাল অবস্থান নিয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতার জন্যই যে এই অবস্থান তা অনেকে বলবার চেষ্টা করলেও আমরা মনে করি, দলমত নির্বিশেষে নিপীড়িত ফিলিস্তিনের জন্য সকলের একাট্টা হওয়াই উচিত। অভ্যন্তরীণ রাজনীতির নিরিখে এই সংহতি প্রকাশে অবস্থান গ্রহণে তারতম্য থাকা উচিত নয়। সেই সঙ্গে সংহতি প্রকাশে কাজ করা উচিত নয় ধর্মীয় বিবেচনাও।

মুক্তিসংগ্রামের ঐতিহ্যিক পরম্পরাকে লালন করা একটি দেশ হিসাবে আমাদের বিশ্বের যেকোন প্রান্তের নির্যাতিত মানুষের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করাই কর্তব্য হওয়া উচিত। মুক্তিকামী মানুষের অনুভূতি যে অভিন্ন তা আমরা ১৯৪৭ সালে ১৫ আগস্ট মধ্যরাতে ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণার সময়ে ব্রিটিশ শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের কণ্ঠেও ধ্বনিত হতে শুনেছি। সেদিন তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাবে স্বীকার করেছিলেন, `Freedom Loving People Everywhere’.

কিন্তু আমরা লক্ষ্য করছি, অভ্যন্তরীণ রাজনীতির মেরুকরণে স্বাধীন ফিলিস্তিনের সংহতি প্রকাশে এখানকার রাজনৈতিক দলগুলির দ্বিধাবিভক্ত অবস্থান। সরকার বিরোধিতায় কোন কোন দলের পশ্চিমাশক্তির মদদপ্রাপ্তির আকাঙ্খা, ফিলিস্তিন নিয়ে তাদের আশ্চর্যরকম নীরবতার কারণ বলে অভিযোগ আছে। ধর্মীয় উন্মাদনার জিগির তুলে ইসলামী দলগুলো অনেক অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে তুলকালাম বাধিয়ে দিলেও ফিলিস্তিনের উপর চলমান বর্বরতায় তাদের উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি দৃশ্যমান নয়। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের এ নিয়ে মূল্যায়ন এরকম যে, দলীয় ও গোষ্ঠীগত স্বার্থে এসকল দল ও সংগঠন একাট্টা হলেও নিপীড়িত মানুষের জন্য তাদের অবস্থান অস্পষ্ট।

অন্যদিকে আমরা গভীর বেদনার সঙ্গে লক্ষ্য করছি, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি ফিলিস্তিনের উপর যুগ যুগ ধরে চলা বর্বরতার বিরুদ্ধে বিস্ময়কর নীরবতা প্রদর্শনের ধারাবাহিকতায় চলমান ইসরাইলি ধ্বংসযজ্ঞেও তাদের কৌশলগত রক্ষণশীলতা অব্যাহত। মুখে মুসলিম সংহতি, পশ্চিমাবিষোদগার আর ইসরাইলের নিন্দা করে গেলেও তাদের পক্ষ থেকে জোরাল কোন পদক্ষেপ নেই। দেশগুলি তাদের নিজস্ব ব্যবসায়িক ও নিরাপত্তা স্ট্রাটেজিকেই সর্বাগ্রে প্রধান্য দিয়ে চলছেন।

প্রতিদিন শত শত নিরীহ ফিলিস্তিনি শিশু, নারী-বৃদ্ধ এমনকি চিকিৎসাধীনরা ইসরাইলি হামলার নিশানা হলেও আরববিশ্বের ঘুম ভাঙছে না। ইরানের সক্রিয় অবস্থানে যখন ইসরাইলসহ পশ্চিমারা নড়েচড়ে বসছেন সেই সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি যদি মিনমিনে নিন্দার বদলে অস্ত্রের ভাষায় কথা বলতো তবে এক সপ্তাহে দৃশ্যপট বদলে যেতে পারত। মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির ওপর নজর রাখা বিশ্লেষকরা বলছেন, ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস যদি ইসরাইলি বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে না তুলতো তবে আরও বহুদূর বিস্তৃত হতো ইসরাইলি আস্ফালন ও ধ্বংসযজ্ঞ।

যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রসংবরণের যে আহ্বান তাকে যদি মেকিও ধরে নিই তারও যে একটা তাৎপর্য রয়েছে, বলা যায় স্পষ্টতই তা হামাসসহ অন্যান্য স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠনের জেগে উঠার ফলশ্রুতি। নানামূখি মেরুকরণে সুর মিলিয়ে কিংবা কৌশলী প্রতিবাদ-নিন্দায় যারা ‘ফিলিস্তিন সংহতি’তে সীমিত থাকছেন তাদের সেখান থেকে বেরিয়ে আসার বিকল্প নেই। বলাবাহুল্য, জোরদার বিশ্ব জনমতেরও একটি অবধারিত মূল্য রয়েছে। সব মতপার্থক্য ও ধর্মীয় পরিচয় ব্যতিরেকেই ফিলিস্তিনের জন্য নিরঙ্কুশ সংহতি সময়ের দাবি।

;

আলো ঝলমলে শহর ও বাইক চালকের অসহায় মুখ



আশরাফুল ইসলাম পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম
অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

তখন সন্ধ্যা ছুঁই ছুই। কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউতে হেটে কর্মস্থলে আসছিলাম। বাংলামটর মোড়ে রাস্তা পেরিয়ে পা বাড়াতেই মোটরসাইকেলে বসা এক তরুণ ডাক দিলেন, ‘ভাই যাবেন?’

অপ্রস্তুত ও খানিকটা বিরক্ত হয়েই জবাব দিলাম, ‘আমি কি আপনাকে জিজ্ঞেস করেছি?’

ওই তরুণ নিরুত্তর থাকেন, মলিন মুখে অন্যদিকে তাকায়। খানিকটা এগিয়ে থমকে দাঁড়াই এই ভেবে যে, মনে হয় তাকে অনেকটা কষ্ট দিয়ে ফেলাম। ভাবলাম, এভাবে না বললেও হতো। অনুশোচনায় ফিরে এসে, ‘দুঃখিত’ বলে জানতে চাইলাম, ‘অনেকক্ষণ যাত্রী পাচ্ছেন না বোধহয়?’

বেশ কষ্ট নিয়েই বাইক চালক জানালেন প্রায় দেড় ঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন, নিয়ে যাওয়ার মতো কাউকেই পাচ্ছেন না। অনেক অপেক্ষার পর কেউ যেতে চাইলে তাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাইকচালকদের মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলে। সেই সুযোগ নেন যাত্রীও। কম ভাড়ায় যেতে সম্মত হয়ে যান কেউ, তাই পথচারী কাউকে হেটে যেতে দেখলেও যেচে তাকে জিজ্ঞেস করেন বাইক চালকরা। ওই চালক জানালেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাশ করে চাকুরি জুটাতে পারেননি, তাই বাধ্য হয়ে বাইক চালাতে নেমেছেন। বললেন, ‘এভাবে কাউকে ডাকতে যে সংকোচ হয় না তা নয়, তবে ক্ষুধা আর বেঁচে থাকার চেয়ে কিছুই বড় নয়।’

কর্মস্থলে আসতে রোজ একইভাবে বাইকচালকদের এভাবে মলিনমুখে দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। বলতে গেলে গোটা ঢাকা শহরজুড়েই তাদের এভাবে বেকার বসে থাকা চোখে পড়ে। বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)সহ বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, রাজধানী ঢাকা শহরে ১০ লাখেরও বেশি মোটরবাইক চলে। ধারণা করা যায়, তাদের একটি বড় অংশই বিভিন্ন রাইড শেয়ারিং অ্যাপে সংযুক্ত হয়ে পথে নেমেছেন ভাড়ায় যাত্রী পরিবহণের জন্য। রাইড শেয়ারিং অ্যাপে কানেক্ট হলেও অধিকাংশ বাইকচালক এখন পথেই আগ্রহী যাত্রীদের সঙ্গে দরকষাকষি করে কাঙ্খিত গন্তব্যে যেতে সম্মত হয়ে যান।

২০২২ সালের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ৩২ লাখেরও বেশি নিবন্ধিত মোটর সাইকেল রয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও মোটর সাইকেলে ভাড়ায় যাত্রী পরিবহণের প্রচলন অনেক আগেই শুরু হয়েছে। ২০১০ সালে সুন্দরবনে বেড়াতে গিয়ে মোংলায় এক বাইকে দু’জন-তিনজন নিয়েও চলতে দেখেছি। পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দেশের শিক্ষিত তরুণদের একটি বৃহৎ অংশ কাঙ্খিত চাকুরি না পেয়ে কিংবা চাকুরির আবেদন করে অপেক্ষায় থেকে থেকে জীবিকার প্রয়োজনে এই মোটর সাইকেলে যাত্রী পরিবহণে নেমেছেন। কিন্তু এই হুজুগে জাতির একজন কিছু করতে দেখলে বা কোন একটা সম্ভাবনার খবর পেলে সবাই তাতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। চিরাচরিত এই রেওয়াজে প্রয়োজনেরও অনেক বেশি বাইক চালক যাত্রী পরিবহণে নেমেছেন। তাই জীবিকার আশায় পথে নামলেও যাত্রীর দেখা পাচ্ছেন না, কাঙ্খিত আয় করতেও ব্যর্থ হচ্ছেন। তরুণ জনশক্তির একটি বড় অংশ এভাবে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে অনেক সময় পথ দুর্ঘটনায় পড়ছেন। কখনো কখনো জড়িয়ে পড়ছেন নানা সামাজিক অপরাধেও।

দ্রব্যমূল্যের চরম উর্ধ্বগতিতে জনজীবনে যে নাভিশ্বাস তা নীতিনির্ধারকরা অনেকেই আমলে নিতে চান না। সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তাদের অনেককেই বলতে শোনা যায়, ‘বাজারে তো কোন জিনিসের সংকট নেই’ কিংবা ‘মানুষের ক্রয় ক্ষমতা এখন বেড়েছে’ ইত্যাদি। কিন্তু সমাজে যেই মানুষেরা শিক্ষা অর্জন করে এক ধরণের আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন হয়েছেন, যাঁরা চরম দারিদ্রেও নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশে কুণ্ঠিত-সেই শ্রেণীর জন্য বর্তমানে টিকে থাকা কতটা কঠিন তা দীর্ঘসময় যাত্রীর জন্য দাঁড়িয়ে থাকা সেই বাইকচালকের মুখাবয়ব দেখে সহজেই বুঝে নেওয়া যায়। বর্তমানে স্যোশাল মিডিয়ার কল্যাণে সমাজের ভেতরকার ক্ষোভ-উত্তাপ আন্দাজ করা যায় কঠিন নয়। আমরা লক্ষ্য করি, উঠতি ধণাঢ্য হয়ে একটি শ্রেণির বেপোরোয়া চাকচিক্যময় জীবনযাপন অন্যদিকে চরম হতাশায় দিনশেষে ক্ষুধার অন্ন জোগাড় করতে না পারার দুঃখ কিংবা মাস শেষে মেসের সামান্য কয়টা টাকা দিতে না পারায় ম্যানেজারের গঞ্জনা।

বাইকে যাত্রী পরিবহণ করে জীবন চালাতে না পারা এমন তরুণদের মতো বিভিন্ন পেশার আরও বহু তরুণদের আমরা দেখি যাদের অবস্থার আরও করুণ। ক’দিন আগে স্যোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া ঘটনা নিয়ে পরবর্তীতে মূলধারার সংবাদপত্রেও খবর হতে দেখেছি-কাওরানবাজারে বড় মাছ কিনে কাটিয়ে নেওয়ার পর মাছের অন্ত্রনালী, পাখনাসহ অন্যান্য ফেলে দেওয়া যেসব অংশ থাকে তাও ভাগা দিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। মুখ ঢেকে তাও কিনে নিয়ে যাচ্ছেন এক শ্রেণির মানুষ। প্রকাশিত খবরের তথ্য অনুযায়ী, তারা ভিখারি কিংবা ছিন্নমূল কেউ নন। যারা মাছের ওইসব ফেলে দেওয়া অংশের ভাগ কিনে নিচ্ছেন তারা অবস্থার পাকে পড়ে জীবনসংকটে থাকা শিক্ষিত বেকার মানুষ। ৭-৮শ’ টাকা কেজিতে মাছ কেনার সমার্থ্য তাদের নেই।

বর্তমানে দেশের অকাঠামোগত ও কিছু মানুষের বিপুল প্রতিপত্তি দেখে তথাকথিত ‘উন্নয়ন-অগ্রযাত্রা’র সরলীকরণ করা যাবে না। এই উন্নয়ন যে সামগ্রিকভাবে আর্থ-সমাজিক অসমতাকে দূর করতে পারেনি তা আমরা দ্ব্যর্থহীনভাবেই বলতে পারি। বাংলামটর মোড়ে দেড় ঘন্টা ধরে যাত্রীর জন্য দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষিত ওই তরুণটির কাছে এই আলোঝলমলে এই শহর যেমন একরাশ হতাশা ছাড়া কিছুই নয় তেমনি প্রত্যন্ত কোন গ্রামে ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া কৃষকের কাছেও ধূসর জীবনের সবই নিরানন্দ।

;