“পাঠক যেটুকু মনে রাখে তার জন্য দু’ চারখানা ভালো লেখাই যথেষ্ট” - সঙ্গীতা বন্দোপাধ্যায়



Tanim Kabir
অলঙ্করণ: কাব্য কারিম

অলঙ্করণ: কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

গল্পকার ও গদ্যকার ইশরাত তানিয়া সম্পাদিত সাক্ষাৎকারগ্রন্থ ‘আলাপের অ্যাম্ফিথিয়েটারে’ স্থান পেয়েছে বাংলা কথাসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ দশজন নারী লেখকের সাক্ষাৎকার। বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম এবং ত্রিপুরার স্বতন্ত্র নারীস্বরকে দুইমলাটে চিহ্নিত করার এই প্রয়াস লক্ষণীয়। বিশেষ করে সাক্ষাৎকার প্রদানকারী প্রত্যেকেই নিজ নিজ কাজের ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র। কথাও বলেছেন ভিন্ন ভিন্ন বিষয় নিয়ে, উত্তর দিয়েছেন নারীবাদ, রাজনীতি, সমাজ-রাষ্ট্র, লেখালেখির দায় এবং প্রতিশ্রুতি ইত্যাদি বহুবিদ গভীর ও অত্যাবশ্যকীয় প্রশ্নের। সাক্ষাৎকার দিয়েছেন নাসরীন জাহান, পাপড়ি রহমান, আনোয়ারা সৈয়দ হক, সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তৃপ্তি সান্ত্রা, ঝুমুর পাণ্ডে, রাশিদা সুলতানা, মঞ্জু দাসসহ বাংলার চারটি ভূখণ্ডের প্রতিনিধিত্বশীল সব নাম।

সমসাময়িক বাংলার নারী লেখকদের শক্তিমত্তা ও বহুবিচিত্রতার সাক্ষ্যদলিল—ব্যতিক্রমী এই সংকলনটির গুরুত্ব বিবেচনায় এখানকার দুটি আংশিক ও একটি পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎকার অনলাইন ভার্সনে প্রকাশ করছে বার্তা২৪। এতে নারী লেখকদের ভাবনাবলয়ের পরিচয় পাওয়ার সঙ্গে তাদের কাজ সম্পর্কে আরো সিরিয়াস এবং নতুন পাঠকদের বিস্তারিতভাবে জানার আগ্রহ তৈরি হবে। এখন থেকে প্রকাশিত কোনো গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের ‘অনলাইন কনটেন্ট শেয়ারিং প্লাটফর্ম’ হিসেবেও কাজ করবে বার্তা। আজ থাকছে কথাসাহিত্যিক সঙ্গীতা বন্দোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার।

সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়

সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৭৪, ২৩ নভেম্বর। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘শাহরুখ আর আমি’। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘অনেক অবগাহন’। ২০০৪-এর ডিসেম্বরে দেশ পত্রিকায় ‘শঙ্খিনী’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। এছাড়া ‘প্যান্টি’, ‘রুহ’, ‘যোগিনী’, ‘ঘাট’, ‘সম্মোহন’, ‘ফাঁকি’, ‘কড়িখেলা’, ‘হাওয়ায় হাওয়ায়’, ‘যখন বিকেল’, ‘কালা ঘোড়া’, ‘গুপ্তধন’, ‘মরিয়ম মেয়েরা’, ‘গলনাঙ্ক’, ‘নিভাননী উপত্যকা’ ইত্যাদি উপন্যাস লিখেছেন। প্রায় ৬০-এর ওপর ছোট-বড় গল্প লিখেছেন। দীর্ঘদিন চাকরি করেছেন এবিপি আনন্দতে। লিখেছেন অসংখ্য ফিচার, ফিল্ম রিভিউ, পোস্ট এডিট, কাভার স্টোরি। প্যান্টি, রুহ, যোগিনী, সম্মোহন ইংরেজি অনুবাদ হয়েছে Penguin, HarperCollins এবং ইউকে বেইসড পাবলিশিং হাউজ Tilted Axis Press থেকে। যোগিনীর জন্য পেয়েছেন ২০১৭ ইন্টারন্যাশনাল পেন ট্রান্সলেশান এওয়ার্ড। বেশ কিছুকাল লন্ডনে বসবাস করেছেন। এবং ভারত ও বিদেশের অনেক সাহিত্য উৎসবে আমন্ত্রিত হয়ে গেছেন। স্বামী আছে। একটি ছেলে আছে। শখ বলতে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক অধ্যয়ন ও এই মহাবিশ্বে মানুষের উপলব্ধিগুলোকে জানা ও বোঝা।


ইশরাত তানিয়া: উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে বিষয়, কাঠামো, চরিত্র নির্মাণ, ভাষার বিশেষ গঠন (কন্সট্রাকশান) এবং প্রকাশভঙ্গি এসবের কোনটিকে আপনার গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়? নিজস্ব কোনো নির্মাণকৌশল ব্যবহার করেন কি? 
সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়: নির্মাণ কৌশল বলতে ফর্ম। আলাদা করে ভেবে এগোই না। উপন্যাসটাই দাবি আদায় করে নেয়। যেমন প্যান্টি উপন্যাসটা মাথায় এসেইছিল স্বপ্নের ভেতর। ওইভাবেই উঠে লিখতে শুরু করি। পরে অধ্যায়গুলোর ওই জাক্সট্রাপোজিশান অনেকটা ভেবে করা। মনে হয়েছিল জীবনে তো কোনো কিছুর কনটিনিউটি নেই। ঘটনার কনটিনিইউটি তো থাকে না। অনেকটা কোর্টের ডেট পরার মতো। একটা ডেট পড়ার পর আর একটা ডেট কবে পড়বে কেউ জানে না। আবার রুহ উপন্যাসে প্রটাগনিস্টকে দুটো খুব কন্ট্রাডিকটোরি সত্তায় ভাগ করেছি যেটা খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল। এছাড়া ভাষাটা তো অনেক ভেবেচিন্তে করতে হয়। গদ্যের স্টাইলটা ভীষণ ভেবে নিয়ে করি। তবে মডার্ন বাংলা গদ্য নিয়ে আমার নিজস্ব কিছু ভাবনা আছে। আমি সেভাবেই শব্দকে অ্যাপ্লাই করি। কিন্তু ধরা যাক আমার গুপ্তধন উপন্যাসটার সময়কাল ৬০-এর দশক। সেখানে ন্যারেটিভটা সেই সময়টাকেই ধরে, ডায়লগও তাই। ফলে পুরোটাই খুব সতর্ক প্রক্ষেপণ। এবং আমার মনে হয় আমার এমন কোনো লেখা নেই যা পাঠক পড়ে বলবে যে লেখক লিখতে হতো তাই লিখেছে। আমি মোটামুটি নিজেকে ধরে রেখেই লিখেছি যা লিখেছি এযাবৎকাল।

ইশরাত তানিয়া: এখন কোনো উপন্যাস লিখছেন? বা নতুন উপন্যাস লেখার ব্যাপারে কিছু ভাবছেন? এ ব্যাপারে কিছু বলুন।
সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়: সারাক্ষণ লেখার কথা ভাবি। মাঝে মাঝে মনে হয় মাথার মধ্যে এই চিন্তার বিজবিজি কোনো পাগলামি নয় তো? এটা এত বেড়ে গেছে যে আজকাল একটু সংশয় হয়। ভাবছি অনেক। লিখছি নগণ্য পরিমাণ। কেন? কারণ কী? জানি না। টায়ার্ড? মনে হয় আমি একটু জীবনটা বাঁচতেও চাই। লেখার জন্য বাঁচতে চাই না। বাঁচলাম লিখলাম দেখলাম ভুলে গেলাম উড়িয়ে দিলাম এরকম হোক। সুচিত্রা ভট্টাচার্য হাত ভেঙে কষ্ট পাচ্ছেন, লিখতে পারছেন না, এক আঙুলে টাইপ করে করে লিখছেন, এত লেখার চাপ। তার মধ্যে বিষম খেয়ে মরে গেলেন। ইস! একটু রেস্ট দরকার ছিল মানুষটার। একটু আরাম দরকার ছিল। কিন্তু পাঠক পাঠক করে সেটা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করলেন। সেই পাঠক তাঁকে কতটুকু স্মরণ করে? কতটা মিস করে? পাঠক তো কারো নয়। পাঠক যেটুকু মনে রাখে তার জন্য দু চারখানা ভালো লেখাই যথেষ্ট। প্রাণ হাতে করে, মরিয়া হয়ে লেখার প্রয়োজন নেই। একমাত্র টাকার প্রয়োজন থাকলে ওরকম করে লেখা উচিত। আমরা ভাবি পাঠক পাঠক। পাঠক একটা অবিরল স্রোত, একটা চৈতন্যের স্রোত। এই স্রোতের খিদের সঙ্গে লেখক পাল্লা দিতে পারে নাকি? কারণ লেখক ওয়ান ম্যান আর্মি। লেখকের থেকে একা, নিঃসঙ্গ, অসহায় কেউ হয় না। আমাদের মধ্যে, মানুষের সভ্যতার মধ্যে একটা দর্শন ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যে কর্মবীর হতে হবে। যে অনেক কাজ করছে সেই আর কী সঠিক পথে আছে। আমার মনে হয় কাজ কম করা উচিত। উই নিড টু স্লো ডাউন। এটা একটা এমন মানসিক অবস্থা যা মানুষকে আরো তলিয়ে ভাবতে সাহায্য করবে যে আমাদের রিপু আর প্রবৃত্তিকে আমরা কী করে উন্নত করব। এই যে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়, কোথায় এগোনোর কথা বলা হয় আমি বুঝি না। ক্রমশ তো সভ্যতারই প্রয়োজন ফুরিয়ে আসছে। পৃথিবীতে মৌমাছি এত কমে গেছে যে এক্সটিঙ্কট হওয়ার মুখে। আর সেটা হলেই মানুষ শেষ। আইনস্টাইন বলে গেছেন কবে, মৌমাছিরা না থাকলে মানুষ ৪ বছরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এখন আমাদের দরকার জঙ্গল, দরকার সরল সাদাসিধে জীবনে ফিরে যাওয়া। এই সব কথাই এখন বলতে হবে। আমার এখন আর এত অহঙ্কার হয় না এই সভ্যতা নিয়ে।
এই সব কারণে আমি অনেক লেখা মনে মনে লিখে ফেলি। অনেক লেখা বাতিল করি। আপাতত এত লেখা মাথায় আছে হয়তো একটা দুটো লিখব তার মধ্যে থেকে। কিন্তু আমার একটা বাতিক হলো আমি কী লিখছি সেটা কাউকে কখনো বলি না। আমার লেখার কোনো প্লট হয় না। একটা জার্নি হয়। শেষ মুহূর্তে অব্দি আমি জানতে পারি না কী লিখছি।


“সাহিত্যকে আমি দুই বাংলায় ভাগ করতে আগ্রহী নই”
- রাশিদা সুলতানা


ইশরাত তানিয়া: একজন লেখকের পাঠকের কাছে পৌঁছানো কতটা জরুরি? কমলকুমার মজুমদার বা সুবিমল মিশ্রের কথা যদি বলি, ওনারা কিন্তু সেভাবে পাঠকের কাছে পৌঁছতে পারেননি। আবার শরৎচন্দ্র, মানিক, বিভূতি, সুনীল পৌঁছে গেছেন। এ প্রসঙ্গে আপনার মতামত জানতে চাইছি ।
সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়: যদিও প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো যে, আমার মনে হয় লেখকের পাঠকের কাছে পৌঁছানোর একটা প্রধান শর্ত রিড্যাবিলিটি। লেখক প্রধানত কমিউনিকেট করার ইচ্ছে থেকেই লিখতে আসেন। নইলে তো মনে মনে কথা বললেও হয়ে যেত। আবার নিজের উপলব্ধিগুলোও কখনো কখনো ফেডেড হয়ে যায়। আমি যে একটা কোনো বড় সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম জীবন সম্পর্কে, সেটা অনেক সময় গুলিয়ে যেতে পারে। তাই সেই অনুভব ও উপলব্ধির শৃঙ্গগুলিকে লিখে রাখতে হয়, আবার কিভাবে আমি সেই উপলব্ধিতে পৌঁছলাম তার জার্নিটাও লিখে রাখতে হয়, নইলে পরে মনে হতে পারে যে আমি এখানে কোথা থেকে এসে উঠলাম? তাই মনে মনে ভেবে ফেলতে পারলেই হয় না, এমনকি মানুষ ডায়রি লেখেও এই জায়গা থেকে। লেখার প্রয়োজন আছে। কোথাও গিয়ে আমার মনে হয় ইতিহাসও সাহিত্যের অঙ্গ। ব্যক্তির ইতিহাস লিখে না রাখলে বৃহৎ ইতিহাসের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা থাকে না। সেখানেই সাহিত্য ইতিহাসকে জমি দেয়। ফিকশন তাই। লেখার প্রয়োজন তৈরি হয় কারণ এই অর্জিত জ্ঞান, তথ্য, আবেগের যাত্রাপথ সবই অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দিতে হয়। এটাই প্রত্যাশা একজন লেখকের। সেখানে রিড্যাবিলিটির একটা প্রয়োজন তো থাকেই। কিন্তু কমলকুমারের মতো লেখকরা হলেন লেখকদের লেখক। একজন অভিভাবক যেন। তাঁকে পাঠ করতে হলে এক ধরনের গভীর অভিনিবেশ ও চর্চা দরকার পাঠকের। একটা জেদ থাকতে হয়। সবার জন্য সবকিছু নয়। আবার এরকম হয়েছে, অনেক কালোত্তীর্ণ লেখকের ক্ষেত্রে ঘটেছে যে তাঁর সময়ে তাঁকে কেউ গ্রহণ করেনি, বুঝতে পারেনি। কাফকা তার জীবিত অবস্থায় কোনোদিন গৃহীত হননি। কিটস্-এর ক্ষেত্রেও এরকম ঘটেছে। সমকাল ঠোঁট উল্টেছে। রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দকে বুঝতে পারেননি। গুরুত্ব দিতে চাননি। রবীন্দ্রনাথ তার মগ্নচেতনাকে সব সময়ই সাবলিমেট করেছেন ঐশ্বরিক চৈতন্যে। সভ্যতার উন্নতির কথা ভেবে গেছেন। এটা একটা কনশাস প্রচেষ্টা। জীবনানন্দ সেখানে ইতিহাসের অন্ধকারে পর্যটন করেছেন। তিনি মানুষের আরো গভীর অন্তঃপ্রকৃতির কথা লিখেছেন। মানুষের অবচেতনকে ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে ধরেছেন। জীবনানন্দ এভাবেই স্বতঃস্ফূর্ত। কিন্তু মূল কথাটা একই। লেখকের এই ফুটপ্রিন্ট, এই পার্টিসিপেশান। নিম অন্নপূর্ণা বা সতীত্ব কি রাখব অপর্ণা কিংবা হার্বাট এসব লেখা চিরকাল সিরিয়াস পাঠককে ভাবাবে, পাঠকের মননে নানা ক্রিয়াবিক্রিয়া ঘটাবে। নবারুণ ভট্টাচার্যের নামও এখানে নিতে হয়। আমি এই রাইটার/ অ্যান্টি-রাইটার এর মধ্যে যেতে চাই না। পাঠকের সংখ্যা দিয়ে লেখকের বিচার হয় না।

ইশরাত তানিয়া: রিডার রেসপন্স থিওরি নিয়ে আপনার মত কী?
সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়: এটা একটা খুব ভালো প্রশ্ন। ইফ দেয়ার ইজ নো রিডার দেয়ার ইজ নো রাইটার। সাহিত্যের প্রতি, একটা ক্রিটিক্যাল লেখার প্রতি পাঠকের অ্যাপ্রোচটা একটা বিরাট বড় ব্যাপার। এটা একটা উদাহরণ দিয়ে বলি। আমি একটা পদ রান্না করলাম। অনেকগুলো সিক্রেট ফ্লেভার মেশালাম তাতে। এবার একটা দশজনের গ্রুপ এক সঙ্গে বসে সেই পদটা ভাগাভাগি করে খেলাম। আমরা খেলাম নিঃশব্দে। কোনো মুখভঙ্গি করলাম না। কোনো ভাব প্রকাশ করলাম না। এবং উঠে চলে গেলাম যে যার রাস্তায়। এবার এই যে রান্নাটা তার কী হবে। সেটা রান্না হলো খাওয়া হলো তার কোনো চিহ্ন থাকবে না। কিন্তু যদি ভাব বিনিময় হতো, আহঃ, বাহ, কী ভালো, এটা কী, ওটা কী, খেতে খেতে এটা ওটা মনে পড়ল ইত্যাদি যদি ওইখানে ঘটত তাহলে এই খাবারটা তার আস্বাদসহ শেষ হয়েও ঝুলে থাকত কোথাও। সেই ঝুলে থাকা একটা অনন্ত সম্ভাবনা। এই অ্যাপ্রোচটা বাদ দিলে খাবার থাকবে, আস্বাদ থাকবে না। অতএব লেখক লেখে, পাঠক পড়ে, এবং তারপর তার রিডিং এক্সপিরিয়েন্স বহুধাবিভক্ত হয়ে এমন বৃহত্তর ডিসকোর্স তৈরি করে যা সাহিত্যের জন্য একান্ত অপরিহার্য। এবং অনেক বড় একটা সময়ের ব্যবধানে এই ডিসকোর্স কিন্তু মূল লেখার ভেতর জুড়ে যায়। এর উদাহরণস্বরূপ আমরা মহাকাব্যগুলোর কথা বলতে পারি। এই কারণেই মহাকাব্যগুলো এত হাজার বছর পরও বহমান। জেমস জয়েসের ইউলিসিস পড়ার একটা কমিউনিটি আছে। সেই কমিউনিটিতে মানুষ আসে, এক সঙ্গে ইউলিসিস পড়ে, যে যার মতো করে সেই পাঠে কনট্রিবিউট করে। পরবর্তীতে সেই কনট্রিবিউশন আবার পাঠের অংশ হয়ে যায়। আমি কলকাতায় এরকম স্টাডি সার্কেলে গেছি। আমি বিদেশে বুক ক্লাব দেখেছি। ব্রুকলিনে গত বছর আমার অ্যাবান্ডন উপন্যাসটা একটা বুক ক্লাব এক মাস ধরে পড়েছে। এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় কতগুলো বইপড়ার গ্রুপ। তারা এক্সটেনসিভলি লেখক এবং লেখকের রচনা নিয়ে আলোচনা করে। খুব দরকারি। যে কারণে উম্বার্তো ইকো না পড়লে আমি তো আনা কারেনিনাকে এত ভালো করে বুঝতে পারতাম না। স্টাডি সার্কেল ছাড়া আমি তো জয়েসকে বুঝতে পারতাম না। এই প্রসঙ্গে উম্বার্তো ইকোর একটা উক্তি মনে পড়ছে—আমরা একটা বই এই জন্য পড়ি না যে, তাতে যা লেখা আছে আমরা সেটাই বিশ্বাস করে নেব। আমরা একটা বই এই জন্য পড়ি যাতে আরেকটা বই পড়ার জন্য আমাদের মনটা আবার অনুসন্ধিৎসু হয়ে ওঠে। অনেকটাই অ্যারিস্টোটল যা বলছেন তারই প্রতিধ্বনি।


“বেশি সতর্কতা, অসতর্কতা লেখার শিল্পগুণ নষ্ট করে”
- নাসরীন জাহান


ইশরাত তানিয়া: পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর অবস্থান আমরা জানি। লেখক সমাজ কি এর বাইরে? একজন নারীর লেখক হতে চাওয়াটা কতটুকু চ্যালেঞ্জিং? এর সমাধানই বা কী?
সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়: আসলে অনেক মানুষ একটা ডিনায়েলে বাঁচে। আমার মধ্যেও একটা ডিনায়েল আছে। আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে চেষ্টা করে গেলাম যে, আসলে আমার যা সাফারিংস সেটা মেয়ে হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে। আর পাঁচটা নারী পুরুষ জীবনে যে দুর্ভোগ সহ্য করে ঘটনাচক্রে আমাকেও সেই রকম অনেক কিছু জীবনে সহ্য করতে হয়েছে। আমার বাবার পুত্র সন্তানের প্রতি একটা অনিচ্ছা ছিল। চাইতেন কন্যা সন্তান হোক। আমার বাবাকে মজা করে খবর দেওয়া হয় যে ছেলে হয়েছে। বাবা খুব আশাহত হয়ে বসে ছিলেন চুপ করে। তখন তাড়াতাড়ি বলা হয় যে—না, মেয়ে জন্মেছে। বাবা সঙ্গে সঙ্গে ছুটে বেরিয়ে যান মেয়েকে দেখতে। এই গল্পটা আমাকে ছোট থেকে বলা হতো। এটা শুনে আমার দুঃখ হতো সেই না হওয়া ছেলেটার প্রতি। যে হলে বাবা তাকে দেখতে যেত না! আবার পুরো গল্পটা একটা স্ট্রেংথ তৈরি করে দিয়েছিল আমার মধ্যে আমাদের সকলের অগোচরে। নিজেকে মূল্যবান ভাবার, ওয়ান্টেড ভাবার এরকম একটা ঘটনা থাকলে একদম ছোট্ট থেকে একটা বিশ্বাস আর নিরাপত্তার বোধ তৈরি হয়ে যায় যেটা পরবর্তী সময় নিজেকে নারী হিসেবে পুরুষের তুলনায় কিছু আলাদা ভাবাটা একেবারে অপ্রয়োজনীয় ভেবে বাতিল হয়ে যায় মন থেকে, চিন্তা থেকে। আমার মামাবাড়ির তরফে এত এত মেয়ে। তাদের খুব কদর ছিল। অনেক বড় অব্দি আমার মামাদের দেখতাম আমার মাসীদের স্নান, খাওয়া, ঘুম, মুখে ক্রিম লাগানো, রাতের দাঁত মাজা, ইসবগুল খাওয়া এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে। “দুপুরে ঘুমোলি না তোরা? খালি গল্প করলি?” এই নিয়ে হয়তো মামা রাগারাগি করলেন। মানে সারাক্ষণ বাড়ির মেয়েদের তোয়াজ করা হতো। যদিও মামারা ছিলেন অতি মধ্যবিত্ত পরিবার। এদিকে আমার বাবার দিকের পরিবার হলো অতি উচ্চবিত্ত, অতিরিক্ত ধনী পরিবার বলতে যা বোঝায় তাই। সেখানেও পরিবারে মেয়েদের সংখ্যা বেশি। আর মেয়েদের সেই রকম আদর, আবদার। আমরা এতটাই প্যামপারড ছিলাম ভাবা যায় না। এই দুদিকে মেয়েদের এত আস্কারা পেতে দেখে আমার ভেতর পুরুষ বিদ্বেষটা গড়ে ওঠেনি। পরবর্তী জীবনে আই হ্যাড বিন সাব্জেক্টেড টু ভেরিয়াস ইল ট্রিট্মেন্টস বাই মেন। কিন্তু আমি ভাবতে শিখিনি যে এটা তারা করেছে কারণ পুরুষদের মধ্যে এইরকম দোষ থাকে আর তারা পুরুষ। আমি ভেবেছি মানুষ হিসেবে এরা কমপ্যাটিবল নয়, ঠিক নয়, যোগ্য নয়। অ্যান্ড আই মুভড অন ইন মাই লাইফ টু মেক মাই লাইফ বেটার ইন হোয়াটএভার মিন্স, ইউ মাইট সে। কিন্তু এ হলো আমার ব্যক্তিগত জীবনের কথা। প্রফেশনাল জগতে, কাজের জগতে আমাকে পুরুষ দ্বারা হ্যারাসড হতে হয়নি কারণ আই ওয়াজ আ ব্লু আইড গার্ল ইন মাই ওয়ার্ক প্লেস। কেউ আমাকে কখনো বিরক্ত করেনি বা কোনো রকম ডিস্ক্রিমেনেশান বা পলিটিক্স কিছু আমাকে সহ্য করতে হয়নি। আই হ্যাড আ সেইফ করিডোর আর তারপরও যেটুকু এসে পড়েছে সেটা খুব সাট্ল। তার কোনো ইফেক্ট হয় না জীবনের কোথাও। এতসব কিছুর পরও বলব যে, অনেক পুরুষই আত্মসম্মান জিনিসটা বোঝেন না। তাদের আপ ব্রিংগিংয়ের মধ্যে নিজেকে রেস্পেক্ট করা ব্যাপারটা কম। বিশেষত মেয়েদের সামনে প্রায়শই তারা পা থেকে মাথা অব্দি একটা ‘পেনিস’-এ রিডিউসড হয়ে যান। এটা তাদের প্রবলেম। তাদেরই সলভ্ করতে হবে। আমরা মেয়েরা নিজেদের ঘাড়ে এইসব কিছু পরিবর্তনের দায়টা আর নেব না। বা নিজেদের পরিবর্তন করে পুরুষদের অ্যাকোমোডেট করব না। মনে রাখতে হবে যে, আমরা মেয়েরা নিজেদের যত ভাঙছি গড়ছি তা এই পুরুষতন্ত্রের উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে করছি। আমাদের জানতে হবে এই চাপটা না থাকলে আমরা কী কী করতাম, কেমনভাবে বাঁচতে চাইতাম। এছাড়া আরো নানা রকম ডিস্ক্রিমিনেশান কর্মক্ষেত্রে আমাদের সহ্য করতে হয়। এগুলো প্রচুর বড় পরিসরে আলোচনা করার বিষয়। এখন তো মধ্যবয়স। অনেকটা জীবন পেরিয়ে এসেছি। এখন আমি পুরুষদের ভালোওবাসি না, ঘৃণাও করি না। পুরুষ প্রকৃতিটাই অবসোলিট হয়ে যাচ্ছে। ম্যাসকিউলিনিটি অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ছে যত দিন যাচ্ছে। আরো হবে। খুব অচিরে এই রিজেকশান অফ ম্যাসকিউলিনিটি নিয়ে বিপুল চর্চা শুরু হবে এটা দেখতে পাবে। পৌরুষ জিনিসটার এলিজি লেখা হলো বলে।

ইশরাত তানিয়া: উপমহাদেশ জুড়ে ইদানীং ধর্মের প্রবল মাতামাতি, কী ভাবছেন? সাম্প্রতিক রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে সাহিত্য কি ঘুরে দাঁড়ানোর মতো শক্তির যোগান দিতে পারে?
সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়: আমি কোনোদিনই কারো শেখানো বুলি আওড়াতে পারিনি, চাইনি। আমার একদম ছোট থেকে নিজস্ব মতামত ছিল। এমন মতামত যা কিনা তুমি বলতে পারো কিছু দেখে, কিছু পড়ে, কিছু শুনে তৈরি হয়নি। একেবারে নিয়ে জন্মেছিলাম বলা যায়। ফলে আমার কথা সবার পছন্দ হয় না। তো, এই প্রশ্নের উত্তরে আমি এটাই বলব যে, পৃথিবীতে সমস্ত ক্ষুদ্রতার উর্ধ্বে ওঠার মতো সাহিত্য বলো, শাস্ত্র বলো, ডিসকোর্স বলো, কম লেখা হয়নি। যা লেখা হয়েছে তাই মানুষ সারা জীবনে পড়ে উঠতে পারবে না। আর সত্যি কথা বলতে কী, বোধ তৈরি হওয়ার জন্য একজন মানুষকে কোটি কোটি পথ প্রদানকারী বই পড়ার প্রয়োজন হয় না যে, সে সারা জীবন খালি পথ খুঁজেই যাবে, কোনো উদ্ধারই তার হবে না। ব্যাপারটা তা নয়। তাই যা লেখা হয়েছে, যথেষ্ট লেখা হয়েছে, এই সভ্যতা তার থেকে শিখতেই পারে। কিন্তু শিখেছে কি? সাহিত্যের নানান ধারা মানুষের মননকে ঋদ্ধ করেছে কিন্তু জীবনের গতিপথ পাল্টাতে পেরেছে কি? একজন কোনো ধর্মে বিশ্বাস করে না, তার বোধ, চেতনা একদম তৈরি, কিন্তু এখন দাঙ্গা লাগল, তাকে মারতে এলো কেউ, সে উঠে গিয়ে মারল বা মরল, দু ক্ষেত্রেই এই যে ঘৃণ্য জিনিসটা ঘটে গেল এটাকে তো সময় থেকে মুছে দেওয়া যাবে না, সময় তো ঘৃণাটাকে নিয়ে চলবে। ইতিহাস তার সাক্ষী হয়ে থাকবে। সেখানে মানুষ তার প্রজ্ঞা, তার জ্ঞান, রুচি, শিক্ষা সব একটা ঘূর্ণির মধ্যে পড়ে জলাঞ্জলি দেবে। দিতে সে বাধ্য কারণ সে আসলে একটা বড় চক্রান্তের ভেতর একটা গিনিপিগ। একটা পরিস্থিতির শিকার। এত ভালো ভালো সব লেখা আছে, যা ঘটনার পর ঘটনা দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, এই সব ধর্ম টর্মের কোনো প্রয়োজন নেই। মানুষ বোঝে, জানে, কিন্তু এঁটে উঠতে পারে না। আমি তো এরকমও কথা বলেছি যে, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, কী সেটা? আঘাত লাগার একটা প্রমাণ তো থাকে, শরীরে, মনে, কী আঘাত লাগল তার একটা প্রামাণ্যতা তো আছে, থাকবে? কেউ পারবে প্রমাণ করতে? কিন্তু দেখো, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত একটা কত্ত বড় বিষয়। এমনকি এমন ছেঁদো একটা দাবিকে আইনও স্বীকার করে, যে হ্যাঁ বাবা, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে! যাই হোক, জানি না কী ধাতুতে তৈরি হয়েছিলাম, জীবনে এসব প্রশ্ন জাগলোই না। সাহিত্যের কাজ এসব নিয়ে প্রশ্ন তোলা, সাহিত্য তার কাজ করে যাবে। আবার দেখো সাহিত্যের একটা বিপজ্জনক বিনির্মাণ হচ্ছে। কাউন্টার সাহিত্য লেখা হচ্ছে। সেগুলোও তো ঢুকে আসছে। যেটা ধর্মকে আবার জীবনের মূলে ফিরিয়ে দিতে চাইছে। যে মানুষ কিছু না, ধর্মের জন্যই মানুষ, তাই মানুষ আর কিছু ভাববে না, ধর্মের জন্য বাঁচবে মরবে। মারিও পুজো বলে গেছিলেন, যে পৃথিবীর সর্ব প্রথম মাফিয়া ছিলেন পোপ আলেকজান্ডার। মারিও সারা জীবন মাফিয়াদের নিয়ে পৃথিবীর জনপ্রিয়তম বই লিখে গেছেন। তিনি একথা বলছেন। ধর্ম এইরকমভাবেই কাজ করে মানুষের জীবনে।
এখানে একটা কথা বলতে চাই, এই উপমহাদেশকে ধর্মের গ্রাস থেকে, অন্ধকার থেকে বাঁচাবে মেয়েরা। মেয়েরা জানে ধর্মের সবচেয়ে বড় বলি তারা। তাদের বাঁচতে দেওয়া হবে না। মেয়েরা লড়াই করবে, সাহিত্য অর নো সাহিত্য, মেয়েরা একেবারে নখ, দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে ফেলবে ধর্মের রাক্ষসকে।

   

শ্রীপুরের কাওরাইদে নজরুল উৎসব শনিবার



ডেস্ক রিপোর্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কাওরাইদ কালি নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ‘ভাগ হয়নিকো নজরুল’ শীর্ষক নজরুল উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে শনিবার। ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারের আয়োজনে এবং নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর সহযোগিতায় এই উৎসবে সেমিনার, আবৃত্তি ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জাতীয় কবির বর্ণাঢ্য জীবন ও সাহিত্যকে তুলে ধরা হবে।

নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর অন্যতম ট্রাস্টি আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক জানান, আয়োজনের শুরুতে শনিবার দুপুর ২টায় সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সুনীল কান্তি দে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক ড. সাইম রানা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস ও ছায়ানট (কলকাতা)’র সভাপতি সোমঋতা মল্লিক।

তিনি আরও জানান, বিকেলে আয়োজনে নজরুলের জাগরণী কবিতা ও গান পরিবেশন করবেন দেশের বরেণ্য শিল্পীরা। আবৃত্তি করবেন-টিটো মুন্সী ও সীমা ইসলাম। নজরুল সঙ্গীত পরিবেশন করবেন শিল্পী ফেরদৌস আরা, সালাউদ্দিন আহমেদসহ অনেকে। সমাপনী পর্বে প্রধান অতিথি থাকবেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ইমেরিটাস অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সভাপতিত্বে সমাপনী অনুষ্ঠানে থাকবেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার।

‘দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে নজরুল চর্চা বেগবান করতে এই উৎসব আয়োজন করা হয়েছে। এবছর কবি নজরুলের ১২৫তম জন্মবর্ষ। এই বছরটি নজরুলচর্চার জন্য খুবই সবিশেষ। উৎসবে দুই দেশের বিশিষ্ট লেখক ও গবেষকদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে সাময়িকী। সাম্য, মানবতা ও জাগরণের যে বাণী কবি সৃষ্টি করে গেছেন, সমকালীন ক্ষয়িষ্ণু সমাজের জন্য তা আলোকবর্তিকা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে নজরুলের এই আলোকবর্তিকা ছড়িয়ে দিতেই আমাদের এই প্রচেষ্টা’-বলেন আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক। 

;

শিশু নজরুল



এ এফ এম হায়াতুল্লাহ
কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারত। এটি বাংলাদেশের তুলনায় আয়তনের দিক দিয়ে বহুগুণ বড় একটি দেশ। বহুজাতির বহু মানুষের বাস সে দেশে। ঐ দেশ অনেকগুলো প্রদেশে বিভক্ত। এই প্রদেশগুলোকে বাংলা ভাষায় রাজ্য বলে অভিহিত করা হয়। এই ভারতবর্ষের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত তদানীন্তন বাংলা প্রদেশের পূর্বাঞ্চল আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আর পশ্চিমাঞ্চল ‘পশ্চিম বঙ্গ’ নামে ভারতের অন্তর্গত রয়ে গেছে।

এই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার অধীন আসানসোল মহকুমার অন্তর্গত জামুরিয়া থানার অন্তর্ভুক্ত চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে এবং ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ তারিখে জন্মলাভের পর একটি শিশুর কাজী নজরুল ইসলাম নাম রাখেন যে পিতা তার নাম কাজী ফকির আহমদ। আর যে মায়ের কোলে তিনি জন্মান তার নাম জাহেদা খাতুন। এই শিশুটির জন্মের আগে এই পিতামাতার আর-ও ৪ জন সন্তান জন্মের সময়ই মারা গিয়েছিল। শুধু তাদের প্রথম সন্তান কাজী সাহেবজানের বয়স তখন ১০ বছর। অর্থাৎ কাজী নজরুলের সর্বজ্যেষ্ঠ বড় ভাই শিশু কাজী নজরুলের চাইতে ১০ বছরের বড় ছিলেন। নজরুলের পর তার আর-ও একজন ভাই ও বোনের জন্ম হয়েছিল। ভাইটির নাম ছিল কাজী আলী হোসেন এবং বোনটির নাম ছিল উম্মে কুলসুম।

শিশু নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমদ বই-পুস্তক পড়তে পারতেন। তিনি স্থানীয় মসজিদ ও মাজারের সেবা করতেন। রাজ্য শাসকগণ কর্তৃক বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ অর্থাৎ বিচারকগণ উন্নত চরিত্রের অধিকারী হতেন। মুসলমান সমাজ থেকে বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাজী বলা হত। মুসলমান সমাজে কাজীগণ অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হতেন। নজরুল ইসলাম এইরূপ সম্মানিত পরিবারে জন্মপ্রাপ্ত এক শিশু। তাই জন্মের পর ক্রমশ বেড়ে উঠার পর্যায়ে তিনি পারিবারিকসূত্রেই ভাল-মন্দের পার্থক্য করার এবং হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত হয়ে সকলকে সমভাবে ভালবাসার গুণাবলি অর্জন করেন।

মানবজাতির ইতিহাসে যে-সমস্ত মহাপুরুষ বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের অধিকাংশই শৈশব থেকে নানারূপ দুঃখ-কষ্টে পতিত হয়ে সেগুলো জয় করে মহত্ত্ব অর্জন করেছেন। তাদের কেউই একদিনে বড় হয়ে যাননি কিংবা বেড়ে-ও উঠেন নি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হযরত মুহাম্মদ (সঃ) জন্মানোর আগেই পিতাকে হারিয়েছিলেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে হারিয়েছিলেন জন্মদাত্রী মাকেও। নজরুল তার পিতাকে হারান নয় বছর বয়সে ১৯০৮ সালে। পিতা তাকে গ্রামের মক্তবে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছিলেন। তখনকার দিনে পড়াশোনা করার জন্যে সরকারি ব্যবস্থা ছিলনা। বাংলাদেশের তখন জন্ম হয়নি।

বিশেষ ভঙ্গিমায় হাবিলদার নজরুল

নজরুলের জন্মভূমি বাংলা প্রদেশ ভারতবর্ষের একটি রাজ্য যা ছিল বিদেশী ব্রিটিশ শাসনাধীন তথা পরাধীন। ব্রিটিশ শাসকরা এদেশের সাধারণ মানুষ তথা প্রজাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেনি। কারণ শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ সচেতন হয়ে উঠে-তাদের আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হয়-তারা পরাধীন থাকতে চায় না-স্বাধীনতার প্রত্যাশী হয়। বিদেশী শাসক ব্রিটিশরা সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষা উন্মুক্ত না করায় জনসাধারণ সম্মিলিতভাবে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করত। সেই প্রতিষ্ঠানে প্রধানত মাতৃভাষা ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হত। এইসব প্রতিষ্ঠান মক্তব নামে পরিচিত হত। এগুলো পরিচালনার ব্যয় অর্থাৎ শিক্ষকদের বেতন মক্তব প্রতিষ্ঠারাই দান, সাহায্য ও অনুদান সংগ্রহ করার মাধ্যমে নির্বাহ করতেন। গ্রামীণ একটি মক্তবে নজরুলের পাঠগ্রহণ শুরু। তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর।

একবার কিছু শোনে ও দেখেই তিনি তা মনে রাখতে পারতেন। কিন্তু শিশুসুলভ সকল প্রকার চঞ্চলতা-ও তাঁর ছিল। পিতৃবিয়োগের পর সেই চঞ্চলতার যেন ছেদ পড়ল। তার মেধাগুণে তিনি হয়ে উঠলেন শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে সেই মক্তবেরই শিক্ষক। একজন শিশু শিক্ষক। এক শিশু পড়াতে লাগলেন অন্য শিশুকে। উদ্দেশ্য নিজের অর্জিত জ্ঞান ও বিদ্যা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া। নিজেকে অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া। কিছু দেয়ার মাধ্যমে আনন্দ লাভ-যে আনন্দ মহৎ।

তার ভেতরে ছিল এক ভবঘুরে মন। মক্তব ছেড়ে ভর্তি হলেন উচ্চ বিদ্যালয়ে-মাথরুন নবীন চন্দ্র ইনস্টিটিউশনে। স্থিত হলেন না সেখানে। গ্রামীণ নিসর্গ, প্রকৃতি, ঋতুচক্র যেমন তার মনকে প্রভাবিত করে, অজানাকে জানার এবং অচেনাকে চেনার নিরন্তর কৌতূহল-ও তাকে আন্দোলিত করে। ঘরছাড়া স্বভাবের এই শিশু অন্য সকল মানুষের জীবন ও সংগ্রামের রহস্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ঘর তাকে বাঁধতে পারে না। বিশাল আকাশকেই তার মনে হয় তার মাথার ওপরে খাঁচার মত উপুড় হয়ে তাকে আটকে রেখেছে। তাই তিনি মনে মনে ‘ভূলোক, গোলোক ও দ্যুলোক’ ছাড়াতে চাইতেন কেবলÑনিজেকে মুক্ত করতে চাইতেন। মনের আহ্বানে সাড়া দিতেন, গান শোনাতেন, শুনে শুনে গাইতেন।

তারই পরিক্রমায় গ্রামীণ লোক-নাট্য ‘লেটো’ গানের দলে যোগ দিলেন। সেখানেও তার দলপতি উস্তাদ শেখ চকোর গোদা ও বাসুদেব তাকে সেরাদের ‘সেরা’ বলে স্বীকৃতি দিলেন। তিনি শুধু লেটোর দলে গানই গাইলেন না। গানের পালা রচনা করলেন। ‘ মেঘনাদ বধ’, ‘হাতেম তাই’ ‘চাষার সঙ’, ‘আকবর বাদশা’ প্রভৃতি পালা রচনা করতে যেয়ে হিন্দু পুরাণ রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, বেদ যেমন পড়লেন, তেমনি পড়লেন কোরান-হাদিস, ইতিহাস-কাব্য প্রভৃতি। মক্তব-বিদ্যালয় ছেড়ে হয়ে গেলেন প্রকৃতির ছাত্র।

কিন্তু আগুন যে ছাই চাপা থাকে না। প্রতিভার আগুনের শিখা দেখে ফেললেন পুলিশের এক দারোগা, যিনি নিজেও কাজী বংশের সন্তান, রফিজুল্লাহ। চাকরি করেন আসানসোলে। কিন্তু তার জন্মস্থান ময়মনসিংহ জেলা। নি:সন্তান রফিজুল্লাহ মায়ায় পড়ে গেলেন শিশু নজরুলের। নিয়ে এলেন জন্মস্থান ময়মনসিংহে। ভ্রাতুষ্পুত্রের সাথে ভর্তি করে দিলেন দরিরামপুর হাই স্কুলে। কেমন ছিলেন তিনি এখানে ? জন্মভিটা চুরুলিয়া থেকে কয়েকশত কিলোমিটার দূরে-মাতৃআঁচল ছিন্ন পিতৃহীন শিশু! সহপাঠীরা কেউ লিখে রাখেন নি।

১৯১১ সনে ময়মনসিংহে আনীত হয়ে থাকলে পেরিয়ে গেছে একশত তের বছর। সহপাঠীদের কেউ বেঁচেও নেই। কিন্তু বেঁচে আছে নানারূপ গল্প ও কল্পনা। বড় বড় মানুষদের নিয়ে এমনই হয়। তাদেরকে কেন্দ্র করে অনেক কাহিনী তৈরী করা হয়। মানুষ জীবনের গল্প শুনতে ভালবাসে। তাই জীবন নিয়ে গল্প তৈরী হয় কিন্তু তা জীবনের অংশ না-ও হতে পারে। কেউ বলেন নজরুল ময়মনসিংহের ত্রিশালে এক বছর ছিলেন, কেউ বলেন দেড় বছর, কেউবা দু’বছর। প্রথমে ছিলেন কাজী রফিজুল্লাহ’র বাড়ি। এরপরে ছিলেন ত্রিশালের নামাপাড়ায় বিচুতিয়া বেপারির বাড়ি। এই দু’বাড়িতে থাকা নিয়ে অবশ্য কোন বিতর্ক নেই। কিন্তু তর্ক আছে তার প্রস্থান নিয়ে।

কেউ বলেন তিনি স্কুল-শিক্ষকের কাছে সুবিচার না পেয়ে, কেউ বলেন অভিমান করে চলে গিয়েছিলেন। তবে তিনি কাউকে না বলেই চলে গিয়েছিলেন এটাই প্রতিষ্ঠিত মত। কিন্তু গেলেন কোথায় ? সেই জন্মস্থানে। তবে এবার চুরুলিয়া থেকে বেশ দূরে রাণীগঞ্জের শিহাড়সোল সরকারি স্কুলে সরকারি বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হলেন অষ্টম শ্রেণিতে। ১৯১৫ সন। পড়াশোনা করলেন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। দশম শ্রেণি পর্যন্ত একটানা। নজরুলের চঞ্চলমতি, ঘরছাড়া ও ভবঘুরে স্বভাবের জন্যে যেন বেমানান। প্রতিটি ক্লাসে প্রথম হলেন।

মেধাবী বলেই নিয়মিত মাসিক ৭ টাকা বৃত্তি পেতেন। ঐ সময়ের হিসাবে মাসিক ৭ টাকা অনেক টাকা। মাসিক ৩ থেকে ৪ টাকায় সকল প্রকার থাকা-খাওয়ার ব্যয় মিটিয়ে অনায়সে চলা যেত। দশম শ্রেণির নির্বাচনী পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে এন্ট্রান্স বা মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার কথা। সে প্রস্তুতি চলছে। নিচ্ছেন-ও। হঠাৎ ব্রিটিশ শাসকদল কর্তৃক যুদ্ধযাত্রার ডাক। কিন্তু প্রলোভন দেখানো হলো যে ব্রিটিশরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জিততে পারলে ভারতবর্ষকে মুক্ত করে দিয়ে যাবে। জন্মাবধি স্বাধীনতা ও মুক্তি-প্রত্যাশীর হৃদয়ে নাড়া দিল। তিনি সাড়া দেবেন কিনা দোদুল্যমান। কিন্তু কপট ব্রিটিশ জাতি বাঙালিকে উত্তোজিত করার নিমিত্ত অপবাদ ছড়ালো যে বাঙালিরা ভীরু।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকার কবিভবনে নজরুল

তারা লড়তে, সংগ্রাম করতে, যুদ্ধে যেতে ভয় পায়। স্বল্পকাল পরের (১৯১৭ সালের মাত্র চার বছর পর লিখিত হয়েছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ১৯২১ সনে) বিদ্রোহী কবির রক্ত ক্ষোভে নেচে উঠলো। কে রুখে তার মুক্তির আকাক্সক্ষা! বাঙালি সেনাদের নিয়ে গঠিত ৪৯ নং বাঙালি পল্টনে নাম লিখিয়ে বাস্তব যুদ্ধযাত্রা করলেন। গন্তব্য করাচি। ১৯১৭-১৯১৯ সাল অব্দি কঠোর সৈনিক জীবন। সুকঠিন নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যেই সাধারণ সৈনিক থেকে হাবিলদার পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পাশাপাশি আরবি-ফার্সি সাহিত্যে অধ্যয়নসহ সঙ্গীতে ব্যুৎপত্তি অর্জনের জন্য মহাকালের এক অবিস্মরণীয় কবি-শিল্পী হিসেবে নিজেকে নির্মাণের ক্ষেত্রে করাচির জীবনই ছিল এক সাজঘর। যুদ্ধযাত্রার পূর্ব পর্যন্ত নজরুল শিশু। কিন্তু যুদ্ধফেরত নজরুল এক পরিপূর্ণ তরুণ ও চিরকালীন শিল্পী-যার মন ও মানস শিশুর মত আজীবন নিষ্পাপ।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট 

;

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;