ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের স্মৃতি ৩

সিলেটের মাধবপুরের যুদ্ধ



সার্জেন্ট (অব.) সৈয়দ জহিরুল হক
গ্রাফিক : বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম

গ্রাফিক : বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের স্মৃতি ১জয়দেবপুরের গণ বিক্ষোভ
ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের স্মৃতি ২আশুগঞ্জের বিমান হামলা


এরপর ক্যাপ্টেন নাসিম সাহেব তেলিয়াপাড়া থেকে আমাদেরকে সিলেটের মাধবপুরে নিয়ে আসেন। সেখানে আসার পর আমাদের সাথে বিডিআর, পুলিশ, আনসার এবং আমাদের নিজেদের হারিয়ে যাওয়া কিছু সৈনিক এসে যোগ দেয়। মাধবপুরের দক্ষিণ পশ্চিম দিক থেকে পশ্চিম পূর্বপাড় পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া-সিলেট রাস্তা নিয়ে ডিফেন্স লাগিয়ে দেন। আমাকে এবং ল্যান্স নায়েক আব্দুল মান্নানকে যে স্থানটি নির্বাচন করে দেন সেটি অন্যান্য ভূমি থেকে কিছুটা উঁচু মাঠ এবং তার উত্তর দিয়ে একটি ক্যানেল পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়। আমরা উভয়ই ছিলাম নতুন সৈনিক। আমাকে উত্তর পাশে রাস্তা সংলগ্ন একটি বট গাছের নিচে বাংকার করতে বলেন। এবং আমার থেকে ৫০০/৬০০ গজ দূরে পশ্চিম দিকে আর একজন এলএমজি ম্যান ল্যান্স নায়েক আব্দুল মান্নানকে বট গাছের নিচে বাংকার করতে বলেন। এবং আমাদের এ দুই এলএমজির সাপোর্টের জন্য একজন এইচএমজি সৈনিক কেরামত আলীকে আমাদের ঠিক মাঝামাঝি ৩০০ পেছনে অবস্থান নিতে বলেন।

আমাদের ৮০০ গজ সামনে ঘনবসতি গ্রাম ও গাছপালা ছিল। একটি ক্যানেল উত্তর পশ্চিম দিক থেকে প্রবাহিত হয়ে রাস্তা পার হয়ে দক্ষিণ পূর্ব দিকে চলে গিয়েছে। গ্রামগুলো থেকে পূর্ব দিকে আমার সামনে নিচু আবাদি ভূমি ছিল। নাসিম সাহেব আমাকে বললেন, তুমি রাস্তা কভার করে উত্তর ও উত্তর পশ্চিম দিক থেকে যদি কোনো পাক আর্মি আসে তাদেরকে আক্রমণ করবে। এবং আব্দুল মান্নানকে বলেন, তুমি পশ্চিম ও উত্তর দিক থেকে গ্রামগুলো কভার করে ফায়ার দিবা। তোমরা দুজনে একে অপরকে ক্রস ফায়ার দিবে। আর তোমাদের পেছন দিক থেকে এইচএমজি ফায়ার দেবে। আমাদের কোম্পানির প্রত্যেক লোকের পজিশন দেখিয়ে দিয়ে নির্দেশনা দিয়ে দেন। আমরা এক রাতের ভিতরেই সিভিল লোকদের সহায়তা নিয়ে শেল্টারসহ বাংকার তৈরি করে ফেলি। পরের দিন সকালে বাংকার দেখে নাসিম সাহেব সন্তুষ্ট হন। বলেন, যদি দেখি পরিস্থিতি খারাপের দিকে তখন আমি ভেরিলাইট পিস্তলের রেডওভার গ্রিন ফায়ার দিলে তোমরা উইড্রল করবে। তার আগে তোমরা ডিফেন্স থেকে উইড্রল করবে না। সম্ভবত যতটা মনে পরে, পরদিন নাসিম সাহেব আমাদের প্রত্যেককে ২০ টাকা করে বেতন দেন। আমরা তাতেই খুশি। কেননা, এ ২০ টাকা খরচ করার মতো কোনো দোকানপাট নেই। আনুমানিক এর দুই/তিন দিন পর পাক আর্মির সম্ভবত একটি ব্রিগেড আমাদেরকে আক্রমণ করার জন্য অগ্রসর হয়।

প্রথমেই তারা অবিরাম আটিলারি গোলা নিক্ষেপ করতে থাকে। ওদিকে তাদের পদাতিক বাহিনী আমাদের ডিফেন্সের পশ্চাৎদিক থেকে আক্রমণ শুরু করে দেয়। এত বড় আক্রমণ শুরু করে যে, এ বিশাল আক্রমণের মুখে আমাদের ক্ষুদ্র বাহিনীর কোনো ক্রমেই টিকে থাকা সম্ভব নয়। সম্ভবত আধাঘণ্টা উভয় পক্ষের গোলাগুলির পর নাসিম সাহেব উইড্রল সিগন্যাল দিয়ে দিলেন। কিন্তু আমরা দুই এলএমজি ম্যান ছাড়া বাকি সকলকে পেছনের দিকে হটানোর সাহায্যে আমরা উভয়ই ফায়ার দিতে থাকি। শত্রু আমাদের খুবই নিকটে ৭/৮শ গজের মধ্যে ছিল। তারা ঐ গ্রামের ভিতরে জড়ো হচ্ছিল। সম্ভবত তাদের উদ্দেশ্য ছিল, পাকা রাস্তা অতিক্রম করে আমাদের পেছন দিক থেকে ঘেরাও করবে। কিন্তু আমাদের দুটি এলএমজির জন্য বিশেষ করে আমার এলএমজি পাকা রাস্তা সংলগ্ন থাকার জন্য এবং সামনে খোলা জায়গা থাকায় তারা পাকা রাস্তা দখল করতে পারে নাই।

শত্রুপক্ষ ও আমাদের মাঝে প্রচণ্ড গোলাগুলি চলছিল। এরই এক ফাঁকে কেরামত ভাই তার লোকসহ এইচএমজি নিয়ে উইড্রল হোন। আমরা তখন এলএমজি ফায়ার দিয়ে পাক বাহিনীকে আটকে রেখে আমাদের কোম্পানির লোকদের সম্পূর্ণভাবে পেছনে যেতে সাহায্য করতে থাকি। শত্রুপক্ষ আমাদের উপর অবিরাম গোলা নিক্ষেপ করছিল। আমাদের কোম্পানি উইড্রল হবার আধাঘণ্টা পর নাসিম সাহেব যখন দেখলেন আমরা উইড্রল হতে পারছি না তখন তিনি আমাদের বিকিউএমএইচ ফরাজ সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে, আমাদের যেখানে এইচএমজি পজিশন ছিল তার কাছে একটি ছোট ঘর ছিল, সেই ঘরকে আঁড় করে আমাদেরকে ডাকতে শুরু করলেন এবং বললেন, তোমরা জলদি উঠে এসো। আমরা তোমাদেরকে ওভারহেড ফায়ার দিচ্ছি। তখনও মুষলধারে শত্রুপক্ষের গুলিবর্ষণ চলছে। এ পরিস্থিতিতে আমরা কিভাবে বাংকার থেকে উঠব। বাংকার থেকে উঠতে গেলে আমাদের গায়ে গুলি অথবা শেলের টুকরা লাগতে পারে। আমার চিন্তা ছিল, আমার কাছে যতক্ষণ বুলেট আছে ততক্ষণ আমি যুদ্ধ চালিয়ে যাব। সর্বশেষে ২টি বুলেট রেখে দেব নিজের জন্য। যাতে শত্রুপক্ষ আমাকে জীবিত ধরতে না পারে। বুলেট শেষ হয়ে গেলে তখন মৃত্যুকে স্বীকার করে বাঁচার জন্য উইড্রল হতে চেষ্টা করব। নাসিম সাহেব ব্যর্থ হয়ে আমাদের না নিয়ে ফিরে গেলেন। উনি আমাদের উঠে আসার জন্য আমাদের ব্যাটালিয়ানের মর্টারকে আমাদের থেকে দুই মাইল পেছনে প্রস্তুত করে রেখেছিলেন। তিনি চলে যাবার পর আমরা পাক বাহিনীর ওপর গুলিবর্ষণ করতে থাকি। আমাদের গুলি যেহেতু সীমিত সেহেতু চেষ্টা করছি হিসাব করে গুলি খরচ করে শত্রুকে হত্যা করতে। এবং শত্রু পক্ষকে আটকে রাখতে। আর মনে মনে আল্লাহকে ডাকছি। একমাত্র তার কাছেই সর্বপ্রকার সাহায্য চাচ্ছি।

স্যার চলে যাবার ১৫/২০ মিনিট পর হঠাৎ ল্যান্স নায়েক মান্নান তার এলএমজি দিয়ে লং ব্রাশফায়ার শুরু করে। আমি বাংকারের মুখ দিয়ে চেয়ে দেখি আমার বাংকারের সামনে ক্যানেলের ভেতর দিয়ে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে পাকা রাস্তা পর্যন্ত অনেকগুলো পাক সৈনিক একত্রিত হচ্ছে। আমিও তৎক্ষণাৎ কালবিলম্ব না করে আমার এলএমজিকে শক্ত করে ধরে শত্রুর দিকে লক্ষ্য করে ডানে বামে ব্যারেল ঘুরিয়ে এলএমজির লং ব্রাশফায়ার করতে থাকি। ঐ সময় ল্যান্স নায়েক মান্নান তার এলএমজি নিয়ে দ্রুত বাংকার থেকে উঠে পাকা রাস্তা পার হওয়ার সময় আমাকে ডাক দিয়ে বলে, জহির ভাই দ্রুত চলে আসুন। এ কথা বলেই সে রাস্তা পার হয়ে নিচে ক্ষেতে নেমে গেল। আমি যখন লং ব্রাশফায়ার করি তখন ক্যানেলে দিকে চেয়ে দেখি পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে বহু পাক সেনা নিহত এবং আহত হয়ে আর্তনাদ করছে। এবং ক্যানেলের পানি রক্তে লাল হয়ে গেছে। আব্দুল মান্নান চলে যাবার পর আমি সম্পূর্ণ একা হয়ে যাই। তখন আমি খেয়াল করে দেখি, আমার গুলির বাক্স প্রায় শেষ। আমি একবার ক্যানেলের দিকে আরেকবার গ্রামগুলোর দিকে লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে যাচ্ছি। ঐ স্থানে আমরা দুজনে সম্ভবত ১০০/১৫০ পাক সেনাকে হত্যা করি।

আব্দুল মান্নান চলে যাওয়ার ১০ মিনিট পর আমি চিন্তা করে দেখলাম, এখন আর আমার পক্ষে এখানে থাকা সম্ভব নয়। পাক সেনাদের এতগুলো লাশ দেখে আমি অনেকটাই আত্মতৃপ্তি অনুভব করলাম। এ মুহূর্তে শত্রুর হাতে আমার মৃত্যু হলেও আমার কোনো আফসোস নেই। শুধু চিন্তা ছিল আমার এলএমজি নিয়ে। কেননা, এ এলএমজিটা পাকসেনাদের দখলে চলে যাবে। আমি ভালো করেই জানি, এ যুদ্ধে আমার নাম নিশানা চিহ্নও থাকবে না। যেভাবে ওরা গণহত্যা করে যাচ্ছে। কার হিসাব কে রাখে। লক্ষ লক্ষ নিরীহ জনগণকে নির্বিচারে হত্যা করে যাচ্ছে। তার মধ্যে আমার মতো একজন নতুন সাধারণ সৈনিকের মৃত্যুর খবর কেই বা রাখবে। এটাই স্বাভাবিক। সত্যি বলতে কী, জেনারেল নাসিম সাহেব, আমাকে শত্রুর মুখ থেকে বাঁচানোর জন্য নিজের জীবনকে বাজি রেখে পরপর ২/৩ বার এগিয়ে এসছিলেন। তাই আমি তাঁর মতো কমান্ডারের অধীনে থেকে নিজেকে গর্বিত মনে করি। যুদ্ধের ময়দানে আমি সর্বদা তাঁর দীর্ঘায়ু কামনা করে মুনাজাত করতাম। আর এখনো আমি তাঁর জন্য দোয়া করি। সত্যি বলতে কী, জেনারেল নাসিম সাহেব আমাদের প্রত্যেক সৈনিককে তাঁর প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। আমি শুনেছি, তিনি এখনো তখনকার দ্বিতীয় বেঙ্গল ও ১১ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকদের পেলে প্রাণ খুলে কথা বলেন, কুশলাদি জিজ্ঞেস করেন।

আমি মাধবপুরের ডিফেন্স থেকে ওঠার জন্য এলএমজিকে ভালো করে কাপড় দিয়ে পেঁচালাম। সমস্ত খালি বাক্সগুলো প্যাকেটে করে কাঁধে ঝোলালাম। মৃত্যুর চিন্তা না করে মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েই বাংকার থেকে বের হলাম। আল্লাহর নাম নিয়ে কালেমা পড়তে পড়তে দৌড় দিলাম। কোনোমতো পাকা রাস্তায় উঠে এলএমজি নিয়ে রোলিং করে রাস্তার পূর্ব পাশে নিচে ক্ষেতে পড়ে গেলাম। ঐ সময় আমার বাম হাতে বড়ো ধরনের ব্যথাও পেলাম। কিন্তু মৃত্যুর ভয়ে সেই ব্যথাকে ব্যথা মনে না করে জীবন বাঁচানোর জন্য দৌড়াতে লাগলাম। কিছু দূর দৌড়াবার পর সেই ক্যানেলটি আমার চোখে পড়ল। অধিক পিপাসা লাগায় আমি সেই ক্যানেল থেকে হাতে পানি উঠিয়ে পান করি। এমন সময় ক্যানেলের অদূরে চেয়ে দেখি পানির সাথে রক্ত ভেসে আসছে। এ দেখে আমি আর পানি পান করি নাই। খাল পার হয়ে দক্ষিণ পুব দিকে দৌড় দিলাম। তারপর দেখলাম, কতগুলো ছোট ছেলেমেয়ে স্মরণার্থী ক্যাম্প থেকে এসে পানি জগ গ্লাস হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বুঝতে পারলাম, ইতোপূর্বেও আমাদের লোকগুলো এ পথেই এসেছিল। তাদের কেউ ওরা পানি পান করিয়েছে। আমি দৌড়াতে দৌড়াতে এত ক্লান্ত এবং তৃষ্ণার্ত হয়েছিলাম যে, আমি মনে করেছিলাম, পানির অভাবে আমার জীবন এখনই বের হয়ে যাবে। আমি একটি ছোট মেয়ের কাছ থেকে একগ্লাস পানি নিয়ে পান করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম ঠিক ঐ মুহূর্তে নাসিম সাহেব ধমকের সুরে আমাকে পানি পান করতে মানা করলেন। আমার আর পানি পান করা হলো না। আমি ক্ষেতের ওপর শুয়ে পড়ি।

একটু বিশ্রামের পর আমাকে লবণের পানি পান করতে দেওয়া হলো। পানি পান করার পর আমি আব্দুল মান্নানকে দেখতে পেলাম। সে আমার কাছেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। চেয়ে দেখি, ওর দু হাতের চামড়া এলএমজির ব্যারেলের সাথে আটকে রয়েছে। ওর হাতের দিকে তাকালে গা শিউরে ওঠে। শুধু হাতের তালুর ও আঙুলের হাড়গুলো দেখা যাচ্ছে। জেনারেল নাসিম সাহেব ওকে তৎক্ষণাৎ আগরতলা হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। এ সময়ে আমদেরকে দেখার জন্য বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ আর্মি অফিসাররাও সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। সম্ভবত জেনারেল সফিউল্লাহ সাহেবও সেখানে উপস্তিত ছিলেন।

মাধবপুরের আক্রমণের পর আমরা আর স্থায়ী ডিফেন্স তৈরি করিনি। এর পর থেকে অস্থায়ী ডিফেন্স নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হতাম। দিনের বেলা যার যার অবস্থানে থাকতাম। রাতের বেলা নিজেদের সুবিধা মতো জায়গা বেছে নিয়ে হাইড-আউট-এ অবস্থান করতাম। এ অবস্থার মাঝেও আমাদেরকে মাঝে মাঝে ছোট ছোট দল তৈরি করে রাতের বেলা রেড, এম্বুসসহ বিভিন্ন অপারেশন করার জন্য বিভিন্ন জায়গায় পাঠিয়ে দিতেন। [চলবে]

   

শ্রীপুরের কাওরাইদে নজরুল উৎসব শনিবার



ডেস্ক রিপোর্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কাওরাইদ কালি নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ‘ভাগ হয়নিকো নজরুল’ শীর্ষক নজরুল উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে শনিবার। ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারের আয়োজনে এবং নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর সহযোগিতায় এই উৎসবে সেমিনার, আবৃত্তি ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জাতীয় কবির বর্ণাঢ্য জীবন ও সাহিত্যকে তুলে ধরা হবে।

নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর অন্যতম ট্রাস্টি আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক জানান, আয়োজনের শুরুতে শনিবার দুপুর ২টায় সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সুনীল কান্তি দে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক ড. সাইম রানা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস ও ছায়ানট (কলকাতা)’র সভাপতি সোমঋতা মল্লিক।

তিনি আরও জানান, বিকেলে আয়োজনে নজরুলের জাগরণী কবিতা ও গান পরিবেশন করবেন দেশের বরেণ্য শিল্পীরা। আবৃত্তি করবেন-টিটো মুন্সী ও সীমা ইসলাম। নজরুল সঙ্গীত পরিবেশন করবেন শিল্পী ফেরদৌস আরা, সালাউদ্দিন আহমেদসহ অনেকে। সমাপনী পর্বে প্রধান অতিথি থাকবেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ইমেরিটাস অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সভাপতিত্বে সমাপনী অনুষ্ঠানে থাকবেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার।

‘দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে নজরুল চর্চা বেগবান করতে এই উৎসব আয়োজন করা হয়েছে। এবছর কবি নজরুলের ১২৫তম জন্মবর্ষ। এই বছরটি নজরুলচর্চার জন্য খুবই সবিশেষ। উৎসবে দুই দেশের বিশিষ্ট লেখক ও গবেষকদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে সাময়িকী। সাম্য, মানবতা ও জাগরণের যে বাণী কবি সৃষ্টি করে গেছেন, সমকালীন ক্ষয়িষ্ণু সমাজের জন্য তা আলোকবর্তিকা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে নজরুলের এই আলোকবর্তিকা ছড়িয়ে দিতেই আমাদের এই প্রচেষ্টা’-বলেন আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক। 

;

শিশু নজরুল



এ এফ এম হায়াতুল্লাহ
কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারত। এটি বাংলাদেশের তুলনায় আয়তনের দিক দিয়ে বহুগুণ বড় একটি দেশ। বহুজাতির বহু মানুষের বাস সে দেশে। ঐ দেশ অনেকগুলো প্রদেশে বিভক্ত। এই প্রদেশগুলোকে বাংলা ভাষায় রাজ্য বলে অভিহিত করা হয়। এই ভারতবর্ষের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত তদানীন্তন বাংলা প্রদেশের পূর্বাঞ্চল আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আর পশ্চিমাঞ্চল ‘পশ্চিম বঙ্গ’ নামে ভারতের অন্তর্গত রয়ে গেছে।

এই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার অধীন আসানসোল মহকুমার অন্তর্গত জামুরিয়া থানার অন্তর্ভুক্ত চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে এবং ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ তারিখে জন্মলাভের পর একটি শিশুর কাজী নজরুল ইসলাম নাম রাখেন যে পিতা তার নাম কাজী ফকির আহমদ। আর যে মায়ের কোলে তিনি জন্মান তার নাম জাহেদা খাতুন। এই শিশুটির জন্মের আগে এই পিতামাতার আর-ও ৪ জন সন্তান জন্মের সময়ই মারা গিয়েছিল। শুধু তাদের প্রথম সন্তান কাজী সাহেবজানের বয়স তখন ১০ বছর। অর্থাৎ কাজী নজরুলের সর্বজ্যেষ্ঠ বড় ভাই শিশু কাজী নজরুলের চাইতে ১০ বছরের বড় ছিলেন। নজরুলের পর তার আর-ও একজন ভাই ও বোনের জন্ম হয়েছিল। ভাইটির নাম ছিল কাজী আলী হোসেন এবং বোনটির নাম ছিল উম্মে কুলসুম।

শিশু নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমদ বই-পুস্তক পড়তে পারতেন। তিনি স্থানীয় মসজিদ ও মাজারের সেবা করতেন। রাজ্য শাসকগণ কর্তৃক বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ অর্থাৎ বিচারকগণ উন্নত চরিত্রের অধিকারী হতেন। মুসলমান সমাজ থেকে বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাজী বলা হত। মুসলমান সমাজে কাজীগণ অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হতেন। নজরুল ইসলাম এইরূপ সম্মানিত পরিবারে জন্মপ্রাপ্ত এক শিশু। তাই জন্মের পর ক্রমশ বেড়ে উঠার পর্যায়ে তিনি পারিবারিকসূত্রেই ভাল-মন্দের পার্থক্য করার এবং হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত হয়ে সকলকে সমভাবে ভালবাসার গুণাবলি অর্জন করেন।

মানবজাতির ইতিহাসে যে-সমস্ত মহাপুরুষ বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের অধিকাংশই শৈশব থেকে নানারূপ দুঃখ-কষ্টে পতিত হয়ে সেগুলো জয় করে মহত্ত্ব অর্জন করেছেন। তাদের কেউই একদিনে বড় হয়ে যাননি কিংবা বেড়ে-ও উঠেন নি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হযরত মুহাম্মদ (সঃ) জন্মানোর আগেই পিতাকে হারিয়েছিলেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে হারিয়েছিলেন জন্মদাত্রী মাকেও। নজরুল তার পিতাকে হারান নয় বছর বয়সে ১৯০৮ সালে। পিতা তাকে গ্রামের মক্তবে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছিলেন। তখনকার দিনে পড়াশোনা করার জন্যে সরকারি ব্যবস্থা ছিলনা। বাংলাদেশের তখন জন্ম হয়নি।

বিশেষ ভঙ্গিমায় হাবিলদার নজরুল

নজরুলের জন্মভূমি বাংলা প্রদেশ ভারতবর্ষের একটি রাজ্য যা ছিল বিদেশী ব্রিটিশ শাসনাধীন তথা পরাধীন। ব্রিটিশ শাসকরা এদেশের সাধারণ মানুষ তথা প্রজাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেনি। কারণ শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ সচেতন হয়ে উঠে-তাদের আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হয়-তারা পরাধীন থাকতে চায় না-স্বাধীনতার প্রত্যাশী হয়। বিদেশী শাসক ব্রিটিশরা সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষা উন্মুক্ত না করায় জনসাধারণ সম্মিলিতভাবে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করত। সেই প্রতিষ্ঠানে প্রধানত মাতৃভাষা ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হত। এইসব প্রতিষ্ঠান মক্তব নামে পরিচিত হত। এগুলো পরিচালনার ব্যয় অর্থাৎ শিক্ষকদের বেতন মক্তব প্রতিষ্ঠারাই দান, সাহায্য ও অনুদান সংগ্রহ করার মাধ্যমে নির্বাহ করতেন। গ্রামীণ একটি মক্তবে নজরুলের পাঠগ্রহণ শুরু। তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর।

একবার কিছু শোনে ও দেখেই তিনি তা মনে রাখতে পারতেন। কিন্তু শিশুসুলভ সকল প্রকার চঞ্চলতা-ও তাঁর ছিল। পিতৃবিয়োগের পর সেই চঞ্চলতার যেন ছেদ পড়ল। তার মেধাগুণে তিনি হয়ে উঠলেন শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে সেই মক্তবেরই শিক্ষক। একজন শিশু শিক্ষক। এক শিশু পড়াতে লাগলেন অন্য শিশুকে। উদ্দেশ্য নিজের অর্জিত জ্ঞান ও বিদ্যা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া। নিজেকে অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া। কিছু দেয়ার মাধ্যমে আনন্দ লাভ-যে আনন্দ মহৎ।

তার ভেতরে ছিল এক ভবঘুরে মন। মক্তব ছেড়ে ভর্তি হলেন উচ্চ বিদ্যালয়ে-মাথরুন নবীন চন্দ্র ইনস্টিটিউশনে। স্থিত হলেন না সেখানে। গ্রামীণ নিসর্গ, প্রকৃতি, ঋতুচক্র যেমন তার মনকে প্রভাবিত করে, অজানাকে জানার এবং অচেনাকে চেনার নিরন্তর কৌতূহল-ও তাকে আন্দোলিত করে। ঘরছাড়া স্বভাবের এই শিশু অন্য সকল মানুষের জীবন ও সংগ্রামের রহস্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ঘর তাকে বাঁধতে পারে না। বিশাল আকাশকেই তার মনে হয় তার মাথার ওপরে খাঁচার মত উপুড় হয়ে তাকে আটকে রেখেছে। তাই তিনি মনে মনে ‘ভূলোক, গোলোক ও দ্যুলোক’ ছাড়াতে চাইতেন কেবলÑনিজেকে মুক্ত করতে চাইতেন। মনের আহ্বানে সাড়া দিতেন, গান শোনাতেন, শুনে শুনে গাইতেন।

তারই পরিক্রমায় গ্রামীণ লোক-নাট্য ‘লেটো’ গানের দলে যোগ দিলেন। সেখানেও তার দলপতি উস্তাদ শেখ চকোর গোদা ও বাসুদেব তাকে সেরাদের ‘সেরা’ বলে স্বীকৃতি দিলেন। তিনি শুধু লেটোর দলে গানই গাইলেন না। গানের পালা রচনা করলেন। ‘ মেঘনাদ বধ’, ‘হাতেম তাই’ ‘চাষার সঙ’, ‘আকবর বাদশা’ প্রভৃতি পালা রচনা করতে যেয়ে হিন্দু পুরাণ রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, বেদ যেমন পড়লেন, তেমনি পড়লেন কোরান-হাদিস, ইতিহাস-কাব্য প্রভৃতি। মক্তব-বিদ্যালয় ছেড়ে হয়ে গেলেন প্রকৃতির ছাত্র।

কিন্তু আগুন যে ছাই চাপা থাকে না। প্রতিভার আগুনের শিখা দেখে ফেললেন পুলিশের এক দারোগা, যিনি নিজেও কাজী বংশের সন্তান, রফিজুল্লাহ। চাকরি করেন আসানসোলে। কিন্তু তার জন্মস্থান ময়মনসিংহ জেলা। নি:সন্তান রফিজুল্লাহ মায়ায় পড়ে গেলেন শিশু নজরুলের। নিয়ে এলেন জন্মস্থান ময়মনসিংহে। ভ্রাতুষ্পুত্রের সাথে ভর্তি করে দিলেন দরিরামপুর হাই স্কুলে। কেমন ছিলেন তিনি এখানে ? জন্মভিটা চুরুলিয়া থেকে কয়েকশত কিলোমিটার দূরে-মাতৃআঁচল ছিন্ন পিতৃহীন শিশু! সহপাঠীরা কেউ লিখে রাখেন নি।

১৯১১ সনে ময়মনসিংহে আনীত হয়ে থাকলে পেরিয়ে গেছে একশত তের বছর। সহপাঠীদের কেউ বেঁচেও নেই। কিন্তু বেঁচে আছে নানারূপ গল্প ও কল্পনা। বড় বড় মানুষদের নিয়ে এমনই হয়। তাদেরকে কেন্দ্র করে অনেক কাহিনী তৈরী করা হয়। মানুষ জীবনের গল্প শুনতে ভালবাসে। তাই জীবন নিয়ে গল্প তৈরী হয় কিন্তু তা জীবনের অংশ না-ও হতে পারে। কেউ বলেন নজরুল ময়মনসিংহের ত্রিশালে এক বছর ছিলেন, কেউ বলেন দেড় বছর, কেউবা দু’বছর। প্রথমে ছিলেন কাজী রফিজুল্লাহ’র বাড়ি। এরপরে ছিলেন ত্রিশালের নামাপাড়ায় বিচুতিয়া বেপারির বাড়ি। এই দু’বাড়িতে থাকা নিয়ে অবশ্য কোন বিতর্ক নেই। কিন্তু তর্ক আছে তার প্রস্থান নিয়ে।

কেউ বলেন তিনি স্কুল-শিক্ষকের কাছে সুবিচার না পেয়ে, কেউ বলেন অভিমান করে চলে গিয়েছিলেন। তবে তিনি কাউকে না বলেই চলে গিয়েছিলেন এটাই প্রতিষ্ঠিত মত। কিন্তু গেলেন কোথায় ? সেই জন্মস্থানে। তবে এবার চুরুলিয়া থেকে বেশ দূরে রাণীগঞ্জের শিহাড়সোল সরকারি স্কুলে সরকারি বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হলেন অষ্টম শ্রেণিতে। ১৯১৫ সন। পড়াশোনা করলেন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। দশম শ্রেণি পর্যন্ত একটানা। নজরুলের চঞ্চলমতি, ঘরছাড়া ও ভবঘুরে স্বভাবের জন্যে যেন বেমানান। প্রতিটি ক্লাসে প্রথম হলেন।

মেধাবী বলেই নিয়মিত মাসিক ৭ টাকা বৃত্তি পেতেন। ঐ সময়ের হিসাবে মাসিক ৭ টাকা অনেক টাকা। মাসিক ৩ থেকে ৪ টাকায় সকল প্রকার থাকা-খাওয়ার ব্যয় মিটিয়ে অনায়সে চলা যেত। দশম শ্রেণির নির্বাচনী পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে এন্ট্রান্স বা মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার কথা। সে প্রস্তুতি চলছে। নিচ্ছেন-ও। হঠাৎ ব্রিটিশ শাসকদল কর্তৃক যুদ্ধযাত্রার ডাক। কিন্তু প্রলোভন দেখানো হলো যে ব্রিটিশরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জিততে পারলে ভারতবর্ষকে মুক্ত করে দিয়ে যাবে। জন্মাবধি স্বাধীনতা ও মুক্তি-প্রত্যাশীর হৃদয়ে নাড়া দিল। তিনি সাড়া দেবেন কিনা দোদুল্যমান। কিন্তু কপট ব্রিটিশ জাতি বাঙালিকে উত্তোজিত করার নিমিত্ত অপবাদ ছড়ালো যে বাঙালিরা ভীরু।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকার কবিভবনে নজরুল

তারা লড়তে, সংগ্রাম করতে, যুদ্ধে যেতে ভয় পায়। স্বল্পকাল পরের (১৯১৭ সালের মাত্র চার বছর পর লিখিত হয়েছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ১৯২১ সনে) বিদ্রোহী কবির রক্ত ক্ষোভে নেচে উঠলো। কে রুখে তার মুক্তির আকাক্সক্ষা! বাঙালি সেনাদের নিয়ে গঠিত ৪৯ নং বাঙালি পল্টনে নাম লিখিয়ে বাস্তব যুদ্ধযাত্রা করলেন। গন্তব্য করাচি। ১৯১৭-১৯১৯ সাল অব্দি কঠোর সৈনিক জীবন। সুকঠিন নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যেই সাধারণ সৈনিক থেকে হাবিলদার পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পাশাপাশি আরবি-ফার্সি সাহিত্যে অধ্যয়নসহ সঙ্গীতে ব্যুৎপত্তি অর্জনের জন্য মহাকালের এক অবিস্মরণীয় কবি-শিল্পী হিসেবে নিজেকে নির্মাণের ক্ষেত্রে করাচির জীবনই ছিল এক সাজঘর। যুদ্ধযাত্রার পূর্ব পর্যন্ত নজরুল শিশু। কিন্তু যুদ্ধফেরত নজরুল এক পরিপূর্ণ তরুণ ও চিরকালীন শিল্পী-যার মন ও মানস শিশুর মত আজীবন নিষ্পাপ।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট 

;

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;