নিজ বলয়ে প্রদক্ষিণরত নক্ষত্র



রোজেন হাসান
অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভালো কবিতা অনেকেই লেখেন, যে কবিতাগুলো পড়ে পাঠকেরা আপ্লুত হন। এই কবিতাগুলো অনেকটাই অতীতের গুরুত্বপূর্ণ কবিদের কবিতার সাথে মিলে যায়। পাঠকেরাও পূর্বকবিদের কবিতা পড়ার কারণে এই ভালো কবিতাগুলোর ভাষা-ভঙ্গিমাকে চিনতে পারেন। তাই যখনই ওইসব গুরুত্বপূর্ণ কবিদের কবিতার মতো কবিতা কোনো কবি লেখেন, সেগুলো পাঠকদের পূর্বঅভিজ্ঞতার সাথে মিলে যায় এবং তারা বাহ্ বাহ্ বলে ওঠেন এবং সেগুলো ভালো কবিতা হিসেবে চিহ্নিত হয়। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় যখন কোনো কবি কথিত ভালো কবিতা লেখেন না, এর বিপরীতে নিজস্ব কাব্যভাষায় নিজের কবিতা লেখেন। এই কবির নিজস্ব কাব্যভাষা আসে তার নিজস্ব কাব্যজগত থেকে। যে জগত তিনি পৃথিবীর চির ইতিহাসের মাঝে বিরাজমান চিন্তা, প্রাণ এবং বস্তুর সাথে নিজের অভিজ্ঞতাকে মিলিয়ে তৈরি করেন। ফলে তার কবিতা নতুন হয়ে ওঠে। আর তার কবিতার এই নতুনত্বের কারণেই অতীতের কবিতায় অভ্যস্ত এবং সাম্প্রতিক কালের ভালো কবিতার দৌরাত্ম্যের কবলে পড়ে পাঠকেরা এই কবিতাগুলোকে ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারেন না।

পাঠকদের মতো সমালোচকেরাও সমস্যায় পড়ে যান কেননা তারা এইরকম কবিতা আগে পড়েননি। আর যা আগে পড়েননি সেরকম কবিতার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা তাদের পক্ষে দুরূহ হয়ে পড়ে। কিন্তু আশার কথা হলো একসময় এইরকম কবিরা গৃহীত হন পাঠক এবং সমালোচক মহলে। সময়ের সাথে সাথে এই কবিদের—যারা সংখ্যায় খুব নগন্য—কাব্যজগতটি ধীরে ধীরে ভাস্বর হয়ে ওঠাই এর মূল কারণ। যখনই তাদের জগতটি উন্মেচিত হতে শুরু করে, তাদের আসে গৃহীত হবার পালা, তখন পাঠক এবং সমালোচকরা উন্মাদপ্রায় হয়ে যান। এই কবির অনুসারীতে কবিতা লেখকদের ছোট পরিধিটি দ্রুত ভরে যেতে থাকে। এই কবি নতুন কবিদের আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হন। অবশ্য তার অনুসারীরাও ভালো ভালো কবিতা লিখতে শুরু করেন। এই ধারা চলতে পারে এমনকি যুগ থেকে যুগ পর্যন্ত। বিনয় মজুমদারও সেই নতুন কবিতা সৃষ্টিকারী কবি, যাঁর রয়েছে একটি স্বতন্ত্র কবিতাবিশ্ব, রয়েছে একটি নিজস্ব কাব্যভাষা। ভালো কবিতালেখকদের ভিড়ে তিনি তাই এক নিজ বলয়ে প্রদক্ষিণরত নক্ষত্র। যার আলো বহু আলোকবর্ষ দূর থেকে আসে। তাই তাঁকে বুঝতে পাঠকদের এবং সমালোচকদের একটু সময় লেগেছে, সময়টা একটু বেশিই।

কী রয়েছে তাঁর কবিতাবিশ্বে? তাঁর কবিতা বিশ্বের স্তম্ভগুলো হলো গণিত, বিজ্ঞান, প্রকৃতিবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান এবং দর্শন। এই সবকিছুকেই তিনি মিলিয়েছেন নিজের অভিজ্ঞতার সাথে, আর অভিজ্ঞতার হীরক স্পর্শে এইসব উপাদান বিনয় মজুমদারের নিজস্বতায় চিহ্নিত হয়ে ওঠার সাথে সাথে বাংলা কবিতাতেও খুলে দিয়েছে নতুন নতুন সব জানালা। তার কাব্যভাষাটিও তাই নতুন। তিনি কবিতায় আবেগকে পরিমিতভাবে ব্যবহার করেন। কবিতাসহ শিল্পের যে কোনো শাখায় অতি আবেগ এবং আবেগহীনতা এই দুটি জিনিসই ক্ষতিকর, বিনয় মজুমদারের কবিতায় আবেগ সবসময় এই দুইয়ের মাঝামাঝি অবস্থান করে; তিনি তাঁর কবিতার জন্য এমন একটি ভাষা নির্মাণ করেছিলেন যেটিতে অনায়াসে গভীর চিন্তাকে উপমা, চিত্রকল্পে ব্যক্ত করা যায়। তাঁর কবিতার ভাষায় গণিতের বস্তুনিষ্ঠতা, নিরপেক্ষতা এবং সিদ্ধান্তগ্রহণ পদ্ধতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে, পর্যবেক্ষণ এবং যুক্তিরও একইরকম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে সেখানে। তবে একসময় তিনি ক্রমশই সহজ-সরলতার দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন। এই কবিতাগুলোতে চারপাশের মানুষ, উদ্ভিদ এবং বস্তু পারস্পরিক পারম্পর্য তৈরি করে ভিন্ন অর্থবোধকতা তৈরি করে। বিনয় মজুমদারের কবিতা থেকে কিছু পঙ্ক্তি পড়া যাক—

আমার আশ্চর্য ফুল, যেন চকোলেট, নিমিষেই
গলাধঃকরণ তাকে না-ক’রে ক্রমশ রস নিয়ে
তৃপ্ত হই, দীর্ঘ তৃষ্ণা ভুলে থাকি আবিষ্কারে, প্রেমে।
অনেক ভেবেছি আমি, অনেক ছোবল নিয়ে প্রাণে
জেনেছি বিদীর্ণ হওয়া কাকে বলে, কাকে বলে নীল—
আকাশের হৃদয়ের; কাকে বলে নির্বিকার পাখি।
[ফিরে এসো, চাকা]

পৃথিবীর আকর্ষণে ফুলগুলি নুয়ে পড়ে, ঝ’রে পড়ে যায়।
কিন্তু দ্যাখো, পাখিগুলি স্বেচ্ছাধীন নেমে পুনরায় উড়ে যেতে পারে।
চেষ্টাকৃত পদ্ধতিতে অসময়ে জন্ম দিতে গেলে
শিশু মরে যেতে পারে, এ সত্যটি চিকিৎসক জানে।
[গায়ত্রীকে]

অমিল পয়ার ছন্দে রচিত বসন্তকাল শেষ হয়ে এলো।
পথের উপরে আজ দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ দেখলাম চারিপাশে মাঠ
কালো কালো ধানগাছ ঢাকা আছে, এই সুমুদ্রিত ধানগাছগুলি
আমার এ জীবনের বসন্তের অভিজ্ঞতা।
[বসন্তকাল]

তিনি অনেকটা সুফি কবি মনসুর আল-হাল্লাজ এবং মাহমুদ শাবিস্তারির মতো মেকি আবরণ ছেড়ে কবিতার অন্তঃসারটিকেই মুখ্য ভূমিকা দিতে চান। মিউজগণ এবং দুয়েন্দের বিপরীতে তাঁর ছিল গণিত, বিজ্ঞান ও দর্শন। বাস্তবেও তিনি গণিতচর্চায় মুখর থাকতেন। গণিতে তাঁর কিছু আবিষ্কারও আছে।

দুই.

বিনয় মজুমদার তাঁর কবিতায় উৎসর্গকৃত জীবন, গায়ত্রী চক্রবর্তীর প্রতি প্রেম এবং তাঁর বারবার পাগল হয়ে যাওয়া নিয়ে মিথে পরিণত হয়েছেন আজ। তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় এক সুন্দরী নারীর প্রেমে পড়েন, সেই নারীটি হলেন গায়ত্রী চক্রবর্তী। ইংরেজি সাহিত্যের এই ছাত্রীর সাথে তাঁর কথা হয়েছিল মাত্র তিন-চারবার। পরে বিনয় মজুমদার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে অন্যত্র চলে যান। কিন্তু গায়ত্রীর প্রতি প্রেম এবং সেই প্রেমের অভিঘাত স্থায়ী হয়েছিল তাঁর সমগ্র জীবনব্যাপী। কৃতিত্বের সাথে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছিলেন এবং সেইকালের মোটা অংকের চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন শুধুমাত্র কবিতায় আরো গভীরভাবে মনোনিবেশ করার জন্য। তাঁর ‘ফিরে এসো, চাকা’র সেই ৭৮টি শিল্পের উত্তুঙ্গ শিখরস্পর্শী কবিতা লেখা সম্ভব হয়েছিল মনে হয় কবিতায় এই বিশুদ্ধ আত্মনিবেদনের ফলেই। এই বইটির নাম গায়ত্রী চক্রবর্তীর নাম থেকেই নেওয়া, তিনি পরে বলেছিলেন গায়ত্রী চক্রবর্তীকে তিনি রূপান্তরিত করেছিলেন ‘গায়ত্রী চাকা’তে। বইটি উৎসর্গও করেছিলেন তাঁকেই।

এই বইয়ের কবিতাগুলোতে আমরা যে বিনয় মজুমদারকে পাই তিনি একাধারে দার্শনিক, বিরহী প্রেমিক, জীবনের গহীন অতল সমস্যাগুলোর পর্যবেক্ষক, বৈশ্বিক বোধের অধিকারী, বিজ্ঞানে নিবেদিত এবং এমন এক কবিসত্তায় উত্তীর্ণ কবি যিনি বিশ্বের মাঝে মানবাত্মার দুরূহ জীবনের বহুবিস্তারী সুন্দরের অনেকগুলো জানালা খুলে দেন। বইটি থেকে কিছু কবিতার পঙ্ক্তি পড়া যাক—

১.
একটি উজ্জ্বল মাছ একবার উড়ে
দৃশ্যত সুনীল কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে স্বচ্ছ জলে
পুনরায় ডুবে গেল—এই স্মিত দৃশ্য দেখে নিয়ে
বেদনার গাঢ় রসে আপক্ক রক্তিম হ’লো ফল।

২.
ভালোবাসা দিতে পারি, তোমরা কি গ্রহণে সক্ষম?
লীলাময়ী করপুটে তোমাদের সবই ঝ’রে যায়—
হাসি, জ্যোৎস্না, ব্যথা, স্মৃতি, অবশিষ্ট কিছুই থাকে না।

৩.
স্রোতপৃষ্ঠে চূর্ণ-চূর্ণ লোহিত সূর্যাস্ত ভেসে আছে;
নিশ্চল, যদিও নিম্নে সংলগ্ন অস্থির স্রোত বয়।
এখন আহত মাছ কোথায় যে চ’লে গেছে দূরে,
তুমিও হতাশ হ’য়ে রয়েছো পিছন ফিরে, পাখি।
এখনো রয়েছে ওই বর্ণময়, সুস্থ পুষ্পোদ্যান;
তবুও বিশিষ্ট শোকে পার্শ্ববর্তী উদাত্ত সেগুন
নিহত, অপসারিত, আর নেই শ্যামল নিস্বন।
কেন ব্যথা পাও পৃথিবীর বিয়োগেবিয়োগে?

৪.
শুনেছি সবার মাঝে একটি কুসুম ঘ্রাণময়ী;
ব্যথিত আগ্রহে দেখি; এত ফুল, কোনটি বুঝি না।
যে-কোনো অপাপবিদ্ধ তারকারো জ্যোৎস্না আছে ভেবে
কারো কাছে যেতে চাও, হে চকোর, স্বপ্নচারী, বৃথা।

৫.
অভিজ্ঞতা থেকে ক্রমে আকাশের বর্ণহীনতার
সংবাদের মতো আমি জেনেছি তোমাকে; বাতাসের
নীলাভতাহেতু দিনে আকাশকে নীল মনে হয়।

৬.
আমিই তো চিকিৎসক, ভ্রন্তিপূর্ণ চিকিৎসায় তার
মৃত্যু হ’লে কী প্রকার ব্যাহত আড়ষ্ট হ’য়ে আছি।
আবর্তনকালে সেই শবের সহিত দেখা হয়;
তখন হৃদয়ে এক চিরন্তন রৌদ্র জ্ব’লে ওঠে।

৭.
শ্বাশ্বত মাছের মতো বিস্মরণশীলা যেন তুমি।

এই কবিতাগুলো শিল্পের সেই উর্ধ্বমেঘে ডানা মেলেছে, যেখানে একজন কবির যাবার প্রত্যাশা থাকে। পাঠকদের জন্যেও এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। এ-বইয়ে শিল্প সক্ষমতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন বিনয় মজুমদার।

‘ফিরে এসো, চাকা’ প্রকাশিত হবার পর থেকে অনেকদিন পর্যন্ত এর কবিতাগুলো জীবনানন্দ দ্বারা প্রভাবিত হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। অবশ্য বিনয় মজুমদারও একবার বলেছিলেন তিনি সারাজীবন জীবনানন্দ দাশের মতো কবিতা লিখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সময় প্রবাহিত হওয়ার সাথে সাথে আজ এটি প্রতিষ্ঠিত যে ‘ফিরে এসো, চাকা’ তাঁর মৌলিক সৃষ্টি। এটি অনন্য, যদি প্রভাবিত হওয়ার বিষয় থাকেও, সেটি তিনি করেছিলেন জীবনানন্দ দাশ থেকে সরে যাওয়ার জন্য, মানে জীবনানন্দকে তিনি একটি উপাদান হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন এখানে। জীবনানন্দ দাশের কাব্যজগত এবং বিনয় মজুমদারের কাব্যজগত সম্পূর্ণ পৃথক।

‘ফিরে এসো, চাকা’ প্রকাশিত হবার দীর্ঘকাল পর তিনি একটি আশ্চর্য কবিতার বিষয়বস্তু খুঁজে পান। সেই বিষয়বস্তু খুঁজে পেয়ে তিনি ১৯৭৪ সালে একমাসে ছয়টি দীর্ঘ কবিতা লিখলেন। তিনি নিজে বলেছিলেন, “১৯৭৪ এক মাসের মধ্যে এ যেন একটা বিশাল যুগ পার হয়ে যাওয়া।” এই কবিতাগুলোই লিপিবদ্ধ হলো ‘অঘ্রানের অনুভূতিমালা’ নামক কবিতার বইয়ে। বাংলা সাহিত্যে স্বার্থক দীর্ঘকবিতা হিসেবে এই কবিতাগুলো এক অনন্য উদাহরণ। কবিতাগুলোতে তিনি একজন দ্রষ্টার মতো বস্তুর, দৃশ্যের, সময়ের, অন্তর্নিহিত সত্তাকে উন্মোচিত করেছেন। এখানে দেখা যায় তিনি একটি বিষয় নির্বাচন করেছেন, এবং এরপর সেই বিষয়টিকে ভিন্ন ভিন্ন কোণ থেকে বিশ্লেষণ করেছেন, সিদ্ধান্ত টেনেছেন, এরপর এরকমভাবে আরেকটি বিষয়ে গেছেন। এগুলো স্বার্থক দীর্ঘকবিতা কারণ কবিতাগুলোকে দশ-বারো লাইনের লিরিক কবিতার মতো টেনে-টেনে বড় করেননি তিনি। এখানে কবিতায় উপস্থাপিত বিষয়বস্তুই প্রধান, একজন কথক তো আছেনই কিন্তু লিরিক কবিতার কবির মতো তিনিই মুখ্য নন, কবির নিজস্ব আবেগই মুখ্য নয় এখানে। কবিতায় আসা প্রতিটি বিষয় এবং ঘটনাই মূল ভূমিকা নিয়ে চিত্রকল্পে, উপমায়, বর্ণনায় হাজির হয়েছে। তাই পাঠকদের ক্লান্তিবোধ জাগে না, বারবার পড়ার পরেও। কবিতাগুলো মহাপয়ারে লেখা। তিনি অবশ্য তাঁর প্রায় সব কবিতাই পয়ার এবং মহাপয়ারে লিখেছেন। বইটি থেকে কয়েকটি পঙ্ক্তি পড়া যাক—

১.
যদি কাছাকাছি থাকি তবে আর অকারণে উদয়ের ভাবনায় কখনো পড়ি না।
থাকে না এমন ভিড়ে খুঁজে-খুঁজে সপ্তর্ষিকে বার ক’রে আনবার বিরাট ঝামেলা।
নিজেই উদিত হলে এ রকম অসুবিধা—অপরের উদয়ের ভরসা লাগে না।
সপ্তর্ষিকে পেতে হলে এইভাবে তার কাছে নিজেই উদিত হতে চিরকাল হয়।

২.
অনেক গভীর রাতে আমি রোজ বাজপাখি হয়ে যাই—বাজপাখি হই,
পাহাড়ের বাজপাখি... এবং আকাশে উঠে এসকল... উড়ে দেখি।

এর বিপরীতভাবে, পাখি যদি মরে যায় তবু সেই মৃতদেহ পাখি,
গাছ যদি মরে যায় তবে যা থাকে তা—তাও গাছ, মৃত বলে অন্য কিছু নয়।
সেইভাবে আমাদের মন ম’রে গেলে যা থাকে তা—তাও মন
মৃত্যুর নিয়মে।
[বিশাল দুপুরবেলা]

কবিতাগুলো মহাজাগতিকতাকে স্পর্শ করে বৈশ্বিকতার দিকে যাত্রা করেছে। এই কবিতাগুলোয় জীবনের বহুমাত্রিক বিস্তারকেও যেন স্পর্শযোগ্য করে তুলেছেন বিনয় মজুমদার।

তাঁর কাব্যকৃতির সর্বোচ্চ নিদর্শন ‘ফিরে এসো, চাকা’ এবং ‘অঘ্রানের অনুভূতিমালা’ নামক কবিতার বই দুটি। অবশ্য তাঁর ‘বাল্মীকির কবিতা’ নামক কবিতার বইটি প্রকাশিত হবার পর থেকেই বিতর্কিত হয়ে আসছে। এতে তিনি মানব-মানবীর যৌনতার যে আড়ালবিহীন প্রকাশ ঘটিয়েছেন, সেটিই এর বিতর্কিত হবার কারণ। কবিতা হিসেবেও সেগুলি বিশেষ উৎরে যায়নি। তাঁর ঠাকুরনগর বাসপর্বে লিখিত কবিতাগুলি ক্রমেই জটিলতামুক্ত হয়ে এসেছে, যেন এক অন্য সহজতার দিকে যাত্রা করেছিলেন তিনি।

বারবার পাগল হয়ে যাওয়া বিনয় মজুমদারের জীবনে নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে উঠেছিল। ২০০২ সালে আবার সেই রোগ ফিরে এলে তিনি বাঙ্গুর সাইকিয়াস্ট্রি ইনস্টিটিউটে দুইমাস চিকিৎসাধীন ছিলেন। কবিতা লেখার তিন বছরের বিরতির পর কিছুটা সুস্থ হলে সেই হাসপাতালেই নতুন করে লিখতে শুরু করেন কবিতা। কবিতাগুলো অনবদ্য। এর সাথে লেখেন একটি ছোটগল্পও। এ বিষয়ে মনে পড়ে ভিনসেন্ট ভ্যান গখের কথা, তিনিও মানসিক হাসপাতালে থাকার সময় বিস্ময়কর সব ছবি এঁকেছিলেন। ২০০৩ সালে বিনয় মজুমদারের এই পর্বে লেখা কবিতা নিয়ে বের হয় ‘হাসপাতালে লেখা কবিতাগুচ্ছ’ শিরোনামে বই। এই বই পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পায় ২০০৫ সালে। বইয়ের ‘আমরা দুজনে মিলে’ কবিতাটা পুরোটাই পড়া যাক, কবিতাটিতে তিনি গায়ত্রী চক্রবর্তীকে উদ্দেশ্য করে বলছেন—

আমরা দুজনে মিলে জিতে গেছি বহুদিন হলো।
তোমার গায়ের রঙ এখনো আগের মতো, তবে
তুমি আর হিন্দু নেই, খ্রিস্টান হয়েছো।
তুমি আর আমি কিন্তু দুজনেই বুড়ো হয়ে গেছি
আমার মাথার চুল যেরকম ছোট করে ছেঁটেছি এখন
তোমার মাথার চুলও সেইরূপ ছোট করে ছাঁটা,
ছবিতে দেখেছি আমি দৈনিক পত্রিকাতেই; যখন দুজনে
যুবতী ও যুবক ছিলাম
তখন কি জানতাম বুড়ো হয়ে যাব?
আশা করি বর্তমানে তোমার সন্তান নাতি ইত্যাদি হয়েছে।
আমার ঠিকানা আছে তোমার বাড়িতে,
তোমার ঠিকানা আছে আমার বাড়িতে,
চিঠি লিখব না।
আমরা একত্রে আছি বইয়ের পাতায়।

অভিমান এবং অভিজ্ঞতার মিশেলে কবিতাটি অনন্য হয়ে উঠেছে। গায়ত্রী চক্রবর্তীর নামের সাথে তখন স্পিভাক যুক্ত হয়েছে এবং তিনি বিশ্ববিখ্যাত একজন তাত্ত্বিক ও যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।

কবিতার পাশাপাশি বিনয় মজুমদার কিছু গল্প, ছড়া, গান এবং প্রবন্ধ লিখেছিলেন। ডায়রিও লিখতেন তিনি। যৌবনে তিনি রুশ ভাষা শিখেছিলেন, অনেক রুশ কবির কবিতা অনুবাদের সাথে সাথে আলেক্সান্দ্র পুশকিনের কবিতাও অনুবাদ করেছিলেন তিনি। সেগুলিও অনন্য। তাঁর মৌলিক গল্পগুলি আকারে খুবই ছোট, অনেকগুলিই এক থেকে দেড় পৃষ্ঠার মধ্যে শেষ হয়েছে। এর মাঝে একটি গল্পের শিরোনাম ‘বিশ্ববীক্ষা’, কল্পিত এক আমি’র সাথে কল্পমামার কথোপকথন দিয়ে এর শুরু এবং শেষ। এর একটি অংশ পড়া যেতে পারে—

আমি: ঐ যে চা বানাচ্ছে সুবোধ। সুবোধ পৃথিবীর অংশ মানে বিশ্বের অংশ।
কল্পমামা: তা ঠিক। সুবোধ পৃথিবীর অংশ বিশ্বের অংশ।
আমি: তা হলে কল্পমামা, আপনিও পৃথিবীর অংশ মানে বিশ্বের অংশ।
কল্পমামা: তা ঠিক। আমি পৃথিবীর অংশ মানে বিশ্বের অংশ।

গল্পগুলোতে সাধারণ কথোপকথনের মাঝে চমকপ্রদ সব সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন তিনি। চারপাশের সব চেনা-জানা মানুষেরাই তাঁর গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র।

বিনয় মজুমদারের কবিতার আবেদন ফুরোবার নয়। তিনি কালে-কালে নতুন-নতুনভাবে মূল্যয়িত হতে থাকবেন। পাঠকেরা প্রতিবারই নতুন সৌন্দর্যের মুখোমুখি হবেন তাঁর কবিতায়, গানে, গল্পে, অনুবাদে।

   

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী আজ



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আজ পঁচিশে বৈশাখ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী। ১৮৬১ সালের (বঙ্গাব্দ ১২৬৮) এই দিনে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে জন্ম নিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই দিকপাল। তার বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মা সারদা সুন্দরী দেবী। তার পূর্বপুরুষেরা খুলনা জেলার রুপসা উপজেলার পিঠাভোগে বাস করতেন।

তিনি একাধারে কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, ভাষাবিদ, চিত্রশিল্পী-গল্পকার। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় তার প্রথম লেখা কবিতা ‘অভিলাষ’ প্রকাশিত হয়। অসাধারণ সৃষ্টিশীল লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে সমসাময়িক বিশ্বে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তার সাহিত্যকর্ম অনূদিত ও পাঠ্য সূচিতে সংযোজিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

লেখালেখির পাশাপাশি বিশ্বকবি ১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রাহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে কবিগুরু সেখানেই বসবাস শুরু করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য ‘শ্রীনিকেতন’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৮৯১ সাল থেকে বাবার আদেশে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে, পাবনা, নাটোরে ও উড়িষ্যায় জমিদারিগুলো তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শিলাইদহে তিনি দীর্ঘদিন অতিবাহিত করেন। এখানে জমিদার বাড়িতে তিনি অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করেন। ১৯০১ সালে শিলাইদহ থেকে সপরিবারে কবি বোলপুরে শান্তিনিকেতনে চলে যান। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত পাঁচটি মহাদেশের ৩০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন তিনি। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ (৭ আগস্ট ১৯৪১) কলকাতায় পৈত্রিক বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবী ঠাকুরের জন্মজয়ন্তীতে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার দেওয়া বাণীতে বলেন, ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধের প্রধান পাথেয় ছিল মনুষ্যত্বের বিকাশ, মানবমুক্তি ও মানবপ্রেম। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য অঙ্গনের এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিনাট্যকার ও প্রবন্ধকার। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তিনি বিচরণ করেননি।

রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, সাহিত্যের মাধ্যমে তিনি গেয়েছেন মানবতার জয়গান। শুধু সাহিত্য সাধনা নয়, পূর্ববঙ্গের জমিদারি পরিচালনার পাশাপাশি দরিদ্র প্রজাসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক মুক্তি ও মানবিক বিকাশের জন্য নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দেওয়া বাণীতে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও সমাজ সংস্কারক। তার হাতেই বাংলা কবিতা, গান, ছোট গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গীতি নাট্য, নৃত্য নাট্য পূর্ণতা পেয়েছে। বাংলা সাহিত্য স্থান করে নিয়েছে বিশ্বসভায়। তিনিই প্রথম বাঙালি কবি, যিনি এশীয়দের মধ্যে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, রবীন্দ্রনাথ শান্তি ও মানবতার কবি। বিশ্বমানবতার সংকটে তিনি সবসময় গভীর উদ্বেগ বোধ করতেন। রবীন্দ্র দর্শনের প্রধান বিষয় অসাম্প্রদায়িক চেতনা, বিশ্বমানবতাবোধ ও মানুষে মানুষে মিলন। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা বিজ্ঞানভিত্তিক, যা আধুনিক শিক্ষায় অগ্রগামী হতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তার (রবীন্দ্রনাথের) রচনা আলোক শিখা হয়ে বাঙালিকে দেখিয়েছে মুক্তির পথ। বাঙালির সুখে-দুঃখে তার গান যেমন দিশা দিয়েছে, বাঙালির জাতীয় সংকটেও তার গান হয়ে উঠেছে একান্ত সহায়। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান হয়ে উঠেছিল মুক্তিকামী বাঙালির চেতনা সঞ্চারী বিজয় মন্ত্র।

 

 

;

তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা



ড. মিল্টন বিশ্বাস
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

  • Font increase
  • Font Decrease

‌‌আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।
তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,
বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে।
তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ উঠে,
কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফুটে।
নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ।
সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে।'

আজ ২৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী। দুর্যোগময় পৃথিবীতে তাঁর জন্মদিন ভিন্নতর তাৎপর্য নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ আমাদের নিত্যসঙ্গী, বাঙালির আত্মপরিচয়ের অন্যতম স্তম্ভ। তাঁকে কেন্দ্র করে কেবল পাকিস্তানি সরকারের বিতর্কিত ভূমিকা নয় ১৯৭১ এর আগে থেকেই বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত হয়েছে তাঁর মাধ্যমে।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের মহানপুরুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এর অন্যতম অনুঘটক। তাঁর দীর্ঘ কারাজীবনের সঙ্গী ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘গীতবিতান’। লেখাবাহুল্য, রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গানের ভক্ত বঙ্গবন্ধুই আমাদের জাতীয় সংগীত হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলা’কে সংবিধানভুক্ত করেন। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি পূর্ব বাংলার শিল্পীগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে তাঁকে দেওয়া এক সংবর্ধনার ভাষণে রবীন্দ্রনাথের কথা এভাবেই বলেছিলেন তিনি- Go to anywhere in the world and tell them that you have come from the country of Tagore, they will respect you.

বিশ্বকবির দেশ বাংলাদেশ। বিশ্বকবির ভাষাপ্রেম এদেশের মানুষকে ভাষা সংরক্ষণের সংগ্রামে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। তাঁর কবিতা ও গান একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছে। তাঁর সঙ্গে বাংলা ও বাঙালির হৃদয়ের সম্পর্ক এবং সংকট-মুহূর্তে তাঁর সাহিত্য-সংগীতের দ্বারা উজ্জীবিত হওয়া সাধারণ একটি ঘটনা। মনে রাখতে হবে পাকিস্তানিদের চেয়ে বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য রবীন্দ্রনাথকে বারবারই সামনে এনেছেন বঙ্গবন্ধু।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ লক্ষ জনতার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন- ‘সাত কোটি বাঙালিকে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি- ‘কবিগুরু, তোমার উক্তি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। দেখে যাও তোমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে।’ জীবদ্দশায় কবিগুরু দেখেছেন যুদ্ধ-বিপর্যস্ত পৃথিবীতে মহাবিপর্যয়ের ত্রাস। মারণব্যাধির মহামারি, দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তরে মানবসভ্যতার পরাজয়ের ভয়ঙ্কর ও বিব্রতকর চিত্র। তবু তিনি মানুষকে আশ্বাস দিয়েছেন, উজ্জীবিত করেছেন ‘দুঃসময়’ (কল্পনা)-এর মতো আরো অনেক কবিতা-গানে।

লিখেছেন-দিক-দিগন্ত অবগুণ্ঠনে ঢাকা-/তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,/এখনি, অন্ধ, বন্ধ করো না পাখা।’ (দুঃসময়) রবীন্দ্রনাথের জন্মের আগে-পরে বিশেষত ১৮১৭ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত একশ বছরে সাতবারের কলেরা মহামারিতে ভারতবর্ষে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ প্রাণ হারায়। ১৮৯৬ সালের প্লেগ মহামারি, ১৮৯৭ সালের বড় ভূমিকম্প অথবা ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লুতে বিপুল সংখ্যক মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। ভূমিকম্পে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির কয়েকটি ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। দুর্যোগের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে সংক্রামক ব্যাধি, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য রক্ষার নিয়মনীতি বিশ্বকবির মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল।

২.
‘পল্লীপ্রকৃতি’ গ্রন্থের ‘সমবায়ে ম্যালেরিয়া-নিবারণ’ (ভাদ্র, ১৩৩০) এবং ‘ম্যালেরিয়া’ (জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩১) প্রবন্ধ ছাড়াও সমাজ ও রাষ্ট্রের নানান প্রসঙ্গে তিনি মানবজীবন থেকে ব্যাধি নিবারণের কথা বারবার বলে গেছেন। একটি উদ্ধৃতি- ‘একটা কথা মনে রাখতে হবে, দুর্গতির কারণ সব দেশেই আছে। কিন্তু মানুষের মনুষ্যত্ব কী। না, সেই দুর্গতির কারণকে অনিবার্য বলে মনে না করে, যখন যাতে কষ্ট পাচ্ছি চেষ্টা-দ্বারা তাকে দূর করতে পারি, এ অভিমান মনে রাখা। আমরা এতদিন পর্যন্ত বলেছি, ম্যালেরিয়া দেশব্যাপী, তার সঙ্গে কী করে লড়াই করব, লক্ষ লক্ষ মশা রয়েছে তাদের তাড়াব কী করে, গভর্মেণ্ট আছে সে কিছু করবে না... আমরা কী করব! সে কথা বললে চলবে না। যখন আমরা মরছি, লক্ষ লক্ষ মরছি... কত লক্ষ না মরেও মরে রয়েছে...যে করেই হোক এর যদি প্রতিকার না করতে পারি আমাদের কিছুতেই পরিত্রাণ নেই। ম্যালেরিয়া অন্য ব্যাধির আকর। ম্যালেরিয়া থেকে যক্ষ্মা অজীর্ণ প্রভৃতি নানারকম ব্যামো সৃষ্টি হয়। একটা বড়ো দ্বার খোলা পেলে যমদূতেরা হুড়্ হুড়্ করে ঢুকে পড়ে, কী করে পারব তাদের সঙ্গে লড়াই করতে। গোড়াতে দরজা বন্ধ করা চাই, তবে যদি বাঙালি জাতিকে আমরা বাঁচাতে পারি।’ আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগে সম্মিলিতভাবে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ব্যাধি বিস্তার রোধ করার উপায় বলেছিলেন কবি।

আরো এক জায়গায় তিনি লিখেছেন- ‘আমরা অনেকে জানি ম্যালেরিয়া কিরকম গোপনে ধীরে ধীরে মানুষকে জীবন্মৃত করে রাখে। এ দেশে অনেক জিনিস হয় না; অনেক জিনিস আরম্ভ করি, শেষ হতে চায় না; অনেক কাজেই দুর্বলতা দেখতে পাই...পরীক্ষা করলে দেখা যায় ম্যালেরিয়া শরীরের মধ্য থেকে তেজ কেড়ে নিয়েছে। চেষ্টা করবার ইচ্ছাও হয় না।’ অর্থাৎ রোগের প্রকৃতি সম্পর্কে তাঁর ছিল স্পষ্ট ধারণা। তাছাড়া তখন বিশ্বভারতীর একটা ব্যবস্থা ছিল- শান্তিনিকেতনের চারিদিকে যে-সমস্ত পল্লিবসতি দেখা যেত সেগুলিকে তিনি নীরোগ রাখার জন্য বাস্তবভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন।

৩.
বিশ্বকবি লিখেছেন- ‘সন্ত্রাসের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান।/সঙ্কটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মাণ/মুক্তো করো ভয়/আপনা-মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়।’ বিভিন্ন সংকটে ও দুর্যোগে আমরা ‘ম্রিয়মাণ’ কিন্তু ভয়-মুক্ত হওয়ার জন্য যাঁর কাছে মানসিক শক্তি পেতে পারি তিনি আমাদের জীবনে আবির্ভূত সংকট নিবারণের বাঞ্চিত সঙ্গী। তিনি নিজেও আশি বছর বয়স পর্যন্ত নিজের স্ত্রী, সন্তান ও নিকটাত্মীয়দের মৃত্যুর করালগ্রাসে হারিয়ে যেতে দেখেছেন; তবে বিচ্ছেদ ও একাকিত্বের গভীর বেদনাকে অন্তরে ধারণ করে নিজের শক্তিতে জয়ী হয়েছেন। তাঁর দু কন্যা মাধুরীলতা ও রেণুকা দেবীর হয়েছিল যক্ষ্মাতে মৃত্যু এবং ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথ মারা গিয়েছিল কলেরায়। অন্য কন্যা মীরাদেবীর পুত্র নীতীন্দ্রনাথের অকাল প্রয়াণও তাঁকে মর্মদাহিক বেদনায় দিশেহারা করেছিল।

তাঁর ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পিতৃস্মৃতি’তে লিখেছেন- ‘ভাগ্যের উত্থান-পতন, দুঃখ কিংবা ক্লেশ কোনো কিছুই অবশ্য বাবার চিত্তের প্রশান্তিতে ব্যাঘাত ঘটাতে পারত না। মহর্ষির মতই তিনিও সর্বাবস্থায় অবিচলিত থাকতেন। বেদনা যতই পীড়াদায়ক হোক না কেন, তা তাঁর ভিতরের শান্তিকে নষ্ট করতে পারত না। সবচেয়ে দুঃখের দুর্ভাগ্যকে সইবার মত এক অতিমানবিক শক্তি ছিল তাঁর।’

এর কারণ হলো তিনি ছিলেন বিশ্বের তাবৎ মানুষের ঐক্যবদ্ধতায় বিশ্বাসী। তিনি ভেবেছেন- ‘মানুষের মধ্যে কোনো বিচ্ছেদ নেই, সমস্ত মানুষ এক। মানুষের সমাজে একজনের পাপের ফলভোগ সকলকেই ভাগ করে নিতে হয়; কারণ, অতীতে ভবিষ্যতে, দূরে দূরান্তে, হৃদয়ে হৃদয়ে, মানুষ যে পরস্পর গাঁথা হয়ে আছে।...যে পাপের ভার এতদিন নানা স্থানে নানা জনে জমাইয়া তুলিতেছিল, তাহারই আঘাতে রুদ্র আজ জাগ্রত হইয়াছেন-দেবতার ও মানবতার অপমান তিনি সহ্য করিতে পারিতেছেন না।’

রুদ্রের রোষেই আজ করোনা মহামারিতে এত মৃত্যু, এত ঝড়-ঝঞ্ঝা; এই মৃত্যু মানবেরই পাপের প্রায়শ্চিত্ত। তাই নতুন বন্দরে নোঙর করতে হলে সে মৃত্যুকেও বরণ করতে হবে; সে মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে অকম্পিত বুকে বলতে হবে- ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।/তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।/তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,/বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে।/...নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ।’

২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে একদিকে যুদ্ধের মৃত্যুভীতি অন্যদিকে উষ্ণ প্রকৃতির অসহনীয়তার পর সতেজ ও অবিনশ্বরতায় প্রাণের নিত্যধারা প্রবহমান। এই কঠিন ও সহজ সময়ে আনন্দ-বেদনা, মিলন-বিরহ, আগমন-বিদায় আর পুনরাগমন-পুনর্মিলনের খণ্ডাংশের যাপিত-জীবনে এসেছে রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকী- যা উজ্জ্বলতর মুহূর্তগুলোর একটি। আর দুর্যোগ, দুর্বিপাকে তাঁকে স্মরণ করেই আমাদের শান্তি ও আনন্দ লাভ সম্ভব।

৪.
পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধের সংকটে মৃত্যু, যন্ত্রণা ও দুঃখ-কষ্টে আমরা যেমন রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করছি তেমনি যারা মানবতার সেবায় নিঃস্বার্থভাবে কাজ করছেন কিংবা মানুষের ধর্ম পালন করছেন তাদেরও সম্মান জানাচ্ছি বিশ্বকবির ভাবনা দিয়েই। রবীন্দ্রনাথের মতে, ‘যা আমাদের ত্যাগের দিকে, তপস্যার দিকে নিয়ে যায় তাকেই বলি মনুষ্যত্ব, মানুষের ধর্ম।’ ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন-‘মানুষ বিষয়বুদ্ধি নিয়ে নিজের সিদ্ধি অন্বেষণ করে। সেখানে ব্যক্তিগত জীবনযাত্রানির্বাহে তার জ্ঞান, তার কর্ম, তার রচনাশক্তি একান্ত ব্যাপৃত।

সেখানে সে জীবরূপে বাঁচতে চায়। তাঁর আরো এবটি দিক আছে যেখানে ব্যক্তিগত বৈষয়িকতার বাইরে। সেখানে জীবনযাত্রার আদর্শে লাভ-ক্ষতির বিচার করে না বরং অনিশ্চিত কালের উদ্দেশে আত্মত্যাগ করতে চায়। সেখানে স্বার্থের প্রবর্তনা নেই। আপন স্বতন্ত্র জীবনের চেয়ে যে বড়ো জীবন সেই জীবনে মানুষ বাঁচতে চায়।’ রবীন্দ্রভাষ্য মতে, আত্মত্যাগী মানুষই মনুষ্যত্বের দিশারি। তারাই এই বিশ্বজগতকে সংকট থেকে রক্ষা করতে পারে। মহামারির সংকটে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।

৫.
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনের প্রারম্ভে সমস্ত মন থেকে বিশ্বাস করেছিলেন আধুনিক সভ্যতার দান হলো ইউরোপের অন্তরের সম্পদ। কিন্তু পৃথিবীর সভ্যতাভিমানের পরিকীর্ণ ভগ্নস্তূপ দেখে ৮০ বছর বয়সে সে বিশ্বাস একেবারে দেউলিয়া হয়ে যায় তাঁর। ‘তবু মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ’ সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করে গেছেন তিনি। ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে আশা করেছিলেন- ‘মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে।

আর-একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাবার পথে। মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপমান মনে করি। এই কথা আজ বলে যাব, প্রবল প্রতাপশালীরও ক্ষমতা মদমত্ততা আত্মম্ভরিতা যে নিরাপদ নয় তারই প্রমাণ হবার দিন আজ সম্মুখে উপস্থিত হয়েছে; নিশ্চিত এ সত্য প্রমাণিত হবে...। ‘অপরাজিত মানুষে’র জয় আর ‘প্রবলপ্রতাপশালীর ক্ষমতা মদমত্ততা আত্মম্ভরিতা’র অবসান যে সত্য হবে সে কথা মৃত্যুর ঠিক আগে বলে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রত্যাশা করেছিলেন ‘মানব-অভ্যুদয়ে’র মধ্য দিয়ে নতুন জীবনের। লিখেছেন- ‘অমারাত্রির দুর্গতোরণ যত/ধূলিতলে হয়ে যাবে ভগ্ন।/ নবজীবনের আশ্বাসে।/ জয় হবে মানব-অভ্যুদয়।’

রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবদ্দশায় মানবপীড়নের মহামারি দেখেছিলেন। দেখেছিলেন মানুষে মানুষে যে সম্বন্ধ সবচেয়ে মূল্যবান এবং যাকে যথার্থ সভ্যতা বলা যেতে পারে তার কৃপণতা ভারতীয়দের উন্নতির পথ সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ করে দিয়েছিল। দেখেছিলেন পাশ্চাত্য সভ্যতার মজ্জার ভিতর বর্বরতা জাগ্রত হয়ে উঠে মানবাত্মাকে অপমানে নিঃস্ব করে দেবার ঘটনাও। তিনি নিভৃতে সাহিত্যের রসসম্ভোগের উপকরণের বেষ্টন থেকে বেরিয়ে এসে ভারতবর্ষের জনসাধারণের নিদারুণ দারিদ্র্য সচক্ষে দেখেছেন। অন্ন-বস্ত্র-পানীয়- শিক্ষা-আরোগ্য প্রভৃতি মানুষের শরীরমনের পক্ষে যা-কিছু অত্যাবশ্যক তার নিরতিশয় অভাব দেখে তিনি আধুনিক-শাসনচালিত ব্রিটিশ শাসকদের প্রতি রুষ্ট হয়েছেন।

জনসাধারণের প্রতি ব্রিটিশদের অপরিসীম অবজ্ঞাপূর্ণ ঔদাসীন্য ছিল বলেই বাংলায় সংক্রমিত কলেরা ও ম্যালেরিয়া মহামারিতে তাঁর ভূমিকা ও দিক-নির্দেশনা পূর্বে উল্লিখিত ‘পল্লীপ্রকৃতি’ গ্রন্থে যথার্থভাবেই উপস্থাপিত হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরের সময়টিও ছিল মানবসভ্যতার এক সন্ধিক্ষণ। সেসময় মানবসভ্যতার পরিবর্তনের রূপ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন কবি। সাম্রাজ্যবাদ ও ধনতন্ত্রের পতন চেয়েছিলেন। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধোত্তর ধনতন্ত্র গণতন্ত্রের সঙ্গেই পথ ধরে চলেছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে কবির শঙ্কিত মন বারবারই বিশ্বের মানুষকে সচেতন করার জন্য উদগীব হয়েছে। এজন্যই ব্যক্তিগত স্বার্থ, লোভ ও আত্মতৃপ্তির পরিধি থেকে মুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন- ‘মানুষ আপন উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিসীমাকে পেরিয়ে বৃহৎমানুষ হয়ে উঠছে, তার সমস্ত শ্রেষ্ঠ সাধনা এই বৃহৎমানুষের সাধনা। এই বৃহৎমানুষ অন্তরের মানুষ। বাইরে আছে নানা দেশের নানা সমাজের নানা জাত, অন্তরে আছে এক মানব। ইতিহাসে দেখা যায়, মানুষের আত্মোপলব্ধি বাহির থেকে অন্তরের দিকে আপনিই গিয়েছে, যে অন্তরের দিকে তার বিশ্বজনীনতা, যেখানে বস্তুর বেড়া পেরিয়ে সে পৌঁচেছে বিশ্বমানসলোকে।’

সংকীর্ণ মানসিকতা দিয়ে পৃথিবীর মঙ্গল করা যায় না। জীবনকে সার্থক করার জন্য প্রয়োজন বিশ্বজনীন কর্মপ্রয়াস। সকল মানুষের মধ্যে ঐক্যসূত্র গাথাই হলো বিশ্বজনীনতা। মানুষ ব্যক্তিগত সীমাকে অতিক্রম করতে পারলেই তার বিশ্বমানব সত্তা চিহ্নিত হয়। ব্যক্তিগত মানুষ নয়, সে বিশ্বগত মানুষের একাত্ম। দেশকালগত সংকীর্ণ পার্থক্যের দিকে মনোযোগ না দিয়ে মানব সভ্যতার সমস্যাকে সমগ্র মানবের সত্য বলে জানতে হবে। চেষ্টা করতে হবে তা থেকে উদ্ধারের।

কবির মতে, ‘মানুষ আপনাকে জেনেছে অমৃতের সন্তান, বুঝেছে যে, তার দৃষ্টি, তার সৃষ্টি, তার চরিত্র, মৃত্যুকে পেরিয়ে। মৃত্যুর মধ্যে গিয়ে যাঁরা অমৃতকে প্রমাণ করেছেন তাঁদের দানেই দেশ রচিত। সব মানুষকে নিয়ে; সব মানুষকে অতিক্রম করে, সীমাবদ্ধ কালকে পার হয়ে এক-মানুষ বিরাজিত।’ এই যে দেশকালপাত্র ছাড়িয়ে মানুষের বিদ্যা, মানুষের সাধনা সত্য হয়ে ওঠা এখানেই মানবধর্মের সারকথা নিহিত। ‘মানুষ এক দিকে মৃত্যুর অধিকারে, আর-এক দিকে অমৃতে; এক দিকে সে ব্যক্তিগত সীমায়, আর-এক দিকে বিশ্বগত বিরাটে। এই দুয়ের কোনোটাকেই উপেক্ষা করা চলে না।’ তবে প্রবৃত্তিতাড়িত মানুষ কখনও বিশ্বজীবনের জন্য কিছু করতে পারে না। এজন্য দরকার আত্মত্যাগী মানুষ যার আত্মগৌরব নেই।

৬.
মূলত জলবায়ুর উষ্ণতা কিংবা যুদ্ধের মহামারিতে সৃষ্ট বৈশ্বিক সংকট ও সভ্যতার বিপর্যয় মোকাবেলা করার জন্য আমরা বিশ্বকবির জন্মদিনে তাঁর রচনা থেকেই আতঙ্ক ও কষ্ট দূর করার রসদ পাচ্ছি। তিনি যেন এসব সংকটে ঠেলে ভাঙনের পথে এসেছেন পৃথিবীকে রক্ষা করতে। কারণ মৃত্যুভীতিতেও আমরা মনে করি তাঁর কথাই সত্য- ‘তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি’… ‘আসব যাব চিরদিনের সেই আমি।’

মারণঘাতি ভাইরাসের মধ্যে তাঁর প্রকাশ সূর্যের মতো কুহেলিকা উদঘাটন করছে। ভয়কে জয় করার জন্য রিক্ত, ব্যর্থ, শূন্য মানুষকে বিস্ময়ে তিনিই উজ্জীবিত করছেন আজও। ২৫ বৈশাখে লেখা তাঁর নিজের কবিতাতেও সেই অভিব্যক্তি- ‘তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদঘাটন/সূর্যের মতন।/ রিক্ততার বক্ষ ভেদি আপনারে করো উন্মোচন।/ ব্যক্ত হোক জীবনের জয়,/ব্যক্ত হোক তোমামাঝে অসীমের চিরবিস্ময়।’ অসীমের চিরবিস্ময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আজকের পৃথিবীতেও স্মরণীয়।

লেখক: অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, email: [email protected]

;

ফেরদৌস আরার প্রবন্ধের আলপথ বেয়ে পাঠক চলে যান জ্ঞানের সমুদ্রদর্শনে



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম ব্যুরো
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘লেখকের প্রচুর অধ্যয়ন, পাঠগভীরতা, নিবিড় অনুসন্ধিৎসা, ঘোরলাগা শব্দপুঞ্জে, ভাষার শিল্পিত সুষমায় লেখাগুলি প্রাণ পেয়েছে। তাই গ্রন্থের তথ্যসমৃদ্ধ বারোটি প্রবন্ধই সুখপাঠ্য শুধু নয়, নতুন চিন্তার খোরাক জোগাবে, জানার তাগাদা তৈরি করবে—বোধে, তৃষ্ণায়, জীবনজিজ্ঞাসায়। নিজের কথাই বলি, ফেরদৌস আরা আলীমের চোখ দিয়ে পড়তে পড়তে আমি নিজে প্রায় তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছি আফরোজা বুলবুল কিংবা প্রতিভা মোদক (‘যে জীবন শিল্পের, যে শিল্প জীবনের’), করুণা বন্দোপাধ্যায়, রবিশংকর বলকে (‘চন্দ্রগ্রস্ত পাঠঘোর’) পড়ার জন্য। একই সঙ্গে আস্বাদ করি সময়-পরিক্রমায় লেখক ফেরদৌস আরা আলীমের কলমের ক্ষুরধার ক্রমমুগ্ধকর সৌন্দর্য।’

শনিবার (৪ মে নভেম্বর) বিকেলে চট্টগ্রাম নগরীর কদম মোবারক গলিতে অবস্থিত মাসিক নারীকণ্ঠ পত্রিকা-আয়োজিত ‘বই আলোচনা’-অনুষ্ঠানে ফেরদৌস আরা আলীমের প্রবন্ধের আলপথে শীর্ষক প্রবন্ধগ্রন্থের মূল আলোচকের আলোচনায় তহুরীন সবুর ডালিয়া এসব কথা বলেন। বইটি নিয়ে বিশেষ আলোচনায় আরও অংশ নেন নারীকণ্ঠের উপদেষ্টা জিনাত আজম, সালমা রহমান ও মাধুরী ব্যানার্জী।

নারীকণ্ঠের সহকারী সম্পাদক আহমেদ মনসুরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নারীকণ্ঠের সম্পাদক ও প্রকাশক শাহরিয়ার ফারজানা। শুভেচ্ছা বক্তব্যে আখতারী ইসলাম বলেন, ‘নানা বিষয়ে ফেরদৌস আরা আলীমের পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা পড়ে আমি অত্যন্ত মুগ্ধ। সহজভাবে তিনি আমাদের সমাজবাস্তবতার যে-চিত্র আঁকেন তা মনের গভীরে সাড়া জাগায়। তার লেখা পড়ে এটুকু বলতে পারি যে, তার লেখা আমাদের জন্য গবেষণা ও আত্মপরিচয়ের মূল্যবান আকর।’

প্রবন্ধের আলপথে বইয়ের প্রকাশক, কবি ও খড়িমাটি-সম্পাদক মনিরুল মনির বলেন, ‘নারীমুক্তি বিষয়ে এ-বইয়ে দুটি তথ্যনির্ভর গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ রয়েছে। ভবিষ্যতে এ-বিষয়ে আরও কাজ করার জন্য গবেষকদের জন্য অবারিত সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে।’

প্রকাশিত বই নিয়ে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে ফেরদৌস আরা আলীম বলেন, ‘বড় কিছু হওয়ার কথা ভেবে লিখিনি, মনের আনন্দেই গোপনে গল্প-কবিতা লিখেছি। এমন একসময়ে আমরা লিখতাম, লেখা প্রকাশ করতে খুব লজ্জাবোধ করতাম। অবশ্য লিখতে গিয়ে তেমন কঠিন বাধা আমাকে ডিঙোতে হয়নি। একালের চেয়ে আমাদের সময়টা ছিল অনেক সুন্দর ও ভালো। মেয়েদের নিরাপত্তা ছিল সমাজে। গণ্ডগ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে ও ট্রেনে চড়ে ঢাকা গিয়েছি একা-একা, কোনওদিন সমস্যা হয়নি। মা-বাবারাও নিশ্চিন্ত থাকতেন। আজকাল মেয়েরা পদে-পদে বাধা ও নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন। এর জন্য দায়ী মূলত আমাদের কলুষিত সমাজব্যবস্থা ও নষ্ট রাজনীতি।’ সাহিত্যচর্চার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘লেখালেখির ক্ষেত্রে প্রশংসার ভূমিকা কম নয়। একজন লেখক তাঁর নিজের লেখা সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য পেলে অনুপ্রাণিত হন যা তাকে সামনে এগিয়ে নিতে শক্তি জোগায়।’

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন নারীকণ্ঠ পত্রিকার উপদেষ্টা ও সদস্য রোকসানা বন্যা, মহুয়া চৌধুরী, রেহানা আকতার, সাহানা আখতার বীথি, কানিজ ফাতেমা লিমা, বিচিত্রা সেন, শর্মিষ্ঠা চৌধুরী, চম্পা চক্রবর্ত্তী, প্রচার ব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম জয়, কবি মেরুন হরিয়াল ও কবি মুয়িন পারভেজ প্রমুখ।

;

নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক—এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
‘নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক- এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’

‘নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক- এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’

  • Font increase
  • Font Decrease

চারপাশে এত কিছু ঘটে যে চিন্তা ও উদ্বেগ প্রকাশ করার মতো বিষয়ের অভাব নেই। তবে এর মধ্যে কিছু জনগোষ্ঠীর চিন্তাভাবনার একটি জায়গায় আটকে আছে; আর তা হলো নারীর পোশাক। নারী কী পোশাক পরল, কেমন পোশাক পরল, কেন পরল ও এমন পোশাক পরা উচিত ছিল না; ইত্যাদি নিয়ে দিন-রাত ব্যস্ত। আর এমন জনগোষ্ঠী সংখ্যায় দিন দিন বেড়েই চলছে। নানা সময়ে এ নিয়ে তর্ক বিতর্কে মেতে উঠে বাঙালি। নারীর পোশাক নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে ব্যক্তিস্বাধীনতা তো বটেই, অন্য ধর্মের অস্তিত্ব এবং ভিন্ন জীবন দর্শনকেও ভুলে যায় সমালোচনাকারীরা।

বিভিন্ন সময় নারী দেহে আঁচলের বিশেষ অবস্থান দেখে ‘ভালো মেয়ে’, ‘খারাপ মেয়ে’র সংজ্ঞা নির্ধারণ পদ্ধতি স্থির করে দিতে চাওয়া হয়েছে মত প্রকাশের স্বাধীনতার আড়ালে। আর এর প্রতিবাদ- প্রতিরোধ উঠে এসেছে সমাজের নানা স্তর থেকে। কেউ কেউ বিপক্ষে মত প্রকাশ করেছেন।

নারী পোশাক নিয়ে ভাবনা ও মতামত ইতিহাসের দলিল রূপে প্রকাশ করার জন্য উদ্যোগে নিয়েছে কলকাতার ঋত প্রকাশনী। আগামী ১১ মে বিকেল সাড়ে ৫টায় অভিযান বুক ক্যাফে-তে প্রকাশিত হতে চলেছে ‘শাড়ি’ নামের এই বইটি।

বইটি বের করার পরিকল্পনা, সম্পাদনা ও নিমার্ণের দায়িত্বের রয়েছেন তানিয়া চক্রবর্তী। প্রচ্ছদ ও চিত্রের দায়িত্বে রয়েছেন অংশুমান।


সংকলনটিতে অলংকরণ ও লেখার মাধ্যমে আলোকপাত করা হয়েছে আবহমানকাল জুড়ে পোশাককে কেন্দ্র করে বাঙালি মেয়েদের আহত দেহ ও মনের দিকে। সোচ্চারে উচ্চারণ করা হয়েছে সেই ইতিহাস যা অনুচ্চারিত থেকে যায় সামাজিক বিধি নিষেধেরে আড়ালে।

বইটির মাধ্যমে বিতর্ক সৃষ্টি নয়, অস্তিত্বের সন্ধানে বের হয়েছেন তেরোজন লেখক। যারা হলেন- জিনাত রেহেনা ইসলাম, যশোধরা রায়চৌধুরী, মধুজা ব্যানার্জি, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়, রোহিণী ধর্মপাল, সেবন্তী ঘোষ, মিতুল দত্ত, অমৃতা ভট্টাচার্য, রত্নদীপা দে ঘোষ, অদিতি বসু রায়, দেবাবৃতা বসু, শ্রুতকীর্তি দত্ত ও তানিয়া চক্রবর্তী।

দৃশ্য বা শব্দের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ভাইরাল হওয়া নয়, সংকলনটির উদ্দেশ্য একটি প্রলেপ সৃষ্টি যা আগামী প্রজন্মের মাথায় ছায়া দেবে। মেনে নেওয়া নয়, প্রশ্ন করার সাহস জোগাবে নতুন করে নয়।

এ প্রসঙ্গে তানিয়া চক্রবর্তী বলেন, ‘শাড়ি’ নিয়ে একটি বই প্রকাশ করা হচ্ছে। সম্প্রতি নারীদের পোশাক নিয়ে ভারতে একটা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। আমি মনে করি, ২০২৪ সালে এসে নারীর পোশাক নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। মেয়েরা যা ইচ্ছা তাই পরতে পারে। তাদের বুদ্ধি, কর্ম ও অভিব্যক্তি বিষয়টিই আসল। এ বিষয়গুলো বইটিতে স্থান পেয়েছে।

;